দ্যা গেইম অব লাইফঃ সিস্টেমের চিপায় আপনি

মানব সমাজে যখন কোন নতুন সদস্য আসে, তখন তাঁদের প্রতি আমাদের যে ধরনের আচরণ ভঙ্গি প্রকাশ পায় তা পুরোপুরি আশ্চর্যজনক। এই আচরণ ভঙ্গি আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি সহ অন্যান্য সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। একটা বাচ্চা যখন সমাজে প্রবেশ করে তখন তাঁকে শুভেচ্ছা না জানিয়ে আমরা বরং তাঁর সাথে এক ধরনের অদ্ভুত আচরণ শুরু করে দেই। যেখানে তাঁকে খোলামেলা ভাবে বলা উচিত যে এই জীবনটা একটা খেলা যা অনেকগুলো নিয়ম মেনে চলে। আমরা তোমাকে এই নিয়মগুলো বুঝিয়ে দিতে চাই যেন তুমি তোমার নিজের রাস্তা নিজে খুঁজে পাও; যখন তুমি বুঝতে পারবে আমরা কী ধরনের নিয়ম মেনে খেলাটা খেলি, এবং যখন তুমি বড় হবে, তখন হয়তো তুমি এর চাইতে আরও উত্তম নিয়ম আবিষ্কার করতে পারবে। সেখানে উল্টো তাঁকে আমরা বুঝিয়ে দেই যে তাঁর এখন পরীক্ষাকালীন সময় চলছে, অর্থাৎ সে এখনো ‘মানুষ’ না, বরং ‘মানুষ’ এর পদপ্রার্থী। মনুষ্য সমাজে পুরোপুরি প্রবেশ করতে হলে তাঁকে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। এবং ঠিক এভাবে আমরা শিশুর জন্যে একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছি, যেইখানে শিশু তাঁর জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকেঃ এই প্রস্তুতি সারা জীবনই চলে, কখনই কেউ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।

অন্য কথায় বলা যায়, আমাদের একটা ‘স্কুলিং সিস্টেম’ আছে যেটা “গ্রেড” দিয়ে  শুরু হয় এবং আমরা এটাকে  সবসময়ই প্রস্তুত করে রাখি এই ভেবে যে ভবিষ্যতে কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু কী ঘটবে সেটা কেউ জানে না। সুতরাং, শিশুকালে আপনি প্রথমে যান নার্সারি স্কুলে, যেখানে আপনার প্রস্তুতি চলে কিণ্ডার গার্টেনের। তারপর আপনি কিণ্ডার গার্টেনে গিয়ে প্রস্তুতি নেন ফার্স্ট গ্রেডের। তারপর আপনি একের পর এক গ্রেড পার হন আর প্রস্তুতি নেন হাই-স্কুলের। তারপর একটা সময় আসে যখন আপনি এই সিস্টেমের চিপায় আটকা পড়ে যান। তখন আপনে চিন্তা করেন কলেজে যাওয়ার কথা। কলেজে যাওয়ার পর যদি আপনি যথেষ্ট মেধাবী হয়ে থাকেন তাহলে আপনি ছুটেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আপনি হয়ে যান একজন প্রফেসর। এভাবে সিস্টেমটা চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। কিন্তু সাধারণ পন্থায় পড়ালেখা শেষ করার পর প্রফেসর হতে সিস্টেম আপনাকে উৎসাহ দিবে না। আপনার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর সিস্টেম আপনাকে বলবে যে, এখনই আপনের জীবনের শুরু। এখন আপনাকে পা রাখতে হবে বাস্তব জগতে। এতদিন আপনার শুধু ট্রেনিং চলেছে, এখন ট্রেনিং শেষ, কর্ম শুরু। আপনে তখন হয়তো ভাববেন যে, যাই হোক, প্রস্তুতি পর্বটা অবশেষে শেষ হলো।

কিন্তু আপনে যখন বাস্তব জগতে পা রাখবেন, তখন টের পাবেন যে তা আসলে শেষ হয়নি। ‘বাস্তব জগতে’ গিয়ে যখন আপনি প্রথম সেলস মিটিং-এ বসবেন, দেখবেন যে তাঁরা আপনারে নির্দিষ্ট কোটা অথবা টার্গেট ধরিয়ে দিয়েছে যেটা আপনাকে পূরণ করতে হবে। তারপর শুরু হবে আপনার কোটা পূরণের প্রস্তুতি। একটা পূরণ হলে আরেকটা, আরেকটা হলে তারপর আরেকটা। এই রকম করতে করতে আপনার বয়স যখন পঁয়তাল্লিশ, তখন ধরুন আপনি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। যদি হয়েই যান, আপনার মনে হতে পারে যে আপনি বোধহয় লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। এমনটা মনে হলে ধরে নিবেন যে আপনি প্রতারিত হয়েছেন। কেননা তাঁর কিছুদিন পরেই আপনার লাইফ আবার আগের মত লাগা শুরু হবে। সিস্টেম আপানাকে এমন একটা চিপায় আটকে দিয়েছে যেখানে আপনি সারা জীবন শুধু ভবিষ্যতের জন্যে “মরিয়া হইয়া থাকিতে বাধ্য”। সুতরাং মজার বিষয় হল, আমাদের কালচার সর্বশেষ যেই লক্ষ্যের জন্যে আমাদেরকে প্রস্তুত করেছে তা হলো ‘অবসর গ্রহণ’।

আপনি যখন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন, তখন আপনি দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যাবেন এবং আপনার কাছে থাকবে অনেক টাকা এবং সম্পদ যেটা আপনে সারা জীবন চেয়ে এসেছেন। আহ! শান্তি! এটা বলে আপনি একটা লম্বা নিঃশ্বাস তখন নিতে চাইতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, একই সময়ে তখন আপনি হবেন একজন বুড়ো নপুংসক। আপনার থাকবে পচা মূত্রনালী আর নকল দাঁত, এবং শরীরে থাকবে না কোনো শক্তি। আফসোস!

সুতরাং এই যে আপনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রস্তুতি নেওয়ার প্রক্রিয়াটা, পুরোটাই ছিলো ভুয়া। সোজা কথা, আপনি বৃহত্তরভাবে একটা অদ্ভুত ব্যবসায়িক ব্যবস্থাতে জড়িয়ে আছেন, যেটা আপনার প্রতিটা দিনকে ‘কাজ’ এবং ‘বিনোদন’ এই দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। কাজ হলো এমন একটা জিনিস যেটা সবাই করে এবং এর জন্যে সবাই টাকা পায়। কেউই এই ‘কাজ’কে অবজ্ঞা করতে পারে না। অন্য কথায়, এই ‘কাজ’ অথবা ‘শ্রম’ এতটাই বীভৎস আর একঘেয়ে যে এটা করার জন্যে মানুষকে টাকা দিতে হয়। না দিলে কেউ করবে না। আর কাজ করার একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো টাকা পাওয়া। আর টাকা কামানোর একমাত্র উদ্দেশ্য হল বাড়িতে গিয়ে কামানো টাকাটাকে উপভোগ করা। টাকা দিয়ে আপনি আনন্দ কিনতে পারবেন। এই কাজটা আপনি অসংখ্য পন্থায় করতে পারেন। ধরুন আপনি বাড়িতে গেলেন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে একটা বড় ধরনের আনন্দোৎসব আর ভোজের আয়োজন করলেন। খেলেন-দেলেন, আনন্দ করলেন। তারপর সন্ধ্যাটা কাটালেন একটা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস অর্থাৎ টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে, যেটার ভিতরে জীবনকে পুনরায় উপস্থাপন করা হয়, যেখানে আপনার আর যন্ত্রটার মধ্যে অবস্থান করে একটা কাঁচের স্ক্রিন। এই কাঁচের স্ক্রিনের পেছনের জীবনটাকে আপনে স্পর্শ করতে পারেন না, তাঁর গন্ধও নিতে পারেন না, শুধু তাকিয়ে থাকতে পারেন। তখন আপনার ভিতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতির উদ্রেক হবে। আপনি অনুভব করবেন যে, পুরো সময় ধরে গ্রেডিং সিস্টেম আপনাকে ভবিষ্যতের যেই মূলা দেখিয়েছে, সেই মূলাটা আপনি কখনোই ধরতে পারবেন না। এর কারণ, একেবারে শুরু থেকেই আমরা আমাদের বাচ্চাদের ভিতরে একটা ত্রুটিপূর্ণ পরিচয় ঢুকিয়ে দেই। আরেকভাবে বলতে গেলে, বাচ্চাদের সামনে আমরা একটা সারা জীবনব্যাপী সমস্যা হাজির করি, যেটার কোনো সমাধান নেই। তারপর তাঁরা পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয় এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায়, কিন্তু কখনোই তা সমাধান হয় না। এতে করে তাঁরা একটা চলমান হতাশার মধ্যে ডুবে থাকে। আর এই সমস্যাটা সমাধানের অযোগ্য হওয়ায়, এটাকে প্রতিনিয়ত ভবিষ্যতে পিছিয়ে দেয়া হয়।

সুতরাং বলা যায়, প্রতিটা ব্যক্তিকে শিশুকাল থেকেই শুধু ভবিষ্যতে বাঁচার শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়, যে ভবিষ্যৎ কখনোই আসে না। কাউকেই বর্তমানে বাঁচার শিক্ষা দেওয়া হয় না। এখন আবার এমনটা ধরে নিয়েন না যে আমি ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা করতে আপনাকে নিষেধ করছি। দার্শনিক কার্পে ডিয়াম বলেছিলেন, “Let us bring today, for tomorrow we die and not make any plans।” আমি আপনাকে যেটা বলতে চাই তা হলো, ভবিষ্যতের জন্যে পরিকল্পনা শুধু তাঁদেরই কাজে লাগে, যারা পুরোপুরি বর্তমানে বাঁচতে পারে। আসুন বাঁচি।

—এলান ওয়াটস, ব্রিটিশ দার্শনিক, লেখক ও বক্তা।

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *