দ্যা আলকেমিস্ট পাওলো কোয়েলোর লেখা প্রথম বই, প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে। ২০২৩ সালে ফরহাদ হোসেন মাসুমের অনুবাদে, আদর্শ প্রকাশনী থেকে, এই বেস্টসেলার বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
দ্যা আলকেমিস্ট – লেখক ও অনুবাদকের কথা
মুখবন্ধ
ভ্যানে করে নিয়ে আসা অনেকগুলো বইয়ের মধ্য থেকে আলকেমিস্ট একটা বই তুলে নিলো। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে নার্সিসাসের গল্পে এসে থামলো।
আলকেমিস্ট নার্সিসাসের ব্যাপারে আগে থেকেই জানতো। নার্সিসাস হ্রদের পাড়ে বসে জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতো আর মুগ্ধ হতো। সে নিজের রুপে এতোটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলো যে দিগ্বিদিক ভুলে পানিতেই পড়ে গেলো, ডুবে মারা গেলো। ঠিক সেখান থেকেই একটা ফুল জন্ম নিলো, ফুলের নাম রাখা হলো নার্সিসাস। কিন্তু এই বইয়ের লেখক সেভাবে বইটার সমাপ্তি টানেননি। তিনি বললেন যে, নার্সিসাস মারা যাওয়ার পর সেখানে বনের দেবীগণ এলেন। এসে দেখলেন, সুপেয় পানির হ্রদটা লবণাক্ত অশ্রুজলের হ্রদে পরিণত হয়েছে।
“তুমি কাঁদছো কেন?” বনদেবীগণ শুধালেন।
“নার্সিসাসের জন্য”, হ্রদ উত্তর দিলো।
“তাতে আর আশ্চর্য কী?” তারা বললেন, “আমরা সবাই বনের মধ্যে ওর পিছু পিছু ছুটতাম, শুধু তুমিই সামনে থেকে ওর রুপ দেখতে পেয়েছো।”
“নার্সিসাস কি রুপবান ছিলো?” হ্রদ জিজ্ঞেস করলো।
“ও মা, সেটা তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?” দেবীগণ অবাক হলেন, “ও তো তোমার পাড়ে বসে, তোমার জলেই নিজপানে চেয়ে থাকতো!”
হ্রদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অবশেষে বললো, “আমার অশ্রু নার্সিসাসের জন্য। কিন্তু আমি কখনো ওর সৌন্দর্য খেয়াল করিনি। যতবারই সে আমার পাড়ে হাঁটু গেড়ে বসেছে, ওর চোখের গভীরতায় আমি নিজের সৌন্দর্য দেখেছি।”
“কী চমৎকার একটা গল্প”, আলকেমিস্ট ভাবলো।
প্রথম অধ্যায়
ছেলেটার নাম সান্তিয়াগো। এক পাল ভেড়া নিয়ে ছেলেটা পরিত্যক্ত একটা গির্জার সামনে এসে হাজির হলো। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। গির্জার ছাদ অনেক আগেই ধসে গেছে। আগে যেখানে পাদ্রীর ঘরটা ছিলো, সেখান এক বিশাল ডুমুর গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটা ঠিক করলো, আজ রাতটা এখানেই কাটাবে। ভালো করে গুণে গুণে সব কয়টা ভেড়াকে গির্জার আধভাঙা দরজা দিয়ে পার করলো। এরপর দরজার আড়াআড়ি করে কয়েকটা তক্তা এঁটে দিলো যাতে রাতের বেলা ভেড়ার দল এদিক সেদিক ঢুঁ মারতে না পারে। এই এলাকায় কোনো নেকড়ে নেই যদিও। কিন্তু রাত পালানো ভেড়া খুঁজতে ওর সারাটা দিন বেরিয়ে যাবে।
নিজের জ্যাকেট দিয়ে মেঝেটা একটু ঝেড়ে নিলো, এরপর ওখানেই সটান শুয়ে পড়লো ছেলেটা। মাত্র শেষ করা একটা বই হাতে ছিলো, সেটাকে বালিশ বানিয়ে নিলো। ভাবলো, এখন থেকে আরো মোটা মোটা বই পড়তে হবে। সেগুলো অনেকদিন ধরে পড়া যায়, আর বালিশ হিসেবেও আরাম হয়।
যখন সে ঘুম থেকে উঠলো, তখনো বাইরে আলো ফোটেনি। ধসে যাওয়া ছাদ পার করে ওর দৃষ্টি চলে গেলো নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে। সে ভাবলো, আরেকটু ঘুমাতে পারলে মন্দ হতো না। সে একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো, সেটা শেষ হবার আগেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। ধ্যাত, গত সপ্তাহেও এরকম হয়েছে। ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখছিলো সে তখনো।
ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো। কিছু কিছু ভেড়ার ঘুম এখনো ভাঙেনি। হাতের লাঠিটা দিয়ে গুঁতো মেরে সে ওদের ঘুম ভাঙালো। সে খেয়াল করে দেখলো, ওর ঘুম ভাঙামাত্র বেশির ভাগ ভেড়াও নড়েচড়ে উঠলো। যেন কোনো এক রহস্যময় শক্তি ওর ভেড়াগুলোর সাথে ওকে বেঁধে রেখেছে। গত দু বছর এদের সাথে থেকে, খাবার আর পানির খোঁজে এদেরকে এই গ্রাম থেকে সেই গ্রামে নিয়ে যেতে যেতে সেই শক্তি আরো জোরদার হয়েছে। “আমার দেহঘড়ি সন্ধান করে ফেলেছে এরা”, বিড়বিড় করে নিজেকে বললো। ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু ভাবলো ছেলেটা। ওর মনে হলো, আসলে ঘটনা উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো আমিই ওদের ঘড়িতে চলছি।
অবশ্য কিছু ভেড়া ঘুম ভেঙে উঠতে আরো বেশ খানিকক্ষণ সময় নিলো। ছেলেটা ওদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আবার খোঁচা দিলো। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, ভেড়াগুলো ওর কথা বোঝে। সে মাঝে মাঝে বই থেকে ওদেরকে কিছু অংশ পড়ে পড়ে শোনায়; বিশেষ করে ওর প্রিয় অংশগুলো। কখনো কখনো সে ওদেরকে খোলা মাঠে রাখাল বালকের একাকীত্ব বা আনন্দের কাহিনী শোনায়। গ্রামপথে হেঁটে যেতে যেতে এটাসেটা নিয়ে ওদের সাথে গল্প করে।
কিন্তু গত কদিন ধরে সে ভেড়াগুলোর সাথে শুধু একটা বিষয় নিয়েই আলাপ করেছে – ঐ যে, সওদাগরের মেয়েটাকে নিয়ে। চারদিন পর ওরা ঐ মেয়েটার গ্রামে পৌঁছুবে। ওখানে সে এর আগে একবারই গেছে, তাও এক বছর আগে। ওর বন্ধু এই দোকানের কথা বলেছিলো। ঐ এলাকার সব শুকনো জিনিস কেনাবেচা হয় ঐ সওদাগরের দোকানে, ভেড়ার পশমও কেনাবেচা হয়। গত বছর ছেলেটা তার ভেড়াগুলোকে নিয়ে গিয়েছিলো ঐ দোকানে। ভেড়ার পশম ছাড়ানোর সময় সওদাগর সামনে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলেন, যাতে কেউ ফাঁকি না দিতে পারে।
আরো কয়েক অধ্যায় পর…
বুড়ি মহিলা ওকে নিয়ে বাসার একদম পেছন দিকে নিয়ে গেলেন। বসার ঘর আর এই ঘরটা হরেক রঙের মুক্তো দিয়ে তৈরি পর্দা দিয়ে আলাদা করা। এই রুমে আসবাবপত্র বলতে কেবল একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, আর দেয়ালে টাঙানো যীশু খ্রিস্টের একটা ছবি।
মহিলা বসলেন, ছেলেটাকেও বসতে বললেন। ছেলেটার দু হাত নিজের দু হাতে নিয়ে, বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। প্রার্থনাটা শুনতে জিপসিদের মন্ত্র আওড়ানোর মত মনে হলো। জিপসিদের সাথে ছেলেটার আগেও মোলাকাত হয়েছে। এরাও ঘুরে বেড়ায়, ঠিক ওর মতই, কিন্তু ওদের ভেড়ার পাল লাগে না। সবাই বলে, জিপসিরা নাকি মানুষকে ঠকিয়ে ধান্দা করে। এমনও শোনা যায় যে, জিপসিদের সাথে নাকি শয়তানের আঁতাত আছে। এরা নাকি ছোটো বাচ্চা অপহরণ করে গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে যায়, ওদেরকে দাস বানিয়ে কী সব যেন করায়। ছোটবেলায় জিপসিদের নাম শুনলেই ছেলেটার আত্মা শুকিয়ে যেতো। বুড়ি মহিলা তার হাত দুটো ধরতেই ছোটবেলার সেই পুরনো ভয়টা আবার তাকে জেঁকে ধরলো।
অবশ্য দেয়ালে যীশু খ্রিস্টের ছবি ঝুলছে, এটা ভেবে সে নিজেকে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করলো। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলো, যাতে হাত না কাঁপে। ও যে ভয় পাচ্ছে, সেটা যাতে বুড়ি মহিলা বুঝতে না পারে।
“বাহ, দারুণ তো!” মহিলা বললেন, এরপর একদম চুপ করে গেলেন। একবারের জন্যেও ছেলেটার হাত থেকে চোখ তোলেননি তিনি। ছেলেটা একটু ইতস্ততবোধ করলো। না চাওয়া সত্ত্বেও ওর হাত কাঁপতে শুরু করলো, মহিলা সেটা টের পেলেন। সে এক টান মেরে হাত ছুটিয়ে নিলো।
“আমি তো হাত দেখানোর জন্য এখানে আসিনি”, সে বললো। কেন যে এখানে এলাম, সে মনে মনে ভাবলো।
ধুর, সব গোল্লায় যাক, মহিলার দক্ষিণা দিয়ে পালাই। কিছু জানা লাগবে না আমার। স্বপ্নই তো, এর চেয়ে বেশি কিছু তো না। অর্থ না জানলেও আমার কিছু যাবে আসবে না।
“তুমি তোমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে এসেছো”, বুড়ি মহিলা বললেন, “স্বপ্ন হচ্ছে খোদার জবান। উনি যখন ঐ জবানিতে স্বপ্ন দেখান, আমি সেটার অনুবাদ করি। অবশ্য উনি যদি আত্মার জবানিতে স্বপ্ন দেখান, তখন তুমি ছাড়া আর কেউ সেটা বুঝতে পারবে না। জবান যেটাই হোক, আমার দক্ষিণাটা কিন্তু দিতে হবে”।
এটাও আরেক জালিয়াতি, ছেলেটা ভাবলো। কিন্তু সে ঠিক করলো, টোপটা গিলবে। রাখালদের সবকিছুই তো জুয়া! নেকড়ে নিয়ে জুয়া, খরা নিয়ে জুয়া! এই জুয়াগুলোর জন্যেই রাখালদের জীবন এত রোমাঞ্চকর!
“আমি একই স্বপ্ন দুইবার দেখেছি”, সে বললো। “আমি আমার ভেড়াগুলোর সাথে একটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি, তখন হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা বাচ্চা মেয়ে হাজির হলো, ভেড়াদের সাথে খেলা শুরু করলো। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হলো না। ভেড়ারা সাধারণত অপরিচিত মানুষদেরকে ভয় পায়। কিন্তু কেন যেন বাচ্চাদেরকে ওরা ভয় পায় না। বোবা প্রাণীগুলো কিভাবে মানুষের বয়স বুঝতে পারে, কে জানে!”
“স্বপ্নের কথা বলো। এরপর কী হলো?” মহিলা বললেন। “আমাকে রান্না করতে যেতে হবে। তোমার কাছে তো টাকাপয়সা তেমন নেই, তোমাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবো না”।
“বাচ্চাটা অনেকক্ষণ ধরে আমার ভেড়াগুলোর সাথে খেললো,” ছেলেটা বললো, কণ্ঠে একটু হতাশার ছাপ, “হঠাৎ করে দৌড়ে এসে সে আমার হাত দুটো ধরলো। আর সাথে সাথে আমরা মিশরের পিরামিডে চলে গেলাম”।
সে বলা থামিয়ে একটু অপেক্ষা করলো। বোঝার চেষ্টা করলো, মহিলা মিশরের পিরামিডের ব্যাপারে আদৌ জানেন কিনা। কিন্তু মহিলা কিছুই বললেন না।
“তারপর, মিশরের পিরামিডের সামনে”, শেষ তিনটা শব্দ একটু ধীরে আর জোর দিয়ে বললো, যাতে মহিলা পিরামিডের গুরুত্বটা বুঝতে পারেন, “বাচ্চাটা আমাকে বললো, ‘যদি এখানে আসতে পারো, তাহলে একটা গুপ্তধন পাবে’। এবং ঠিক যে মুহুর্তে বাচ্চা মেয়েটা আমাকে একদম আসল জায়গাটা দেখাতে যাবে, ঠিক তখনই স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেলো। দুইবারই, ঠিক একই জায়গায় এসে ঘুমটা ভেঙে গেলো।”
মহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর আবারো ছেলেটার হাত দুটো ধরলেন, মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
“এখন তোমাকে কোনো দক্ষিণা দিতে হবে না,” মহিলা আস্তে করে বললেন, “কিন্তু তুমি যদি কথা দাও যে গুপ্তধন পেলে আমাকে দশ ভাগের এক ভাগ দেবে, তাহলে একটা কথা বলতে পারি”।
ছেলেটা হাসলো, আনন্দের হাসি। দক্ষিণার জন্য যে টাকাটা এনেছিলো, সেটা বেঁচে যাবে। কারণ, স্বপ্নটা গুপ্তধন নিয়ে! বেশ মজার তো!
“তো, স্বপ্নের মানে কী, বলো এবার,” সে বললো।
“না, আগে কথা দাও। ওয়াদা করো যে, বিনিময়ে গুপ্তধনের এক-দশমাংশ আমাকে দেবে।” রাখাল ওয়াদা করলো। বুড়ি মহিলা তাকে যীশু খ্রিস্টের ছবির দিকে তাকিয়ে আবারো প্রতীজ্ঞা করতে বললেন। “জগৎসংসারের একটা সার্বজনীন ভাষা আছে, তোমার স্বপ্নটা বুঝতে হলে সেই ভাষা জানতে হবে। হ্যাঁ, এটার ব্যাখ্যা আমি জানি, অবশ্য ব্যাখ্যাটা বেশ জটিল। এজন্য আমার মনে হয়, তুমি যা পাবে তাতে আমারও একটা ভাগ থাকা উচিৎ।
“তোমার অবশ্যই মিশরের পিরামিডে যাওয়া উচিৎ। আমি কখনো এমন কোনো গুপ্তধনের কথা শুনিনি। কিন্তু যেহেতু একটা মাসুম বাচ্চা তোমাকে নিয়ে গেছে, তাহলে জিনিসটা অবশ্যই আছে। ওখানে গেলে তুমি অনেক বড় একটা গুপ্তধন পাবে, বড়লোক হয়ে যাবে।”
ছেলেটা প্রথমে অবাক হলো, এরপর বেশ বিরক্ত হলো। এই ব্যাখ্যার জন্য তো কোনো জিপসি বুড়ির দরকার পড়ে না। কিন্তু তখন ওর মনে পড়লো, ওকে তো কোনো টাকাপয়সা দিতে হচ্ছে না।
“শুধু শুধু সময়টা নষ্ট করলাম,” সে বললো।
“আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম যে তোমার স্বপ্নটা বেশ জটিল। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, জীবনের সাদামাটা জিনিসগুলোই সবচেয়ে জটিল; শুধু জ্ঞানীরাই সেগুলো বুঝতে পারেন। আমার তো সেই জ্ঞান নেই, তাই আমাকে আরো এটাসেটা শিখতে হয়েছে, যেমন হাতের রেখা পড়া। অবশ্য হাতের রেখা পড়েও আমার দিন চলে না। আমার বেশির ভাগ খরচ আমার মেয়েরাই চালায়।”
মহিলার আবোলতাবোল কথায় ছেলেটা আরো বিরক্ত হলো, “আচ্ছা, তো আমি মিশরে কিভাবে যাবো, শুনি?”
“আমি শুধু স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিই। সেটাকে কিভাবে বাস্তব করতে হবে, তা আমার জানা নেই। যদি জানতাম, তাহলে তো খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য আমার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না।”
“যদি কোনোদিন মিশরে না যেতে পারি?”
“তাহলে আমিও কোনো পারিশ্রমিক পাবো না। সে আর নতুন কী!”
এরপর মহিলা তাকে চলে যেতে ইশারা করলেন। বললেন, উনি নাকি ইতোমধ্যেই ওর জন্য অনেক বেশি সময় নষ্ট করে ফেলেছেন।