THE HUMAN CRISIS
March 28, 1946
শুরুতে আমি আমার প্রজন্মের সংজ্ঞাটা দিয়ে নিতে চাই।
ফ্রান্স আর ইউরোপে আমার প্রজন্মের যারা ছিল, তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বা যুদ্ধ চলার সময় জন্ম নিয়েছিল। কৈশোরে তারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে। বয়স যখন বিশের কোঠায়, তখন তারা দেখেছে হিটলারের ক্ষমতায় আসা। তারা দেখেছে স্পেনের গৃহযুদ্ধ আর মিউনিখ চুক্তি, দেখেছে ১৯৩৯ সালে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ কিংবা ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের পতন। এই প্রজন্মের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে চার বছর জুড়ে চলা দখল আর গুপ্ত সংগ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে।
আমাদের প্রজন্মকে একটা বিশেষ প্রজন্ম বলা যায়। এই প্রজন্মের বুদ্ধিমত্তা আর চিন্তার জন্ম হয়েছে ভয়ংকর ঐ সময়ে, তাদের দেশের মত লজ্জা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। তাই আমার বক্তব্যের কর্তা হিসাবে নিজেকে না রেখে ফ্রান্সের ত্রিশের ঘরে থাকা লোকদের রাখছি।
আগের প্রজন্ম যে অর্থহীন জগত সাজিয়ে গিয়েছিল, আমাদের প্রজন্ম তার কিছুতে বিশ্বাস না করে বিদ্রোহের স্বপ্ন দেখেছে। এ সময়ের সাহিত্য ছিল প্রাঞ্জলতার বিরুদ্ধে, বর্ণনার বিরুদ্ধে, বাক্যের ধারণার বিরুদ্ধে কথা। চিত্রকর্ম ছিল বিমূর্ত; রূপকতার বিরুদ্ধে, বাস্তববাদের বিরুদ্ধে, সামগ্রিক সঙ্গতির বিরুদ্ধে। সংগীত ছিল সুর-তাল-লয় বিরুদ্ধ। এ সময়ের দর্শন আমাদের শেখায় সত্য বলতে কিছু নেই, আছে শুধু ঘটনা (phenomena)। জনাব স্মিথ বা জনাব দুরান হের ভোগেলের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তাদের অস্তিত্বের মধ্যে কোনো যোগসাজশ নাই।
নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের প্রজন্ম ছিল অনেক বেশি পরিষ্কার। জাতীয়তাবাদকে সেকেলে মনে করা হত, ধর্ম ছিল পালানোর পথ। পঁচিশ বছরের আন্তর্জাতিক রাজনীতি আমাদের শিখিয়েছে শুদ্ধতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। শিখিয়েছে, কেউই ভুল না, কারণ সবাই-ই সঠিক হতে পারে।
সমাজে যে নৈতিকতা প্রচলিত ছিল, সেটা একটা ভণ্ডামী ছাড়া কিছু ছিল না। আমরা সবকিছুকে অস্বীকার করে বাঁচা শুরু করলাম। অবশ্য এটা নতুন কিছু না। অন্য দেশে অন্য সময়ে অন্য প্রজন্ম একই ব্যাপার দেখেছে। কিন্তু ওদের সাথে আমাদের একটা পার্থক্য ছিল। আমরা যারা নৈতিকতার প্রচলিত ধারণা মানি না, তাদেরকে বলা হল হত্যা আর সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত নৈতিকতাকে মানিয়ে নিতে। বুঝতে পারলাম, চারদিকে মানবিকতার সংকট চলছে। এ সংকটের মধ্যে আমরা বেড়ে উঠলাম। কিন্তু আমরা যুদ্ধে নেমেছিলাম সবকিছু অস্বীকার করার লক্ষ্যে। তাই নিজেদের ভেতর অবিরাম একটা সংঘর্ষ চলছিল। যুদ্ধ বা সহিংসতা পছন্দ না করলেও আমাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল যুদ্ধকে মেনে নিতে, সহিংসতার চর্চা করতে। আমরা ঘৃণাকে ঘৃণা করতাম, কিন্তু আমাদের শেখানো হয়েছিল অন্যকে ঘৃণা করতে। আমরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, অথবা সংঘাত আমাদের সাথে। আমরা কেমন পরিস্থিতিতে ছিলাম, তা বুঝানোর জন্য কয়েকটা ছোট গল্প বলা যেতে পারে। মানুষ হয়ত ভুলতে বসেছে সে সময়ের গল্প, কিন্তু আমাদের মনে এখনো সেগুলো দাউদাউ করে জ্বলছে।
১। গেস্টাপোর দখল করা ইউরোপের এক এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। দুইজন রক্তাক্ত বন্দীকে দেখা যাচ্ছে। আগের রাতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। এরপর তারা নিজেদের বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করে। বিল্ডিংয়ের গৃহপরিচারিকা কাজ করতে এসে ওদের এ অবস্থায় দেখেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তার কথা ছিল, “ভাড়াটিয়াদের কাজে আমি নাক গলাই না।”
২। লিও শহরের এক জেলখানা। আমার এক সহযোদ্ধাকে তৃতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার কান ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ বাঁধা। প্রশ্নকর্তা জার্মান অফিসার মায়া ভরে তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কানের কী অবস্থা?” এ অফিসারই আগের জিজ্ঞাসাবাদে তার কান ছিঁড়ে নিয়েছিল।
৩। গ্রীসে গুপ্তযোদ্ধা হিসেবে তিন ভাইকে গ্রেফতার করার পর জার্মান অফিসাররা তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তাদের বৃদ্ধা মা অফিসারদের কাছে সন্তানদের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। অফিসাররা একজনের প্রাণ ভিক্ষা দিতে রাজি হল। শর্ত হল, মায়ের বেছে নিতে হবে কোন দুইজনকে হত্যা করা হবে, আর কাকে ছাড়া হবে। মা বড় ছেলেকে মুক্ত করলেন কারণ তার বাচ্চা আছে। বাকি দুই ছেলেকে ঠেলে দিতে হল মৃত্যুর মুখে। জার্মান অফিসাররা ঠিক এটাই চেয়েছিল।
৪। আমাদের সহযোদ্ধা নারীদের একটা দলকে সুইজারল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সে ফেরত পাঠান হয়েছিল। সুইস সীমানায় পৌঁছানোর পর তারা মৃতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখে হাসতে শুরু করল। “মৃতদের সাথে এমন আচরণ করে এখানে?”, তারা হাসতে হাসতে বলল।
এই গল্পগুলো বেছে নেওয়ার কারণ হল, এগুলো আমাকে ‘মানবিকতার সংকট আছে কি না’, এ জিজ্ঞাসার জবাবে শুধু ‘হ্যাঁ’ ছাড়া আরো কিছু বলার সুযোগ দেয়। এগুলো আমাকে বলার সুযোগ দেয়, “হ্যাঁ, মানবিকতার সংকট আছে। মানুষের নির্যাতন আর মৃত্যুকে বর্তমান পৃথিবী উদাসীনতা, হালকা উদ্বেগ, বৈজ্ঞানিক আগ্রহ, আর সাধারণ নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়।”
হ্যাঁ, মানবিকতার সংকট আছে। মানুষকে হত্যা করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এখন ভয় আর কেলেঙ্কারি ছাড়াও অন্য কিছু ভাবা যায়। মানুষের দুঃখ-কষ্টকে ক্লান্তিকর প্রয়োজনীয়তা হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে। একটু খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ানোকে মেনে নেয়া হয়েছে। এসবের জন্য হিটলারকে দায়ী করা খুব সহজ। বলা সহজ, “সাপ মারা গেছে, বিষও চলে যাবে।” কিন্তু আমরা জানি বিষ চলে যায়নি। বিষ আমরা মনে ধরে রেখেছি। বিষের প্রভাব বুঝা যায় যখন দেশ, জাতি, রাজনৈতিক দল, আর সাধারণ ব্যক্তি একে অন্যকে ঘৃণার চোখে দেখে।
একটা দেশ বা জাতি তার নায়কদের জন্য যতটা দায়ী, খলনায়কদের জন্যও ততটাই দায়ী। শ্বেতাঙ্গ সভ্যতাকেও তাদের সফলতা আর স্বেচ্ছাচারিতা, উভয়ের জন্য সমানভাবে দায়ী করা উচিত। আমি মনে করি, হিটলারের জন্য আমরা সবাই দায়ী। হিটলারের কারণে ইউরোপের যে দুর্দান্ত ক্ষতি হল, আমাদেরই উচিত তার কারণ খুঁজে বের করা। উপরে যে গল্পগুলো বলেছি, সেগুলোর আলোকে লক্ষণগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করা যায়।
প্রথম লক্ষণ হচ্ছে আতঙ্কের জন্ম। আমাদের নৈতিকতা বিকৃতির অন্যতম পরিণতি হল, আমরা মানুষ কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনাকে তাদের মর্যাদা দিয়ে বিবেচনা করি না, বিবেচনা করি সফলতা দিয়ে। এ ধরনের সংকট দেখা যাওয়াটা অনিবার্য ছিল কারণ পশ্চিমারা তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিশ্চিত না। তার উপর, সবাই ইতিহাস ভুলে যাওয়ায় দক্ষ, আর সবসময় ভয়ে থাকে সমালোচিত হওয়ার। এই দূর্ভাগাদের বাঁচানোর জন্য, এই আধুনিক জোবকে (কোরআনে বর্ণিত নবী আইয়ুব) ঘায়ের কারণে মারা যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে ভয় আর উদ্বেগ থেকে তুলে আনতে হবে। সে যেন চিন্তার স্বাধীনতা খুঁজে পায়। সে যেন আধুনিক বিবেক দিয়ে আধুনিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
কাউকে যদি প্ররোচিত করা অসম্ভব হয়, তাহলেও এই সংকটের জন্ম হতে পারে। খেয়াল করে দেখুন, অন্যের সাথে নিজের বিশ্বাসগত মিল থাকলেই কেবল মানুষ মিলেমিশে চলতে পারে। কেউ কাউকে মানুষের মত সম্বোধন করলে তার কাছ থেকে পাল্টা মানুষ সুলভ জবাবই আশা করে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যাদের প্ররোচিত করা যায় না। নাৎসি বন্দীশিবিরের বন্দীরা জার্মান অফিসারদের প্ররোচিত করতে পারেনি তাদের নির্যাতন না করার জন্য। তৃতীয় গল্পের গ্রীক মা পারেননি। কারণ জার্মান আর SS অফিসাররা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা সহিংসতার প্রবৃত্তি ধরে রাখতে চায়। প্রবৃত্তির স্থানে যদি গভীর আবেগও হত, ব্যাপারটা এত খারাপ হত না। আবেগের সময়সীমা থাকে। একটা আবেগ শেষ হলে আরেকটা আবেগ কিংবা মনের আরেকটা ভাবনা সেটার স্থান দখল করে। কিন্তু কান ছিঁড়ে নেয়া ব্যক্তির ছেঁড়া কানের ব্যাপারে যে উদ্বেগ, সেটা আবেগ থেকে আসে না। এটা গাণিতিক হিসাব থেকে আসে, যার সাথে যুক্তিতর্ক করা যায় না।
এই সংকট আসে যখন আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে বস্তুকে ছাপার কাগজ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। মানুষ নিজের আর প্রকৃতির মাঝে একটা বিমূর্ত আর জটিল ব্যবস্থাকে রাখতে চায় যা তাকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে। রুটির অভাব দেখা দিলেই রুটির কুপনের প্রয়োজনীয়তা আসে। ফরাসি লোকেরা দৈনিক ১২০০ ক্যালরি খাবারের উপর চলে, কিন্তু ১২০০ ক্যালরির জন্য তাদের ছয়টা ফর্ম পূরণ করতে হয়। প্রত্যেকটা ফর্মে একশটা দপ্তরের সিল থাকে। এভাবেই আমলাতন্ত্র বেড়ে চলেছে। ফ্রান্স থেকে আমেরিকা আসতে আমার দুটো দেশেই কাগজের অনেকগুলো ফর্ম পূরণ করতে হয়েছে। এত এত কাগজ যে, চাইলে এখানে না এসে আমার বক্তব্য ছেপে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম।
কাগজ, দপ্তর আর দাপ্তরিকদের ভিড়ে আমরা মানুষের সংস্পর্শ হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিকতার দায়িত্ব ছাড়া কেউ কারো সংস্পর্শে আসার প্রয়োজন দেখি না। আমার বন্ধুর কান ছিঁড়ে নেয়া জার্মান অফিসার কাজটাকে তার দায়িত্ব ভেবে করেছে। সে ভেবেছে, দায়িত্ব পালনে খারাপের কিছু নেই। সংক্ষেপে বললে, কেউই বাঁচে না, মরে না, ভালবাসে না, বা হত্যা করে না। তারা অন্যদের দিয়ে এসব কাজ করায়। একেই ভাল সংগঠন বলা হয় বোধ হয়।
এই সংকটের আরেকটা কারণ হচ্ছে মানুষকে রাজনৈতিক মানুষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা। ব্যক্তিগত আবেগ এখন আর সম্ভব না, শুধু সামগ্রিক আর বিমূর্ত আবেগই সম্ভব। আমরা চাই বা না চাই, রাজনীতিকে আমরা এড়াতে পারব না। একজন মায়ের সংগ্রামকে আমরা সম্মান করব, না তাকে সাহায্য করব, এসব ব্যাপার এখন আর কোনো মানে রাখে না। এখন শুধু একেকটা মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বই বড়। মানুষের দৈন্যদশা এখন আর কোনো কেলেঙ্কারি হিসাবে গণ্য হয় না, একেকটা মতবাদের গণনার উপাত্ত হিসাবে ধরা হয় যার ফলাফল আমরা এখনো হিসাব করতে পারিনি। এটা পরিষ্কার যে, এসব লক্ষণকে আমরা দক্ষতা আর বিমূর্ততার অর্চনা বলতে পারি। এ কারণেই ইউরোপিয়ানরা নিঃসঙ্গতা আর নিঃশব্দতায় ঘিরে আছে। তারা তাদের নৈতিকতার ব্যাপারে কারো সাথে কথা বলতে পারে না, কারণ কেউ তাদের নৈতিকতার ব্যাপারে একমত না। নৈতিকতার পারস্পরিক সম্মান না থাকায় ইউরোপিয়ানরা এখন হয় ভুক্তভোগী অথবা শোষকের ভূমিকায় চলে আসা ছাড়া বিকল্প দেখছে না।
এ ব্যাপারই আমার প্রজন্মের নর-নারী বুঝতে পেরেছে। তারা এই সংকট দেখেছে, এখনো দেখছে। আমাদের নৈতিকতা দিয়ে আমরা একে সমাধান করতে চেয়েছি। আমাদের নৈতিকতা বলতে অর্থহীনতার সচেতনতা, বা অন্যভাবে বলতে গেলে কোনো নৈতিকতাই না। এমন একটা সময়ে আমাদের যুদ্ধ আর সন্ত্রাসের সাথে পরিচিত হতে হয়েছে, কোনো সান্ত্বনা বা নিশ্চয়তা ছাড়া।
আমরা শুধু জানতাম ইউরোপের চার কোণা থেকে আগ্রাসন চালানো বর্বরদের কাছে হার মানা যাবে না। কিন্তু এই বাধা দেওয়ার কোনো নৈতিক কারণ আমাদের জানা ছিল না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ লোকরাও জানত না তারা কোন মূলনীতির কারণে সন্ত্রাস আর হত্যার বিরোধিতা করছে। যদি কেউ কোনো কিছুতে বিশ্বাস না করে, তাদের যদি কোনো নৈতিকতা না থাকে, তাহলে সবই অনুমত আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ না। তার মানে ন্যায় বা অন্যায় বলতে কিছু নেই, আর হিটলার ভালোও না, খারাপও না। কেউ একজন চাইলে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে পারে, আবার চাইলে কুষ্ঠরোগ নিরাময়ে কাজ করতে পারে। কেউ চাইলে এক হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরেক হাত দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলতে পারে; গৃহপরিচারিকা চাইলেই নির্যাতিত লোকেদের সামনে ঘরের কাজ করতে পারে, কেউ চাইলে মৃতদেহকে আবর্জনার মতো ফেলে দিতে পারে, অথবা চাইলে সম্মান দিয়ে দাহ করতে পারে। যেহেতু আমরা বলি কোনো কিছুরই অর্থ নেই, সেহেতু যে শেষ পর্যন্ত জিতে যায় সে-ই সঠিক কাজ করেছে বলা যায়। হিটলার যদি যুদ্ধে জিতে যেত তবে হিটলারকে ইতিহাসের নায়ক বলা হত, তার পথকে সঠিক পথ বলা হত। আমরা যখন বলি সবকিছুই অর্থহীন, তখন আমরা এও বলি যে, হত্যা আর সন্ত্রাস অর্থহীন। আমরাই হিটলারের ক্ষেত্রেও হত্যা আর সন্ত্রাসের পক্ষেই থাকতাম।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন ভেবেছিলেন বাহ্যিক নৈতিকতা না থাকলেও ইতিহাসের একটা লক্ষ্য আছে। তারা সে অনুযায়ী কাজও করেছেন। তারা বলতেন জাতীয়তাবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত একটা বৈশ্বিক সমাজের কথা, যা স্বর্গের মত হবে। তাদের এ চিন্তাও আমাদের মত একই উপসংহারে আসে যে, সব কিছুই অর্থহীন। কারণ যদি ইতিহাসের লক্ষ্য বা অর্থ থাকে, সে লক্ষ্য বা অর্থ হবে সামগ্রিক। তারা ভাবতেন ইতিহাস অলৌকিক দ্বান্দিকতা মেনে চলে, যেন আমরা সবাই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে আগাচ্ছি। তারা হেগেলের ঘৃণ্য মূলনীতি “মানুষ ইতিহাসের জন্য, ইতিহাস মানুষের জন্য নয়” মেনে চলতেন।
সত্য কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক আর নৈতিক বাস্তববাদীতা যা বর্তমান সময়ে চলছে, সেটা জার্মান ইতিহাসের দর্শন থেকে এসেছে যে, মানুষ যৌক্তিকতার সাথে নিশ্চিত মহাবিশ্বের দিকে আগাচ্ছে। ধ্বংসবাদ বা নিহিলিজমের স্থানে পরম যৌক্তিকতাবাদ চলে এসেছে, আর দুই ক্ষেত্রেই ফলাফল এক। যদি এ কথা সত্য হয় যে, ইতিহাস অলৌকিক আর অপরিবর্তনীয় যুক্তি মেনে চলে, আর জার্মান দর্শন যদি সত্য হয় যে, সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দিয়ে বর্তমান নৈরাজ্যকে প্রতিস্থাপিত করা উচিত, জাতিরাষ্ট্র দিয়ে সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আর সাম্রাজ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপিত করা উচিত, আর সর্বশেষে একটা বৈশ্বিক সমাজের জন্ম হওয়া উচিত; সে লক্ষ্যে করা যেকোনো কাজ বা ঐতিহাসিক ঘটনাই ভাল আর যৌক্তিক। যেহেতু এমন লক্ষ্য যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, হত্যা-গণহত্যা ছাড়া সম্ভব না, সেহেতু এদেরকে ন্যায় অন্যায় দিয়ে বিবেচনা না করে তাদের বিবেচনা করা উচিত লক্ষ্য পূরণে দক্ষতা দিয়ে।
আমার প্রজন্মের নরনারীরা দুইটা প্রলোভনে পড়েছিল। তারা ভাবতো সত্য বলতে কিছু নেই, বা ইতিহাসের অপরিবর্তনীয় প্রভাব সত্য। এদের অনেকেই এক বা অন্য প্রলোভনের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল, যার ফলে পৃথিবী শাসিত হয়েছে শাসনের প্রবল ইচ্ছা দিয়ে, আর পরবর্তীতে সন্ত্রাস দিয়ে। যদি কোনো কিছুই সত্য না হয়, আর যদি দক্ষতা একমাত্র নৈতিকতা হয়, দক্ষ আর পারদর্শী হওয়াই উচিত, অর্থাৎ দাপট দেখানো উচিত।
পৃথিবী আর ন্যায় অন্যায়ের ভাগে বিভক্ত না, দাস আর প্রভুর ভাগে বিভক্ত। যে-ই প্রভু সে-ই সঠিক। গৃহপরিচারিকা ঠিক, নির্যাতনের ভুক্তভোগী না। জার্মান অফিসার যে নির্যাতন আর হত্যা করে, SS অফিসার যে গোরখোদক হয়েছে, তারাই বিশ্বের যৌক্তিক লোক।
আশেপাশে চেয়ে দেখুন, এখনো কি এমনই হচ্ছে না? সন্ত্রাস আমাদের উপর রাজত্ব করছে। প্রতিটি দেশে, আর সারা পৃথিবীতে, অবিশ্বাস, ঘৃণা, লোভ আর ক্ষমতার লড়াই আমাদের একটা অন্ধকার জগতে নিয়ে গেছে যেখানে মানুষ বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ভবিষ্যতের চিন্তা করলেই তার মধ্যে ভয় চলে আসে, কারণ সে বিমূর্ত ক্ষমতার বন্দি, আনন্দ আর বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত, প্রকৃতির সত্য থেকে দূরে।
আপনারা যারা আমেরিকায় আছেন, তারা হয়ত এখনো দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি যাদের কথা বলছি, তারা যুগ যুগ ধরে এসব দেখে আসছে। তাদের শরীরে অনুভব করেছে, প্রিয় মানুষের চেহারায় দেখেছে। তারা জানে একটা অবশ্যম্ভাবী বিদ্রোহই সব কিছু নষ্ট করে দেবে। তারা ইতিহাসের দানবীয় রূপ দেখেছে। তারা জানে সব কিছু ভেঙ্গে গড়া সহজ হবে না। তারা জানে পরিবর্তনের পথ কঠিন, রক্তাক্ত, সহিংস। তারপরও তারা জানে, এ সংকটকে চলতে দেওয়া যাবে না।
এখানেই মূল সমস্যার জন্ম। যদি এই সংকটের চরিত্র ক্ষমতার লোভ, সন্ত্রাস, আসল মানুষকে রাজনৈতিক আর ইতিহাসের মানুষ দিয়ে বদলানো, বিমূর্ততা, ভাবমূর্তি বন্দনা, আর সর্বনাশা, অনিশ্চিত নিঃসঙ্গতা হয়, তবে এসব চরিত্রকে বদলে দিয়ে আমাদের এই সংকটকে সমাধান করতে হবে।
আমাদের প্রজন্ম এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, আর একে এড়িয়ে গিয়েছিল। আমরা আমাদের লড়াই করার শক্তি নিয়েছিলাম আমাদের এই নির্লিপ্ততা থেকেই। আমাদের বিফলে বলা হয়েছিল “ঈশ্বরে বিশ্বাস করো, বা প্লেটোকে বা মার্ক্সকে” কারণ আমাদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল না। আমাদের সামনে একমাত্র প্রশ্ন ছিল আমরা ভুক্তভোগী হব, নাকি জল্লাদ। আমরা কোনোটিই হতে চাইনি, কারণ আমরা জানতাম দিনশেষে আমরা আসলে ভুক্তভোগীই হব। হত্যা আর নিহত হওয়ার মধ্যে, খুনি আর মৃতের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না আমাদের কাছে। আমরা দুজনেই পরাজিত আর পরাধীন। এই ধরনের পৃথিবীকে স্বীকার বা অস্বীকার করা সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল একে কী কারণে অস্বীকার করব সেটা না জানা। আমরা কারণ খুঁজেছিলাম আমাদের নিজের দ্রোহে, কোনো কারণ ছাড়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করছিলাম। শুধু আমাদের জন্য নয়, আমাদের যুদ্ধ ছিল সব মানুষের জন্যে।
কীভাবে ঘটল জিনিসটা?
অর্থহীন, লক্ষ্যহীন এই জগতে, মননের এই মরুভূমি যেখানে আমরা ছিলাম, সেখানে দ্রোহের মাহাত্ম্য কী? আমাদের দ্রোহ আমাদের “না” বলতে শিখিয়েছে, কিন্তু “হ্যাঁ” বলা লোকও আমরাই। আমরা এই জগতকে “না” বলেছিলাম, জগতের অর্থহীনতাকে “না” বলেছিলাম। বিমূর্ততা যা আমাদের হুমকি দিয়েছে তাকে আমরা নাকচ করেছি, মৃত্যুর সভ্যতাকে আমরা “না” বলেছিলাম। “না” বলার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছিলাম। অমানবিকতা, যুদ্ধ, নিপীড়নের সীমালঙ্ঘন দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু, একই সময়ে আমরা পরোক্ষভাবে মেনে নিচ্ছিলাম সীমার মধ্যে অমানবিকতা, যুদ্ধ, নিপীড়ন করা সম্ভব। আমরা মেনে নিচ্ছিলাম আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে যা এসব অন্যায়কে অগ্রাহ্য করছে, আর এসবের জন্যে আমরা আর লজ্জিত হতে চাই না।
এই সাংঘর্ষিকতা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল আমাদের, অবশ্যই। আমরা ধরে নিয়েছিলাম এই পৃথিবীর অস্তিত্বের আর মানুষের সংঘর্ষের মধ্যে কোনো মূল্য নেই। কিন্তু আমরাই আবার জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার ফরাসি সহযোদ্ধারা ট্রেনে করে প্রচারপত্র বিলি করতে যাওয়ার সময় মন্টেইনকে পড়ত। সংশয়বাদকে যে আমরা সম্মানও জানাতে পারতাম তার প্রমাণ এটি। আমরা সবাই বেঁচে থাকার মাধ্যমে, যুদ্ধ আর আশাবাদ প্রকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কিছু বোধের প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমাদের বোধ কি মূল্যবোধ হতে পারে? এই বোধ কি ব্যক্তিগত মতামতের চেয়ে বেশি কিছু ছিল? আর এই বোধকে কি নৈতিকতার মানদণ্ড বিবেচনা করা সম্ভব?
এর উত্তরটা সহজ।
আমি যাদের কথা বলছি তারা তাদের দ্রোহের জন্য মরতেও প্রস্তুত ছিল। মৃত্যুর মাধ্যমে তারা তাদের চেয়ে বড় কিছুর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করছিল, নিজের অস্তিত্ব, নিজের ভাগ্যের চেয়ে বড় কিছুর জন্য তারা মরতে রাজি ছিল। আমার সহযোদ্ধারা একটা দুর্ভাগ্যজনক ভবিষ্যতকে নস্যাৎ করতে যুদ্ধ করছিল, এই ভাবনায় অন্য সকলের সাথে আমাদের মিল ছিল। যখন মানুষকে গৃহপরিচারিকার সামনে নির্যাতন করা হয়, যখন নিষ্ঠার সাথে কারো কান কেটে নিয়ে যাওয়া হয়, মায়েদের বাধ্য করা হয় তার সন্তানদের মধ্যে কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে, মৃত মানুষকে যেনতেন ভাবে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়; এসব দেখে আমার সহযোদ্ধারা বুঝতে পারেন যে এমনটা হওয়ার কথা না, কোনো কিছুর অভাব বোধ করেন তারা, কিছু যেন নাকচ করা হয়েছে তাদের। এমন কিছু যা শুধু তাদের একার না, সবার একটা পাওনা কিছু, যার লক্ষ্যে সকল মানুষ একমত হতে পারে।
যুদ্ধের দুর্যোগপূর্ণ বছরগুলোর মহান শিক্ষা এটাই ছিল। প্রাগের এক ছাত্রকে অপমান করা ফরাসি শহরতলীর কাউকে প্রভাবিত করেছে। পূর্ব ইউরোপের কারো রক্তক্ষরণ টেক্সাসের কৃষককে প্রভাবিত করেছে যদিও কেউ কাউকে চেনে না। কিন্তু এ ব্যাপারটি উদ্ভট, অসম্ভব, আর বোধগম্যতার বাইরে। এই অর্থহীনতার মাঝে আমরা শিখেছিলাম যে সামগ্রিক এই দুর্যোগে আমাদের সকলের আত্মসম্মান হুমকির মুখে পরেছিল। আমাদের যুদ্ধটা ছিল সকল মানুষের বোধগম্য একটা ভাষা, তাদের আত্মসম্মানকে রক্ষা করার যুদ্ধ। আমাদের এই বোধকে সামনে রেখে আমরা শিখেছি কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে, আর শিখেছি নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের সময়েও নিজেদের মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
মানুষ যখন বুঝতে শুরু করল যে, মানুষের আত্মসম্মানকে স্বীকৃতি দিতে হবে, তখন সকলের যোগাযোগ সহজ হয়ে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম, এই ভাষাকেই ব্যবহার করতে হবে যুদ্ধের সময়। এই ভাষায় যোগাযোগকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রয়োজন ছিল মানুষকে মুক্ত করা, কারণ দাসত্বে বন্দীদের সাথে যোগাযোগ করা যায় না। হ্যাঁ, পরাধীনতার শিকল মানুষকে নিশ্চুপ করায়। এই নিঃশব্দতা ভয়াবহ নিঃশব্দতা। এই যোগাযোগ টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রয়োজন ছিল অন্যায়কে বিলুপ্ত করা, কারণ শোষক আর শোষিতের মধ্যে যোগাযোগের কোনো ভাষা হয় না। প্রয়োজনও এই ভাষাহীনতার সামনে হার মানে। এই যোগাযোগকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রয়োজন ছিল মিথ্যাচার আর সহিংসতাকে বিলুপ্ত করা। কারণ যারা মিথ্যা বলে তারা অন্যের সাথে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলে, আর যারা নির্যাতন-নিপীড়ন করে তারা নিঃশব্দতা চায়।
আমাদের অর্থহীন জীবন দর্শন থেকে, আমাদের লক্ষ্যহীনতার নেতিবাচক প্রেরণা থেকে আমরা মুক্তি আর আন্তরিকতার মূল্যবোধ আবিষ্কার করেছিলাম। হ্যাঁ, হত্যাকামী জগতের সাথে লড়াই করতে আমাদের প্রয়োজন ছিল মুক্তির ইচ্ছা আর আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করা। যুদ্ধকালে আমরা এই বোধ লাভ করেছিলাম, আর আমাদের এমন যোগাযোগই পারে বর্তমানের হত্যাকামী পৃথিবী থেকে আমাদের বাঁচাতে।
আমরা এখন জানি আমাদের লড়াই অন্যায়, দাসত্ব আর সহিংসতার বিরুদ্ধে। কারণ এ তিনটি চাবুকের আঘাত মানুষকে নিঃশ্চুপ করায়, তাদের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়, তাদের মধ্যে ভিন্নতার সৃষ্টি করে। এ তিন সমস্যা মিলে তাদের মানবজীবনের দূর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে দূরে রাখে। এই জগতের বিরুদ্ধে লড়াই-ই পারে মানবজাতিকে বাঁচাতে।
সংকটে ভোগা এ পৃথিবীকে দেখার পর আমাদের কী করা উচিত আমরা এখন জানি।
কী করা উচিত? যা যেমন তাকে তেমনই বলা উচিত। আমাদের বুঝা উচিত যে প্রতিবার যখন আমরা সবাই একত্রে নির্দিষ্ট কোনো চিন্তা করেছি তখনই আমরা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছি। হত্যাকারীরা মানুষকে হত্যা করার চিন্তা করে না, মানুষকে হত্যা করার চিন্তা যারা করে তারাই হত্যাকারী হয়। তো, কাউকে হত্যা না করেও আপনি হত্যাকারী হতে পারেন, আমরা সবাই কম-বেশি খুনি।
মানব সংকট কাটাতে আমাদের প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটা হচ্ছে কারো প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ, বা প্রাণঘাতী চিন্তা বা চিন্তাপদ্ধতিকে কোনো দ্বিমত ছাড়াই নাকচ করে দিতে হবে। দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে সহিংসতার ভাবনায় বুঁদ পৃথিবীকে এই ভাবনা থেকে মুক্ত করতে হবে, সহিংসতা মানুষকে শুদ্ধ চিন্তা করতে বাঁধা দেয়। শুনেছি এই শহরেই নাকি জাতিসংঘের সম্মেলন হবে, নুর্যেমবার্গ ট্রায়ালের প্রাক্কালে যেন এই বিশ্বসংস্থার প্রথম লিখিত মূলনীতি যেন হয় বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলুপ্ত করে দেয়া।
তৃতীয় যে কাজটি প্রয়োজন, যেখানেই সম্ভব সেখানে রাজনীতিকে তার নির্দিষ্ট স্থানে, গৌন হিসাবে রাখতে হবে। রাজনৈতিক বা নৈতিক মূলনীতি দিয়ে পৃথিবী সাজানোর প্রয়োজন নাই। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে রাজনীতি আমাদের মূলনীতি নির্দিষ্ট করে দেয়, জীবন দর্শন ঠিক করে দেয়, ভালবাসার নিয়মও ঠিক করে দেয়! কিন্তু রাজনীতির কাজ হচ্ছে সবকিছুকে ঠিকঠাক ভাবে চালানো, আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান বা নিয়ন্ত্রণ করা না। কোনো পরম নীতি আছে কি না আমার জানা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে যদি পরম কোনো নীতি থেকে থাকে সেটা রাজনৈতিক নীতি হবে না। পরম নীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা ভোট হয় না, পরম নীতির ধারণা সবার কাছে আলাদা। আমাদের সবারই স্বাধীনতা আছে নিজের পরম নীতির ব্যাপারে চিন্তা করার, পরম নীতির অর্থ বুঝার। আমাদের বাহ্যিক সম্পর্কও আমাদের সে স্বাধীনতা দেয়া উচিত।
আমাদের জীবন অন্যদের জন্য, আর অন্যদের জন্য জীবন ত্যাগ করতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের মৃত্যু শুধু আমাদের নিজের সিদ্ধান্ত। আমার কাছে স্বাধীনতার সংজ্ঞা এটাই।
চতুর্থ যা প্রয়োজন, আমাদের নেতিবাচকতার উপর ভিত্তি করে ইতিবাচক মূল্যবোধ যা নেতিবাচক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে ইতিবাচক কাজ করাবে তা খুঁজে বের করা বা সৃষ্টি করা। এটা দার্শনিকদের কাজ, এ ব্যাপারে আমি বেশি কিছু বলছি না এখন।
পঞ্চম যে কাজটি করতে হবে সেটা হচ্ছে চতুর্থ কাজটি যে একটা সার্বজনীন মনোভাবের জন্ম দেবে যাতে ভালো লোকেরা এক সাথে কাজ করতে পারবেন, তা বুঝতে পারা। একাকিত্ব আর নিঃশ্চুপতা কাটাতে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কথা বলতে হবে স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীনভাবে, কোনো পরিস্থিতিতেই মিথ্যা বলা যাবে না, আমরা যাকে সত্য বলে জানি তা-ই বলতে হবে সকল ক্ষেত্রেই। কিন্তু আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে সত্যভাষণ সম্ভব যদি পৃথিবীর সকল মানুষ নির্দিষ্ট আর নির্ধারিত মূল্যবোধের ব্যাপারে একমত হয়। হিটলার ঠিক করে দেবে না কে ন্যায় আর কে অন্যায়। ন্যায় অন্যায় কোনো একক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত না, কারো একার সিদ্ধান্ত সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার কারোই নেই, এখনই না শুধু, কখনোই না। সার্বজনীন মূল্যবোধের মাধ্যমে নরনারী মিলে এই স্বপ্নকে সত্যি করতে পারেন। তাদের এই মূল্যবোধকে আবার আবিষ্কার করতে হবে। আমরা যে স্বাধীনতার জন্য লড়ছি সেটা হচ্ছে মিথ্যা না বলার স্বাধীনতা। তখনই আমরা খুঁজে পাবো বেঁচে থাকা আর প্রাণত্যাগের যোগ্য কারণ কী আছে।
তো, আমাদের অবস্থান এই, আর আমি এই অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি, যে মানুষের ইতিহাসই হচ্ছে ভুলের ইতিহাস, সত্যের ইতিহাস না। সত্য হয়তো আনন্দের মত, সরল আর ইতিহাসহীন। আমরা এই বোধ দিয়ে কি আমাদের সব সমস্যা শেষ করে ফেলতে পেরেছি? না, অবশ্যই না। এই জগত এখনো উত্তম না, যৌক্তিকও না। আমরা আমাদের অর্থহীনতাকে পেছনে ফেলে সামনে আগাতে পারিনি, তবে এখন আমাদের কাছে আমাদের আচরণ পরিবর্তন করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এ কারণটাই আমরা এত দিন খুঁজছিলাম। এই জগত এখন যেমন আছে মানুষ না থাকলেও তেমনই থাকতো। কিন্তু মানুষ আছে, তার আবেগ, তার স্বপ্ন, তার আলাপন সহ। ইউরোপের আমরা কিছু লোক মিলে একটা হতাশাবাদী দর্শন বানিয়েছি যা এই পৃথিবীকে মানুষের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ দেয়।
ইতিহাস থেকে আমরা আলাদা হতে পারি না, কারণ আমরা নিজেই ইতিহাস। আমরা শুধু পারি ইতিহাসের প্রাঙ্গনে লড়াই করতে যেখানে আমরা লড়বো সে সব চিন্তার সাথে যার কোনো স্থান ইতিহাসে নাই। আমরা চাই মানুষ যেন ইতিহাসের দাস হয়ে না থাকে, আবার যেন ইতিহাসকে ভুলে না যায়। অন্যদের ব্যাপারে যে সব দায়িত্ববোধ মানুষকে আবদ্ধ করে তার সাথে সাম্যাবস্থা বজায় রেখে মানুষ তার নিজের আত্মপ্রতিফলন আর আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।
আমি বলতে চাই আমরা সবসময়ই ইতিহাসের ঘটনা, প্রপঞ্চ, ধনদৌলত, ক্ষমতা, আর ভবিষ্যতের বন্দনার বিরোধিতা করবো। মানুষের human condition-কে আমরা তার আসল রূপেই দেখতে চাই। আমরা জানতে চাই human condition কী। এই human condition মানুষকে ট্রাক ভরা লাশ আর ইতিহাস ভরা সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে যেখানে মানুষই মানুষকে চিনতে পারে নি। এটাই নিয়ম। আঠারো শতকে যুগ যুগ ধরে ফ্রান্সে মানুষের শিরঃচ্ছেদ হয়েছে বৃষ্টির মত। ফরাসি বিপ্লব সবাইকে উদ্যমী আর সহিংসও করেছে। নতুন শতকে এসে আমরা চিরায়ত রাজতন্ত্রকে সরিয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রকে ক্ষমতায় এনেছি। বিংশ শতকের ফরাসিরা জানেন এই পরিবর্তন কেমন খারাপ ছিল। যুদ্ধ, দখল, গণহত্যা, বন্দিত্ব, আর ইউরোপ জুড়ে দুর্দশার মধ্য দিয়ে আমরা আশার আলো খুঁজে পেয়েছিলাম যা আমাদের মুক্তি দিতে পারে।
আমাদের পরিস্থিতিতে এই আশাবাদকে অশ্লীলতা মনে হয়। আমাদের শহীদরা ছিলেন আমাদের সবচেয়ে উত্তম লোক, কারণ তারা নিজে যুদ্ধে এসেছিলেন। আমরা যারা বেঁচে আছি তারা নিজেদের বারবার মনে করিয়ে দেই যে আমরা অন্যদের চেয়ে কম ত্যাগ স্বীকার করার কারণেই বেঁচে আছি। আর তাই আমরা একটা সাংঘর্ষিকতা নিয়ে বাঁচি। পার্থক্য হচ্ছে এই প্রজন্ম এই সাংঘর্ষিকতাকে মানবজাতির জন্য আশাবাদের রূপান্তরিত করতে পারবে।
আমি এখানে এসেছিলাম ফরাসি আন্তরিকতার কথা বলতে, আমি যা বলবো তা আপনাদের অবশ্যই মনে থাকবে। ফ্রান্সে আর ইউরোপে এখন একটা প্রজন্ম আছে যারা ভাবে human condition-এ যারা আশা রাখে তারা পাগল, কিন্তু যারা হতাশাবাদী তারা ভীতু। এই প্রজন্ম রাজনীতির দর্শনকে অস্বীকার করে, কিন্তু মানুষের মুক্তি স্বপ্ন দেখে। এরা সাবর্জনীন আনন্দ আর সন্তোষ সম্ভব বলে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এরা মানুষের দুর্দশা কমানোতে বিশ্বাস করে। কারণ পৃথিবী অসুখী নয় যে আমাদের সুখ আবিষ্কার করতে হবে। পৃথিবী অন্যায্য আর আমাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর পৃথিবী অর্থহীন, আমাদের নিজেদের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে নিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত এসবের অর্থ কী? এর অর্থ হচ্ছে আমাদের কাজে আর চিন্তায় আমাদের নম্রতা দেখাতে হবে, কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ় হতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে দল আর সরকারে বাইরে আমাদের চিন্তা করতে হবে, যোগাযোগ বাড়াতে হবে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে অন্যদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হতে হবে। সবাই মিলে আমরা পৃথিবীকে যুদ্ধ, শোষণ, পুলিশী নির্যাতন মুক্ত করবো, পৃথিবীকে আমরা বানাবো মানুষের পৃথিবী যেখানে মানুষ তার কাজের সুফল পাবে, আর বিশ্রাম উপভোগ করবে।
আমাদের চেষ্টা, চিন্তা, আর প্রয়োজন হলে আমাদের ত্যাগকে এ-দিকেই নিয়ে যেতে হবে বলে আমার ধারণা। প্রাচীন ইতিহাসের পচন শুরু হয় সক্রেটিসের হত্যার মধ্য দিয়ে, আর আমরা ইউরোপে অনেক সক্রেটিসকে মেরেছি এই কয় বছরে। এটা একটা ইঙ্গিত বটে। এটা ইঙ্গিত যে সক্রেটিক ভাবনা- সহনশীলতা, আর নিজের চিন্তার ব্যাপারে দৃঢ়তাই পারে খুনি সরকারব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিতে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে চিন্তার এই ধারাই পারে পৃথিবীকে বদলে দিতে। অন্য সকল উপায়, যতই মহৎ হোক না কেন, যেগুলো ক্ষমতার ব্যবহার আর চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতার ব্যবহার করে; তারা মানুষের দুর্দশা বাড়াবেই। এই বিপ্লবই ইউরোপ আর ফ্রান্সে ঘটছে।
আপনারা হয়তো ভাবছেন একজন ফরাসি লেখক কেন তার আমেরিকা সফরে এসে ফ্রান্সের সৌন্দর্যের কথা না বলে, কোনো প্রোপাগান্ডা না ছড়িয়ে কেন কথা বলছে। কিন্তু আপনি যদি খেয়াল করে আমার কথা শুনে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন কেন।
আমার মনে হয় প্রোপাগান্ডা ব্যাপারটা মানুষের মধ্যে এমন আবেগ সৃষ্টি করে যা তাদের মধ্যে আগে ছিল না। কিন্তু আমার প্রজন্মের ফরাসিরা কারো করুণা বা ভালোবাসা চায় না। তাদের জাতীয় সমস্যা বিশ্ব বিবেকের মতামতের উপর নির্ভরশীল ছিল না। যুদ্ধের ৫ বছরে আমাদের কাছে আমাদের আত্মসম্মান রক্ষাই ছিল সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। আমরা চেয়েছিলাম যুদ্ধের শেষে যেন আমরা আমাদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে পারি। আমরা চাইনি আমাদের এই অধিকার অন্য কারো দ্বারা অনুমোদিত হয়ে আসুক। আমাদের বাকস্বাধীনতার অনুমোদন আমরা নিজেরাই করতে চাই। ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করেছি, কারণ আমরা জানি, আর শুধু আমরাই জানি এই অধিকারের জন্য আমাদের কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের ত্যাগের কারণে আমরা অন্যদের জ্ঞান দিতে পারি না। পরাজিতদের লজ্জাস্কর নিঃশ্চুপতাকে পাশ কাটিয়ে মানুষের প্রতি তাদের ঘৃণাকে প্রকাশ করতে পারি শুধু আমরা। এছাড়া আমরা জানি আমাদের স্থান কোথায়, বিশ্বাস করুন।
হয়তো অনেকে যেমন বলছেন তেমনই আগামী ৫০ বছরের ইতিহাস রচনা করবে ফ্রান্স ব্যতীত অন্যান্য দেশগুলো। এ ব্যাপারে আমার কোনো মতামত নাই। আমি শুধু জানি আমাদের দেশ ২৫ বছর আগে ১৬ লক্ষ ২০ হাজার লোককে হারিয়েছে, আর এই যুদ্ধে কয়েক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যুর পর এখন ক্লান্ত। নিজের সিদ্ধান্তে বা অন্যের কারণেই সে এখন দূর্বল। এটাই সত্য। সারা বিশ্বের করুণা বা ঘৃণা সত্যকে বদলাতে পারবে না। সত্যকে প্রভাবিত করার কোনো চেষ্টা আমার পক্ষে অনুচিত হবে। কিন্তু বর্তমানের সংকটের ব্যাপারে, ক্ষমতা আর রাষ্ট্রনায়কদের ব্যাপারে কথা বলা মোটেও অনুচিত হবে না।
আজকের বক্তব্যের সারমর্ম যদি করতে চাই আমি শুধু বলবো ফ্রান্স বা যে কোনো দেশকে ক্ষমতার মাপকাঠিতে দেখতে গেলেই আমরা ইতিহাসের ভুলগুলোকে আবারও জাগিয়ে তুলবো। দাপট দেখানোর তৃষ্ণাকে আমরা আবার উৎসাহ দিয়ে বসবো যার ফলাফল হচ্ছে হত্যা আর গণহত্যা। কাজের জগতে যা সত্য চিন্তার জগতেও তাই সত্য। আর যারা বলেন ফলাফল উপায়কে ন্যায্যতা দেয়, বা ক্ষমতাই হচ্ছে মহত্বের মাপকাঠি, তারাই দায়ী ইতিহাসের এই সংকটের জন্য।
আমার মনে হয় আমার দায়বোধ থেকে যা যা বলার ছিল তা আমি বলে ফেলেছি। আমার দায়িত্ব ছিল আমার সহযোদ্ধাদের কথা আর অভিজ্ঞতা আপনাদের জানানো যেন আপনারা তাদের অন্যায্যভাবে বিশ্লেষণ না করেন, কারণ তারা কারো বিশ্লেষণের ধার ধারে নি। শুধু খুনীদের বিশ্লেষণ ছাড়া। আর তারা সকল জাতিকে আশা আর নিশ্চয়তা দিয়ে দেখেছে যে সবাই মানুষের অন্তরীন সত্যকে খুঁজে পেতে সক্ষম। দর্শকের মধ্যে তরুণদের (আমেরিকান) ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রচুর সম্মান ছিল, আপনাদের মানবিকতা, স্বাধীনতা আর মুক্তির ভক্ত ছিলেন তারা, আমেরিকানদের সাথে তাদের পরিচয় থেকে আপনাদের ব্যাপারে তারা আশাবাদী হয়েছেন। আর তারা আপনাদের কাছ থেকে তা-ই চান যা তারা সকল মানুষের কাছেই চেয়েছেন, জাতির সীমার বাইরে গিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা।
আমাদের সংগ্রাম, আমাদের আশা, আমাদের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের কাছে হতবুদ্ধিকর মনে হতে পারে, ব্যর্থ মনে হতে পারে। সত্য আর জ্ঞানের পথে এ লোকেদের পথটা সরল বা সম্ভাব্য পথ নাও মনে হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে জগত আর ইতিহাস কখনোই সরল পথ দেখায় না। তারা তাদের ক্ষমতার মধ্যে চেয়েছেন সত্য আর জ্ঞানের পথ সৃষ্টি করতে। হয়তো তারা ব্যর্থ। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তারা যদি ব্যর্থ হোন তবে এ জগতও ব্যর্থ। সহিংসতা আর ঘৃণায় ভরা পৃথিবীতে, যেখানে ভয়ের রাজত্ব চলছে সেখানে আমার সহযোদ্ধারা চেয়েছেন মানুষের মধ্যে যা যা বাঁচানো যায় তা-ই বাঁচাতে। এটাই ছিল তাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। তাদের চেষ্টা যদি ফ্রান্সে কোন প্রভাব ফেলতে পারে, আর আজকের বক্তব্য যদি তাদের ন্যায্যতার আশার ব্যাপারে যদি সূক্ষ্মতম ধারণা দিয়ে থাকতে পারি, তবে সেটাই হবে আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা, আর আমার প্রচণ্ড গর্বের উৎস।
————————————————————————————————————————-
[আমাকে যখন বলা হল আমেরিকায় এসে বক্তৃতা দিতে হবে, আমি কিছুটা দ্বিধাবোধ করছিলাম। লেকচার দেওয়ার বয়স আমার হয়নি। তাছাড়া আমি বক্তব্য বাজির চেয়ে চিন্তাব্যবস্থার সাথে বেশি পরিচিত। আমি দাবি করি না সাধারণ সত্য বলতে কোনো কিছুর উপর কোনো দাবি প্রতিষ্ঠা করি না।
আমি জানাতে চাই যে, আমার মতামত কোনো অর্থ রাখে না। আমি ফ্রান্সের ব্যাপারে কিছু তথ্য উপস্থাপন করব, যেন শ্রোতারা তাদের নিজেদের মতামত তৈরি করতে পারেন। বলা হয়েছিল, আমি দর্শককে ফরাসি থিয়েটার, সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে জানাতে পারব। আমি জানিয়েছিলাম, ফরাসি রেলপথের কর্মীদের ব্যাপারে, বা দক্ষিণ ফ্রান্সের কয়লাখনির শ্রমিকদের কথা বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব।
আমাকে তখন বলা হয়েছিল, যার যে ক্ষেত্রে জানাশোনা আছে তার সে ব্যাপারেই কথা বলা উচিত। যেহেতু আমি ট্রেনের ব্যাপারে কিছুই জানি না, আর সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করি, তাই আমার উচিত সাহিত্য নিয়ে কথা বলা, ট্রেন না।
শেষ পর্যন্ত আমি বুঝলাম।
শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম ফ্রান্সের ব্যাপারে যা জানি, ফ্রান্সে যা ঘটছে তা নিয়েই বক্তব্য দিব। এ কারণে আমি থিয়েটার বা সাহিত্য নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছি না। সাহিত্য, থিয়েটার, দর্শন, গবেষণা, আর একটা দেশের সামগ্রিক চেষ্টা হচ্ছে একটা মৌলিক প্রশ্নের প্রতিফলন। প্রশ্নটা হচ্ছে জীবনের সংগ্রাম আর মানবিকতার সংগ্রামের ব্যাপারে, যা আমাদেরকে বর্তমানে ঘিরে রেখেছে।
ফরাসিরা বুঝতে পারে, মানবজাতির বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। তারা এও বুঝে বর্তমান পৃথিবী যে সংকটে আছে সেখান থেকে মানবিকতাকে বের করে আনতে হবে। নিজের দেশের প্রতি আনুগত্য থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এই মানবিক সংকট নিয়ে বক্তব্য দেব।
আমি এখানে এসেছি যা জানি তা বলতে। সবচেয়ে ভাল যে কাজটা করতে পারি সেটা হচ্ছে একটা শব্দচিত্র আঁকা। আমার প্রজন্মের অভিজ্ঞতার, তার নৈতিকতার একটা চিত্র। আমার প্রজন্ম দেখেছে পুরো পৃথিবীতে একটা মানব সংকট ছড়িয়ে পড়তে। আমার প্রজন্মের অভিজ্ঞতার আলোকে মানব সংকটে আলোকপাত করতে গিয়ে মানুষের ভবিষ্যতের আলোচনা করবো, আর কিছু ক্ষেত্রে ফরাসি মানুষের সংবেদনশীলতার উপর চর্চা করতে পারবো।]