মূল লেখাঃ How do we know that evolution is really happening?
বিবর্তন তত্ত্ব হল বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি। জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এই তত্ত্ব ছাড়া গতি নেই। এককোষী প্রাণ থেকে কীভাবে বহুকোষী প্রাণ হল, কিংবা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে হাজার লক্ষ কোটি কিসিমের প্রাণীর বিকাশ কীভাবে ঘটলো, এগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা দেয় বিবর্তন তত্ত্বই।
আপনি কি এই ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহী? জানতে চান কীভাবে ব্যাকটেরিয়া থেকে এলো আম গাছ বা নীল তিমি? তাহলে পড়ে ফেলুন নিচের প্রবন্ধটি।
বিজ্ঞানী কিংবা যুক্তিবাদী মানুষের কাছে বিবর্তন একটি সত্য ঘটনা। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, কিংবা পৃথিবী সম্পূর্ণ গোল নয় বরং উত্তর-দক্ষিণ মেরুতে কিছুটা চাপা – এই সত্যগুলোর মতোই বিবর্তন তত্ত্বও সত্য। তবু মিডিয়ার কল্যাণে মাঝে মাঝে আমরা “বিবর্তন শুধুই একটা তত্ত্ব” অথবা “বিবর্তন তত্ত্ব পুরাই ভুয়া” টাইপের মন্তব্য শুনি।
কথা হচ্ছে, কেন জীববিজ্ঞানীরা বিবর্তন তত্ত্বকে সত্য মনে করেন? বিবর্তনের প্রমাণ কোথায়? উত্তর হল, বিবর্তনের এত শত উদাহরণ আমাদের সামনে আছে যে, কোথা থেকে শুরু করবো, সেটাই বিপত্তির বিষয়! তাই এ প্রবন্ধে বিবর্তনের প্রমাণ দেওয়া হবে, সহজ ভাষায় উদ্ঘাটন করা হবে জীবনের বিবর্তিত হওয়ার কাহিনি।
চলুন, সবার আগে জেনে নিই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আসলে কী।
এই তত্ত্ব সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের মনে যে ভাসা ভাসা ধারণা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ বিভিন্ন প্রজাতি সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়, পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে সবচেয়ে ফিট প্রজাতিটি বেঁচে থাকে, এবং বানরের মতো দেখতে কোনো এক প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে।
কথা হল, বিবর্তনের ধাপ সম্পর্কে জানা না থাকলে এটা মেনে নেওয়া আসলেই কঠিন যে, আপনি ওয়ার্ম থেকে কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হতে হতে আজকের মানুষ অবস্থানে এসেছেন। অর্থাৎ কিনা আপনি ওয়ার্মের বংশধর! কিন্তু ধাপে ধাপে দেখলে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বলে যে, প্রতিটা নতুন প্রাণীসত্ত্বা তার পিতামাতার চেয়ে একটু হলেও আলাদা। অর্থাৎ জীনগতভাবে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হলেও বংশধরেরা খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের বাবা মায়ের তুলনায় অনন্য (ইউনিক)। এই পার্থক্যগুলো কখনও কখনও সন্তানকে সুবিধা দেয়, আবার কখনও বিপদে ফেলে। যেহেতু প্রাণীরা খাদ্য এবং যৌনসঙ্গীর জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, তাই যেসব প্রাণী “সুবিধাজনক পার্থক্য” বা উপকারী বৈশিষ্ট্য বহন করে, তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং “অসুবিধাজনক পার্থক্য” বা অপকারী বৈশিষ্ট্য বহনকারীদের তুলনায় অনেক বেশি বংশধর উৎপন্ন করে। ফলে একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভেতর উপকারী বৈশিষ্ট্য বহনকারীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একসময় দেখা যায়, অপকারী বৈশিষ্ট্য বহনকারীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
এখন চিন্তা করে দেখুন, বারবার যদি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্য বিশিষ্ট সন্তান সন্তদি জন্ম নিতে থাকে, তাহলে কালের পরিক্রমায় আদি পিতামাতার তুলনায় সম্পূর্ণ নতুন একটা প্রজাতির উদ্ভব ঘটাটা কতোটা স্বাভাবিক? আর এভাবেই ওয়ার্ম থেকে বিবর্তিত হয়েছে মাছ, মাছ উঠে এসেছে ডাঙায়, ডাঙার প্রাণীদের গজিয়েছে চারটা পা, চারপেয়ে জীবগুলোর দেহে গজিয়েছে চুল – আর – তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুই পায়ে হাঁটা শুরু করেছে, নিজেদেরকে “মানুষ” বলে পরিচয় দিয়েছে আর একসময় বিবর্তন তত্ত্ব আবিষ্কার করে বসেছে!
অবশ্য এই বিষয়টা বিশ্বাস করা কষ্টকরই বটে। আপনি আপনার মা বাবার চেয়ে একটু ভিন্ন (যেমনঃ আপনার চুলের রঙ তাদের চেয়ে আলাদা হতে পারে, বা আপনি তাদের চেয়ে লম্বা হতে পারেন) – এই ব্যাপারটা মেনে নেওয়া এক জিনিস; আর আপনি অসংখ্য প্রজন্ম ধরে বিবর্তিত হতে হতে ওয়ার্ম থেকে আজকের “মানুষ” অবস্থানে এসেছেন, এটা মানা আরেক জিনিস। তবে কিনা, বিষয়টা তেতো হলেও সত্য। যারা এটা হজম করতে পারেন না, তাদেরকে বলবো, সবকিছু বাদ দিন। চলুন আপনাকে কিছু জিনিস দেখাই। হুট করে বিশ্বাস করার দরকার নেই যে, আপনার পূর্বপুরুষ ছিল এককোষী ব্যাকটেরিয়া। চলুন আপনার দরজার সামনে থেকে একটা অভিযান শুরু করি। এর মাধ্যমে আপনাকে দেখাবো, চোখের সামনেই কীভাবে ঘটছে বিবর্তন।
১৮৫৯ সালে ডারউইনের “অন দা অরিজিন অফ স্পিসিজ” বইটি প্রকাশিত হয়। বইটির শুরুতেই পাঠককে অনুরোধ করা হয় তার চারপাশের চেনা জগতটার উপর চোখ বুলাতে। এখানে বলা হয়নি অ্যামাজন বনের গহীনে যাওয়ার কথা, যেখানে এখনও কারো পা পড়েনি। বরং বলা হয়েছে বাড়ির পাশের বাগান কিংবা খামারের দিকে তাকাতে। কারণ বিবর্তন দেখার জন্য আসমুদ্রহিমাচল পার হতে হয় না, “ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া” বাইরে এসে দাঁড়ালেই আপনি দেখতে পাবেন, কীভাবে বিভিন্ন প্রাণী আর উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঘটে চলা এসব পরিবর্তনকে বলে “descent with modification“
ডারউইন বলতে চাচ্ছিলেন চাষাবাদ এবং পশুপাখির প্রজননের (ব্রিডিং) ব্যাপারে। আদিকাল থেকেই কৃষকরা নিজেদের লাভের জন্য নির্দিষ্ট প্রজাতির পশুপাখির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে বড় আকৃতির কিংবা শক্তিশালী পশুপাখির জন্ম দিতে আগ্রহী ছিলো। একইভাবে তারা অধিক উৎপাদনশীল ফসলের প্রজাতিও তৈরি করেছে। মানুষের পছন্দনীয় প্রজাতির মধ্যে এই যে প্রজনন ঘটানোর প্রক্রিয়া, একে বলে কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection)। আর এই কৃত্রিম নির্বাচন ঠিক সেভাবেই কাজ করে, যেভাবে বিবর্তন কাজ করে বলে ভেবেছিলেন ডারউইন মহাশয়।
মনে করুন, আপনার একটা বন্য মুরগির খামার আছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার সব মুরগি সমান সংখ্যক ডিম দিবে না। কেউ কম দিবে, কেউ বেশি। এখন যে মুরগিগুলো বেশি ডিম পাড়ে, আপনি চান তাদের সংখ্যা বাড়াতে। কারণ তাতে আপনার খামারের লাভ হবে বেশি। তো আপনি কী করবেন? প্রথমেই খুঁজে বের করবেন বেশি ডিম পাড়া মুরগিগুলোকে। এরপর তাদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে উৎপন্ন করবেন ডিম। সেই ডিম ফুটিয়ে আপনি শুধুমাত্র ঐ ডিম থেকে জন্ম নেওয়া মুরগিগুলোর মধ্যে প্রজনন হতে দেবেন। ফলে বেশি ডিম পাড়া মুরগির সংখ্যা যাবে বেড়ে। মুরগির প্রত্যেক প্রজন্মে যদি ধারাবাহিকভাবে আপনি এই প্রক্রিয়া চালাতে থাকেন, তাহলে একসময় দেখবেন, বন্য মুরগির (যারা কম ডিম পাড়ে) তুলনায় আপনি বেশি ডিম পাড়া মুরগির একটা আলাদা গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছেন।
এবার বোঝা গেলো, কীভাবে “ব্রয়লার মুরগি” নামে আলাদা একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বে? খেয়াল করেছেন এরা দেখতে বন্য মুরগির চেয়ে কতোটা ভিন্ন? কিংবা কতো বেশি পরিমাণে মাংস ধারণ করে দেহে? বলা বাহুল্য, এদের পূর্বপুরুষ কিন্তু বন্য মুরগিই!
আর এটাকেই বিবর্তন বলছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক স্টিভ জোন্স। “বিবর্তন আর কিছুই না, শুধু অনেকগুলো দুর্ঘটনার মাধ্যমে গড়ে ওঠা একটি কাঠামো।”
মনে হতে পারে, প্রজননের মাধ্যমে কয়েকটা মাত্র পরিবর্তন আসে। কিন্তু আসল কথা হল, এই পরিবর্তনের কোনো শেষ নেই। ডারউইন লিখেছিলেন, “এমন কোনো চলমান প্রক্রিয়া দেখা যায়নি, যার চলন থেমে গেছে। সবচেয়ে প্রাচীন কৃষিজাত ফসল (যেমনঃ গম) এখনও নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে সক্ষম। আমাদের প্রাচীন গৃহপালিত পশুপাখিরাও দ্রুত উন্নতি কিংবা পরিবর্তনে সক্ষম।”
প্রজননকে ডারউইন বলেছিলেন “মানুষের তত্ত্বাবধানে ঘটে চলা বিবর্তন”। এর মাধ্যমে বুঝা যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, সেগুলো একত্রিত হয়ে নতুন একটা প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে। জোন্সের মতে, “এটা অনিবার্য। এটা ঘটবেই।” তবে এটা ঠিক, কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে বেশি ডিম পাড়া মুরগির গোষ্ঠী তৈরি করার চেয়ে Natural Selection বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হওয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার।
বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, এই মুরগি এসেছে ডাইনোসর থেকে, আর ডাইনোসর কোথা থেকে এসেছে? জ্বী হ্যাঁ, মাছ থেকে। কিন্তু কীভাবে আমরা এটা বিশ্বাস করবো? আমরা তো এটা দেখতে পাচ্ছি না!
হ্যাঁ, এটা দেখতে পাচ্ছি না কারণ বিবর্তনের মাধ্যমে বড়সড় পরিবর্তন ঘটতে প্রচুর সময় লাগে। তাই প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রমাণ চাইলে আপনাকে চোখ বুলাতে হবে প্রাচীন তথ্য উপাত্তের উপর, তাকাতে হবে ফসিলের দিকে।
অনেক অনেককাল আগে মারা যাওয়া প্রাণীদের অবশিষ্টাংশ, যা পাথরের গায়ে সংরক্ষিত থাকে, তাকে ফসিল বলে। যেহেতু পাথর স্তরীভূত অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ একটা স্তরের উপর আরেকটা, তাই ফসিল রেকর্ড হিসেব করা হয় পুরানো থেকে নতুনের দিকে। সবচেয়ে পুরানো ফসিল সংরক্ষিত থাকবে সবচেয়ে নিচের স্তরের পাথরের গায়ে।
জোন্সের মতে, ফসিল রেকর্ড থেকেই বিবর্তনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়
ফসিল রেকর্ড থেকেই স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, সময়ের সাথে সাথে জীবন পরিবর্তিত হয়েছে। এটা একটা উল্লেখ করার মতো বিষয় যে, অরিজিন অফ স্পিসিজ বইটির প্রতি ছয় পৃষ্ঠার মধ্যে একটা পৃষ্ঠায় ফসিল রেকর্ড দিয়ে প্রমাণ দেখানো হয়েছে।
সবচেয়ে পুরাতন ফসিল হিসেবে পাওয়া গেছে এককোষী প্রাণকে, যেমনঃ ব্যাকটেরিয়া। এর অনেক অনেক বছর পরে পাওয়া গেছে অপেক্ষাকৃত জটিল প্রাণের ফসিল, যেমনঃ উদ্ভিদ এবং জন্তু। বিভিন্ন জন্তুর ফসিলের মধ্যে মাছের ফসিল পাওয়া গেছে উভচর, পাখি কিংবা স্তন্যপায়ীর আগে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, লেজবিহীন শিম্পাঞ্জী বা গরিলার (যাদেরকে আমরা সাধারণভাবে এইপ বলি) ফসিল পাওয়া গেছে পাথরের একদম নতুন স্তরে।
কিন্তু আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে, একটা প্রজাতি থেকে আরেকটা প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে?
ফসিলগুলোকে পরীক্ষা করলেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সাথে আজকালকার জীবিত অনেক প্রাণীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এটা থেকে অনেক ক্ষেত্রে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে যে, একটা থেকে আরেকটা এসেছে। যেমন, ২০১৪ সালে গবেষকরা ৫৫ মিলিয়ন বছরের পুরানো এক মাংসাশী প্রাণীর (Dormaalocyon) ফসিল সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, যাকে এ যুগের সিংহ, বাঘ আর ভালুকের সাধারণ পূর্বপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্রাণীটির দাঁতের আকৃতি এই সম্ভাবনাকে দৃঢ় করেছে।
কিন্তু এরপরও আপনার সন্দেহ থাকতে পারে। মনে হতে পারে বাঘ, সিংহ, ভালুক কিংবা Dormaalocyon-এর হয়তো একই রকম দাঁত আছে। কিন্তু তারপরও তো তারা সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতির প্রাণী! তাহলে কীভাবে আমরা সত্যিই একটা সলিড প্রমাণ পেতে পারি যে, একটা প্রজাতি (Dormaalocyon) থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে আরেকটা প্রজাতি (বাঘ) এসেছে?
দুর্দান্ত। পর্ব দুই এর অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ!
দেওয়া হলো পর্ব দুই।
http://onubadokderadda.com/evolution-in-front-of-eyes-2/
অসাধারণ। প্রবন্ধ নির্বাচন এবং অনুবাদ – দুটোই দুর্দান্ত হয়েছে।
ধন্যবাদ সহযাত্রী!