শক্তিমান বর্তমান, প্রথম অধ্যায়

|| লেখক পরিচিতি || অনুবাদকদের কথা || শক্তিমান বর্তমানের ভূমিকা || সংগ্রহ করুন ||

 অধ্যায় ০১
তুমি কিন্তু তোমার মন নও

 নির্বাণ লাভের পথে সবচেয়ে বড় বাধা

‘নির্বাণ লাভ’ করা অর্থ কী?

ত্রিশ বছর ধরে এক ভিখারী একই রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করতো। একদিন সেই রাস্তার পাশ দিয়ে এক আগন্তুক হেঁটে যাচ্ছিলো। ভিখারীটি যন্ত্রের মত তার বেসবল টুপিটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কিছু খুচরা পয়সা হবে?”

আগন্তকটি বললো, ” তোমাকে দেবার মত আমার কাছে কিছুই নেই। কিন্তু তুমি বসে আছো কিসের ওপর?”

“ও কিছু না,” ভিখারীটি জবাব দেয়, “স্রেফ একটা পুরনো বাক্স। জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি এটার ওপর বসে ভিক্ষা করছি।”

“কখনো ভিতরে তাকিয়ে দেখেছো?”

“নাহ। তাকিয়েই বা কী লাভ? কিছুই নেই এই বাক্সে।”

“একবার ভিতরে তাকিয়েই দেখো না!” আগন্তুকটি বেশ জোর দিয়ে বললো।

ভিখারীটি একটু অনিচ্ছার সাথে বাক্সের ঢাকনা খুললো। তারপর সে অপার বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলো, বাক্সভর্তি ঝলমল করছে সোনা।

আমি সেই আগন্তুকের মতই, যার নতুন করে তোমাকে দেবার মত কিছুই নেই, আমি তোমাকে শুধু বলবো ভেতরে তাকাতে। তবে গল্পের মত কোনো বাক্সের ভেতরে নয়, বরং এর চেয়ে আরও অনেক কাছের এক জায়গায়—তোমার নিজের ভেতরে।

আমি জানি তুমি এখন বলছো, “কিন্তু আমি তো গল্পের সেই ভিখারী নই।”

যারা তাদের সত্যিকারের ঐশ্বর্য খুঁজে পায়নি, খুঁজে পায়নি অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া সেই তীব্র আনন্দ, আর এর সঙ্গী হয়ে আসা সেই স্থায়ী গভীর প্রশান্তি, তারা গল্পের সেই ভিখারীর মতই, যদি তাদের অগাধ ঐশ্বর্য থাকে তবুও। তারা সামান্য ছিটেফোঁটা আনন্দ-ভালবাসা আর নিরাপত্তা বাইরের পৃথিবীতে খুঁজে বেড়ায়। অথচ তাদের নিজেদের ভেতরেই রয়েছে এমন এক ঐশ্বর্য, যার মাঝে এসব কিছু তো আছেই, তার সাথে আছে এমন কিছু যা এই পৃথিবীর পক্ষে তাদেরকে দেয়া সম্ভব নয়।

‘নির্বাণ’ শব্দটা শুনলেই মনে হয় অতিমানবীয় কিছু, আর মানুষের অহং (ego) একে এভাবে দেখাতেই পছন্দ করে। কিন্তু এটা শুধুই তোমার নিজের অস্তিত্বের সাথে একাত্মতার অনুভূতি। এটা সীমাহীন এক অনন্ত সত্তার সাথে তোমার একাত্মতা; যা একই সাথে তুমি, তবুও তোমার চেয়ে অনেক বড় কিছু। এরকম ধাঁচের কথা শুনলে অনেকটা ধাঁধার মতই মনে হতে পারে। সব নাম আর আকারের ঊর্ধ্বে, এটা তোমার প্রকৃত সত্তা। এর সাথে একাত্মতা অনুভব করার অক্ষমতা থেকেই জন্ম নেয়, নিজের আর চারপাশের পৃথিবীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি। জেনে বা না জেনেই তুমি তখন নিজেকে বিছিন্ন এক সত্তা মনে করতে থাকো। জন্ম নেয় ভয়। ভেতরে বাইরে সবখানে ভয় আর নিরন্তর যুদ্ধই হয়ে পড়ে প্রতিদিনের গল্প।

“সকল দুঃখ কষ্টের সমাপ্তি”, নির্বাণের ব্যাপারে বুদ্ধের দেয়া এই অতি সরল সংজ্ঞাকে আমি পছন্দ করি। লক্ষ্য করে দ্যাখো, এখানে অতিমানবীয় কিছুই নেই। অবশ্য সংজ্ঞা হিসেবে এটি সম্পূর্ণ নয়। এটা শুধু তোমাকে বলছে যে, নির্বাণপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট নেই। কিন্তু কোনো কষ্ট না থাকলে সেখানে আর বাকি থাকে কী? বুদ্ধ এই ব্যাপারে মৌন ছিলেন, আর এই নীরবতার অর্থ হলো – উত্তরটা তোমাকে নিজেই খুঁজে বের করতে হবে। তিনি একটি অসম্পূর্ণ সংজ্ঞা ব্যাবহার করেছেন, যাতে তোমার মন সেটাকে এমন কোনো অতিমানবীয় রূপ দিতে না পারে, যেটা তোমার পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। এই সাবধানতা সত্ত্বেও বুদ্ধের বেশিরভাগ অনুসারী এখনো মনে করে নির্বাণ শুধুমাত্র বুদ্ধের জন্যই, তাদের জন্য নয়। অন্তত এই জীবনে তো নয়ই।

তুমি অস্তিত্ব (Being) শব্দটা ব্যবহার করেছোকিন্তু এটা দিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইছো?

অস্তিত্ব হলো সকল জন্ম মৃত্যুর মাঝে প্রবাহমান একক-অনন্ত-সদা বর্তমান জীবন। অস্তিত্ব শুধু সকল বস্তুর মাঝে প্রবাহমান নয়, বরং সকল বস্তুর মাঝে অন্তর্নিহিত অনন্ত সত্তা। অর্থাৎ, তোমার নিজের প্রকৃত সত্তা হিসেবে তুমি এর মাঝে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু তোমার মন দিয়ে এটা ধরতে অথবা বুঝতে চেষ্টা কোরো না। তোমার মন স্থির থাকলেই কেবল তুমি একে বুঝতে পারবে। যখন তুমি বর্তমানে থাকবে, যখন তোমার মনযোগ তীক্ষ্ণভাবে বর্তমানে থাকবে, তুমি অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারবে। তবে এটা তুমি কখনোই মানসিকভাবে বুঝতে পারবে না। নির্বাণ লাভের মানে হলো, অস্তিত্বের এই চেতনাকে পুনরুদ্ধার করা আর সেই চেতনার মাঝে বাস করা।

অস্তিত্বের কথা বলে তুমি কি ঈশ্বরকে বোঝাতে চাইছো? তাই যদি হয়, তবে সেটা সোজাসাপ্টা বলছো না কেন?

হাজার বছর ধরে অপব্যবহারের ফলে, ‘ঈশ্বর’ শব্দটা হয়ে পড়েছে অন্তঃসারশূন্য। আমি যদিও এটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করি, তবে তা কদাচিৎ। যে মানুষেরা কখনোই এই শব্দের অসীম বিশালতা অনুভব করতে পারেনি, যারা কখনো সেই স্বর্গীয় চেতনার দেখা পায়নি, তারা খুব জোরের সাথে এই শব্দ ব্যবহার করে; যেন তারা সত্যি সত্যি জানে তারা কী নিয়ে কথা বলছে। অথবা তারা এর বিরুদ্ধে তর্ক করে, তারা যেন সত্যি সত্যি জানে তারা কী অস্বীকার করছে। এই অপব্যবহার থেকে জন্ম নেয় ভ্রান্ত বিশ্বাস আর ধারণা, যেমন “আমার বা আমাদের ঈশ্বরই একমাত্র সত্যিকারের ঈশ্বর, তোমার ঈশ্বর মিথ্যা”।  নতুবা নীটশের (Nietzsche) সেই বিখ্যাত উক্তি, “ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে।”

ঈশ্বরের ধারণা হয়ে গেছে এক বন্ধ দরজার মত। যে মুহূর্তে ঈশ্বর শব্দটা উচ্চারণ করা হয়, সাথে সাথে এর একটি মানসিক অবয়ব তোমার মনে ভেসে ওঠে। হয়তো আগের মত সাদা দাঁড়ির এক বুড়ো মানুষের মুখচ্ছবি নয়; তবে এমন কেউ বা এমন কিছু, যার অবস্থান তোমার বাইরে। আর সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই এক পুরুষ বা পুরুষালি কোনো কিছুর প্রতিচ্ছবি।

ঈশ্বর বা অস্তিত্ব বা অন্য কোনো শব্দই আসলে সেই অনন্ত সত্তাকে ধারণ করতে পারেনা। তাই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো—একটা শব্দ যে অর্থ নির্দেশ করছে, সেই অর্থ বোঝার জন্য শব্দটা কি তোমাকে সাহায্য করে? নাকি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? শব্দ কি নিজের অর্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সেই অনন্ত সত্তার দিকে পথ দেখায়? নাকি সেটা শুধুই তোমার মাথায় একটি ধারণা হয়ে থেকে যায়, যা তুমি বিশ্বাস করো? যা কেবলই একটা মানসিক প্রতিচ্ছবি?

অস্তিত্ব বা ঈশ্বর কোনো শব্দই কিছু ব্যাখ্যা করেনা। অবশ্য অস্তিত্ব শব্দটার একটা ভাল দিক আছে। এই শব্দটা অনেক উন্মুক্ত। এটা অদৃশ্য, অসীম সত্তাকে কোনো ক্ষুদ্র ধারণায় সংকুচিত করে ফেলে না। এর কোন মানসিক প্রতিবিম্ব তৈরি করাও অসম্ভব। কেউ দাবি করতে পারে না যে তার কাছে অনেক বেশি অস্তিত্ব আছে। এটা তোমার প্রকৃত সত্তা, যার ভেতরে তুমি এখুনি প্রবেশ করতে পারো, শুধু ‘আমি আছি’ এই উপলব্ধির মাধ্যমে। এটা ‘আমি এই হনু’ অথবা ‘আমি ওই হনু’, এসব ধারণার চেয়ে মৌলিক। তাই ‘অস্তিত্ব’ (Being) শব্দটি থেকে অস্তিত্বের সত্যিকারের অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য, দরকার খুব ছোট্ট একটা পদক্ষেপের।

সত্যর দেখা পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা কী?

তোমার মনের প্রতি আসক্তি, যা তোমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে। অবিরাম চিন্তার প্রবাহ না থামাতে পারাটা এক ভয়াবহ যন্ত্রণার ব্যাপার। কিন্তু আমরা কেউই এই ব্যাপারটা বুঝি না। কারণ, ধরতে গেলে প্রায় সবাই এই যন্ত্রণায় ভোগে, তাই এটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয়। এই অবিশ্রান্ত মানসিক কোলাহল ভেতরের স্থিরতার সাথে আমাদের সম্পর্কে ছিন্ন করে, যে স্থিরতা আমাদের অস্তিত্বের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এছাড়াও এটা এক মিথ্যা মানসিক সত্তা তৈরি করে, যার ছায়া আমাদের জীবনে তৈরি করে ভয় আর যন্ত্রণা। আমরা এই ব্যাপারটা পরবর্তীতে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।

দার্শনিক দেকার্ত (Rene Descartes)-এর ধারণা ছিলো, তিনি তার জীবনের পরম সত্যের সন্ধান পেয়েছেন তার সেই বিখ্যাত উক্তিটির মধ্য দিয়ে, “আমি চিন্তা করি, সূতরাং আমার অস্তিত্ব আছে” (I think, therefore I am)। আসলে তিনি সেই চিরাচরিত ভুলকেই আবার নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেনঃ অস্তিত্বের সাথে চিন্তাকে গুলিয়ে ফেলা আর চিন্তার সাথে নিজের সম্পৃক্ততা। যারা সবসময় চিন্তা করতে বাধ্য, (অর্থাৎ, প্রায় সবাই) তারা বাস করে এক বিচ্ছিন্নতার জগতে। অগণিত সমস্যা আর সংঘাতে লিপ্ত অস্বাভাবিক এবং উন্মাদ এক পৃথিবীতে। এমন এক পৃথিবী যেখানে মানবমন বাস করে এক অসীম বিচ্ছিন্ন সত্তায়। নির্বাণ লাভ করা মানে সত্তার পরিপূর্ণতা পাওয়া, জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া; এবং ফলাফল হিসেবে প্রশান্তি লাভ করা। পৃথিবীর বাস্তব জীবনের সাথে পরিপূর্ণরূপে একাত্ম হওয়ার পাশাপাশি নিজের ভেতরের গহীনের সত্তা আর অস্তিত্বের সাথে এক হওয়া। নির্বাণ লাভ করা মানে শুধু ভেতরের আর বাইরের সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার সমাপ্তিই নয়, অবিরাম চিন্তার দাসত্ব থেকেও মুক্তি। কী অবিশ্বাস্য এক মুক্তি!

মনের প্রতি আসক্তি জিনিসটা একটা নিরেট দেয়াল তৈরি করে – ধারণা, অবয়ব, শব্দ, মূল্যায়ন, এগুলো নির্মাণের মাধ্যমে। আর এই দেয়ালটা সত্যিকারের সব সম্পর্ককে আড়াল করে দেয়। নিজের সাথে, সহকর্মীদের সাথে, প্রকৃতির সাথে, এমনকি ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কের মাঝে এই দেয়াল এসে দাঁড়ায়। এই দেয়াল বিচ্ছিন্নতার এক অলীক ধারণা সৃষ্টি করে। সেখানে আছো তুমি, আর আছে তোমার কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন “অন্যরা”। তুমি তখন সেই পরম সত্য ভুলে যাও যে, বাহ্যিক সব রূপ আর বিচ্ছিন্ন সত্তার অন্তরালেই আসলে তোমার প্রকৃত সত্তা মিশে আছে। ‘ভুলে যাও’ বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে, তুমি সত্যিকার অর্থে তখন আর এই একাত্মতা অনুভব করতে পারো না। তুমি হয়তো সেটা বিশ্বাস করো, তবে অনুভব আর করতে পারো না। বিশ্বাস করাটা হয়তো স্বস্তিদায়ক হতে পারে, তবে শুধু সরাসরি অভিজ্ঞতাই তোমাকে মুক্তি দিতে পারে।

চিন্তা জিনিসটা এক অসুস্থতায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো জিনিসের ভারসাম্য নষ্ট হলে, একটা সময়ে সেটা অসুস্থতার পর্যায়ে চলে যায়। যেমন, কোষ বিভাজন আর দেহের আকার বৃদ্ধির মাঝে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (টিউমার, ক্যান্সার) রোগের সৃষ্টি করে।

সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে কিন্তু মন এক অসাধারণ যন্ত্র। আর ভুল ব্যবহারে তা হয়ে ওঠে অতি ধ্বংসাত্মক। আরেকটু যথাযথভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, তুমি আসলে তোমার মনকে ভুলভাবে ব্যবহার করো না। বরং এটাই তোমাকে ব্যবহার করে। এটা এক ধরনের অসুস্থতা। তুমি বিশ্বাস করো যে তুমিই আসলে তোমার মন। এটাই বিভ্রম। যন্ত্র তোমার কাছ থেকে তোমার নিজের দখল নিয়ে নিয়েছে।

আমি পুরোপুরি একমত হতে পারলাম নাএটা সত্যি যে অন্য সবার মত আমিও অনেক অগোছালো চিন্তাভাবনা করি; কিন্তু আমি আমার মনকে নিজের ইচ্ছামত অনেক কাজে ব্যবহার করতে পারি। এমনটা তো আমি সবসময়ই করি।

তুমি একটা শব্দধাঁধার উত্তর বের করতে পারো, অথবা একটি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারো। তার মানে এই না যে, তুমি তোমার মনকে ব্যবহার করো। কুকুর যেমন হাড্ডি চিবোতে পছন্দ করে, মনও নানা সমস্যার উপর নিজের দাঁত বসাতে পছন্দ করে। এজন্যই মন শব্দধাঁধা সমাধান করে আর পরমাণু বোমা বানায়। এতে আসলে তোমার নিজের কোনো আগ্রহ নেই। তোমাকে একটা প্রশ্ন করিঃ তুমি কি নিজের ইচ্ছেমত মন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারো? তুমি কি সেই “বন্ধ” নামক সুইচটা খুঁজে পেয়েছো?

তুমি বলতে চাইছো যে চিন্তাভাবনা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে? না, আমি সেটা পারি না। হয়তো খুব বেশি হলে দু-এক মুহূর্তের জন্য।

তাহলে তোমার মনই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তুমি নিজের অজান্তেই নিজের মনের প্রতি আসক্ত হয়ে গেছো। তাই, তুমি নিজেও জানো না যে তুমি এর দাস। জানো না যে তুমি আসলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছো। আর তাই, তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রক মনে করছো। তুমি যে নিয়ন্ত্রক নও, এই উপলব্ধিটাই মুক্তির প্রথম শর্ত। এই উপলব্ধির পর তুমি সেই সত্তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। যে মুহূর্ত থেকে তুমি ভেতরের চিন্তককে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করবে, চেতনার একটি উচ্চতর স্তর তোমার মাঝে কাজ করা শুরু করবে। তুমি উপলব্ধি করতে শুরু করবে যে চিন্তার বাইরেও বুদ্ধিমত্তার এক অসীম জগত রয়েছে, চিন্তা বুদ্ধিমত্তার খুবই নগণ্য এক অংশ। তুমি এটাও উপলব্ধি করবে যে, যা কিছু মহান—সৌন্দর্য, প্রেম, সৃজনশীলতা, আনন্দ, অন্তরের প্রশান্তি—সবকিছুর জন্ম হয় মনের চেয়ে গভীরতর কোনো জায়গা থেকে। এবার, তুমি জেগে উঠতে শুরু করবে।

নিজেকে মনের কাছ থেকে মুক্ত করো

চিন্তককে পর্যবেক্ষণ করো এই কথার মাধ্যমে তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছো?

কেউ যদি ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে যে, ‘আমি মাথার ভিতর একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই’, তাহলে এটা ধরে নেয়াই যায় যে তাকে কোনো মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠানো হবে। তবে বাস্তবতা হলো, ঠিক একই ভাবে, বলতে গেলে প্রায় সবাই সবসময় তাদের মাথার ভেতর এক বা একাধিক কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। অবিরত কথা বলতে থাকা একটি কণ্ঠ, অথবা কথোপকথন। এটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চলতে থাকা এক চিন্তাপ্রক্রিয়া, যা তুমি বন্ধ করার ক্ষমতা রাখো। তবে তোমার এই ক্ষমতা সম্পর্কে তুমি অবগত নও।

তুমি সম্ভবত রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবিরত নিজের সাথে কথা বলতে থাকা ‘পাগল’ দেখেছো। অথচ সেটা কিন্তু তুমি যা করো বা বাকি সব ‘সুস্থ’ মানুষ যা করে, তার চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। তফাৎ এই যে, তুমি হয়তো তা উচ্চস্বরে করো না। এই কণ্ঠস্বর মন্তব্য করে, দোষারোপ করে, তুলনা করে, অভিযোগ করে, পছন্দ-অপছন্দ করে – এরকম আরও অনেক কিছু করে। এই কণ্ঠ যে সবসময় তোমার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত হবে, এমনটা নাও হতে পারে। হয়তো সেটা তোমার কোনো নিকট বা দূর অতীতকে খুঁচিয়ে বের করছে, অথবা সম্ভাব্য ভবিষ্যতের চিত্র কল্পনা করছে। সেখানে প্রায়শই ভবিষ্যতের এমন এক সংকটময় চিত্র থাকে, যেখানে কোনো কিছুই ঠিকমত হচ্ছে না। একে বলা হয় দুশ্চিন্তা। কখনো কখনো এই কণ্ঠের সাথে সাথে দৃশ্যমান অবয়ব অথবা ‘মানসিক চলচ্চিত্র’ থাকে।

বর্তমান অবস্থার সাথে যদি এই কণ্ঠস্বরটা কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েও থাকে, তবুও সেটা সবসময়ই বর্তমানকে বিচার করবে অতীতের নিরিখে। কারণটা হলো, এই কণ্ঠস্বর জন্ম নেয় তোমার অভ্যস্ত মন থেকে, তোমার অতীত ইতিহাস এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সামগ্রিক সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই বর্তমানকে তুমি সবসময় অতীতের চোখ দিয়ে বিচার করো, এবং এর একটা পুরোপুরি বিকৃত চিত্র দেখতে পাও। এরকম ঘটনা বিরল নয় যখন এই কণ্ঠই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে। অনেক মানুষ তাদের মাথায় এই যন্ত্রণাদায়ী নিপীড়ক নিয়ে বাস করে, যা তাদের উঠতে বসতে শাস্তি দেয়; দিতে দিতে তাদের সব শক্তি শুষে নিঃশেষিত করে ফেলে। এটাই অগণিত রোগ, যন্ত্রণা, আর দুঃখের কারণ।

তবে সুখবর হলো, তুমি তোমার মন থেকে মুক্ত হতে পারো। সত্যিকারের স্বাধীনতা শুধু এই উপায়েই সম্ভব। আর এটা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ তুমি ঠিক এই মুহূর্তেই নিতে পারো। যখনই সম্ভব হয়, তোমার মাথার ভেতরের কণ্ঠস্বরটিকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করো। পুরনো গ্রামোফোনের মত যে চিন্তাগুলো তোমার মাথায় বছরের পর বছর ধরে বেজেই চলেছে, সেগুলোর প্রতি বিশেষ মনযোগ দাও। ‘চিন্তককে পর্যবেক্ষণ করো’- বলতে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি। এটাকে একটু ঘুরিয়ে এভাবেও বলা যায় – যখন তোমার মাথার ভেতরের কণ্ঠস্বরটি শুনছো, একজন পর্যবেক্ষণকারী বা দর্শক হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকো।

যখন তুমি সেই কণ্ঠস্বরটি শুনবে, নিরপেক্ষতা বজায় রাখো। অর্থাৎ, দাঁড়িপাল্লা হাতে একে বিচার করতে বসে যেও না। যা শুনছো, তাকে দোষারোপ কোরো না। কারণ এরকম করলে সেই একই কণ্ঠ আবার পিছনের দরজা দিয়ে  ঢুকে পড়বে। খুব তাড়াতাড়িই তুমি বুঝবে – এই সেই কণ্ঠস্বর, আর এই তো আমি এটাকে শুনছি, পর্যবেক্ষণ করছি। এই যে আমিত্বের অনুভূতি, এই যে তোমার এই উপস্থিত থাকার অনুভূতি, এটা কোনো চিন্তা নয়। এর জন্ম মনের চেয়েও গভীর কোনো স্থানে।

যখন তুমি একটা চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করছো, তখন শুধু সেই চিন্তা সম্পর্কেই নয়, এর পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে তুমি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেও সচেতন। তোমার মাঝে চেতনার একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। যখন তুমি চিন্তাগুলোকে অবলোকন করছো, এই সব চিন্তার স্রোতের আড়ালে তুমি তোমার গভীরতর সত্তার উপস্থিতি অনুভব করবে। এতে তোমার উপর চিন্তার ক্ষমতা কমে আসবে এবং চিন্তাগুলো তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যাবে। কারণ তুমি তখন আর তোমার মনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তোমার চিন্তাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছো না। এখান থেকেই তোমার অনিচ্ছাকৃত এবং বাধ্যতামূলক চিন্তাগুলোর সমাপ্তির সূচনা।

একটি চিন্তা মিলিয়ে যাওয়ার পর, তুমি অবিরত চলতে থাকা মানসিক চিন্তাস্রোতে একটি বিরতি অনুভব করবে – মনশূন্য বিরতি। শুরুতে এই বিরতিগুলো হবে সংক্ষিপ্ত, হয়তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তবে পর্যায়ক্রমে তাদের সময়কাল বাড়বে। এই বিরতিগুলোর সময় তুমি তোমার ভিতরে কিছু মাত্রায় স্থিরতা এবং প্রশান্তি অনুভব করবে। এটা হল তোমার অস্তিত্বের সাথে তোমার স্বাভাবিক একাত্মতা বোধের সূচনা, যেটা এমনিতে তোমার মনের প্রতিবন্ধকতার কারণে আড়াল হয়ে থাকে। অনুশীলনের সাথে সাথে তোমার এই স্থিরতা আর প্রশান্তির গভীরতা বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে, এই গভীরতার কোন শেষ নেই। তুমি তোমার ভেতরের গভীর থেকে এক সূক্ষ্ম আনন্দের বিকিরণ অনুভব করবে – অস্তিত্বের আনন্দ।

এটা কোন নেশাগ্রস্ত অবস্থা নয়; একেবারেই না। এখানে চেতনা বিন্দুমাত্র লোপ পায় না। বরং উল্টোটাই সত্যি। যদি প্রশান্তি অনুভবের জন্য আমাদের চেতনার মাত্রাকে কমাতে হতো, আর স্থিরতার মূল্য আমাদের চেতনা আর প্রাণবন্ততা বিকিয়ে দিয়ে পরিশোধ করতে হতো, তাহলে সেই অবস্থা আমাদের মোটেই কাম্য হতো না। নিজের মনের সাথে সম্পৃক্ত অবস্থার চেয়ে তুমি এখন অনেক বেশি সজাগ আর অনেক বেশি সচেতন থাকবে। তুমি পুরোপুরি বর্তমানে থাকবে।

যদি তুমি এই ‘মনশূন্য’ পৃথিবীতে আরো গভীরভাবে প্রবেশ করো, প্রাচ্য দর্শন অনুসারে তুমি ‘বিশুদ্ধ চেতনা’কে উপলব্ধি করতে পারবে। এরকম অবস্থায় তুমি নিজের উপস্থিতি এতো তীব্র আনন্দের সাথে অনুভব করবে যে, সেই তুলনায় তোমার চিন্তা, আবেগ, শরীর, এবং সমস্ত বাহ্যিক পৃথিবীকে নগণ্য মনে হবে। কিন্তু তবুও এটা কোনো স্বার্থপর অবস্থা নয়, বরং নিঃস্বার্থ অবস্থা। এটা তোমাকে তোমার আগের সেই ‘আমিত্ব’র ভাবনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। তোমার এই উপস্থিতি (presence) যুগপৎ তুমি এবং তোমার চেয়েও অকল্পনীয় গুণে বড় কিছু। যা বোঝাতে চাচ্ছি, সেটা শুনতে ধাঁধার মত, এমনকি অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো ভাষায় এটা প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।

‘চিন্তককে পর্যবেক্ষণ করা’র পরিবর্তে, তুমি সরাসরি বর্তমানের ভেতরে মনযোগ আবদ্ধ করে তোমার মনের স্রোতের মাঝে বিরতি সৃষ্টি করতে পারো। কেবলমাত্র ‘এই’ মুহূর্তটির মাঝে তীব্রভাবে মনযোগ দাও। কাজটা কিন্তু বেশ সন্তুষ্টিদায়ক! এভাবে, মনের কাছ থেকে চেতনাকে মুক্ত করে মনের মাঝে বিরতি সৃষ্টি করতে পারবে, যেখানে তুমি তীব্রভাবে সজাগ কিন্তু চিন্তাহীন থাকবে। এটাই ধ্যানের মূল নির্যাস।

তুমি তোমার প্রাত্যহিক জীবনে এটা অনুশীলন করতে পারো। ছকে বাঁধা যে কাজগুলো তুমি সাধারণত শেষ করার উদ্দেশ্যেই করে থাকো, তাতে তোমার পরিপূর্ণ মনযোগ দাও, যাতে এই কাজের মাঝেই কাজের পরিসমাপ্তি ঘটে। যেমন ধরো, প্রতিবার যখন তোমার বাড়ি বা কর্মস্থলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠো, প্রতিটা পদক্ষেপ, নড়াচড়া, এমনকি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দিকেও তীব্রভাবে মনযোগ দাও। পুরোপুরি বর্তমানে বাস করো। অথবা তুমি যখন হাত ধোও, এর সাথে সম্পৃক্ত সকল ইন্দ্রিয় অনুভূতির দিকে মনযোগ দাও। পানির শব্দ, তোমার হাতের নাড়াচাড়া, সাবানের ঘ্রাণ, স্পর্শ, এবং এরকম যা কিছু সেখানে আছে সবকিছুর দিকেই মনযোগ দাও। অথবা গাড়িতে ওঠার পর, কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নাও এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি খেয়াল করো। অস্তিত্বের এই নিঃশব্দ অথচ শক্তিশালী উপস্থিতির অনুভূতিকে অনুভব করো। একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে, যা দিয়ে তুমি এই অনুশীলনের সাফল্য পরিমাপ করতে পারবে। আর সেই মাপকাঠি হচ্ছে, তোমার নিজের ভেতর অনুভূত প্রশান্তির পরিমাণ ।

তাই, নির্বাণের অন্বেষণে তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে—মনের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে শেখা। প্রতিবার মনের চিন্তাস্রোতের মাঝে একটা বিরতি সৃষ্টি করার সাথে সাথে তোমার মাঝে চেতনার আলো আরো শক্তিশালী হবে।

হয়তো কোনো একদিন তুমি নিজের মাথার ভেতরের কণ্ঠস্বর শুনে হাসবে, যেভাবে তুমি একটা বাচ্চার খুনসুটি দেখে হাসো। এর মানে হলো, তুমি তোমার মনের কাজকর্মকে আর তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছো না, যেহেতু তোমার আমিত্ববোধের অনুভূতি এখন আর এটার উপর নির্ভরশীল নয়।

নির্বাণঃ চিন্তার ঊর্ধ্বে আরোহণ

পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য চিন্তা করাটা কি অত্যাবশ্যকীয় নয়?

তোমার মন হচ্ছে একটা যন্ত্র। কোনো কাজের জন্য দরকার হলে এটাকে ব্যবহার করবে, এবং কাজ শেষ হলে সরিয়ে রাখবে। আশেপাশে যা দেখি, তাতে আমার ধারণা বেশিরভাগ মানুষেরই শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগ চিন্তা শুধু অনর্থক এবং পুনরাবৃত্তিমূলকই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও বটে। কারণ, বেশির ভাগ চিন্তাই তো অসুস্থ এবং দূষিত। নিজের মনকে যাচাই করে দেখো, তাহলেই এর সত্যতা খুঁজে পাবে। এটা তোমার ভেতরের সতেজ প্রাণবন্ত শক্তিকে নিঃশেষিত করে ফেলে।

এরকম বাধ্যতামূলকভাবে চিন্তা করা আসলে একধরনের আসক্তি। একটা আসক্তিকে কিভাবে চিহ্নিত করা যায়? সহজভাবে বললে ব্যাপারটা এরকমঃ তোমার কাছে আর মনে হয় না যে থামার আর কোনো উপায় আছে। জিনিসটাকে তোমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। এটা তোমাকে একটা সাময়িক উপভোগ্যতার অনুভূতি দেয় ঠিকই, তবে তা সবসময়ই অবধারিতভাবে যন্ত্রণায় পরিণত হয়।

আমরা আবার চিন্তার প্রতি আসক্ত হতে যাবো কেন?

তুমি যেহেতু এর মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে গেছো, তোমার আমিত্ববোধের অনুভূতিও আসে তোমার মন এবং মনের কার্যক্রম থেকেই। তুমি মনে করো যে, চিন্তা করা থামিয়ে দিলেই তোমার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তুমি যখন ছোট থেকে বেড়ে ওঠো, তখন তোমার ব্যক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের উপর ভিত্তি করে  নিজের সম্পর্কে তোমার একটা মানসিক অবয়ব গড়ে ওঠে। এটাকে আমরা বলতে পারি একটা অলীক সত্তা – অহং। মনের কার্যক্রম থেকে এটা জন্ম নেয়, এবং শুধুমাত্র অনবরত চিন্তা করার মাধ্যমেই এটা বেঁচে থাকতে পারে। অহং শব্দটার অর্থ বিভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে আমি এটা ব্যবহার করছি এক মিথ্যা সত্তাকে বোঝাতে, যা কারো অজান্তেই তার নিজের মনের সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়।

বলতে গেলে, অহং-এর কাছে বর্তমানের কোন অস্তিত্বই নেই। অহং শুধু অতীত আর ভবিষ্যতকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সত্যর সাথে এই সরাসরি বিরোধেই বোঝা যায়, কেন অহং-এর নিয়ন্ত্রণে থাকলে মন সবসময় অসুস্থ আচরণ করে। এটা সবসময়ই অতীতকে ফিরিয়ে আনার কাজে ব্যস্ত থাকে, কারণ অতীত ছাড়া তোমার পরিচয় কী? এটা সবসময়  নিজেকে ভবিষ্যতের পর্দায় আরোপিত করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং কোনোভাবে কিছুটা মুক্তি অথবা পূর্ণতা পাবার আশায়। এটা বলে, ”কোনো একদিন যখন এই এই ঘটনা ঘটবে তখন আমি সুখী হবো”। অহং কোনোভাবে বর্তমানের মুখোমুখি হলেও এটা আসলে ঠিক বর্তমানকে দেখে না। অতীতের চোখ দিয়ে পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর এক বর্তমানকে দেখে। অথবা, এটা বর্তমানকে কোনভাবে শেষ করে ফেলতে চায়, যার লক্ষ্য থাকে মনের বানানো মিথ্যা ভবিষ্যতের দিকে। নিজের মনকে পর্যবেক্ষণ করলেই তুমি বুঝতে পারবে এটা কিভাবে কাজ করে।

বর্তমানই মুক্তির চাবি। কিন্তু যতক্ষণ তুমি মনের মাঝে হারিয়ে আছো, ততক্ষণ বর্তমানকে খুঁজে পাবে না।

আমি আমার বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে হারাতে চাই না। আরও মনযোগের সাথে, স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আমি আমার মনকে হারিয়ে ফেলতে চাই না। চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এটা না থাকলে আমরা স্রেফ আরেকটা পশুর মতই হয়ে থাকতাম।

চেতনার বিবর্তনের ইতিহাসে মনের এই আধিপত্য একটা মামুলি পর্যায় ব্যতীত আর কিছু নয়। আমাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে খুব দ্রুতই এর পরের পর্যায়ে যেতে হবে, নচেৎ আমরা আমাদের মনের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাবো, যেটা ক্রমশ এক দানবে পরিণত হয়েছে। আমি এটা নিয়ে পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবো।

চিন্তা আর চেতনা এক জিনিস নয়। চেতনার একটা ক্ষুদ্র অংশ হলো চিন্তা। চেতনা ছাড়া চিন্তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না, তবে চেতনার অস্তিত্বের জন্য চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই।

নির্বাণ লাভের অর্থ হলো, চিন্তার ওপরের স্তরে আরোহণ করা, একটা উদ্ভিদ বা পশুর মত চিন্তার নিচের স্তরে নেমে যাওয়া নয়। নির্বাণপ্রাপ্ত অবস্থায়ও তুমি প্রয়োজনের সময় তোমার চিন্তাশীল মনকে ব্যবহার করবে, তবে আগের চেয়ে অনেক মনযোগের সাথে এবং কার্যকরভাবে। তুমি মূলত কাজের দরকারে চিন্তা করবে, কিন্তু তুমি নিজের ভেতরের অনিচ্ছাকৃত কথোপকথন থেকে মুক্তিলাভ করবে, তোমার মাঝে একটা স্থিরতা থাকবে। যখন তুমি মনকে ব্যবহার করবে (বিশেষ করে কোনো সৃজনশীল সমাধানের প্রয়োজনে) তখন প্রতি অল্প কয়েক মিনিট পর পর চিন্তা আর স্থিরতার মাঝে ওঠানামা করবে, মন আর মনশূন্য অবস্থার মাঝে। ‘না-মন’ হল চিন্তাবিহীন চেতনা। শুধুমাত্র এভাবেই সৃজনশীল চিন্তা করা সম্ভব। কারণ, শুধু এভাবেই চিন্তার সত্যিকারের ক্ষমতা থাকে। চেতনার বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে গেলে চিন্তাগুলো খুব দ্রুত নির্জীব, অপ্রকৃতস্থ, ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়ে।

মন আসলে টিকে থাকার জন্য সহায়ক একটা যন্ত্র। অন্য মনকে আক্রমণ এবং প্রতিরোধ করা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এবং বিশ্লেষণ করা-এ কাজগুলোতে সে খুব দক্ষ। তবে এটা একেবারেই সৃজনশীল নয়। সব সত্যিকারের শিল্পীরা সচেতনভাবে অথবা নিজেদের অজান্তেই ভেতরের স্থিরতা থেকে এক মনশূন্য জগৎ সৃষ্টি করেন।  মন তারপর সেই সৃজনশীলতার তাড়না বা অন্তর্দৃষ্টিকে একটা আকার দেয়। মহান বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে তাদের সমস্যার সৃজনশীল সমাধান এসেছিলো মানসিক নীরবতার সময়ে। দেশব্যাপী এক অনুসন্ধানের বিস্ময়কর ফলাফলে জানা গেছে যে, আইনস্টাইনসহ আমেরিকার সামনের সারির গণিতবিদদের কার্যপ্রক্রিয়াতে, সৃজনশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে চিন্তা জিনিসটার ভূমিকা গৌণ এবং ক্ষুদ্র। তাই, আমি সরল যুক্তিতে বলবো, অধিকাংশ বিজ্ঞানীর সৃজনশীল হতে না পারার কারণ এটা নয় যে তারা চিন্তা করতে পারে না, বরং কারণটা হলো তারা চিন্তা করা থামাতে পারে না!

পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিস্ময়, অর্থাৎ, প্রাণের সৃষ্টি কিন্তু মন অথবা চিন্তাপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়নি। তোমার দেহের সৃষ্টি হওয়া বা টিকে থাকা, কোনোটাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হচ্ছেনা। এখানে স্পষ্টতই মনের চেয়ে অনেক বড় মাত্রার কোনো বুদ্ধিমত্তা কাজ করছে। ১/১০০০ ইঞ্চি সমপরিমাপের মানুষের একটা কোষ কিভাবে তার ডিএনএ এর মাঝে এমন নির্দেশনা বহন করে যার জন্য ১০০ পৃষ্ঠার ১০০০ টা বই লেগে যাবে? দেহের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আমরা যতই জানছি, আমরা তত ভালভাবে বুঝতে পারছি কি সুবিশাল বুদ্ধিমত্তা এখানে কার্যরত আছে! আর আমরা এর সম্পর্কে কত কম জানি। যখন মন এর সাথে আবার পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করবে, এটা এক বিস্ময়কর যন্ত্রে পরিণত হবে। এটা নিজের চেয়ে বড় কিছুর সেবায় নিয়োজিত থাকবে।

আবেগঃ মনের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া

আবেগের ব্যাপারে কী বলবে? মনের চেয়ে আবেগের কাছে আমি বেশি ধরাশায়ী হই

মন, আমি যে অর্থে শব্দটা ব্যবহার করছি, তাতে শুধু চিন্তা বোঝায় না। এটা কিন্তু আবেগের পাশাপাশি তোমার মন এবং আবেগের সাংঘর্ষিক ভূমিকাকেও বোঝায়। দেহ আর মনের সংযোগস্থল থেকেই আবেগের উৎপত্তি হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি আক্রমণাত্মক বা প্রতিকূল চিন্তা শরীরে একরকম শক্তির জন্ম দেয়, যাকে আমরা বলি ক্রোধ। তোমার শরীর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তোমাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, এই চিন্তা তোমার দেহকে সংকুচিত করে। আমরা যেটাকে ভয় বলি, এটা হলো তার শারীরিক প্রতিফলন। গবেষণায় দেখা গেছে যে একটা শক্তিশালী আবেগ এমনকি তোমার দেহের প্রাণরসায়নকেও বদলে দিতে পারে। প্রাণরসায়নের মাঝে এই পরিবর্তন আবেগের শারীরিক বা বস্তুগত স্বরূপকে প্রকাশ করে। স্বাভাবিকভাবেই, সাধারণ অবস্থায় তুমি কী ধরণের চিন্তা করছো সে সম্পর্কে সচেতন থাকো না। তোমার আবেগকে ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমেই তুমি তাদের সম্পর্কে সচেতন হতে পারো।

চিন্তার প্রতি যত তীব্রভাবে আসক্ত হবে, মনের পর্যবেক্ষক হিসেবে যতটা অমনোযোগী হবে, তোমার আবেগের তীক্ষ্ণতা ততই বেশি হবে, তুমি তা সম্পর্কে সচেতন হও বা না হও। যদি নিজের আবেগকে একেবারেই অনুভব করতে না পারো, যদি আবেগের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও; একটা পর্যায়ে তুমি তাদেরকে পুরোপুরি শারীরিক স্তরে অনুভব করবে, কোনো শারীরিক সমস্যা বা অসুস্থতার লক্ষণ হিসেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, তাই আমার আর ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনকি একটা শক্তিশালী অচেতন আবেগ কোন বাহ্যিক ঘটনার মাধ্যমেও নিজের প্রতিফলন ঘটাতে পারে, যা হয়তো বাইরে থেকে স্রেফ আরেকটা সাধারণ ঘটনা মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমি দেখেছি যারা অচেতনে এবং অপ্রকাশ্যভাবে নিজের ভেতর অনেক রাগ পুষে রাখে, তারা শারীরিক বা মৌখিকভাবে অন্য রাগী মানুষদের দ্বারা বেশি আক্রমণের শিকার হয়; মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই। তাদের এই চেপে রাখা রাগ অনেক মানুষের সুপ্ত ক্রোধকে জাগিয়ে দেয়।

তুমি যদি সহজে নিজের আবেগ অনুভব করতে না পারো, নিজের শরীরের ভেতরের শক্তি বলয়ে মনযোগ দিয়ে শুরু করো। ভেতর থেকে শরীরকে অনুভব করো। এটা তোমাকে নিজের আবেগ সম্পর্কে সচেতন করবে। এটা নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

তুমি বলছো যে আবেগ হচ্ছে শরীরের উপর মনের প্রতিফলন। কিন্তু মাঝে মাঝে এই দুইয়ের মাঝে এক দ্বন্দ্ব চলে—মন বলে না‘, অথচ শরীর বলে হ্যাঁ‘, অথবা উল্টোটা।

তুমি যদি সত্যিই নিজের মনকে জানতে চাও, শরীর সবসময়ই তোমাকে সত্যি উত্তরটা দেবে, তাই আবেগকে লক্ষ্য করো। অথবা এটাকে নিজের শরীরে ‘অনুভব’  করো। যদি তোমার মনে হয়, তাদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব আছে , তাহলে চিন্তাটি মিথ্যা হবে, আবেগটিই সত্যি হবে। তোমার আত্মপরিচয়ের পরম সত্য নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে তোমার মনের আপেক্ষিক সত্য।

উপরিভাগের চিন্তা আর অচেতন মানসিক প্রক্রিয়ার মাঝে এই দ্বন্দ্ব খুব সাধারণ ঘটনা। তুমি হয়তো এখনো তোমার অচেতন মনের কার্যপ্রণালীকে সচেতন ‘চিন্তা’ হিসেবে বুঝতে পারছো না, কিন্তু সেটা সবসময়ই তোমার শরীরে একটা আবেগ হিসেবে প্রতিফলিত হবে, যা সম্পর্কে তুমি সচেতন হতে পার। আবেগকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করা আসলে চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করার মতই, যেমনটা আমি আগেই বলেছি। একমাত্র পার্থক্য হলো, চিন্তা থাকে তোমার মাথার ভেতরে, আর আবেগ অনুভূত হয় শরীরে; কারণ, আবেগের অত্যন্ত শক্তিশালী একটা শারীরিক উপাদান আছে। ঐ সময়টাতে আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত না হয়েই, তুমি সেখানে আবেগকে স্থান দিতে পারো। আবেগটি তখন আর ‘তুমি’ নও; তুমি সেখানে দর্শক, পর্যবেক্ষণকারী উপস্থিতি। এভাবে অনুশীলন করলে, তোমার মাঝে যা কিছু অচেতন, তার সবকিছু চেতনার আলোয় প্রকাশিত হবে।

তাহলে আবেগকে পর্যবেক্ষণ করা কি চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করার মতই জরুরি?

হ্যাঁ। এই প্রশ্নটা করা অভ্যাস করো যে, ‘এই মুহূর্তে আমার ভেতরে ঠিক কী চলছে?’। এই প্রশ্নটিই তোমাকে সঠিক নির্দেশনা দেবে। তবে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করতে যেও না, শুধু দেখো। তোমার ভেতরে মনযোগ দাও। আবেগের তীব্রতা অনুভব করো। যদি সেখানে কোন আবেগ উপস্থিত না থাকে, তোমার দেহের ভেতরের শক্তিবলয়ে গভীরে মনযোগ দাও। এটা হলো অস্তিত্বের মাঝে প্রবেশের দরজা।

আবেগ সাধারণত চিন্তার ছাঁচেরই এক বিবর্ধিত এবং শক্তিশালী রুপ।  এটার শক্তি এতো বেশি থাকে যে, প্রথম দিকে এটাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য জায়গামত উপস্থিত থাকাটা সহজ হয় না। এটা তোমার দখল নিতে চায়, এবং সাধারণত সফলও হয় – যদি না তোমার মাঝে যথেষ্ট সচেতন উপস্থিতি (presence) থাকে। সাধারণত, সচেতন উপস্থিতির অভাবে তুমি নিজের অজান্তেই চিন্তার প্রতি আসক্ত হয়ে যাও, তখন সাময়িকভাবে সেই আবেগটা হয়ে যায় ‘তুমি’। চিন্তা আর আবেগের মাঝে প্রায় সবসময়ই একটা অশুভ দুষ্ট চক্র গড়ে ওঠেঃ তারা একজন আরেকজনকে শক্তি যোগান দেয়। চিন্তাপ্রক্রিয়া তার নিজের এক বিবর্ধিত রূপের জন্ম দেয়ার মাধ্যমে আবেগের আকার ধারণ করে, আর আবেগের তীক্ষ্ণতা মূল চিন্তাপ্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখে। পরিবেশ, ঘটনা বা ব্যক্তি হচ্ছে আবেগের মূল উৎস। এগুলোকে খোঁচাখুঁচি করে চিন্তা জিনিসটা আবেগকে তীব্র করে রাখে, আর আবেগ চিন্তাকে শক্তি যোগায় । এভাবেই চলতে থাকে।

আসলে সব আবেগই এক আদিম অভিন্ন আবেগের ভিন্নরূপ। তোমার প্রকৃত পরিচয়, যা সব নাম আর আকারের ঊর্ধ্বে, সে সম্পর্কে বিস্মৃত হবার ফলে এর জন্ম হয়। এর অনন্য রূপের কারণে, এমন কোনো নাম খুঁজে পাওয়া কষ্টকর যা এই আবগকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। ‘ভয়’ অনেকটা কাছাকাছি আসে। তবে সবসময় একরকম হুমকির অনুভূতি ছাড়াও এই আবেগের মাঝে এক গভীর বিচ্ছিন্নতা আর অসম্পূর্ণতার অনুভূতি থাকে। হয়তো এজন্য এই মৌলিক আবেগের মতই কোন অনুপম নাম দিয়ে একে বলা যেতে পারে দুঃখ (pain)। মনের প্রধান কাজগুলোর একটা হল এই আবেগীয় দুঃখের সাথে যুদ্ধ করা, অথবা একে সরানোর চেষ্টা করা। মন সবসময়ই এই কাজে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, বেশিক্ষণের জন্য সে আবেগকে ধামাচাপা দিতে পারে না। ঘটনা হলো, মন যত তীব্রভাবে দুঃখকে এড়ানোর চেষ্টা করে, দুঃখের মাত্রা ততই বেশি হয়। মন কখনোই এর কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। এটা তোমাকেও কোনো সমাধান খুঁজে পেতে দেয় না, কারণ এটা নিজেই ‘সমস্যার’ একটা অংশ। কল্পনা করে দেখো, এক পুলিশবাহিনীর প্রধান একজন অপরাধীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, যখন সেই পুলিশপ্রধান নিজেই আসলে অপরাধী। তুমি নিজের মনের সাথে, অর্থাৎ অহং এর সাথে নিজের সম্পৃক্ততা ছিন্ন না করলে কখনো দুঃখের কাছ থেকে মুক্তি পাবে না। মন তখন নিজের ক্ষমতার আসন থেকে চিৎপটাং হয়ে পড়বে, আর অস্তিত্ব নিজের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত করবে।

হ্যাঁ, আমি জানি তুমি এখন কী জিজ্ঞেস করবে।

আমি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলামঃ ভালবাসা আর আনন্দের মত সুন্দর আবেগের বেলায় কী হবে?

অস্তিত্বের সাথে তোমার একাত্মতার অপরিহার্য অঙ্গ ওগুলো। যখন চিন্তার স্রোতের মাঝে একটা বিরতি ঘটে, কয়েক পলকের জন্য আনন্দ-ভালবাসা, অথবা অল্প কিছুটা সময়ের জন্য গভীর প্রশান্তি অনুভব করা সম্ভব। বেশিরভাগ মানুষের জন্য এই বিরতিগুলো ঘটে দৈবাৎ, এবং দুর্ঘটনাবশত, যে মুহূর্তগুলোয় মন ”বাকশক্তিহীন” হয়ে যায়। অপার সৌন্দর্য, চরম মাত্রার শারীরিক পরিশ্রম, এমনকি ভয়ংকর বিপদের মুখেও এরকম হয়। হঠাৎই সেখানে ভেতরের স্থিরতা খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেই স্থিরতার মাঝে প্রচ্ছন্ন কিন্তু তীব্র এক আনন্দ থাকে; ভালবাসা থাকে, প্রশান্তি থাকে।

সাধারণত এই মুহূর্তগুলো ক্ষণস্থায়ী হয়, যেহেতু মন খুব তাড়াতাড়ি তার কোলাহল তৈরি করার কাজ শুরু করে, যাকে আমরা বলি চিন্তা করা। ভালবাসা, আনন্দ, প্রশান্তি বিকশিত হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মনের শাসন থেকে নিজেকে মুক্ত না করছো। কিন্তু তাদেরকে আমি আবেগ বলছি না। তারা আবেগের চেয়ে গভীর কোনো স্থানে থাকে। তাই আবেগের গভীরে যা আছে, তাকে অনুভব করার জন্য তোমাকে আগে নিজের আবেগ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন হতে হবে, তারপর তাদেরকে অনুভব করতে হবে। আবেগ আক্ষরিক অর্থেই বোঝায় জ্বালাতন (Disturbance). আবেগ (emotion) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন emovere থেকে, যার মানে ‘জ্বালাতন করা’।

ভালবাসা, আনন্দ, এবং প্রশান্তি হল অস্তিত্বের গভীরতম অবস্থা, অথবা অস্তিত্বের সাথে তোমার একাত্মতার তিনটি রূপ। সেজন্য, তাদের বিপরীত কিছু নেই। এর কারণ হলো, তারা মনের চেয়ে গভীরতর স্থান থেকে আসে। পক্ষান্তরে, আবেগ যেহেতু মনের দ্বৈততার নিয়মের অধীন, তাদের বিপরীত আছে। এর সরল অর্থ হলো, তুমি খারাপ বাদ দিয়ে শুধু ভালোকে বেছে নিতে পারবে না। তাই মনের প্রতি আসক্ত থাকার সময়ে যাকে মাঝেমধ্যে ভুলবশত আনন্দ বলা হয়, তা আসলে অবিরত ঘুরতে থাকা সুখ/দুঃখ মুদ্রার একপিঠ মাত্র। সম্ভোগ (Pleasure) সবসময়ই তোমার বাইরের পৃথিবীর কোনো কিছু থেকে পেতে হয়, আনন্দ (Joy) আসে তোমার ভেতর থেকে। যা তোমাকে আজকে সম্ভোগের সুখ দিচ্ছে, আগামীকালই তা তোমাকে বেদনা দেবে। অথবা তোমাকে ত্যাগ করবে, যার অনুপস্থিতি তোমাকে কষ্ট দেবে। যেটাকে সাধারণত প্রেম বলা হয়ে থাকে, তা কিছু সময়ের জন্য সুখকর আর উত্তেজনাময় মনে হতে পারে। তবে এটা এক আসক্তিকর নেশার মত, এক ক্ষুধার্ত অবস্থা, যা চোখের পলকেই আবার রংবদল করতে পারে। অনেক ”প্রেমের” সম্পর্ক তাই প্রাথমিক ঘোর কেটে গেলে বারবার ”ভালবাসা” আর ”ঘৃণা”, আকর্ষণ, আর আক্রমণের মাঝে রংবদল করে।

সত্যিকারের ভালবাসা তোমাকে কষ্ট দেয় না। কিভাবে দেবে, বলো? এটা যেমন হঠাৎই ঘৃণায় পরিণত হয় না, সত্যিকারের আনন্দও কখনো কষ্টে পরিণত হয় না। আমি যেমনটা বলেছি – তুমি নির্বাণ লাভ করে নিজেকে মনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার আগেই ক্ষণিকের জন্য সত্যিকারের আনন্দ, সত্যিকারের প্রেমের, ভেতরের স্বর্গীয় প্রশান্তির দেখা পেতে পারো, যা স্থির কিন্তু একেবারে জীবন্ত। এটা তোমার সত্যিকারের সত্তার চেহারা, যা সাধারণত তোমার মনের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে। এমনকি একটা ”সাধারণ” আসক্তিকর সম্পর্কেও এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যখন আরও পবিত্র, অনন্ত কোন কিছুকে অনুভব করা যায়। তবে তারা ক্ষণিকের আভাসমাত্র, যা খুব তাড়াতাড়িই আবার মনের আড়ালে ঢাকা পড়বে। তখন তোমার কাছে মনে হতে পারে, তুমি তোমার মূল্যবান কিছুকে হারিয়ে ফেলেছো। অথবা তুমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারো যে, ওটা আসলে শুধুই এক বিভ্রম ছিলো। সত্যি কথা হলো, ওটা কোনো বিভ্রম ছিল না, এবং তুমি ওটা কখনো হারাতে পারো না। এটা তোমার প্রকৃত সত্তা, যা মনের দ্বারা আড়াল হতে পারে, কিন্তু মন কখনো এটা ধ্বংস করতে পারে না। ঘন মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়লেও তা কখনো অদৃশ্য হয়ে যায় না, সূর্য তখনও মেঘের ওপারে থাকে ঠিকই।

বুদ্ধ বলেছেন আকাঙ্ক্ষা বা আসক্তির জন্যই দুঃখ কষ্টের সৃষ্টি হয়। তাই দুঃখমুক্তির জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা বর্জন করতে হবে।

সব আকাঙ্ক্ষাই হলো বাহ্যিক পৃথিবীতে মনের মুক্তি বা সম্পূর্ণতা খুঁজে পাবার একটা চেষ্টা, আর ভবিষ্যতের জন্য অস্তিত্বের আনন্দের একটা বিকল্প খোঁজার চেষ্টা। যতক্ষণ পর্যন্ত আমিই আমার মন, ততক্ষণ আমিই সেই কামনা, সেই ক্ষুধা, সেই অভাব আর বিতৃষ্ণা। আর এদের বাইরে আলাদাভাবে কোনো ”আমি” নেই, একটা সুপ্ত সম্ভাবনা বাদে, যে বীজ এখনো অংকুরিত হয়নি। এই অবস্থায়, আমার নির্বাণ লাভের ইচ্ছাও আসলে কেবল ভবিষ্যতে সম্পূর্ণতা লাভের জন্য আরেকটি কামনা। তাই বাসনা থেকে মুক্ত হতে অথবা নির্বাণ ‘অর্জন’ করতে চেও না। বর্তমানে উপস্থিত থাকো। নিজের মনের পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকো। বুদ্ধের উক্তি দেয়ার বদলে নিজেই বুদ্ধ হও। “জাগ্রত”’ হও, যা বুদ্ধ শব্দের মর্মার্থ।

যুগযুগান্তর ধরে মানুষ দুঃখের যাতনায় ভুগছে, আর এটা শুরু হয়েছে যখন তারা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে মন আর সময়ের জগতে প্রবেশ করেছে। তখন থেকে মানুষ অচেনা এক জগতে নিজেদেরকে অর্থহীন বিচ্ছিন্ন সত্তা মনে করে, যারা নিজেদের উৎসের কাছ থেকে, আর একে অপরের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছো (আধ্যাত্মিক ভাষায় বলতে গেলে, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি অচেতন অবস্থায় আছো), ততক্ষণ পর্যন্ত দুঃখ অনিবার্য।

আমি এখানে মূলত আবেগীয় দুঃখের কথা বলছি, যা শারীরিক কষ্ট আর শারীরিক রোগেরও মূল কারণ। বিরক্তি, ঘৃণা, নিজের প্রতি করুণা, আফসোস, রাগ, হতাশা, হিংসা, আর এ জাতীয় সবই, এমনকি খুব সূক্ষ্মতম বিরক্তিও, আসলে দুঃখেরই বিভিন্ন রূপ। সব সুখ বা আবেগীয় উচ্চতা (High) তার নিজের ভেতরেই দুঃখের বীজ বহন করে। দুঃখ হল এর অবিচ্ছেদ্য বিপরীত, যা একটা সময়ে নিজেকে প্রকাশিত করবে।

যে কখনো ‘পিনিক’ নেয়ার জন্য মাদক নিয়েছে, তার জানা আছে এই পিনিক একসময় আবার নেমে আসে; সেই সুখানুভূতি পরিণত হয় যন্ত্রণায়। অনেক মানুষ তাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটাও জানে যে, কত দ্রুত একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সুখের ফোয়ারা থেকে দুঃখের উৎসে পরিণত হতে পারে। ওপর থেকে পুরো জিনিসটা একসাথে দেখলে সহজেই বোঝা যায়—সুখ আর দুঃখ দুই মেরুই আসলে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দুটোই ভেতরের গভীরের এক মৌলিক দুঃখের অংশ, যা মন-সম্পৃক্ত চেতনা থেকে অবিচ্ছেদ্য।

তোমার দুঃখের দুটি স্তর আছে। যে দুঃখ তুমি এখন সৃষ্টি করছো, আর অতীতের যে দুঃখ তোমার দেহমনে এখনও বিরাজ করে চলেছে। বর্তমানে আর কোনো দুঃখ সৃষ্টি না করা এবং অতীতের দুঃখকে দ্রবীভূত করা। এসো, এখন এটা নিয়ে কথা বলি।

9 thoughts on “শক্তিমান বর্তমান, প্রথম অধ্যায়

      1. আমি শক্তিমান বর্তমান বইটি পেতে চাই কি ভাবে পেতে পারি? এবং মুল্য কিভাবে পরিশোধ করবো। আমার ঠিকানা, পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে, প্রধান সড়ক মাদারীপু, ফোন- 01748004609.

  1. মন্তব্য *আমিও এধরনের সমস্যায় আছি।অতীত টা অসহ্য এবং সেই অতীতের সাথে ভবিষ্যতকে মিলিয়ে ভাবতে থাকি।যেগুলো আসলে আমি ভাবতে চাই না। নিজেকে বার বার অদ্ভুত সব প্রশ্ন করি।বর্তমান সময় আর কাছের মানুষগগুলোর কথা ভাবলে খুব কষ্ট লাগে কিন্তু মনে হয় তারা আমার থেকে অনেক দূরে আমি তাদের কাছাকাছি যেতে পারছি না।আমি বের হোতে পারছি না এসব থেকে।

    1. আপনার লেখাটা পড়ে মনে হলো আমিই লিখেছি নাকি , অদ্ভূত লাগলো কারন আমার পরিচিত কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আমরি মতো । সবার মানসিক শক্তি আমার চেয়ে বেশী , যারা অতীতকে হয়তো মনে রাখছে কিন্তু বর্তমানকে গ্রহণ করতে দ্বিধা নেই।তাদের কষ্টগুলো তাদের কষ্ট দেয় কিন্তু সব সময় ভাবনায় চাদরে ঘীরে রাখছে আমার মতো।

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *