ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নোর প্রথম অধ্যায় (অনুবাদ)

আমিই সেই ছায়া
আমি ছুটে যাই, বিষণ্ন শহরের পথ ধরে
আমি ছুটতে থাকি, চিরন্তন বিষণ্ণতা চিরে

আর্নো নদীর তীর ধরে আমি ছুটছি, অবিশ্রান্ত…… ভিয়া দেই কাস্তেলানির দিকে এসে বাম দিকে মোড় নেই, ছুটতে থাকি উত্তরের দিকে, উফিৎজি (Ufizi museum)-এর ছায়ার মধ্যে গাদাগাদি করে!

এখনো তারা আমার পিছু ধাওয়া করছে। তাদের পদধ্বনি এখন আগের চেয়ে স্পষ্ট, যেন তাদের শিকারের ইচ্ছা আগের চেয়েও দৃঢ়।

বছরের পর বছর ধরে তারা আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। তাদের গোয়ার্তুমি আমাকে ঠেলে দিয়েছে ভূ-গর্ভে…… বাধ্য করেছে প্রায়শ্চিত্তস্থলে থাকতে…… ভূ-গর্ভস্থ দানবের মত হাতড়ে বেড়াতে।

আমিই সেই ছায়া

আর এখন মাটির ওপরে, আমি উত্তর আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই, কিন্তু মোক্ষলাভের সুনির্দিষ্ট কোন পথ খুঁজে পাই না…… এপেনাইন পর্বতমালা ভোরকে এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে।

এক-হাতওয়ালা ঘড়ি আর খাঁজকাটা মিনারওয়ালা পালাজ্জো কে পেছনে ফেলে সাপের মত এঁকে-বেঁকে আমি ছুটে যাই, পাশ কাটাই পিয়াজ্জা দি সান ফিরেঞ্চির প্রত্যুষের মাতাল বিক্রেতাদেরকে। বার্জেলো-কে অতিক্রম করে, আমি বাঁক নেই পশ্চিমে, বাদিয়ার কুণ্ডলীর দিকে এবং ছুটে চলি সিঁড়ির গোড়ার লৌহ নির্মিত গেটের দিকে।

সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে হবে এখন।

আমি হাতল ঘুরিয়ে প্রবেশ করি প্যাসেজে, এখান থেকে আমার পিছু ফেরার কোন পথ নেই। আমার মন্থর পা দুটোকে আমি টেনে নিয়ে চলি সরু সিঁড়ি বেয়ে, নরম মার্বেলের তৈরি পুরনো সর্পিলাকার সেই সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে আকাশটাকে ছোঁবে বলে এগিয়ে গেছে যেন।

কণ্ঠগুলো নিচে থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তারা আমার পেছনে, অদম্য, দূরত্ব কমে আসছে।

তারা জানে না কী ঘটতে যাচ্ছে, জানে না আমি তাদের জন্য কী কী করেছি! অকৃতজ্ঞের দল!

ওপরের দিকে উঠছি, আর চিত্রটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে…… কামুক শরীরগুলো মুচড়ে উঠছে অগ্নিবৃষ্টিতে, লোভী আত্মাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে বিষ্ঠার মাঝে, শয়তানের শীতল থাবার মধ্যে জমে আছে ধোঁকাবাজের দল।

শেষ সিঁড়িগুলো টপকে আমি পৌঁছে যাই একেবারে ওপরে, স্যাঁতস্যাঁতে সকালের বাতাসে প্রায় অর্ধমৃত। আমি এগিয়ে যাই মাথা-সমান উঁচু দেয়ালের দিকে, ফাঁক দিয়ে নিক্ষেপ করি আমার দৃষ্টি। নিচে শায়িত সেই আশীর্বাদপুষ্ট শহর; যারা আমাকে নির্বাসিত করেছে, তাদের কাছ থেকে যে শহরকে আমি আমার অভয়ারণ্য হিসেবে পেয়েছি।

পেছন থেকে ডাক দিলো একটা কণ্ঠ, ঠিক পেছনেই এসে পড়েছে তারা এখন, “তুমি যা করেছো, সেটা স্রেফ উন্মত্ততা”

উন্মত্ততা জন্ম দেয় নতুন উন্মত্ততা।

“ঈশ্বরের দোহাই” তারা চিৎকার করে বললো, “বলো কোথায় সেটাকে লুকিয়ে রেখেছো”

ঠিক ঈশ্বরের জন্যই, আমি বলবো না।

আমি দাঁড়িয়ে আছি, কোণঠাসা, পিঠ ঠেকে আছে ঠাণ্ডা পাথরে। তারা আমার গভীর সবুজ চোখের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে রইলো। তাদের দৃষ্টি এখন আর তোষামোদ জ্ঞাপন করছেনা, হুমকি প্রদর্শন করছে, “তুমি জানো, আমাদের কিছু পদ্ধতি আছে। আমরা তোমাকে বলতে বাধ্য করতে পারি”

এবং এই কারণেই, আমি ইতোমধ্যে স্বর্গের পথ অর্ধেক পাড়ি দিয়ে ফেলেছি।

কোনো সতর্কতা না দিয়েই আমি পিছু ফিরলাম, দেয়ালের উঁচু প্রান্ত আঁকড়ে ধরে নিজেকে টেনে তুললাম, প্রথমে কাঁপতে থাকা হাঁটিতে ভর দিয়ে, এরপর সোজা হয়ে…… চূড়ার ওপরে বেসামাল। অন্ধকার চিরে আমাকে পথ দেখাও, ভার্জিল।

নিজের দৃষ্টিকে বিশ্বাস করতে না পেরে তারা ছুটে আসলো আমার দিকে, আমার পা ধরতে চাইছিলো বোধহয়, কিন্তু ন্যূনতম ধাক্কায় আমার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছিলো। অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে তারা মিনতি করলো, কিন্তু আমি ইতোমধ্যেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমি জানি, আমাকে কী করতে হবে।

নিচে, ভয়াবহ অস্পষ্ট রকম নিচে, লাল টাইলসের ছাদগুলো গ্রাম্য আগুনের সমুদ্রের মত মনে হচ্ছে, যেন ফুটিয়ে তুলছে সেই ভূ-খণ্ডের কথা যেখানে এক সময় দৈত্যেরা অবাধে বিচরণ করতো…… গিয়োত্তো, দোনাতেল্লো, ব্রুনেলেশি, মিকেলেঞ্জেলো, বতিচেল্লি।

আমি প্রান্তের দিকে আরেক ইঞ্চি এগিয়ে যাই।

“নেমে আসো” তারা চিৎকার করে উঠলো, “এখনো সময় আছে”।

কূপমণ্ডুকের দল! তোমরা কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও না? তোমরা কি দেখতে পাও না আমার সৃষ্টির মাহাত্ম্য? আমার সৃষ্টির প্রয়োজন?

আমি আনন্দের সাথেই বরণ করে নেবো এই চূড়ান্ত আত্মত্যাগ…… এবং একই সাথে আমি নিভিয়ে দেবো সেটা খুঁজে পাওয়ার জন্য তোমাদের আশার শেষ প্রদীপ।

তোমরা কখনোই সেটাকে সময় থাকতে খুঁজে পাবে না।

শ’কয়েক ফুট নিচে, কাঁকরবিছানো পিয়াজ্জা (বাঁধানো উঠোন) যেন এক শান্ত মরুদ্যানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সময়, যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে বেশি চাই। সময়, আমার বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার যে জিনিসটা কিনতে পারবে না।

শেষ এই মুহূর্তগুলোতে, আমি তাকাই নিচের পিয়াজ্জার দিকে, এবং দেখতে পাই এমন এক দৃশ্য যা আমাকে হতচকিত করে তোলে।

আমি দেখতে পাই তোমার চেহারা।

ছায়ার ভেতর থেকে তুমি তাকিয়ে আছো আমার দিকে। তোমার চোখ খুবই শোকগ্রস্ত, তবুও আমি টের পাই, সেখানে লুকিয়ে আছে শ্রদ্ধা, আমি যা সম্পূর্ণ করেছি, সেটার জন্য! তুমি জানো যে, আমার আর কোন উপায় ছিলো না। মানবতার খাতিরে, আমাকে রক্ষা করতে হবে আমার মাস্টারপিসকে।

এখনো সেটা বেড়ে চলেছে…… অপেক্ষা করছে…… যে হ্রদের রক্তিম জল কোন নক্ষত্রকে প্রতিফলিত করে না, সে হ্রদের গভীরে মৃদু আঁচে ফুটছে।

এবং এখন, আমি তোমার চোখ থেকে দৃষ্টি সরালাম, মনোনিবেশ করলাম দিগন্তের দিকে। ভারগ্রস্ত এই পৃথিবী থেকে অনেক ওপরে, আমি আমার শেষ প্রার্থনা সারলাম।

হে ঈশ্বর, আমি প্রার্থনা করি, পৃথিবী যতে আমাকে মনে রাখে, মহাপাপী হিসেবে নয়, বরং ত্রাণকর্তা হিসেবে, আপনি তো জানেনই। আমি প্রার্থনা করি, মানবজাতি যাতে বুঝতে পারে, আমি তাদের জন্য কি উপহার রেখে গেলাম।

আমার উপহার, ভবিষ্যৎ

আমার উপহার, পরিত্রাণ

আমার উপহার, ইনফার্নো

এবার আমি মৃদু স্বরে বলি, আমিন…… এবং নেই আমার শেষ পদক্ষেপ, অতল গহবরের দিকে!

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *