আমি এই কথা কখনো বলিনি। সত্যি বলছি। ও আচ্ছা, আমি বলেছিলাম সেখানে হয়তো ১০০ বিলিওন গ্যালাক্সী এবং ১০ বিলিওন ট্রিলিওন নক্ষত্র আছে। আসলে কোনো বড় সংখ্যা ব্যবহার ব্যতীত মহাশূন্য নিয়ে কথা বলা খুবই কঠিন। আমি ‘কসমস’ টিভি সিরিজে “বিলিওন” কথাটা বহুবার বলেছি, যেটা বহু মানুষ দেখেছিলো। কিন্তু আমি কখনোই বলিনি “বিলিওন এবং বিলিওন”। এর একটা কারণ হচ্ছে, এটা খুবই অস্পষ্ট। কত বিলিওনে আসলে “বিলিওন এবং বিলিওন” হয়? অল্প কিছু বিলিওনে? বিশ বিলিওনে? একশ বিলিওনে? “বিলিওন এবং বিলিওন” আসলে খুবই ভাসাভাসা। যখন আমরা সিরিজটাকে পুনর্বিন্যস্ত এবং আরো উন্নত করে সাজিয়েছিলাম, আমি তখনো যাচাই করে দেখেছি- এবং আমি নিশ্চিত, আমি এটা কখনো বলিনি।
কিন্তু জনি কারসন- যার ‘টুনাইট শো’ তে আমাকে এতগুলো বছরে প্রায় ত্রিশবারের মত উপস্থাপন করা হয়েছে – সে বলেছে। সে একটা মোটা কাপড়ের জ্যাকেট, একটা গলাবদ্ধ সোয়েটার এবং ঘর মোছার ন্যাকড়ার মত কিছু একটা মাথায় পরচুলা হিসেবে পরে উপস্থিত হতো। সে প্রায় আমার কাছাকাছি ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো, অনেকটা প্রতিমূর্তির মত! সে মধ্যরাতের টিভি অনুষ্ঠানে অনবরত বলে বেড়াতো “বিলিওন এবং বিলিওন”। আমি একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম যে আমার ব্যক্তিছবির একটা প্রতিমূর্তি নিজে নিজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এমন সব কথা বলছে যেগুলো পরদিন সকালে আমার বন্ধু এবং সহকর্মীরা আমার কাছে এসে রিপোর্ট করছে। (ছদ্মবেশ ধারণ সত্ত্বেও, কারসন- একজন একনিষ্ঠ শিক্ষানবীশ জ্যোতির্বিদ- প্রায়ই আমার অনুকরণে বলা কথাগুলোকে সত্যিকারের বিজ্ঞান বানিয়ে ছাড়তো।) বিস্ময়করভাবে, “বিলিওন এবং বিলিওন” প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলো। মানুষেরা কথাটাকে পছন্দ করে ফেললো। এমনকি আজও আমাকে রাস্তায় কিংবা বিমানে কিংবা পার্টিতে দাঁড় করানো হয় আর জিজ্ঞেস করা হয়, একটু বিনয়ের সাথেই, যে আমি কি- শুধু তাদের জন্যেই- একবার শুধু “বিলিওন এবং বিলিওন” শব্দটা বলতে পারবো কিনা।
“আসলে, আমি এই কথাটা কখনো বলিনি”, আমি জবাবে তাদের বলি।
“আরে ব্যাপার না”, তারা প্রত্যুত্তরে বলেন। “তবুও বলুন একবার শুনি”।
আমাকে বলা হয়েছিলো শার্লক হোমস নাকি কখনোই বলেনি, “এতো অতি সাধারণ ব্যাপার, প্রিয় ওয়াটসন” (অন্তত আর্থার কোনান ডয়েলের বইগুলোতে); জিমি ক্যাগনে কখনো বলেনি, “হতচ্ছাড়া ধাড়ি ইঁদুর কোথাকার”; এবং হামফ্রে বোগার্ট কখনো বলেনি, “আরেকবার বাজাও, স্যাম”। কিন্তু তারা হয়তো এগুলো বলেছেও, কারণ এই প্রশ্নসাপেক্ষ বস্তুগুলোই তাদেরকে জনপ্রিয় শিল্পগুলোতে সুকৌশলে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছে।
কম্পিউটার ম্যাগাজিন (“যেমনটা কার্ল সেগান বলে থাকেন, এর জন্যে প্রয়োজন বিলিওন বিলিওন বাইট”), অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা, খেলোয়াড়দের বেতনবিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে এখনো আমার নাম উল্লেখ করে বলা হয় আমি নাকি এই সহজ-সরল কথাটা উচ্চারণ করেছি। একটা সময়, ছেলেমানুষি করে জিজ্ঞেস করা হলেও, আমি এই কথাটা উচ্চারণ করতাম না। কিন্তু আমি এখন সেই জড়তাটা কাটিয়ে উঠেছি। তাই, সেটার প্রমাণ হিসেবেই, এখানে একবার বলা হয়ে যাকঃ
“বিলিওন এবং বিলিওন”
কোন ব্যাপারটা আসলে “বিলিওন এবং বিলিওন” কথাটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে? এক কালে তো অগণিত সংখ্যক কিছু বুঝাতে বিকল্প হিসেবে “মিলিওন” শব্দটা ব্যবহৃত হতো। ফাটাফাটি ধনীরা ছিলো মিলিওনেয়ার। যীশুর সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিলো ২৫০ মিলিওন। ১৭৮৭ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় আমেরিকানদের সংখ্যা ছিলো ৪ মিলিওন; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জনসংখ্যা ছিলো ১৩২ মিলিওন। পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব ৯৩ মিলিওন মাইল (১৫০ মিলিওন কিলোমিটার)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৪০ মিলিওন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো; যেটা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ মিলিওন। ৩১.৭ মিলিওন সেকেন্ডে এক বছর (খুব সহজেই যাচাই করে নেয়া যায়)। ১৯৮০’র শেষে সারাবিশ্বে মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রসমূহের সম্মিলিত বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১ মিলিওন হিরোশিমাকে ধ্বংসের জন্যে যথেষ্ট। বহু উদ্দেশ্য সাধনে এবং বহুসময় ধরে “মিলিওন” ছিলো বিশাল বড় সংখ্যার সার্থক উদাহরণ।
কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন পৃথিবীতে মিলিওনেয়ারদের সংখ্যাও আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না- এবং এর কারণ শুধু মুদ্রাস্ফীতি নয়। পৃথিবীর বয়স মোটামুটি ৪.৬ বিলিওন বছর হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এর জনসংখ্যা এখন ৬ বিলিওন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা জন্মদিন নির্দেশ করে সূর্যের চারপাশে বিলিওন কিলোমিটার পথ আবর্তনের (ভয়েজার মহাশূন্যযান যত দ্রুত পৃথিবী হতে দূরে সরে যাচ্ছে, পৃথিবী তার চেয়েও দ্রুতগতিতে সূর্যকে পরিক্রমণ করে চলছে)। চারটা বি-২ বোমারু বিমানের মূল্য হচ্ছে বহু বিলিওন ডলার (কেউ কেউ বলেন ২ এমনকি ৪ বিলিওন পর্যন্ত)। আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেট হচ্ছে, যখন গোপন ব্যয়গুলোও হিসেবে ধরা হয়, বছরে ৩০০ বিলিওন ডলারেরও বেশি। আমেরিকা এবং রাশিয়ায় কোনক্রমে যুদ্ধ বেঁধে গেলে প্রাণহানি ঘটবে প্রায় এক বিলিওন মানুষের। সামান্য ইঞ্চি পরিমাণ দূরত্বে প্রায় এক বিলিওন অণু অবস্থান করে। আর এর বাইরে বিলিওন সংখ্যক সেই নীহারিকা এবং নক্ষত্রগুলোতো আছেই।
১৯৮০ সালে, যখন কসমস টিভি সিরিজ প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিলো, মানুষ বিলিওন এর জন্যে প্রস্তুত ছিলো। গুটিকয় মিলিওন হয়ে পড়েছিলো নগণ্য, কেতাদুরস্তহীন, তুচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে, এই দুটো শব্দই উচ্চারণে এমন কাছাকাছি যে তাদের আলাদা করে বোঝাতে আপনাকে খুব সতর্ক হতে হয়। এই কারণেই, কসমসে, আমি “বিলিওন” কথাটা বলেছিলাম “বি” এর স্পৃষ্ট উচ্চারণের মাধ্যমে, যেটাকে অনেক মানুষই ব্যক্তিভেদে আলাদা আলাদা উচ্চারণরীতি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এর বিকল্প হিসেবে, যেমনটা টিভি বক্তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বলা হয়, “এটা হচ্ছে বিলিওন যার শুরুর অক্ষর হচ্ছে বি”- তুলনামূলকভাবে অধিক ঝামেলাপূর্ণ।
একটা কৌতুক প্রচলিত আছে যেখানে এক প্লানেটারিয়াম বক্তা তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন যে ৫ বিলিওন বছরের মধ্যে সূর্য ফুলে-ফেঁপে উঠে রেড জায়ান্ট হয়ে উঠবে, বুধ এবং শুক্রকে গিলে খাবে আর সেইসাথে সম্ভবত পৃথিবীটাকেও। এরপরেই এক উদ্বিগ্ন শ্রোতা তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেনঃ
“দুঃখিত ডক্টর, কিন্তু আপনি কি বলেছেন যে সূর্য ৫ বিলিওন বছরের মধ্যে পৃথিবীকে পুড়িয়ে ছাই করে দিবে?”
“হ্যাঁ, এর বেশি বা কমও হতে পারে”।
“সব ঈশ্বরের দয়া! এক মূহুর্তের জন্যে আমি ভেবেছিলাম আপনি বলেছেন ৫ মিলিওন”।
এটা ৫ মিলিওন কিংবা ৫ বিলিওন যাই হোক না কেন, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এর খুব সামান্য প্রভাবই আছে, তা পৃথিবীর পরিণতি যতই চমকপ্রদ হোক না কেন। কিন্তু মিলিওন এবং বিলিওনের পার্থক্য নিরুপণ জাতীয় বাজেট, বৈশ্বিক জনসংখ্যা এবং পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করার জন্যে অতীব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও “বিলিওন এবং বিলিওন” এর জনপ্রিয়তা এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, কিন্তু এই সংখ্যাটাও ধীরে ধীরে নগণ্য, সংকীর্ণ দৃষ্টির এবং উহ্য হয়ে পড়ছে। এর থেকেও কেতাদুরস্ত সংখ্যাটাকে এখন দিগন্তে কিংবা আরও কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। ট্রিলিওন এখন আমাদের উপর প্রায় উপনীত।
***
বইয়ের নাম- বিলিওনস অ্যান্ড বিলিওনস থটস অন লাইফ অ্যান্ড ডেথ অ্যাট দ্যা ব্রিঙ্ক অব দ্যা মিলেনিয়াম
লেখক- কার্ল সেগান
পর্ব- ১ (দ্যা পাওয়ার অ্যান্ড বিউটি অব কোয়ান্টিফিকেশান)
অধ্যায়- ১ (বিলিওনস অ্যান্ড বিলিওনস)
***
এখানে প্রথম অধ্যায়ের খুব সামান্য অংশই অনুবাদ করে দিয়েছি। পড়ে হয়তো সবার ভালো লাগবে তাই!