
নোয়াম চমস্কি হলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ইনস্টিটিউট প্রফেসর এমেরিটাস এবং অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের লরিয়েট প্রফেসর। তিনি ইনস্টিটিউট অফ নিউ ইকোনমিক থিংকিং [আইএনইটি] এর সাথে পররাষ্ট্র নীতি, ইন্টারনেটের যুগে ভিন্ন মত, পাবলিক এডুকেশন, কর্পোরেট আগ্রাসন, আমেরিকার নির্বাচনসমূহে কারা বাগড়া দিচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আরও অনেক বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লিন প্যারামোর।
লিন প্যারামোরঃ আপনি তো অনেক দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করছেন। এই দুই ক্ষেত্রে কয়েক দশক যাবত কোন ধরনের ধারাবাহিকতা প্রতিভাত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
নোয়াম চমস্কিঃ ধারাবাহিকতা যেটা আছে তা হচ্ছে মেলো নিবাসীদের উদ্দেশ্যে এথেন্স নিবাসীদের বার্তাটিঃ “ক্ষমতাবানেরা ইচ্ছেমত যা খুশি করে আর দুর্বলদের অবশ্যই এর ফল ভোগ করতে হয় ” [থুসিডাইডের হিস্ট্রি অফ দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়ার থেকে]। একে অনেক সময় লোকহিতকর পরিভাষা দিয়ে আড়াল করা হয়। ধরণ ও প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়। পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয় কিন্তু বার্তা একই থেকে যায়।
লিন প্যারামোরঃ আপনি কোনগুলোকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখেন?
নোয়াম চমস্কিঃ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার উপর অবরোধ ও সীমা আরোপের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ তো আছেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলো ভেতর থেকেই আসে। তাই উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকান এবং ভিয়েতনামে জন এফ কেনেডি ও লিন্ডন জনসন কর্তৃক পরিচালিত কার্যকলাপের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন যে, এগুলো সম্ভব হয়েছে জনসাধারণের মনোযোগের প্রায় সম্পূর্ন ঘাটতির কারণে।
আপনি জানেন কিনা জানি না, তবে ১৯৬৬ সালের দিকে বস্টনে আমরা যুদ্ধ-বিরোধী কোনো কার্যকলাপ চালাতেই পারতাম না কারণ সংবাদপত্রের সহায়তায় এগুলোকে সহিংসভাবে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হতো এবং আরও কত কী। তত দিনে দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাস্তবিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধটা ইন্দোচীনের অন্যান্য এলাকায় বিস্তার লাভ করেছে। খুব শুরুতেই রিগ্যান প্রশাসন সেটার পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করলো যেটা ১৯৬১ সালে কেনেডি করেছিলেন মধ্য আমেরিকার ক্ষেত্রে। সুতরাং কমিউনিস্টরা সবকিছু দখলে নিচ্ছে, কেনেডির সময়ের এই সরকারি বিবৃতির উপর ভিত্তি করে তাদেরও কম-বেশি একটি সরকারি বিবৃতি তৈরি ছিলো। এটি ছিলো একটি সাধারণ পদক্ষেপ, যা হলো প্রোপাগান্ডা, তবে এটি দ্রুতই ধ্বসে পড়লো। কেনেডির সরকারি বিবৃতির বেলায় এর বেশিরভাগই যে সকল ক্ষেত্রে প্রতারণামূলক তা প্রমাণিত হতে অনেক বছর লেগেছিলো, তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ছয় মাসেই এটা উদ্ঘাটন করেছিলো। চার্চ গ্রুপসমূহ এবং জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হয়েছিলো কিন্তু তাদের এক রকম পিছু হটতে হয়েছিলো। যা ঘটেছিলো সেটা যথেষ্ট খারাপ, তবে ইন্দোচীনের মতো নয় একদমই।
সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে ইরাক-ই হলো প্রথম কোনো ঘটনা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। লোকে একে ব্যর্থ মনে করে, কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমার মতে, তারা যেসব জিনিস করতে পারতো সেটা পূর্বে কখনোই করতে আরম্ভ করেনি। জনবহুল এলাকায় বি-৫২ টহল কিংবা ইন্দোচীনে তাদের রাসায়নিক যুদ্ধের মতো মতো কোনো যুদ্ধ হয়নি। মোটের উপর অবরোধটা এসেছে ভেতর থেকে, আর তারা সেটা বুঝতে পেরেছে। আপনি প্রথম বুশ প্রশাসনের দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তারা জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশলগত নীতির পত্তন করেছে। তারা আদতে যা বলেছে তা হলো, তারা যাদেরকে দুর্বল শত্রু হিসেবে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি এবং এগুলো তাড়াতাড়ি ও স্থিরসংকল্প হয়ে পরিচালিত করতে হবে, নয়ত সেটা হবে বিব্রতকর — এ ধরনের বয়ানেই জনপ্রিয় প্রতিক্রিয়া ঠিক হয়ে থাকে। আর এভাবেই তা হয়ে এসেছে। এটা খুব বেশি নয়, তবে এক প্রকার সীমাবদ্ধতা।
রোম চুক্তির [১৯৫৭ সালের চুক্তি যার উপর ভিত্তি করে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি প্রতিষ্ঠিত হয়] মতো আন্তর্জাতিক আইনে শর্তসমূহ বেড়েই চলেছে এবং আরো অনেক কিছু, তবে পরাশক্তিগুলো এগুলো একদমই অগ্রাহ্য করে যদি তারা এই ব্যাপারে পগার পার হয়ে যেতে পারে। আর পগার পার হওয়া মানে অন্যান্য রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতাকে অগ্রাহ্য না করা, যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় দেখা যায়। অথবা আমি মনে করি, সমাজের ভেতরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা, যেটা শর্তগুলোতে কিছু তাৎপর্য যোগ করেছে।
এটা এখন প্রায় অকল্পনীয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো যুদ্ধ শুরু করবে, যেটা অনেকটা এলিট মতামতের স্বীকৃতি নিয়ে ইন্দোচীনে করেছিলো। একটি সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে [ওয়াল্টার] ক্রোঙ্কাইট এবং তিনি কীভাবে সবকিছু পরিবর্তন করেছিলেন সেটা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ মার্ক বাউডেনের সেদিনকার সম্পাদকীয়। আচ্ছা, ওয়াল্টার ক্রোঙ্কাইট কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, মনে হচ্ছে না যেন আমরা জিততে চলেছি। এটিই যুদ্ধের সমালোচনা। এভাবেই বিষয়টাকে সে সময় আত্মস্থ করা হয়েছিলো, আর এভাবেই আজও বুদ্ধিজীবী এলিটরা এটাকে হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন। তবে আপনি যদি জনসাধারণের মতামতের দিকে নজর দেন — যেটা সত্যিকার অর্থেই বেশি অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে খুব বেশি বুঝা যায় না যে আসলে কী বুঝানো হচ্ছে, তবে এটি কৌতূহলোদ্দীপক — সত্তর ও আশির দশকে সব ধরনের ইস্যু নিয়ে শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স জরিপ পরিচালনা করছিলো, আর ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এই যুদ্ধকে ভ্রান্তি হিসেবে নয়, বরং মৌলিকভাবে ভুল ও অনৈতিক হিসেবে অভিহিত করেছে। প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা থামানোর আগ পর্যন্ত সেটা কয়েক বছর যাবত মোটামুটি একই রকম চলেছে। গবেষণাটির পরিচালক জন রাইলি তার ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, অনেক বেশি সংখ্যক আমেরিকান প্রাণ হারাচ্ছিলো। হয়ত তা-ই। “মৌলিকভাবে ভুল ও অনৈতিক” এই কথাটির আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করছে। তবে এটি কখনোই তদন্ত করা হয়নি কারণ অত্যধিক বৌদ্ধিক অসঙ্গতি দেখা দিয়েছিলো। এলিট বুদ্ধিজীবীরা সেই সম্ভাবনাকে ধারণ করতে পারেন না।
যখন যুদ্ধ শেষ হলো তখন প্রত্যেকেরই একটা মন্তব্য ছিলো, আর তাই আমলারা বললেন, “পেছন থেকে ছুরি মারো” [অর্থাৎ বেসামরিক সমালোচকরা সামরিক বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে] এবং “আমরা যদি আরও কঠোরভাবে লড়াই করতাম তাহলে জিততে পারতাম।” নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর অ্যান্থনি লেউইসের মতো শান্তিকামী কূটনীতিকরা এমন প্রচার চালাচ্ছিলেন, যিনি সম্ভবত এদের মধ্যে সবচেয়ে চরমপন্থী ছিলেন। যখন ১৯৭৫ সালে যুদ্ধ শেষ হলো তখন তিনি বললেন, কল্যাণসাধন করতে গিয়ে ভুল প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। “কল্যাণ করার প্রচেষ্টা” হলো একটি ব্যবহারিক পুনরুক্তি, সেখানে বাস্তবিক সত্যের প্রাসঙ্গিকতা নেই; আর “ভুল” মানে হলো এটি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বললেন, ১৯৬৯ সালের মধ্যে এটি একটি দুর্যোগ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গ্রহণযোগ্য মূল্য দিয়ে ভিয়েতনামে গণতন্ত্র নিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে এটিই ছিলো যুদ্ধ নিয়ে অতি বামপন্থী সমালোচনা। আর বাউডেন, যিনি একটি সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখছিলেন, তিনি কিছু দিন আগে আদতে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেনঃ ক্রোঙ্কাইটের মহৎ অবদান ছিলো, “দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আমরা জয় লাভ করবো না, আর আমরা যদি জিততে না পারি…” আমার মতে, রাশিয়ান জেনারেলরা আফগানিস্তানে একই কথা বলেছিলেন। আমরা সেজন্য তাদেরকে সম্মানিত করি না।
লিন প্যারামোরঃ ডিজিটাল যুগের আগেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং পাওয়ার-এ আপনি প্রতিবাদগুলোর কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ভিন্নমতাবলম্বী ও প্রতিবাদকারীদের পক্ষে তখন একে অপরের সাথে যুক্ত হওয়া মুশকিল ছিলো। ইন্টারনেট এটাকে কীভাবে পরিবর্তন করেছে? প্রতিবাদকারীরা অবশ্যই অনলাইনে নজরদারির মধ্যে থাকেন, তবে তারা একে অপরের সাথে খুব দ্রুতই যুক্ত হতে পারেন। যারা যুদ্ধ ও দমন-পীড়নের বিরোধিতা করেন তাদের কোনো লাভ হয়েছে কি? নাকি এই লাভটা অলীক?
নোয়াম চমস্কিঃ আপনার হয়ত স্মরণে আছে, কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভের সময়, সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে যেটাকে সংগঠিত করা হচ্ছিলো তখন এক পর্যায়ে [হোসনি] মোবারক আসলেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর ফলে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো। মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলতে শুরু করলো। এটা ভিন্ন এক ধরনের যোগাযোগ। এটা অনেক কিছু। তাই আমি মনে করি, হ্যাঁ, সামাজিক মাধ্যম দ্রুত সংগঠন ও সংযোগের ব্যাপারে সুযোগ তৈরি করে দেয়, তবে সেটা সাধারণভাবে একটি অগভীর স্তরে হয়ে থাকে। মুখোমুখি সংগঠিত হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। একই জিনিস ঘটনাচক্রে নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখা যায়। [২০১৬ সালের] প্রচারাভিযানের সময় অ্যান্ড্রু ককবার্ন হার্পারস্-এ একটি চমকপ্রদ নিবন্ধে সম্ভাব্য ভোটারদের উপর বিজ্ঞাপন, যেমন টিভির প্রভাব নিয়ে করা গবেষণা এবং ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলার প্রভাব নিয়ে করা গবেষণার মধ্যে তুলনা করেছেন। এটি অভিভূত করার মতো যে পরেরটা বেশি কার্যকরী। আমরা এখনো মানুষই আছি।
লিন প্যারামোরঃ গুগল ও ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো ক্রমাগত আমাদের অধিগত তথ্যকে নিয়ন্ত্রিত করে। ঘটনাসমূহের তদন্ত করা ও মেকি তথ্য নির্মূল করার ক্ষেত্রে এগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যদিও এমন প্রমাণ আছে যে এগুলো হয়ত ন্যায়সঙ্গত ভিন্নমতকে নির্মূল করছে। তারপরও তাদের গুণকীর্তন করা হয় যেন তারা কোনো পরিষেবা প্রদান করছে। এ ধরনের জিনিসগুলো কীভাবে আমাদের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে?
নোয়াম চমস্কিঃ এই পরিষেবা একটি বাজে কারণকে নির্দেশ করে। তরুণরা বেশি পড়ে না, তাই তারা এমন কিছু চায় যা হবে ত্বরিত, দ্রুত, সহজ। আপনি যখন একটি পত্রিকা পড়েন তখন এটার পেছনে কিছু সময় ব্যয় হয়। আপনাকে দেখতে হবে কলামটির শেষে কী বলা হয়েছে, শুধু শিরোনামে কী আছে তা নয়। সুতরাং এই ধরনের তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তির লাভের সংস্কৃতি মানুষকে এসমস্ত দ্রুততর সারাংশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবিকভাবে সবাই ফেসবুকে আছে (আমি ছাড়া)।
আরেকটা কৌতূলোদ্দীপক জিনিস তারা করছে তা হচ্ছে ক্ষুদ্র লক্ষ্যবস্তু স্থিরকরণ, যেটা নির্বাচনী কারচুপির জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিছু ঘটনা আছে যেগুলো আমার জানামতে ব্যবসা সংক্রান্ত সংবাদের বাইরে আলোচিত হয়নি। জার্মানিতে বিগত নির্বাচনের সময় রাশিয়ার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে যা কিনা এটি নির্বাচনের ফল উলটে দেবে। এই মিলিত প্রয়াসটি ফেসবুকের বার্লিন অফিস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিডিয়া কোম্পানির। এই কোম্পানিটি ট্রাম্প, লা পেন, নেতানিয়াহু ও অন্য সব চমৎকার মানুষের স্বার্থ সিদ্ধি করে। জনগোষ্ঠীর অংশসমূহের একটি জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে নব্য-নাৎসী পার্টি এএফডি-র সমর্থনে ক্ষুদ্র লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য তারা বার্লিনে ফেসবুককে ব্যবহার করেছে, যেটা নির্বাচনে দলটির অপ্রত্যাশিত বেশি ভোটের পক্ষে একটি নিয়ামক হয়ে থাকতে পারে। এটি ব্লুমবার্গ নিউজউইক-এ প্রকাশিত হয়েছে। এটি নির্বাচনী কারচুপির একটি বাস্তব ঘটনা কিন্তু কোনো এক কারণে তা শিরোনামে আসে না।
লিন প্যারামোরঃ আমরা এবার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপটে চলে আসি। আমি বুঝতে পারছি আপনি এই বাক্যটি নিয়ে খুব আগ্রহী নন।
নোয়াম চমস্কিঃ আসলে কিছু কারণে এটাকে গুরুত্বসহকারে নেওয়া কঠিন। একটি কারণ হচ্ছে থমাস ফার্গুসন ও তাঁর সহকর্মীরা [“ট্রাম্প কীভাবে অর্থের মাধ্যমে হোয়াইট হাউজ জিতে নিলেন?”]। আসলে নির্বাচনে কারচুপি আছে, কিন্তু এটা রাশিয়ানদের কাছ থেকে আসছে না। যারা নির্বাচন কিনে নেয় তাদের দিক থেকেই এটি আসছে। ২০১৬ সালের নির্বাচন নিয়ে তাঁর গবেষণার কথাই ধরুন [“হাঙ্গার গেমসের যুগে শিল্প কাঠামো ও পার্টি প্রতিযোগিতাঃ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন”]। এভাবে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে হয়। অথবা তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এক বছর আগে “অর্থ কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নির্বাচনকে চালিত করে” শিরোনামে কংগ্রেসের উপর যে দৃষ্টি আকর্ষক গবেষণা করেছিলেন, যেখানে আপনি একটি সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পাবেন [কংগ্রেসের প্রধান পার্টিগুলোর ভোট ও অর্থের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ]। সামাজিক বিজ্ঞানে এই ধরনের ফলাফল আপনি কদাচিৎ দেখতে পাবেন। এটা ব্যাপক কারচুপি। এর তুলনায় রাশিয়া যা করে থাকতে পারে তা খুবই সামান্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশে যা করে থাকে সেই সত্যকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বলছি।
লিন প্যারামোরঃ ফাঁস হওয়া ইমেইল থেকে এটা পরিষ্কার যে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেন্সিয়াল মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি অনধিকার চর্চা করেছে, যেটা সকল প্রার্থীর জন্য নিরপেক্ষ হওয়ার কথা ছিলো। একজন সত্যিকারের সংস্কারপন্থী প্রার্থী, একজন সত্যিকারের গণপন্থীর পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে কোন জিনিসটি দরকার বলে আপনি মনে করেন?
নোয়াম চমস্কিঃ আসলেই যেটা দরকার তা হলো জনপ্রিয় সংগঠন ও এক্টিভিজম। সকল ত্রুটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো মোটামুটি একটি স্বাধীন দেশ। এই ক্ষেত্রে, বার্নি স্যান্ডার্সকে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির ব্যবস্থাপকদের অনধিকার চর্চা করতে হয়েছে। তাঁর প্রচারাভিযান, আমি মনে করি, সত্যিই নজর কাড়ার মতো। আমি এমন কিছু আঁচ করতে পারতাম না। আমেরিকার একশো বছরের বেশি সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি ছেদ টেনে দিয়েছে। কোনো রকম কর্পোরেট সমর্থন নেই, কোনো আর্থিক সম্পদ নেই, তিনি ছিলেন অচেনা একজন, কোনো গণমাধ্যমের সহায়তা নেই। গণমাধ্যম একদমই তাঁকে অগ্রাহ্য করেছে নয়ত হেয় করেছে। আর তিনি প্রায় কাছাকাছি চলেই এসেছিলেন — তিনি হয়ত মনোনয়ন পেয়েই যেতেন, এমনকি নির্বাচনও জিতে যেতেন। কিন্তু ভাবুন তিনি নির্বাচিত হলে কী হতো? তিনি কিছুই করতে পারতেন না। কোনো গর্ভনর, কোনো আইন সভা, কোনো বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি, এবং কংগ্রেসের এমন কেউই নেই, যাদের কিনা নীতিমালার উপর ব্যাপক প্রভাব আছে। সকলেই তাঁর বিরুদ্ধে ছিলো। তাঁর পক্ষে কোনো কিছু করতে হলে তাঁর একটি বাস্তবিক, ক্রিয়াশীল পার্টি কাঠামো থাকতে হতো, যেটাকে তৃণমূল থেকে উঠে আসতে হতো। একে স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হতে হতো, একে স্থানীয় পর্যায়ে, রাজ্য পর্যায়ে, কংগ্রেসে, আমলাতন্ত্রে পরিচালনা করতে হতো — আপনাকে গোড়া থেকে পুরো সিস্টেম নির্মাণ করতে হবে।
এখন এটি আগ্রহ জাগায় যে, আমি নিশ্চিত আপনি সেই জরিপগুলো দেখেছেন যেখানে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য হয়েছেন। একটি কার্যকরী গণতন্ত্রে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, তার কোথাও অধিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তবে তিনি যা করেন তা খবরে আসে না। এটি ঘটছে, এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উদারপন্থী মিডিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এর যেন কোনো অস্তিত্বই নেই।
লিন প্যারামোরঃ সাম্প্রতিক সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিনেটর ডায়ান ফেইনস্টেইন ষষ্ঠ মেয়াদে রাজ্য ডেমোক্রেটিক পার্টিতে অনুমোদন জিততে না পেরে খুব বড় ধাক্কা খেয়েছেন। এ ব্যাপারে কী বলবেন? এটা কি স্যান্ডার্সের ঘটনার মতো, অর্থাৎ যেসব মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ও শ্রমিকদের সুরক্ষার মতো মৌলিক বিষয়গুলো চায় তারা নির্বিকার থাকা প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করার মাধ্যমে তাদের অগ্রাধিকারগুলো জানান দিচ্ছে?
নোয়াম চমস্কিঃ তাঁকে ভোটে পরাজিত করা হয়েছে, আর স্যান্ডার্সের মতো অথবা ইংল্যান্ডে [জেরেমি] করবিনের মতো একটি অভ্যুত্থান হয়েছে, আর একে যদি শক্ত ভিতসহ টেকসই কিছুতে পরিণত করা যেতো তাহলে এটি অনেক অর্থ বহন করতো। ঐতিহ্যগতভাবে, এটি সবসমই শ্রমিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, এবং তাই কর্পোরেট সেক্টর ইউনিয়নগুলোকে ধ্বংস করার জন্য এত নিবেদিত। জেনাস মামলায় বিষয়টি উঠে আসছে, যেটা সেদিন জানা গেলো। সম্ভবত তা জেনাসের পক্ষে যাবে, আর সেটা হবে পাবলিক ইউনিয়নগুলোর প্রতি একটি মারাত্মক আঘাত। [মার্ক জেনাস হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে জেনাস বনাম এএসএসসিএমই মামলার বাদী। মামলার বিষয় হচ্ছে যৌথ দর কষাকষি ও অভিযোগসমূহের সমাধান করার খরচ বহন করার জন্য ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারি চাকরিজীবীদের অবশ্যই বকেয়া অর্থাদি পরিশোধ করতে হবে কিনা।]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র প্রাইভেট সেক্টর ইউনিয়ন আন্দোলনকে ধ্বংস করার ব্যাপারে উৎসাহী। এটি অনেক লম্বা সময় ধরে চলে আসছে, তবে এখন তারা সত্যিই ভাবছে যে এর শ্বাসরোধ করতে পারবে কারণ এটিই হচ্ছে প্রায় সব এক্টিভিজমের কেন্দ্র। যেমন স্বাস্থ্য সেবার দিকে তাকান। পঞ্চাশের দশকে কানাডায় ইউনিয়নগুলোই জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার জন্য তোরজোর করছিলো, আর অনেকটা চমকপ্রদভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ইউনিয়নগুলোই তাদের জন্য, ডেট্রয়েটে মোটর শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য সেবার ব্যাপারে তোরজোর করছিলো। এই দুটো মোটামুটি একই রকম দেশ হলেও স্বাস্থ্য সেবার ফলাফলে এদের মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে।
আরও কৌতূহলোদ্দীপক একটি ঘটনা আছে ইংল্যান্ডে। জ্যাকবিন-এর সর্বশেষ ইস্যুতে একটি চমৎকার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য সেবার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। এটি ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিলো চল্লিশের দশকে বেভানের আমলে। তখন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য সেবা ছিলো তাদের — এখনো আছে বোধহয়, এবং তখন তো অবশ্যই ছিলো। ওয়েলসের নয়জন খনি শ্রমিকদের নিয়ে এটি শুরু হয়েছিলো যারা স্বল্প পরিসরে তাদের নিজস্ব সমবায়মূলক স্বাস্থ্য সেবা গড়ে তুলেছিলো। অ্যানিউরিন বেভান ছিলেন একজন ওয়েলশ খনি শ্রমিক। লেবার পার্টি একটি কর্মসূচি হিসেবে সমবায়মূলক সিস্টেমটি বাছাই করেছিলো এবং লেবার পার্টি ১৯৪৫ সালে আদতেই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলো, আর বেভান এটাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস পেয়ে গেলো।
আচ্ছা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে দু’টো সংকটপূর্ণ বিষয় আছে। তা হচ্ছে এর ইউনিয়নসমূহ। এ কারণেই আপনাকে ইউনিয়নগুলো ধ্বংস করতে হবে। আপনাকে সংহতি ধ্বংস করতে হবে। একই কারণে পাবলিক স্কুলগুলোর উপর আঘাত, সামাজিক নিরাপত্তার উপর আঘাত আসে। এসব কিছুই এমন একটি ধারণার উপর ভিত্তি করে আছে যে আপনি কোনোভাবে অন্যদের ব্যাপারে ভাবেন, কমিউনিটি ও আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবেন, এবং এটি সেই সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য যেখানে আপনি সম্পদ ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন। আপনি মানুষকে নিজেদের জন্য সাধ্যমত সম্পদাহরণ ব্যতিরেকে অন্য কোনো কাজ করতে দিতে চান না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তারা খুব দুর্বল হয়ে পড়বে। যখন আপনি একযোগে সংগঠিত হবেন তখনই কেবল আপনি প্রাইভেট পুঁজির মোকাবেলা করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, একটি রাজনৈতিক দল ছিলো। আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি একটি বৈধ ব্যবস্থা হিসেবে সম্ভবত ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস কর্তৃক গৃহীত হতো না। কোনো স্বাধীন পার্টির এই ব্যবস্থায় প্রবেশের কোনো পথ নেই। ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি খুবই ছোট একটি দল হিসেবে শুরু করেছিলো। তবে বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতই যেহেতু সেখানকার সিস্টেম ছোট দলগুলোকে অনুমোদন করে, তাই তারা পার্লামেন্টে বিকশিত হয়েছে ও কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সরকারকে পেয়েছে এবং অবশেষে একটি বড় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অসম্ভব। আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্যালটের দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন এতে আছে ডেমোক্রেট, রিপাবলিকান, অন্যান্য। কেউ একে ভাঙতে পারে না। এটি একটি রাজনৈতিক মনোপলি। এখানে দু’টোর কোনোটিই সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দল নয়। আপনি সত্যিকার অর্থে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হতে পারবেন না, আপনি এর কার্যক্রম পরিকল্পনার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আপনি লেবার পার্টির একজন সদস্য হতে পারবেন। এগুলো বড় ধরনের পার্থক্য, তাই আমি মনে করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’টো বিরাট সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঘাটতিসমূহ, যেটা টম ফার্গুসন ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণার মতো ব্যাপারগুলোয় উঠে এসেছে — আপনি জানেন, কুক্ষিগত সম্পদের সাংঘাতিক ক্ষমতা নির্বাচনের ফলাফল ও পরবর্তীতে নীতিমালাকে নির্ধারণ করে। এটা হলো একটা, আর অন্যটা হলো শ্রমিক আন্দোলনের বিনাশ।
পাবলিক স্কুলগুলোর উপর আঘাত নিয়ে আলোচনা করা যাক। গর্ডন লেফার তাঁর দ্য ওয়ান পারসেন্ট সলিউশন বইতে এ বিষয়ে রূপরেখা দিয়েছেন।
নোয়াম চমস্কিঃ হ্যাঁ, খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বই।
লিন প্যারামোরঃ অনলাইন শিক্ষা দিয়ে শিক্ষকদের প্রতিস্থাপিত করতে, ক্লাসগুলোর আকার বাড়াতে, বেসরকারি অর্থায়নে পরিচালিত চার্টার স্কুল দিয়ে পাবলিক স্কুলগুলোকে প্রতিস্থাপিত করতে এবং আরও অনেক কিছুর আইন পাশ করানোর জন্য এবং পাবলিক শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য এএলইসি ও অন্যান্য কর্পোরেট-সমর্থিত গ্রুপসমূহের প্রচেষ্টা সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। আপনি গণশিক্ষার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছেন। আমেরিকার স্কুলগুলোতে এই কর্পোরেট এজেন্ডাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
নোয়াম চমস্কিঃ আপনি জানেন সর্বজনীন গণশিক্ষা, তার সকল ত্রুটিসহ, আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রকৃত অবদানগুলোর একটি। ল্যান্ড গ্র্যান্ট কলেজসহ কলেজ পর্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করলে এটা সব দিক থেকে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ মাত্রই এর সাথে তাল মেলাতে শুরু করে। এখানে এটি ১৯ শতকের শেষ দিকে আরম্ভ হচ্ছিলো। সমগ্র সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এখন একটি সত্যিকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চলছে। এএলইসি ও কচ ভ্রাতৃদ্বয় সম্প্রতি অ্যারিজোনাকে একটি টেস্ট কেস ধরে মাত্রই একটি প্রচারাভিযান ঘোষণা করেছে। তারা অ্যারিজোনাকে একটি সহজ পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছে কারণ সম্ভবত শিক্ষা খাতে এখানকার মাথাপিছু ব্যয় সবচেয়ে কম এবং এখানকার আইন সভা খুবই ডানপন্থী। তারা যেটা করার চেষ্টা করছে — তারা এটা সরাসরি বলে থাকে — যে তারা আবশ্যিকভাবে সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়, সবগুলোকে ভাউচার ও চার্টার স্কুলে পরিণত করতে চায়। এটা হবে একটা আগ্রহোদ্দীপক লড়াই, আর এটা যদি অ্যারিজোনায় কাজ করে তাহলে তারা অন্যত্র এটি করতে চাইবে।
এটি একটি বিরাট কর্পোরেট আগ্রাসন। এর সাথে ইউনিয়নের উপর আঘাতের অনেক মিল। প্রথমে ফ্রেডরিখরা [ফ্রেডরিখস্ বনাম ক্যালিফোর্নিয়া টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, যেখানে দর কষাকষি ও অন্যান্য কার্যক্রমের খরচ বহন করার ক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরের ইউনিয়নগুলো যেসব শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের কাছ থেকে, এমনকি যারা ইউনিয়নগুলোতে যোগদান করেনি, তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার অধিকারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ দোদুল্যমান ছিলেন], এখন আছে জেনাস মামলা, এবং সম্ভবত তারা সফল হবে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নিরুৎসাহিত করতে যে আইন পাশ করা হয় তা অন্যান্য দেশে স্রেফ অগ্রহণযোগ্য। বস্তুত, নাফটা নিয়ে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে কানাডা প্রস্তাব করে যে, একটি পর্যালোচনার অংশ হওয়া উচিত শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নিরুৎসাহিত করতে যে আইন পাশ করা হয় সেই আইনের মতো শ্রম অধিকারসমূহের ক্ষতিসাধনকারী কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা। যে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নে ও ধর্মঘটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ধর্মঘটকারী শ্রমিকের জায়গা দখল করে নেয়, তাকে দিয়ে কাজ চালানোর মতো ব্যাপার এটি। মানুষ এটা সম্বন্ধে কিছুই শোনেনি। কিন্তু রিগ্যান এখানে এটি চালু করেছেন — আমার মনে হয় শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকা এটি অনুমোদন করেছে। কার্যত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রথম নীতি অর্থাৎ সংগঠনের অধিকারকে অনুসমর্থন করেনি। সত্যি কথা বলতে আমি মনে করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গীহীন হতেই হবে। এটি খুবই ব্যবসা-চালিত একটি সমাজ।
লিন প্যারামোরঃ কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গির যে শিক্ষা দেশে জায়গা করে নিচ্ছে সেখানে ছাত্রদের এখন কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে? তাদের কী ধরনের ভবিষ্যৎ থাকবে? আর গণতন্ত্রের ধারণার সাথে এর কাজ কী?
নোয়াম চমস্কিঃ ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং তারা হবে শৃঙ্খলাবদ্ধ। এই শিক্ষা কোনো মিথষ্ক্রিয়ার জন্য, সৃষ্টিশীল কার্যকলাপের জন্য, শিক্ষকদের নিজেদের কিছু করার জন্য, ছাত্রদের কিছু করার একটি উপায় বের করার জন্য কোনো সুযোগ রাখেনি। আমি শিক্ষকদের গ্রুপগুলোর সাথে কথা বলেছি। আমার মনে পড়ে একবার আমি বক্তৃতা দিচ্ছিলাম এবং ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষক আমার কাছে এসে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন একটি ক্লাসের শেষে একটি ছোট্ট মেয়ে এগিয়ে এসে বলেছিলো যে, সে কিছু একটাতে আগ্রহ বোধ করে এবং জানতে চেয়েছিলো কীভাবে সে ওটা নিয়ে কাজ করতে পারে। আর শিক্ষক তাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তুমি এটা করতে পারো না। তোমাকে এমসিএএস-এর জন্য পড়াশোনা করতে হবে, যেটা হচ্ছে নিয়মিত পরীক্ষার ম্যাসাচুসেটস সংস্করণ [ম্যাসাচুসেটস কমপ্রিহেনসিভ অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম]। এর উপর সবকিছু নির্ভর করে। এমনকি শিক্ষকের বেতনও এর উপর নির্ভর করে। সুতরাং একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে আপনি সৃষ্টিশীল কিছু করতে পারবেন না। আপনাকে নিয়ম মানতে হবে। এটা মেরিন কর্পস। আপনাকে যা বলা হয় আপনি তাই করেন। অন্য কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা নেই। একটি গভীর স্বেচ্ছাচারী সমাজ সৃষ্টির জন্য এটি একটি নিখুঁত সিস্টেম।
এটি একটি দ্বি-স্তরবিশিষ্ট সিস্টেম। স্যাম বোলস ও হার্ব গিনটিস গোড়ার দিককার গণশিক্ষা নিয়ে লিখতে গিয়ে [ স্কুলিং ইন ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকা গ্রন্থের লেখকদ্বয়] যা আলোচনা করেছিলেন, এটা কিছুটা সেরকম। সাধারণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তাদেরকে ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকে পরিণত করা হয়, কিন্তু এলিট হতে গেলে আপনার সৃষ্টিশীলতা থাকতে হবেঃ এমআইটি, হার্ভার্ড। অর্থনীতির পরবর্তী ধাপ তৈরি করার জন্য মানুষ থাকা চাই।
লিন প্যারামোরঃ বিগত কয়েক বছরে অনেকগুলো প্রতিবাদ আন্দোলন দেখেছি, যেমন অকুপাই, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, এবং #মিটু আন্দোলন। এগুলো উদারপন্থী মিডিয়াতে প্রায়ই বৈরিতা কিংবা বর্জনের সম্মুখীন হয়েছে। #মিটু-র কথাই ধরুনঃ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে করা এই প্রতিবাদটি শ্রেণী প্রশ্নে ও বিভিন্ন দেশজুড়ে সংহতি প্রদর্শন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, লাতিনা খামার কর্মীরা ও ইন্ডিয়ান নারীবাদীরা এর প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। বাধ্যতামূলক সালিশির ধারাসমূহ যেটা শ্রমিকদের অভিযোগসমূহকে আদালতে নিয়ে যেতে দেয় না, সেসব চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোতে দমনমূলক ব্যবস্থাপনার কাছ থেকে শ্রমিকদের দিকে ক্ষমতা স্থানান্তর করতে সহায়তা করছে এই আন্দোলন। তারপরও কয়েকটি উদারপন্থী মিডিয়া #মিটু আন্দোলনকারীদেরকে ম্যাককার্থিপন্থীদের সাথে তুলনা করেছে ও উইচ হান্ট (অজনপ্রিয় ও ভিন্নমত পোষণকারী এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে অভিহিত ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে শায়েস্তা করার প্রচেষ্টা)-এর ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
নোয়াম চমস্কিঃ এটি খুবই যুক্তিযুক্ত প্রতিবাদ এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। অভিযোগসমূহকে এক ধরনের যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কেবল অভিযোগই যথেষ্ট নয়। আমি যত দূর জানি, বামঘেঁষা গ্রুপগুলো যেমন ইপিআই [ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট] বাধ্যতামূলক সালিশ খতম করার পক্ষে, যেটি আরও অনেক অভিযোগকেও প্রভাবিত করে। আমার মতে তারা শ্রম অধিকারের দিকে নজর দিচ্ছে।
লিন প্যারামোরঃ এটা সত্য, তবে মনে হচ্ছে অনেকে বোধহয় #মিটু-কে সত্যিকার অর্থে শ্রম অধিকার সংগ্রামের অংশ হিসেবে মানছে না।
নোয়াম চমস্কিঃ হ্যাঁ। খুব বেশি করে তাই মনে হচ্ছে।
লিন প্যারামোরঃ অর্থনৈতিক অসমতার বৃহত্তর ইস্যু নিয়ে কথা বলা যাক। এ বছর দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে জরিপকৃত সম্পদশালী এলিটরা তাঁদের বৈশ্বিক উদ্বেগের তালিকায় অসমতাকে ৭ নম্বরে স্থান দিয়েছেন। তাঁরা ডেটার গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও অনিচ্ছাকৃত অভিবাসনের মতো অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। আপনি কি মনে করেন যে, তাঁরা এই বিষয়ে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে তাঁরা কিছু ভয়ানক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে গেছেন, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে একজন পুরোদস্তর লোকরঞ্জনবাদীর উপস্থিতি, আর তাই তাঁরা একটু শিথিল হতে পারেন? তাঁদের কি আরও উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
নোয়াম চমস্কিঃ যে বিপদটা তাঁরা উপলব্ধি করেছেন সেটা হয়ত একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, তাই আপনাকে ওটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মেধার বিষয়ে কিছু স্ট্যান্ডার্ড অজুহাত আছে, আপনি বিস্তারিত দেখলে বুঝতে পারবেন এটি একটি কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়। মানে, বিল গেটসের কথাই ধরুন — একজন নিখুঁত প্রশংসনীয় ব্যক্তি, কিন্তু আমি নিশ্চিত তিনি প্রথমেই বলবেন যে তিনি দু’টো জিনিসের উপর ভিত্তি করে ভাগ্য গড়েছেন, প্রথমত কয়েক দশকব্যাপী রাজ্য পর্যায়ের কাজগুলোই প্রযুক্তির সৃষ্টি করেছিলো — সৃষ্টিশীল, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যা পঞ্চাশের দশক থেকে চলে আসছে। তিনি এটি বেছে নিয়েছেন এবং বাজারজাত করেছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, যা তাঁকে একচেটিয়া মূল্য নির্ধারণ করার অধিকার দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা বেশ তবে…
লিন প্যারামোরঃ অনেকটা হোরাশিও অ্যালজারের মিথের বিপক্ষে চলে যায় [একটি বিশ্বাস যে কঠোর পরিশ্রম করে যে কেউ ধনী হতে পারে]।
নোয়াম চমস্কিঃ হ্যাঁ।
লিন প্যারামোরঃ অবশেষে, আপনি যখন সামনের দিকে তাকান, কোনটিকে ভবিষ্যতে মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন? কোন বিষয়টি নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
নোয়াম চমস্কিঃ জলবায়ু পরিবর্তন ও পারমাণবিক যুদ্ধ। এগুলো সত্যিই অস্তিত্ববাদী হুমকি। আর এখন যা ঘটছে তা খুবই আশ্চর্যজনক। মিডিয়া যদি গুরুত্বসহকারে সক্রিয় থাকতো তাহলে এই বিস্ময়কর তথ্যই হতো প্রতিদিনের শিরোনাম — সেটা হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে প্রত্যেকটি দেশ অন্তত কিছু করার জন্য চেষ্টা করছে কিংবা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একটি দেশ — একটি! — ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ — জলবায়ুকে ধ্বংস করার চেষ্টায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। তারা শুধু অন্যদের প্রচেষ্টা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারই করছে না, বরং সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়াগুলোকেও চরমে পৌঁছে দিচ্ছে।
ইতিহাসে এর আগে এমন কোনো কিছুই ছিলো না। এটি কিছুটা সাংঘাতিক বাক্য, তবে এটা সত্য যে মানব জাতির ইতিহাসে রিপাবলিকান পার্টি হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক সংগঠন। কেউই, এমনকি নাৎসীরাও সংঘবদ্ধ মানব জীবনের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার জন্য নিবেদিত ছিলো না। এ বিষয়টি মিডিয়া থেকে একেবারেই গায়েব। আদতে আপনি যদি যুক্তিসঙ্গত ব্যবসার সংবাদ পড়েন, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, বিজনেসউইক, এগুলোর যে কোনো একটা পড়েন, যখন এরা জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে আলোচনা করে তখন নিবন্ধগুলো কেবল মুনাফার সম্ভাব্যতা নিয়েই লেখা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এক নম্বরে চলে যাচ্ছে আর এতে লাভটা কী? এটি যে সংঘবদ্ধ মানব জীবনকে সমূলে উৎপাটিত করতে উদ্যত হয়েছে সেটা কোথাও লেখা নেই। হয়ত কোথাও এটি কেবলই একটি পাদটীকা। এটি আসলেই আশ্চর্যজনক।