বিজ্ঞানচর্চায় নির্বুদ্ধিতার প্রয়োজনীয়তা

অনেক দিন পর পুরনো এক বন্ধুর দেখা পেলাম। আমরা দুজন একসময় একই সাথে পিএইচডি করছিলাম, বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছিলাম, গবেষণার বিষয় ভিন্ন ছিলো অবশ্য। মাঝপথে মেয়েটা গ্র্যাজুয়েট স্কুল ছেড়ে দিলো, চলে গেলো হার্ভার্ড’এ আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে, এবং এখন সে একটি নামকরা পরিবেশ সংগঠনে সিনিয়র আইনজীবী। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা উঠলো, কেন সে গ্র্যাজুয়েট স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলো। আমাকে হতবাক করে দিয়ে সে বললো, গ্র্যাজুয়েট স্টাডি নাকি ওকে বারবার মনে করিয়ে দিতো, যে সে একটা নির্বোধ!! দুই বছর ধরে প্রতিদিন নিজেকে নির্বোধ অনুভব করার পর, তার মনে হয়েছিলো, এবার অন্য কিছু করা দরকার।

আমার পরিচিতদের মধ্যে তাকে আমি অন্যতম মেধাবী বলেই জানতাম, এবং তার পরবর্তী ক্যারিয়ার সেই পর্যবেক্ষণটাকে সমর্থনও করে। কিন্তু এইমাত্র সে যা বললো, সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো, ব্যাপারটা মাথায় আটকে গেলো। পরদিন, হঠাৎ একসময়, আমার ওপর বজ্রপাতের মত আপতিত হলো- বিজ্ঞান আমাকেও একই অনুভূতি দেয় যে আমি একটা নিরেট হাঁদারাম; এবং আমি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এতোটাই অভ্যস্ত হয়েছি যে, আমি এখন এই হাঁদারাম অনুভূতি পাওয়ার নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করি। ঐ অনুভূতি ছাড়া এখন আমার আর চলে না। এমনকি আমার মনে হয়, এটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই তো হবার কথা।

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি……

আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হাই স্কুল বা কলেজে বিজ্ঞান পছন্দ করার অন্যতম একটি কারণ ছিলো যে আমরা এটাতে খুবই ভালো রেজাল্ট করতাম। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ হওয়া আসলে সম্ভব না; প্রকৃতিকে বোঝার আকাঙ্ক্ষা এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করার আবেগটাও এর সাথে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান হচ্ছে জাস্ট কোর্স নেয়া, এবং সেই কোর্সে ভালো করার অর্থ হচ্ছে পরীক্ষায় সঠিক উত্তর লেখা। আপনি যদি সেই উত্তরগুলো জানেন, তাহলে ভালো করবেন এবং নিজেকে স্মার্ট ভাববেন।

পিএইচডি, একেবারেই ভিন্ন একটা জিনিস- সেখানে আপনাকে একটা গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতে হয়। অন্তত আমার জন্য এটা বেশ ভীতিকর একটা কাজ ছিলো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ দেখাবে এমন কিছু প্রশ্ন তৈরি করা, ফলাফলটা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য হয় এমন একটা এক্সপেরিমেন্টের পরিকল্পনা ও ব্যাখ্যা করা, আগে থেকেই প্রতিবন্ধকতাগুলো অনুমান করে অন্য পথ খোঁজা এবং খুঁজে না পেলে অন্তত সমস্যাগুলোর সমাধান বের করা – এটা কি আসলেই আমার পক্ষে সম্ভব? আমার পিএইচডি প্রজেক্ট কিছুটা মিশ্রপ্রকৃতির ছিলো, এবং যখনই আমি কোথাও আটকে যেতাম, তখনই আমার ডিপার্টমেন্টের সেসব ফ্যাকাল্টি মেম্বারদেরকে জ্বালাতন করতাম যারা বিভিন্ন বিষয়ে এক্সপার্ট ছিলেন। সেই দিনটার কথা মনে পড়ে, যেদিন হেনরী টব (যিনি দুই বছর পর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন) এর কাছে তার বিষয় সম্পর্কিত একটা সমস্যা নিয়ে আমি যাওয়ার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এটার সমাধান তার জানা নেই। আমি তখন পিএইচডি’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং আমি জানতাম যে তিনি আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জানেন (আরো বেশি হতে পারে)…… যদি তার কাছে এটার সমাধান না থাকে, পৃথিবীর কারো কাছেই নেই।

তখনই আমি ধাক্কাটা খেলাম- কারো কাছেই নেই। এবং এজন্যেই এটা গবেষণার বিষয়। এবং যেহেতু এটা আমার গবেষণার বিষয়, এটার সমাধানের দায়িত্ব আমার কাঁধে। এবং যখন নিজের ঘাড়ে এসে পড়লো, দু-দিনের মধ্যেই আমি এটাকে সমাধান করে ফেললাম। ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন ছিলো না, আমাকে জাস্ট কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছিলো। অত্যন্ত জরুরী যে ব্যাপারটা শিখতে পারলাম, তা হলো আমার না জানা বিষয়ের পরিধিটা যে শুধু বিশাল তা-ই নয়; বলতে গেলে, অসীম। এই অনুভূতিটা মোটেও নিরুৎসাহমূলক ছিলোনা, বরং বেশ স্বস্তিদায়ক ছিলো। আমাদের অজ্ঞানতা যদি অপরিসীম হয়, তাহলে পথ হাতড়ানো-ই তো একমাত্র পথ, যতটা দক্ষতার সাথে সম্ভব।

আমাদের পিএইচডি প্রোগ্রাম দু’ভাবে ছাত্রদেরকে হেয় করে থাকে। প্রথমত, আমার মনে হয়না ছাত্ররা এটা বোঝে যে গবেষণা করা আসলে কতটা কঠিন; এবং কতটা বেশিমাত্রায় কঠিন জরুরী গবেষণা করা। বাজারে সবচেয়ে বেশি ডিমান্ড আছে, এমন যে কোন কোর্সের চেয়ে এটা অনেক গুণ কঠিন। যে জিনিসটা গবেষণাকে কঠিন করে তোলে, তা হলো অজানার সাগরে ঝাঁপ দেয়া। আমরা জানিইনা, আমরা আসলে কি করছি!! আমরা জানিনা যে আমরা ঠিক ঠিক প্রশ্নগুলো করছি কিনা বা ঠিক ঠিক এক্সপেরিমেন্ট করছি কিনা, যতক্ষণ না আমরা ফলাফল হাতে পাচ্ছি!! গবেষণার বাজেটের জন্য প্রতিযোগিতা, এবং মর্যাদাসম্পন্ন জার্নালে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে স্পষ্টতই বিজ্ঞান আরো কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু এসব বাদ দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করা সহজাতভাবেই কঠিন; এবং সদা পরিবর্তনরত বিভাগীয়, প্রাতিষ্ঠানিক অথবা জাতীয় শাসনতন্ত্র এই সহজাত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে অক্ষম।

দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের ছাত্রদেরকে এটা শেখাইনা যে কিভাবে উৎপাদনক্ষম (উৎপাদনে সক্ষম উপায়ে) নির্বোধ হতে হয়- অর্থাৎ, যতক্ষণ নিজেকে নির্বোধ না মনে করতে পারছি, তার মানে হচ্ছে কাজটা করার জন্য আসলে আমি চেষ্টাই করছিনা। আমি সেই ধরনের নির্বুদ্ধিতার কথা বলছিনা যেখানে ক্লাসের অন্যান্য ছাত্ররা শুধুমাত্র বই থেকে পড়ে, সামান্য চিন্তা করেই সিদ্ধিলাভ করছে, অথচ আপনি ফেল মেরে বসে আছেন। আমি এ ধরনের কিছুও বলছিনা যেখানে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন এক বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হা-পিত্যেস করছেন, যা আসলে তার প্রতিভার সাথে খাপ খায় না। বিজ্ঞান হলো, প্রকৃত নির্বুদ্ধিতার মুখোমুখি হওয়া। এই ধরনের নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে এক ধরনের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা, আমাদের প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত একটি অংশ, যা অজানার মধ্যে পথ তৈরি করে নিতে সহায়তা করে। প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা বা থিসিস-বিষয়ক পরীক্ষাগুলো এই ব্যাপারটার সত্যিকারের ধারণা দেয়। এ ধরনের পরীক্ষায় ফ্যাকাল্টি কমিটি ততক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকে, যতক্ষণ না ছাত্রটি ভুল উত্তর দিচ্ছে অথবা হাল ছেড়ে দিয়ে বলছে, আমি জানিনা। এই পরীক্ষার মূল লক্ষ্য কোনভাবেই এটা যাচাই করা নয় যে ছাত্রটি সকল প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়ে ফেলবে। যদি দিতে পারে, তার মানে দাঁড়ায় যে আসলে ফ্যাকাল্টি মেম্বাররাই ফেইল করেছে। লক্ষ্যটা হচ্ছে, কোথায় ছাত্রটির দুর্বলতা আছে, সেটা বের করা- এটা দেখার জন্য যে কোন ক্ষেত্রে তাকে আরেকটু কসরত করতে হবে এবং তার জ্ঞানের পরিধি এমন পর্যায়ে আছে কিনা যে পর্যায়ে গেলে বলা যায় যে সে এখন একটা গবেষণা প্রকল্পের ভার কাঁধে নিতে সক্ষম।

উৎপাদনক্ষম নির্বুদ্ধিতার অর্থ হচ্ছে স্বজ্ঞানে অজ্ঞ হওয়া। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর ওপর আলোকপাত করতে গেলে হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়তেই হয়। বিজ্ঞান আমাদেরকে বারংবার হোঁচট খাওয়ার অনুমতি দেয়, ভুল করতে দেয়, এবং তৎস্বত্ত্বেও আমরা মানসিক শান্তি অনুভব করি, যদি প্রত্যেক ভুলের মাধ্যমে নতুন কিছু শিখতে পারি- এবং এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। যারা সঠিক উত্তর পেতে পেতে অভ্যস্ত, তাদের জন্য এভাবে চিন্তা করাটা নিঃসন্দেহে বেশ মুশকিল। পরিমিত আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক দৃঢ়তা অবশ্যই জরুরী, কিন্তু বিজ্ঞানের শিক্ষাটা বেশ ভিন্ন ধরনের- আয়েশ অনুভব করার জন্য বিজ্ঞান চর্চা নয়, অন্যদের আবিষ্কার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজে কিছু আবিষ্কার করার জন্যেই আপনার বিজ্ঞান চর্চা। নিজেকে নির্বোধ ভাবার অনুভূতিটাকে আমরা যত সহজ ভাবে নিতে পারবো, তত সহজে অজানার সাগরে নিজেদেরকে মানিয়ে দিতে পারবো, এবং তাহলেই হয়তো আমরা বেশ বড়সড় কিছু আবিষ্কার করতে পারবো!

Original Article
The importance of stupidity in scientific research

Martin A. Schwartz
Department of Microbiology,
UVA Health System, University of Virginia,
Charlottesville, VA 22908, USA

I recently saw an old friend for the first time in many years. We had been Ph.D. students at the same time, both studying science, although in different areas. She later dropped out of graduate school, went to Harvard Law School and is now a senior lawyer for a major environmental organization. At some point, the conversation turned to why she had left graduate school. To my utter astonishment, she said it was because it made her feel stupid. After a couple of years of feeling stupid every day, she was ready to do something else.

I had thought of her as one of the brightest people I knew and her subsequent career supports that view. What she said bothered me. I kept thinking about it; sometime the next day, it hit me. Science makes me feel stupid too. It’s just that I’ve gotten used to it. So used to it, in fact, that I actively seek out new opportunities to feel

stupid. I wouldn’t know what to do without that feeling. I even think it’s supposed to be this way. Let me explain.

For almost all of us, one of the reasons that we liked science in high school and college is that we were good at it. That can’t be the only reason – fascination with understanding the physical world and an emotional need to discover new things has to enter into it too. But high-school and college science means taking courses, and doing well in courses means getting the right answers on tests. If you know those answers, you do well and get to feel smart.

A Ph.D., in which you have to do a research project, is a whole different thing. For me, it was a daunting task. How could I possibly frame the questions that would lead to significant discoveries; design and interpret an experiment so that the conclusions were absolutely convincing; foresee difficulties and see ways around them, or, failing that, solve them when they occurred? My Ph.D. project was somewhat interdisciplinary and, for a while, whenever I ran into a problem, I pestered the faculty in my department who were experts in the various disciplines that I needed. I remember the day when Henry Taube (who won the Nobel Prize two years later) told me he didn’t know how to solve the problem I was having in his area. I was a third-year graduate student and I figured that Taube knew about 1000 times more than I did (conservative estimate). If he didn’t have the answer, nobody did.

That’s when it hit me: nobody did. That’s why it was a research problem. And being myresearch problem, it was up to me to solve. Once I faced that fact, I solved the problem in a couple of days. (It wasn’t really very hard; I just had to try a few things.) The crucial lesson was that the scope of things I didn’t know wasn’t merely vast; it was, for all practical purposes, infinite. That realization, instead of being discouraging, was liberating. If our ignorance is infinite, the only possible course of action is to muddle through as best we can.

I’d like to suggest that our Ph.D. programs often do students a disservice in two ways. First, I don’t think students are made to understand how hard it is to do research. And how very, very hard it is to do important research. It’s a lot harder than taking even very demanding courses. What makes it difficult is that research is immersion in the unknown. We just don’t know what we’re doing. We can’t be sure whether we’re asking the right question or doing the right experiment until we get the answer or the result. Admittedly, science is made harder by competition for grants and space in top journals. But apart from all of that, doing significant research is intrinsically hard and changing departmental, institutional or national policies will not succeed in lessening its intrinsic difficulty.

Second, we don’t do a good enough job of teaching our students how to be productively stupid – that is, if we don’t feel stupid it means we’re not really trying. I’m not talking about ‘relative stupidity’, in which the other students in the class actually read the material, think about it and ace the exam, whereas you don’t. I’m also not talking about bright people who might be working in areas that don’t match their talents. Science involves confronting our ‘absolute stupidity’. That kind of stupidity is an existential fact, inherent in our efforts to push our way into the unknown. Preliminary and thesis exams have the right idea when the faculty committee pushes until the student starts getting the answers wrong or gives up and says, ‘I don’t know’. The point of the exam isn’t to see if the student gets all the answers right. If they do, it’s the faculty who failed the exam. The point is to identify the student’s weaknesses, partly to see where they need to invest some effort and partly to see whether the student’s knowledge fails at a sufficiently high level that they are ready to take on a research project.

Productive stupidity means being ignorant by choice. Focusing on important questions puts us in the awkward position of being ignorant. One of the beautiful things about science is that it allows us to bumble along, getting it wrong time after time, and feel perfectly fine as long as we learn something each time. No doubt, this can be difficult for students who are accustomed to getting the answers right. No doubt, reasonable levels of confidence and emotional resilience help, but I think scientific education might do more to ease what is a very big transition: from learning what other people once discovered to making your own discoveries. The more comfortable we become with being stupid, the deeper we will wade into the unknown and the more likely we are to make big discoveries.

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *