ডেনমার্কের ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইভান হিল্টপল্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হক্সবেরি ইনস্টিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট-এর একদল গবেষক পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে উদ্ভিদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে সিলিকনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণাটি জার্নাল সয়েল বায়োলজি এন্ড বায়োকেমিস্ট্রি নামক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক এডাম ফ্রিউ এ গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক। গবেষণাটির জন্য অর্থ দিয়েছে ‘সুগার রিসার্চ অস্ট্রেলিয়া’।
ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কলেজ অফ এগ্রিকালচার এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’-এর কীটতত্ত্ব ও বন্যপ্রাণী বাস্তুবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিল্টপল্ডের মতে, গবেষণা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিলো আখের পুষ্টিমানের উপর, এবং আখের শিকড় অঞ্চলে যেসব পোকামাকড়ের বিচরণ দেখা যায় (বিশেষত আখের অন্যতম ক্ষতিকারক পোকা কেইন বিটল), সেগুলোর উপর আরবাসকুলার মাইকোরাইজাল ছত্রাকের প্রভাব বিশ্লেষণ করা। তো, কীভাবে পরীক্ষণটি করেছিলেন গবেষকরা? হিল্টপল্ড বলেন, “অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে মাটিতে আমরা সিলিকনও দিয়েছিলাম। পরীক্ষণে যে ছত্রাক ব্যবহার করেছিলাম, সেটা উদ্ভিদ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সাথে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে পারে। ফলে সবকিছু মিলে পোকামাকড়ের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।”
উল্লেখ্য, ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এমন মৌলিক পদার্থের মধ্যে অক্সিজেনের পরেই সিলিকনের স্থান। তবে এটি পাথর বা খনিজ আকারে থাকে বলে উদ্ভিদ সরাসরি গ্রহণ বা শোষণ করতে পারে না। যদি মাটির সাথে সিলিকা আকারে সিলিকন প্রয়োগ করা হয়, তবে উদ্ভিদ সেটি সহজে শোষণ করতে পারে। সিলিকা শোষণের ফলে গাছের মধ্যে ফাইটোলিথস বা প্লান্ট স্টোন নামে এক ধরনের পদার্থ তৈরি হয়। এই প্লান্ট স্টোন উদ্ভিদভোজী পোকামাকড়, এমনকি ইঁদুরের বিরুদ্ধেও কাজ করতে পারে। কীভাবে?
উদ্ভিদের দেহে পাথরের মত পদার্থ (প্লান্ট স্টোন) তৈরি হওয়ায় উদ্ভিজ্জ পদার্থের বিপাকীয় ক্ষমতা কমে যায়, কারণ পোকা পাথর খেয়ে হজম করতে পারে না। বরং পোকা আর ইঁদুর যখন এগুলো খায়, তখন তাদের দাঁত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষতিগ্রস্থ দাঁত নিয়ে পোকামাকড় আর আগের মত খেতে পারে না। ফলে শস্যের ওপর পোকামাকড়ের আক্রমণ কমে যায়।
এখন দেখি, মূল গবেষণাটি কীভাবে করা হয়েছিল।
গবেষণায় ব্যবহারের জন্য আখের দুটো জাত বাছাই করা হয়েছিল এবং গ্রিন হাউসে সেগুলোর চাষ করা হয়েছিল। এই চাষের সময়ই মাটিতে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে সিলিকন দেওয়া হয়েছিল। এরপর উদ্ভিদের শিকড় খেয়ে বেঁচে থাকে, এমন পোকা (কেইন গ্রাব) ছাড়া হয়েছিল আখগুলো খাওয়ার জন্য। যেহেতু কেইন গ্রাব পোকাটি অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রধান ক্ষতিকারক পোকা, সেজন্য গবেষণায় এ পোকাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। পোকাগুলো কী পরিমাণ মূল খেল এবং তাদের কতখানি দৈহিক বৃদ্ধি হলো, সেসবের হিসাব রাখা হয়েছিল। পরের ধাপে এ পোকাগুলোকেই পোকাভোজী কৃমির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পোকাভোজী কৃমিরা মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড় খেয়ে থাকে। তো, কেইন গ্রাবগুলোকে সেরকম কৃমি দিয়ে খাওয়ানো হয়। গবেষকরা দেখলেন, অধিক মাত্রায় সিলিকনের প্রভাবে পোকার দৈহিক বৃদ্ধি যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে তাদের শিকড় খাওয়ার পরিমাণ। আশ্চর্য হলেও সত্যি, শিকড় খাওয়ার পরিমাণ ৭১ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল!
সিলিকনের উপস্থিতি যেহেতু তৃণভোজী গবাদিপশুর উপর প্রভাব ফেলে না, তেমনি মানুষের উপরও এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। ব্যাপারটা অনেকটা সেদ্ধ গাজর কিংবা সেদ্ধ ভূট্টা খাওয়ার মতই।
আখ অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম প্রধান ফসল, এবং কেইন বিটলের লার্ভাগুলো আখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। একেকটা লার্ভার প্রস্থ বুড়ো আঙুলের ব্যাসের সমান। যেহেতু এ পোকাগুলো মাটির নিচে থাকে, সেহেতু কীটনাশক দিয়ে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আখ গাছে আক্রমণের আগ পর্যন্ত এদের হদিস পাওয়া যায় না। তবে আক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পেতে অনেক দেরি হয়ে যায় বলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। এজন্য এ পোকা দমনের কার্যকরী উপায় হাতে থাকা নিঃসন্দেহে আশীর্বাদস্বরূপ। সিলিকন প্রয়োগ করে উদ্ভিদকে পোকার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও প্রতিরোধী করে তোলার প্রক্রিয়াটি পরিবেশগতভাবে যেমন নিরাপদ, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও সাশ্রয়ী। কারণ এক্ষেত্রে কৃষকদের অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে না।
সিলিকন যদিও প্রকৃতিতে সহজলভ্য, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উদ্ভিদ তা গ্রহণ বা শোষণ করতে পারে না। কিন্তু যদি শোষণ উপযোগী অবস্থায় সিলিকন মাটিতে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেটি উদ্ভিদের গঠন ও বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে। হিল্টপল্ড বলেন, মাটিতে সিলিকন প্রয়োগের ফলে শুধু যে উদ্ভিদের ফলন ক্ষমতা বাড়ে তাই নয়, পোকামাকড় এমনকি স্তন্যপায়ী ইঁদুরের বিরুদ্ধেও উদ্ভিদের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। আখের পাশাপাশি অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রেও এ গবেষণাকে কাজে লাগানো যাবে বলে তিনি অভিমত দেন।
হিল্টপল্ড আরো বলেন, সিলিকনের পাশাপাশি ছত্রাকের সাথে উদ্ভিদের যে মিথস্ক্রিয়া হয়, তার ফলেও পোকামাকড় দমন হয়। কিন্তু এটা এখনো পরিষ্কার হয়নি যে, ছত্রাকের সংস্পর্শে প্রকৃতপক্ষেই পোকার প্রতিরোধী ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়, নাকি উদ্ভিদের ভেতরে অন্য কোন পরিবর্তনের কারণে তা ঘটে। এ ধরনের গবেষণার ফলাফল আগে কখনো প্রকাশ হয়নি বলেও দাবি করেন বিজ্ঞানী হিল্টপল্ড।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.sciencedaily.com/releases/2017/08/170815121450.htm
Adam Frew, Jeff R. Powell, Ivan Hiltpold, Peter G. Allsopp, Nader Sallam, Scott N. Johnson. Host plant colonisation by arbuscular mycorrhizal fungi stimulates immune function whereas high root silicon concentrations diminish growth in a soil-dwelling herbivore. Soil Biology and Biochemistry, 2017; 112: 117 DOI: 10.1016/j.soilbio.2017.05.008