ওমেলাস ছেড়ে যারা চলে যায়- উরসুলা কে ল’ গুইন

Ursula Le Guin. Photo by Marian Wood Kolisch

ঘণ্টার শব্দ জানান দেয় ওমেলাসে গ্রীষ্মকালীন উৎসব শুরু হয়েছে। বন্দরে থাকা নৌকা রঙ্গিন পতাকায় ভরা। লাল ছাদ আর রঙ্গিন দেয়ালের শহরে ঘাস আর গাছের মধ্য দিয়ে ছুটে গেছে রাস্তা, বিশাল পার্ক, দালান আর বাসা। তার মাঝের রাস্তা দিয়ে মিছিল হাঁটছে। রঙে রঙে সাজানো মিছিলে কেউ কেউ বেশিই রঙ্গিন, বৃদ্ধরা লাল আর ধূসর রঙের লম্বা আলখাল্লা গায়ে, নিশ্চুপ গোরখোর, আর শিশু কোলে মায়েরা তাদের বাচ্চার সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছে।

আরেকটা রাস্তায় আরও বেশি বাদ্য বাজছে। ঢোল, গং আর খঞ্জনীর সুরে-তালে মানুষ নাচছে, পুরো মিছিলই নাচছে। বাচ্চাদের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, যেন এই আনন্দ সংগীতের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। সব মিছিলই ছুটে চলেছে শহরের দক্ষিণ দিকে, সেখানে সাগর পাড়ের সবুজ মাঠে বাচ্চারা বসে খেলছে।

বড়রা তাদের ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ঘোড়াদেরও সাজানো হয়েছে। ঘাড়ের চুলে সোনালী, সবুজ আর রূপালী রং দিয়ে বেণী করা হয়েছে। ঘোড়াগুলোও যেন অন্যদের সাথে এই উৎসবকে নিজেদের উৎসব হিসেবে মেনে নিয়েছে।

দূরে তাকালে দেখা যায় ওমেলাসের সীমানা। পাহাড়ে ঘেরা শহরটা যেন পৃথিবীর কোলে বসে থাকা একটা শিশু। সকালের মিষ্টি হাওয়ায় অষ্টাদশ চূড়া থেকে নেমে আসা শীতল বরফের অনুভূতি পাওয়া যায়। সূর্যের তাপের সাথে এই ঠাণ্ডা হাওয়া খারাপ লাগে না। হাওয়ায় ব্যানার ভেসে বেড়ায় আর অদৃশ্য হাওয়া শব্দের রূপ পায়।

অষ্টাদশ চূড়ায় দাঁড়ালেও ওমেলাসের উৎসব থেকে ভেসে আসা সংগীত শোনা যায়। যত কাছে আসা যায় তত বেশি সংগীত, আর ঘণ্টার ঢংঢং শব্দ মানুষের মনে আনন্দের জন্ম দেয়।

আনন্দ! আনন্দের বিবরণ শব্দে দেয়া যায়? ওমেলাসের বাসিন্দাদের বিবরণ কীভাবে দেয়া যায়?

ওমেলাসের লোকেরা সহজ সরল, কিন্তু তারা খুশী। আমরা এখন আর “খুশী” শব্দটা খুশী হয়ে বলি না। হাসি এখানে আদিম।

এমন বিবরণে আপনারা কিছু ধারণা পেতে পারেন। এমন বিবরণে আপনারা ভাবতে পারেন নতুন কোনো রাজার রাজ্যাভিষেক হবে হয়ত। রাজকীয় ঘোড়ায় চড়ে, সেনাপতি আর রাজকীয় সংগীতের সাথে, হৃষ্টপুষ্ট দাসদের সাথে এসে জনগণের সামনে দাঁড়াবে কোনো শাসক! কিন্তু ওমেলাসের কোনো রাজা নেই। তারা তলোয়ার চেনে না, না তাদের আছে দাস। তারা বর্বর না। তাদের রাজ্য কীভাবে চলে আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় তাদের নিয়মনীতি খুবই কম।

যেহেতু তাদের রাজা বা দাস নেই, তাদের সমাজে স্টক মার্কেট, বিজ্ঞাপন, পুলিশ আর বোমাও নেই। কিন্তু আবার বলি, তারা সহজ সরল হলেও বোকা না। মেষপালক বা বর্বর অথবা কোনো ইউটোপিয়ান না। তারা আমাদের মতই জটিল।

আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা ভাবি সুখ একটা বোকামি। আমাদের কাছে বেদনা গভীর, মন্দ আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। শিল্পীর বিদ্রোহ তাই এখানেই। তারা মন্দকে কুৎসিত আর বেদনাকে একঘেয়ে করে দেখান। আমরা ভাবি যদি কোনো কিছু তোমার ক্ষতি করে তাকে মানিয়ে চলো। কারণ ভীতিকে প্রশংসা করার মানে আনন্দকে নিন্দা করা, সহিংসতাকে মেনে নেয়া মানে সবকিছু হারানো। আমরা সবই হারিয়েছি। আমরা সুখী মানুষের বিবরণ দিতে পারি না, আনন্দ উৎসব করতে পারি না।

ওমেলাসের কথা আপনাদের কীভাবে বলি?

তারা সরল খুশিমনা শিশুদের মত না, তবে তাদের শিশুরা খুশি। তাদের প্রাপ্তবয়স্করা বুদ্ধিমান, অনুরাগী। তারা মন্দ লোক না। ইউরেকা! আমি এর চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। যদি আপনাদের বুঝাতে পারতাম! ওমেলাসকে মনে হয় একটা রূপকথা, দূরের কোনো দেশে, অনেক অনেক কাল আগের!

মনে হয় আপনাদের যদি আমাদের সমাজের মানদণ্ডে বলা যায় তাহলে ওমেলাসকে আপনারা বুঝতে পারবেন। সবাই পারবেন না, তবে অনেকেই পারবেন।

যেমন- প্রযুক্তি। ওমেলাসের রাস্তায় গাড়ি আর আকাশে হেলিকপ্টার নাই। কিন্তু ওমেলাসের মানুষ সুখী।

সুখের রূপ হচ্ছে- নিজের প্রয়োজন বুঝতে পারা, প্রয়োজন আর ধ্বংসের পার্থক্য করতে পারা, আর ধ্বংস করতে পারা। মাঝের রূপটা হচ্ছে আরামের প্রয়োজন পূরণ কিন্তু কোনো কিছু ধ্বংস না করার রূপ- রুম হিটার, ট্রেন, ওয়াশিং মেশিন, আলো, জ্বালানীবিহিন ইঞ্জিন আর চিকিৎসার উন্নতি।

ওমেলাসের হয়ত এমন কিছুই নেই, কিন্তু সেটা কোনো বড় ব্যাপার না। যার যেমন ইচ্ছা!

আমার মনে হয় ওমেলাসে আসা লোকেরা দ্রুতগতির ট্রেন আর দ্বিতল ট্রামে করে এসেছে। ওমেলাসের ট্রেন স্টেশন খুব সুন্দর। শহরের সুন্দরতম দালান বলা যায়, কিন্তু কৃষকদের বাজারের মত সুন্দর না। কল্পনায় ট্রেন দিলেও আমার মনে হয় ওমেলাসের লোকেরা সাধারণ, সহজ-সরল। হাসিমুখ, ঘণ্টা, মিছিল, ঘোড়া…আপনাদের যা ইচ্ছা যোগ করে নিতে পারেন। তবে কোনো ধর্মালয় যোগ করবেন না। নগ্ন দেবী আর নগ্ন যাজক যাজিকারা কামের বশে সবার সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন এমন কল্পনা করবেন না, যদিও আমি এমনই ভেবেছিলাম! ওমেলাসে কোনো ধর্মালয় নেই। ধর্ম আছে, ধর্মালয়-যাজক নাই। এছাড়া যা ইচ্ছা আপনি ভাবতে পারেন, নগ্ন বাসিন্দারা যেখানে যার সাথে ইচ্ছা মিলিত হচ্ছে, উৎসবের সংগীতের তালে তালে সবাই মিলিত হচ্ছে। আপনি এমন ভাবতেই পারেন।

আমি মনে করি ওমেলাসে অপরাধবোধ বলতে কিছু নেই। আর কী কী ভাবতে পারি আমি? আমার শুরুতে মনে হয়েছিল ওমেলাসে কোনো নেশা দ্রব্য নাই, কিন্তু এমন ভাবনা খুব গোঁড়ামিপূর্ণ। যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য আছে মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ধূপ, যার সুগন্ধে সারা শহর সুবাসিত হয়। সুবাসে মানুষের মনে আর দেশে শ্রান্তি আসে। কিছু ঘণ্টা পরে আসে চিন্তার স্বচ্ছতা। আর কিছু সময় পরে মহাবিশ্বকে পরিষ্কার দেখা যায়- এই আনন্দ যৌনতা আর ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে বড়।

আমার মনে হয় তাদের বিয়ার আছে। আর কী থাকতে পারে এমন শহরে? বিজয়ের আর বীরত্বের আনন্দ অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু ধরে নিয়েছি যাজক ছাড়া তারা চলছে, চলুন সেনাও বাদ দিয়ে দিই। হত্যাকাণ্ডে লাভ করা আনন্দ সঠিক আনন্দ না, এটা ভয়ের আনন্দ। এটা অনেক ক্ষুদ্র। তারা যে বিজয় উদযাপন করে সেটা জীবনের বিজয়। গ্রীষ্মের রূপে তারা শহরকে সাজায় জীবনের জয়কে স্মরণ করতে, কাউকে হারানোর আনন্দ না। এমন অবস্থায় আমার মনে হয় না তাদের ধূপ প্রয়োজন আছে।

আমাদের মিছিল ইতোমধ্যে মাঠে চলে এসেছে। কিছু একটা রান্না হচ্ছে যার সুবাস আসছে লাল নীল তাঁবু থেকে। বাচ্চাদের মুখ আর বুড়োদের দাড়িতে পিঠার টুকরো লেগে আছে। কিশোর-কিশোরীরা তাদের ঘোড়ায় চড়ে বসেছে, আর ঘোড়ারাও তাদের লাইন সোজা করে দাঁড়িয়ে গেছে। এক বৃদ্ধা তাঁর হাতের টুকরি থেকে ফুল ছড়িয়ে যাচ্ছেন, আর পাশের মানুষেরা ফুল কুড়িয়ে তাদের টুপিতে বসিয়ে নিচ্ছে। মাঠের কোণায় নয় বা দশ বছরের এক বাচ্চা আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে। মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছে কিছুক্ষণ, আবার চলে যাচ্ছে। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা হাসি দিচ্ছে। বাচ্চাটা বাঁশি বাজানো থামায় না। সে যেন বাঁশির মিষ্টি আর সরু সুরে ভেসে যাচ্ছে।

তার বাজানো শেষ হলে সে মাথা নিচু করে মাঠেই বসে থাকে।

যেন বাঁশির থামা-ই ছিল একটা ইঙ্গিত, সাথে সাথেই আবার খঞ্জনী, ঢোল, ডঙ্কা বাজা শুরু হয়। ঘোড়ারা যেন একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়, ঘোড়সওয়াররা আলতো করে ঘোড়ার গায়ে হাত বুলায়- “শান্ত হও, শান্ত হও, প্রিয়…”। তারা লাইন আবার সোজা করে দাঁড়ায়, মিছিলও আস্তে আস্তে নড়াচড়া শুরু হয়। গ্রীষ্মের উৎসব শুরু হল!

বিশ্বাস হয় না? এমনও শহর হয়? এত আনন্দ? এত সুখী? বিশ্বাস হয় না? তাহলে আরেকটা জিনিস শুনুন।

ওমেলাসের অনেকগুলো দালানের মাঝে একটি রাষ্ট্রীয় দালানের নিচে আছে একটা বেসমেন্ট, অন্যান্য দালানের বেসমেন্টের চেয়ে বড়। এই বেসমেন্টে একটা ছোট দরজা আছে, কিন্তু কোনো জানালা নেই। কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একটু বাতাস ঢুকে, একটু আলো আর একটু ধূলা। আলো আর বাতাস যথেষ্ট না, জানালার মাকড়শার জাল এই সামান্য আলো আর বাতাসে ভাগ বসায়। ঘরের এক কোণায় একটা বালতি আর একটা ঝাড়ু আছে। ঝাড়ুর মাথাটা শক্ত, লাল, আর দুর্গন্ধযুক্ত। মেঝেতে ধূলা কিন্তু মেঝে ভেজা-ও।

ঘরটা একদম ছোট, বড় বড় পায়ে ৩ কদম হবে হয়ত। ঘরের মাঝামাঝি একটা বাচ্চা বসে আছে। ছেলেও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে। এর বয়স মনে হয় ছয়, কিন্তু আসলে তার বয়স দশ। বাচ্চাটা অনেক দুর্বল। হয়ত তার জন্মই এমন অপুষ্টিতে হয়েছে, হয়ত সে ভয়ে, অবহেলায় এমন হয়ে গেছে। বাচ্চাটা নাক খুঁটে, মাঝেমধ্যে পা নাড়ায়, পায়ের আঙ্গুল টানে। সে এমনভাবে বসেছে যেন ঝাড়ু থেকে তার দূরত্ব সবচেয়ে বেশি হয়।

সে এই ঝাড়ুকে ভয় পায়। একে দানব কল্পনা করে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু সে জানে ঝাড়ুটা দাঁড়ানো আছে, আর দরজাও বন্ধ, কেউই আসবে না। দরজাটা সবসময়ই বন্ধ থাকে, আর কেউ কখনোই আসে না- কিন্তু মাঝেমধ্যে- বাচ্চাটা জানে না কখন- দরজাটা ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠে আর একজন বা কয়েকজন লোক ভেতরে আসে। একজন এসে বাচ্চাটাকে লাথি দিয়ে দাঁড় করায়। অন্যরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, ওরাও যেন ভয় পায়। কারো চোখে হয়ত ঘৃণাও থাকে, বাচ্চাটা বুঝতে পারে না। খাবারের পাত্র আর পানির পাত্র ভরে দেয়া হয়, আবার সবাই চলে যায়। দরজায় দাঁড়ানো লোকেরা কিছু বলে না কখনো। কিন্তু বাচ্চাটা জন্ম থেকে এখানে ছিল না, সে তার মায়ের কণ্ঠ, সূর্যের কথা মনে করত পারে। মাঝেমধ্যে সে বলে ওঠে- “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি দুষ্টামি করবো না”। কিন্তু দরজাটা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। কেউ জবাব দেয় না কখনোই।

বাচ্চাটা রাতে চিৎকার করে কাঁদত শুরুতে, কিন্তু এখন আর কাঁদতেও পারে না- শুধু অস্পষ্ট কান্নার শব্দ করতে পারে। কথা বলাও কমে যায় সময়ের সাথে। শুকিয়ে তার বুকের হাড়গুলো দেখা যায়, কিন্তু তার পেট ফোলা। তাকে খাবার দেয়া হয় এক বেলা- অর্ধেক পাত্র প্রত্যেক দিন। সে নগ্ন। তার নিতম্বে অনেক ঘা, কারণ সে তার নিজের মল-মূত্রের উপর বসে দিন পার করে।

বাচ্চাটার কথা ওমেলাসের লোকেরা জানে, সকল লোকেরাই জানে। কিছু লোক তাকে দেখতে আসে, অন্যরা আসে না, তারা শুধু জানে বাচ্চাটা এখানে আছে। তারা জানে বাচ্চাটাকে এখানে থাকতেই হবে। কেউ বুঝে না কেন, কেউ জানে না কেন, কিন্তু তারা সবাই জানে যে তাদের সুখ, তাদের শহরের সৌন্দর্য, তাদের উৎসব, তাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, তাদের সভ্যতা, তাদের ফসলের প্রাচুর্য, তাদের আবহাওয়া- সব কিছুই নির্ভর করে এই বাচ্চার অকথ্য দুর্দশার উপর।

ওমেলাসের বাসিন্দারা তাদের বাচ্চাদের কাছে ব্যাখ্যা করে যখন তাদের বয়স আট থেকে বারোর মধ্যে থাকে- কারণ এই বয়সে তারা বুঝতে পারবে, আর যারা এই বাচ্চাকে দেখতে আসে তাদের বয়সও বাচ্চাটার মতই। মাঝেমধ্যে বড়রাও আসে। কিন্তু তাদের যত করেই বুঝানো হয়, যারা বাচ্চাটাকে দেখে তারা প্রায়ই বিস্মিত হয়, পীড়ায় ভোগে। তারা ঘৃণায় ভোগে, ঘৃণা যা তাদের সমাজে বিলুপ্ত বলে মনে করা হত। তারা রাগান্বিত হয়, ক্রোধে জ্বলে, অসহায়ত্ব বোধ করে, কোনো যুক্তিই তাদের মন ভোলাতে পারে না। বাচ্চাটাকে যদি বের করে আনা হয়, গোসল করানো হয়, খাওয়ানো হয়, মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়- তাহলে ভাল হবে, কিন্তু যদি কাজটা করা হয় ওমেলাস সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটিই শর্ত। ওমেলাসের জনজীবনের প্রত্যেকটা ভাল আর সুন্দর জিনিস, হাজার মানুষের জীবনের আনন্দ, সব কিছুই একটা বাচ্চার দুর্দশার কারণে সম্ভব হয়েছে- এই জিনিসটা স্বীকার করার মানে নিজেদের জীবনে অপরাধবোধকে নিয়ে আসা।

এই শর্তটা মৌলিক, আর অপরিবর্তনীয়; বাচ্চাটার প্রতি কোনো দয়া দেখানো- এমনকি তার সাথে ভাল করে কথা বলাও যাবে না।

দর্শনার্থী বাচ্চারা বাসায় ফেরার সময় হয়ত কাঁদে, বা অশ্রুহীন ক্রোধ নিয়ে ফেরে, যারা বাচ্চাটাকে দেখে তারা সকলেই একটা প্যারাডক্সে বাস করে। তারা হয়ত এই অনুভূতি নিয়ে সপ্তাহ বা বছর পার করে দেয়। সময়ের সাথে তারা বুঝতে পারে বাচ্চাটাকে মুক্ত করে দিলেও সে তার স্বাধীনতার কোনো মূল্য পাবে না। সামান্য কিছুক্ষণের জন্য খাবার আর আদর পাবে, কিন্তু তার বর্তমান অবস্থায় সে এই আদর সহ্য করতে পারবে না। বাচ্চাটার এতই ক্ষতি হয়ে গেছে যে সে কোনো আনন্দই বুঝতে পারবে না। তাকে এমনভাবে ভয়ে রাখা হয়েছে যেন সে কখনোই ভয় থেকে মুক্ত হতে পারবে না। এর আচরণ এমন হয়ে গেছে যে একে মানবিকতা দেখালেও সে বুঝতে পারবে না। এত দীর্ঘ সময় বন্দি থাকার পরে সে হয়ত তার বদ্ধ ঘরে ফিরে যাইতে চাইবে, অন্ধকারে থাকায় সে আলোকে ভয় পাবে, মলমূত্র ছাড়া সে বসতেই চাইবে না।

বাচ্চাটার জন্য ফেলা অশ্রু শুকিয়ে যায়, কারণ বাস্তবতার ন্যায়বিচারকে তারা বুঝতে পারে আর মেনে নেয়। কিন্তু তাদের ক্রোধ আর দুঃখের কারণে, তাদের অসহায়ত্ব আর তাদের দয়াপরবশতার কারণেই ওমেলাসের উন্নতি হয়েছে। তারা সুখ পেয়েছে বিসর্জনের মাধ্যমে। তারাও জানে এই বাচ্চাটির মতই তারাও মুক্ত না। তারা সহমর্মিতাকে জানে। এই বাচ্চার অস্তিত্ব আর বাচ্চাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের জ্ঞাত থাকার কারণেই তাদের শহরের সৌন্দর্য, তাদের সংগীতের উৎকর্ষ, তাদের বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে। এই বাচ্চাটির কারণেই তারা নিজের বাচ্চাদের ভালবাসে। তারা জানে যে অন্ধকারের এই বাচ্চাটা যদি না থাকে তবে মাঠে বাঁশি বাজানো বাচ্চাটাও থাকবে না, সূর্যের আলোয় তাদের শহরের রং দেখা যাবে না, অষ্টাদশ চূড়া থেকে শীতল মিষ্টি হাওয়া বইবে না। গ্রীষ্মের উৎসব বলতে কিছু থাকবে না।

এখন বিশ্বাস হচ্ছে? এখন ওমেলাসকে বাস্তব মনে হচ্ছে না?

কিন্তু আরেকটা বিস্ময়কর জিনিস আছে।

মাঝেমাঝে কিশোর-কিশোরীরা বাচ্চাটাকে দেখে ঘরে ফিরে কাঁদে না, কারণ তারা আর ঘরেই ফেরে না। মাঝেমাঝে বয়স্ক লোকেরাও বাচ্চাটাকে দেখে এসে নির্বাক হয়ে যায়, আর দুই তিন দিন পরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এরা রাস্তায় নেমে একা হাঁটতে থাকে। এরা ওমেলাসের দ্বার দিয়ে বের হয়, ফসলের মাঠ ধরে হাঁটতেই থাকে।

এরা একা বের হয়, ছেলে, মেয়ে, কিশোর, কিশোরী, পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা। রাত হয়ে যায়, কিন্তু এরা হাঁটতেই থাকে। শহরের রাস্তা দিয়ে, হলুদ রঙয়ের জানালা দিয়ে এদের দেখা যায়, আর একসময় তারা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। সবাই একা, পশ্চিমে বা দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে যেতে থাকে। তারা ওমেলাস ছাড়ে, অন্ধকারে চলে যায়, আর কখনো ফেরে না। আনন্দের এই শহরের বাইরে তারা কোথায় যায় কেউ জানে না। আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। হয়ত এরা হারিয়ে যায়, হয়ত এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এরা একসাথে আছে, কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় ওরা জানে ওরা কোথায় যাচ্ছে- ওমেলাস ছেড়ে যারা চলে যায়। 

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *