পিটার মিচেল ছিলেন এক খেয়ালি প্রকৃতির লোক। যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালে এক পুরনো জমিদারবাড়ি ঘষেমেজে সেখানেই তিনি তাঁর গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি ওখানেই কাটান, আর সেখানে তাঁর গবেষণার আংশিক খরচ যোগাত পোষা এক পাল গাভী। প্রাণের সবচেয়ে মৌলিক যে প্রক্রিয়া – যেভাবে এর শক্তির চাহিদা পূরণ হয় – সে ব্যাপারে তাঁর চিন্তাধারা ছিল সমসাময়িক অন্যান্য জীববিজ্ঞানীদের কাছে হাসির খোরাক।
“আমার মনে আছে, ভাবতাম, আমি যেকোন কিছু বাজি ধরে বলতে পারি যে ব্যাপারটা এভাবে ঘটেনি,” অর্ধ শতাব্দী আগে মিচেলের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে জৈবরসায়নবিদ লেসলি অরগেল এমনটা লিখেছিলেন। “ডারউইন আর ওয়ালেসের পর অন্তর্জ্ঞানের বিপরীতে গিয়ে এমন ধারণা জীববিজ্ঞানে আর কেউ দেয়নি, যেমন ধরুন, (পদার্থবিজ্ঞানে) আইন্সটাইন, হাইজেনবার্গ এবং শ্রোডিঙ্গারেরগুলো ছিল।”
পরের দশকগুলোতে অবশ্য দেখা গেলো মিচেলই সঠিক ছিলেন। তাঁর যথার্থতা প্রমাণিত হয় ১৯৭৮ সালে, যখন তিনি নোবেল পুরষ্কারটি বগলদাবা করেন। এমনকি আজও, বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানীই তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মর্ম পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেন নি – বিশেষ করে প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে।
“মিচেলের চিন্তাধারা ছিল মূলত কীভাবে কোষগুলো স্থানিকভাবে বিন্যস্ত থাকে এবং তারই একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোষীয় শক্তি উৎপাদন,” বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনায় অবস্থিত নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে কর্মরত জিওকেমিস্ট মাইক রাসেল। “সমস্যাটা ছিল এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক ধারণাগুলোতে স্থানিক বিন্যাস এবং তার প্রতিরূপ তৈরি বা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির সরবরাহের ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা ছিল না।”
রাসেল সহ আরও বেশ কিছু গবেষক মিচেলের ধ্যানধারণার আলোকেই এখন নতুন করে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে ভাবছেন। তাঁরা মনে করেন, প্রাণের সবচেয়ে অচিন্তনীয় বৈশিষ্ট্যটিই হচ্ছে এর উৎপত্তির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ক্লু। যার ফলে, সবচেয়ে পুরনো প্রাণ কেমন ছিল এবং তার বিবর্তন হয় কোথায়, সে ব্যাপারে তাঁরা একেবারে মৌলিক একটা চিত্র দাঁড় করিয়েছেন। এ চিত্রের সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
মিচেলের আগে সবাই মনে করতো, কোষ তার শক্তি পায় সোজাসাপ্টা রাসায়নিক প্রক্রিয়াতেই। প্রাণিজগতে শক্তির সার্বজনীন মুদ্রাব্যবস্থা হচ্ছে ATP নামের এক অনু – একে ভাঙো, ব্যাস, শক্তি বের হবে। প্রোটিন তৈরি করা থেকে শুরু করে পেশীর সঞ্চালন – শক্তির দরকার হয় এ্করম সমস্ত কোষীয় প্রক্রিয়ারই শক্তির যোগান আসে এই ATP থেকে।
অন্যদিকে ATP এর ব্যাপারে ভাবা হতো এটা তৈরি হয় খাদ্য ভেঙে সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। মিচেল ভাবলেন অন্যকিছু। তিনি যুক্তি দিলেন, প্রাণের শক্তি সরবরাহ হয় টেস্টটিউবে সংঘটিত সাধারণ ধাঁচের রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে নয়, বরং এক ধরনের বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়া হতে।
তাঁর মতে, খাদ্য হতে প্রাপ্ত শক্তি একটা মেমব্রেন বা ঝিল্লীর মধ্য দিয়ে ধনাত্মক চার্জযুক্ত হাইড্রোজেন আয়ন বা প্রোটনকে পাম্প করতে ব্যবহৃত হয়। ঝিল্লীর একপাশে যখন প্রোটন জমা হয়, তখন তার মধ্য দিয়ে একটা তাড়িতরাসায়নিক গ্রেডিয়েন্ট তৈরি হয়। সুযোগ পেলে সেই প্রোটনগুলোই আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারে, এবং এ সময় যে শক্তি নির্গত হয়, তা দিয়েই ATP অনু গঠন করা যায়। সোজা কথায়, একটা উঁচু ট্যাঙ্ককে পানিভর্তি করে সেই পানি দিয়ে একটি ওয়াটার হুইল চালনা করার সঙ্গে ব্যাপারটার তুলনা চলে।
মিচেল তাঁর এ তত্ত্বের নাম দিয়েছিলেন কেমিঅসমোসিস, এবং এটা মোটেও অবাক করার বিষয় নয় যে জীববিজ্ঞানীদের জন্য এটাকে গ্রহণ করা খুবই কষ্টকর ছিল। জীবের কী দরকার ছিল এমন জটিল প্যাঁচঘোঁচের মধ্য দিয়ে শক্তি তৈরি করার যেখানে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়াই এ জন্য যথেষ্ট? এর কোন মানেই হয় না।
হতে পারে এটা প্রচলিত ধারণার বিপরীত, কিন্তু দেখা গেলো এই কেমিঅসমোসিস প্রাণিজগতের সবখানেই উপস্থিত। প্রোটনের শক্তি কেবল কোষের শ্বসন নয়, সালোকসংশ্লেষণেরও চালিকাশক্তিঃ সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি একটা প্রোটন গ্রেডিয়েন্টে রূপান্তরিত হয় ঠিক খাদ্য থেকে পাওয়া শক্তির মতো করেই।
ATP তৈরিতে ব্যবহার না করেও সরাসরি এ প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট অর্জন করা যায়। ব্যাক্টেরিয়ার ফ্ল্যাজেলাম চালনা থেকে শুরু করে নানারকম উপাদান কোষের ভেতর এবং বাইরে আনা-নেওয়া করতেও এটা ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, প্রোটনের ক্ষমতাই হচ্ছে শক্তি উৎপাদন, চলন ও অভ্যন্তরীন পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষনের একেবারে কেন্দ্রীয় ব্যাপার – যেগুলো কিনা প্রাণের একেবারে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোরই কয়েকটা।
এর মানে দাঁড়ায়, প্রোটন-শক্তির ব্যবহার কোন সাম্প্রতিক উদ্ভাবন নয়, বরং প্রাণের ইতিহাসের একেবারে প্রথম দিককার বিবর্তনের ফল। প্রাণবৃক্ষের একেবারে প্রথম শাখাটা তৈরি হয় সরল কোষের দুইটি বড় গ্রুপের মধ্যে, ব্যাকটেরিয়া এবং আর্কিয়া। এ দু’টি গ্রুপেরই প্রোটন পাম্প আছে এবং উভয়ই ATP তৈরি করে একই রকম একটা প্রোটিনকে ব্যবহার করে সৃষ্ট প্রোটন কারেন্ট দ্বারা। এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, এরা উভয়ই এই কলকব্জা উত্তরাধিকারীসূত্রে পেয়েছে তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের থেকে – পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগতেরই সাধারণ পূর্বপুরুষ সে।
“সেই সাধারণ পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে একবার ভাবুন, আপনি যেটা পাবেন, তা সত্যিই এক অদ্ভূত জীব,” বলেন জার্মানির ডুসেলডর্ফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল মার্টিন। তাঁর অনুমান হচ্ছে, যে বৈশিষ্ট্যগুলো আর্কিয়া এবং ব্যাক্টেরিয়া উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান, সেগুলো তারা পেয়েছে তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের কাছ থেকে (যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে এগুলোর বেশ কয়েকটা তারা নিজেদের মধ্যে জিন বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জন করেছে), অন্যদিকে যেগুলো আলাদা, সেগুলো পরবর্তীতে তাদের স্ব স্ব পথে বিবর্তিত হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে সেই সাধারণ পূর্বপুরুষের নিজস্ব ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন ছিল। ছিল একটি সার্বজনীন জেনেটিক কোড, রাইবোজোম (প্রোটিন তৈরির কারখানা), ATP এবং ATP তৈরিতে ব্যবহৃত একটি প্রোটন-চালিত এনজাইম। ডিএনএ-তে থাকা নির্দেশ মেনে জিন থেকে প্রোটিন তৈরি করার বিস্তৃত কলাকৌশলও তাতে ছিল। মোদ্দা কথা, সমস্ত জীবজগতের যে সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ, সেটা দেখতে ছিল প্রায় আধুনিক যুগের এক কোষের মতোই।
এরপরও এর পার্থক্যগুলো ছিল খুবই চমকপ্রদ। বিশেষ করে, ডিএনএ-এর প্রতিরূপ তৈরির পুঙ্খানুপুঙ্খ কলাকৌশল ছিল এখনকার থেকে অনেকটা ভিন্ন। মেরিল্যান্ডের বেথিসডায় অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের ইউজিন কুনিনের মতে, ডিএনএ-এর প্রতিরূপ তৈরির কর্মপদ্ধতি দৃশ্যত ব্যাক্টেরিয়া এবং আর্কিয়ার মধ্যে আলাদা আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, অনেক জৈবরাসায়নিক পাথওয়েতেই প্রভাবক হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন এনজাইম কাজ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন, অক্সিজেন ছাড়াই খাদ্য থেকে শক্তি উৎপাদন। ফার্মেন্টেশনকে মনে করা হয় শক্তি তৈরির সবচেয়ে আদিম প্রক্রিয়া। তদসত্ত্বেও মার্টিন দেখিয়েছেন যে এর জন্য দায়ী এনজাইম আর্কিয়া এবং ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। দেখে মনে হয় যেন ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া প্রাণের প্রারম্ভে উদ্ভূত হওয়ার বদলে দুইটি গ্রুপের মধ্যে আলাদা আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে।
দুর্বোধ্য সীমারেখা
মার্টিনের ভাষ্যমতে এমনকি আরও দুর্বোধ্য ব্যাপার হচ্ছে, কোষঝিল্লী এবং কোষপ্রাচীরের মধ্যেও কোন মিল নেই। তিনি বলেন, “দেখেশুনে যা মনে হয়, কোষের সীমানা নির্ধারিত হয় যে ঝিল্লী বা প্রাচীর দিয়ে, ব্যাক্টেরিয়া ও আর্কিয়ার মধ্যে তা বিবর্তিত হয়েছে স্বতন্ত্র উপায়ে।”
কিন্তু তা-ই যদি হয়, তাহলে এই সাধারণ পূর্বপুরুষ কী রকম কোষ ছিল? কোনরকম সীমানাপ্রাচীর ছাড়াই কোন কোষ? অসম্ভব! তবে কি একেবারেই অনন্য কিছু? অসম্ভব সবকিছুকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলে বাকি যা থাকে তা-ই তো সত্যি হতে বাধ্য।
মার্টিন যদি সঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল তার জিন এবং প্রোটিনের প্রেক্ষাপটে এক জটিল সত্তা, এবং এর শক্তির যোগান আসত ফার্মেন্টেশনের বদলে প্রোটনের তড়িৎপ্রবাহ দ্বারা। সে সঙ্গে তার সীমানা প্রাচীরও ছিল এখনকারগুলো থেকে বাহ্যত আলাদা। এটা প্রাণ ছিল ঠিকই, তবে আমরা যেমনটা জানি, তেমন নয়।
এরপর ২০০২ সালের দিকে রাসেলের কাজের সঙ্গে মার্টিনের পরিচয় হয়। তার আগ পর্যন্ত রাসেল নিভৃতেই কাজ করে গেছেন। প্রাণের উদ্ভব নিয়ে তাঁর ভূরাসায়নিক ধ্যানধারণা সেসময় এ বিষয়ে একচ্ছত্রভাবে কাজ করা সব আনবিক জীববিজ্ঞানীদের থেকে ছিল স্বকীয়।
নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই রাসেল অ্যালকালাইন ভেন্ট নামক এক বিশেষ ধরনের হাইড্রোথার্মাল রন্ধ্রের সম্ভাব্যতার খোঁজ করে আসছিলেন। তখন পর্যন্ত একে কেবল প্রাচীন শিলার ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেত। ১৯৭৭ সালে আবিষ্কৃত ‘ব্ল্যাক স্মোকার’-দের থেকে এরা ভিন্ন, এরা তৈরি হয় মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত শৈলশ্রেণীর চূড়ায় উদ্গত আগ্নেয়গিরির লাভার সঙ্গে সাগরের পানির তীব্র বিক্রিয়ায়। রাসেলের ভেন্টগুলো ছিল আরও নিরীহ প্রকৃতির, গোলকধাঁধার মতো ছিদ্রযুক্ত ক্ষুদ্র বুদ্বুদাকৃতির শিলার চেয়ে ওগুলো বেশি কিছু নয়।
এই ভেন্টগুলো তৈরি হয় যখন পানি্র সঙ্গে খনিজ অলিভিনের (olivine) বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। সমুদ্র তলদেশে এটি খুবই সহজলভ্য (এবং অতীতে এর পরিমান ছিল আরও বেশি, ভূত্বক আরও পুরু হয়ে ওঠার আগে)। এ প্রক্রিয়ায় আরেকটা নতুন খনিজ তৈরি হয়, যাকে বলে সার্পেন্টাইন, এবং নির্গত হয় হাইড্রোজেন, ক্ষারীয় তরল এবং তাপ। তাছাড়া এর ফলে শিলা আয়তনে সম্প্রসারিত হয় এবং ফেঁটে যায়, যার ফলে এর ভেতর আরও পানি প্রবেশ করতে পারে এবং এতে করে বিক্রিয়াও সচল থাকে। এই উষ্ণ, হাইড্রোজেনপূর্ণ স্রোতধারা সমুদ্র তলদেশের ভূপৃষ্ঠকে ভেদ করে তৈরি করে অ্যালকালাইন হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট।
২০০০ সালে এসে এই ক্ষারীয় রন্ধ্রগুলোর ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায় যখন সিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ডেবোরাহ কেলি এবং তার সহকর্মীরা মিড অ্যাটলান্টিক রিজের সামান্য বাইরে আচমকা এক সক্রিয় অ্যালকালাইন ভেন্টের ক্ষেত্র আবিষ্কার করে বসেন, ঠিক রাসেল যেখানে বলেছিলেন এদেরকে পাওয়া যেতে পারে। আবিষ্কারক দলটি এ জায়গার নাম দিয়েছে ‘লস্ট সিটি’, তার আংশিক কারণ হচ্ছে এর শিলাগুলোর দৃষ্টিনন্দন সব মোচাকৃতির চূড়া, এগুলো তৈরি হয় যখন ক্ষারীয় তরলের মধ্য দিয়ে কার্বোনেট যৌগ অধঃক্ষিপ্ত হয়।
প্রাচীন সব ভেন্টের মতোই লস্ট সিটির এই চূড়াগুলো গোলকধাঁধার মতো ক্ষুদ্রকায় ছিদ্রে পূর্ণ, যাদের কোন কোনটার আয়তন আধুনিক কোষদের থেকে মোটেও ভিন্ন নয়। এখানকার রসায়নও ঠিক যেমনটি প্রত্যাশিত। গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে যে স্বয়ং হাইড্রোজেন ছাড়াও এতে মিথেন ও অন্যান্য ক্ষুদ্র হাইড্রোকার্বন উপস্থিত (সায়েন্স, খণ্ড ৩১৯, পৃঃ ৬০৪)।
এ ভেন্টগুলো নিজেরা হয়ত সেই চারশ কোটি বছর আগেকারগুলোর মতোই আছে, তবে সে সময়ের মহাসাগরগুলো ছিলো এখনকার থেকে একেবারে অন্যরকম। আদ্দিকালের সেই মহাসাগরের জল ছিলো কার্বন ডাইঅক্সাইডে পরিপূর্ণ এবং এ কারণে অম্লীয়, যেখানে এখনকার সাগরগুলো কিঞ্চিৎ ক্ষারীয়। এছাড়া সে সময় কার্যত কোন অক্সিজেনই ছিল না। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে লোহা সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায়। সারা পৃথিবী জুড়েই যে ব্যান্ডেড আয়রন ফর্মেশন দেখতে পাওয়া যায়, তার থেকে বোঝা যায় কী পরিমাণ লোহা তখন মহাসাগরে দ্রবীভূত অবস্থায় ছিল – অক্সিজেনের মাত্রা যখন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, শত শত কোটি টন লোহা তখন মরিচা রূপে সাগরজলে অধঃক্ষিপ্ত হয়।
রাসেলের মতে এর মর্মকথা হচ্ছে, অ্যালকালাইন ভেন্ট এবং সে সময়ের সাগরের মিথষ্ক্রিয়া ছিল আদি জৈবরসায়নের পক্ষে এখনকার তুলনায় অনেক বেশি অনুকূল। বিশেষত, ভেন্টগুলোতে আয়রন-সালফার খনিজের বুদ্বুদ তৈরি হয় যাদের চমৎকার অনুঘটকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। এটা কোন অনুমান নয়। রাসেল এরকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেক প্রাচীন ভেন্ট খুঁজে পেয়েছেন, এমনকি পরীক্ষাগারেও তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
এই অ্যালকালাইন ভেন্টগুলোতে যে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতির প্রকোষ্ঠ রয়েছে, ঠিক এ ব্যাপারটিই মার্টিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ প্রকোষ্ঠগুলোই হয়ত জৈব কোষপ্রাচীরের পূর্বসুরি ছিল, যেমনটা তিনি খুঁজছিলেন। এগুলোর কাজ ছিল অনেকটা ছাঁচের মতন, যার ভেতরে কোষের উপাদানগুলো তৈরি হতে পারে। মার্টিন ও রাসেল একসঙ্গে দেখিয়েছেন যে ঠিক একইরকম আয়রন-সালফার খনিজ আর্কিয়া ও ব্যাক্টেরিয়ার প্রোটিনের মধ্যেও বিদ্যমান, যেমন – মিথানোজেন ও অ্যাসিটোজেন, যেগুলো দ্বারা এরা কার্বন ডাইঅক্সাইডকে শর্করায় রূপান্তরিত করে (হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে)।
ভেন্টের মধ্যকার তরলে এছাড়া নাইট্রোজেন যৌগ যেমন- অ্যামোনিয়াও ছিল এবং এর পরিবেশও ছিল প্রোটিনের গাঠনিক একক অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরির সহায়ক।
এখানেই শেষ নয়। ফসফেটের উপস্থিতিতে খনিজ পদার্থগুলো অনুঘটক হিসেবে তৈরি করে নিউক্লিওটাইড – আরএনএ ও ডিএনএ-এর গাঠনিক একক। এবং খনিজের অনুঘটনে যদি নিউক্লিওটাইড তৈরি হয়েই থাকে, তবে সে সময় অ্যালকালাইন ভেন্টের রন্ধ্রগুলোতে আরও একটা অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল।
মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির ডিয়েটার ব্রাউনের দল সিমুলেশনে দেখিয়েছেন যে রন্ধ্রের উপর ও নিচের মধ্যকার তাপমাত্রার গ্রেডিয়েন্টের ফলে এর এক প্রান্তে নিউক্লিওটাইড জমা হতে থাকে এবং এভাবে অনুগুলো যুক্ত হয়ে তৈরি করে আরএনএ ও ডিএনএ-এর সূত্রক। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এই অনুগুলো এরপর ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে এমনকি আরও বড় হতে পারে। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, পরিচলন স্রোতের ফলে এখানকার তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত ওঠা-নামা করতে পারে – ঠিক যেভাবে সারা দুনিয়ার পরীক্ষাগারগুলোতে ডিএনএ তৈরি করা হয়ে থাকে।
আরএনএ-এর জগৎ
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জ্যাক শসট্যাকের নেতৃত্বে গবেষণাগারে পরিচালিত কিছু পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় এ বছরের শুরুর দিকে। তাঁরা নিশ্চিত করেছেন এ ধরনের পরিবেশে সত্যিই নিউক্লিওটাইড এবং নিউক্লিয়িক অ্যাসিড ঘণীভূত হয়। গবেষকদের এ দলটি আরো দেখেছেন যে ফ্যাটি অ্যাসিড ঘণীভূত হয়ে রন্ধ্রের ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোষসদৃশ বুদ্বুদ তৈরি করে।
সরল জৈব যৌগ এবং জটিল ডিএনএ ও প্রোটিনের সংযোগসাধনকারী আরএনএ জগতের জন্য এর চাইতে উৎকৃষ্ট আর কোন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা কঠিন। সুতরাং, সুপ্রাচীন অ্যালকালাইন হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলোই যে প্রাণের সূতিকাগার, সে ধারণা খুবই যুক্তিসঙ্গত। এমনকি এদের সবচেয়ে চমকপ্রদ যে বৈশিষ্ট্য – রেডিমেইড প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট – সেটাকে গোনায় না ধরেও এ কথা বলা চলে।
অতীতে সাগর ছিল অম্লীয়, এবং অম্লত্ব সংজ্ঞায়িত হয় মূলত প্রোটনের ভিত্তিতে – বস্তুত অম্ল আসলে এদের দ্বারাই পরিপূর্ণ। রাসেল বলেন, “অম্লীয় মহাসাগরে বুদ্বুদ তোলা ক্ষারীয় তরল থেকে অজৈব ঝিল্লীর ভেতরে তৈরি হয় প্রোটন গ্রেডিয়েন্টসমৃদ্ধ অনুঘটক খনিজ ‘কোষ’। ওদের গঠন ছিল ঠিক এ যুগের কোষেদের মতোই।”
কিছু গবেষক রাসেলের এই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কেমিঅসমোটিক “কোষের” ধারণাকে তুচ্ছ কৌতূহলের ছুতোয় খারিজ করে দিতে চান। তাঁদের মতে প্রাণের উৎপত্তির সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু যখন মার্টিন ও রাসেল সরলতম প্রোক্যারিওটদের বায়োএনার্জেটিক্সকে বিবেচনায় আনেন, দেখা গেল কেমিঅসমোসিস আয়ত্ত না করে প্রথম দিককার কোষেদের পক্ষে ভেন্ট ছেড়ে বের হওয়া সম্ভব ছিল না – মিচেলের বর্ণিত এই বিচিত্র প্রক্রিয়া কেন প্রাণের এত কেন্দ্রীয় ও সার্বজনীন এক বিষয়, তার ব্যাখ্যা মেলে এ থেকে।
মহাপরিত্রাণ
পৃথিবীতে প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের সুপ্রতুল প্রাচুর্য্য থাকা সত্ত্বেও কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে তাকে জৈব পদার্থে রূপান্তরিত করার উপায় আছে মাত্র পাঁচটি – যার মধ্যে মাত্র একটি ক্ষেত্রে জীবকে কোন বাড়তি খরচ করতে হয় না। সেটা হলো কার্বন ডাইঅক্সাইডের সঙ্গে হাইড্রোজেনের সরাসরি বিক্রিয়া। এ তাপোৎপাদী বিক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড সরল জৈব অনুতে রূপান্তরিত হয় এবং নির্গত হয় শক্তি। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ভিনগ্রহের প্রাণ ও এর অনুকূল পরিবেশ বিষয়ক বিজ্ঞানী (এক্সোবায়োলজিস্ট) এভারেট শক যেমনটা বলেছেন, এটা হলো কড়ি না ফেলেই আপনাকে তেল মাখতে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার। সাধারণত হাইড্রোজেন এমনি এমনিই ভূমি ফুঁড়ে উঠে আসে না, কিন্তু অ্যালকালাইন ভেন্টগুলোতে ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটে থাকে।
ভেন্টের ভেতরকার প্রাণ আবর্তিত হয়েছে হাইড্রোজেনের সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিক্রিয়াকে ঘিরে, কিন্তু এখানেই রয়েছে একটা বড় সমস্যাঃ এক্ষেত্রে বিক্রিয়া আরম্ভ করতে গেলে শুরুতেই কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়, যেখানে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ থাকে খুবই নগণ্য। জার্মানির মারবার্গে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর টেরেস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজিতে কর্মরত রল্ফ থাউয়ারের মতে, এর পরিমাণ এতই নগণ্য যে কেবল রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা ব্যাক্টেরিয়াদের পক্ষে বিকশিত হওয়া অসম্ভবঃ তাদের দরকার কেমিঅসমোসিসের প্রোটন-শক্তি।
ব্যাপারটা বুঝতে হলে এভাবে চিন্তা করুন – ধরুন ATP দ্বারা সঞ্চিত শক্তি হচ্ছে ১০ টাকার সমতুল্য। বিক্রিয়া আরম্ভ করতে যদি ১০ টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে বিক্রিয়া শেষে নির্গত হয় ১৫ টাকা। সে হিসেবে একটা কোষের আয় হচ্ছে ৫ টাকা। এখন, একটা কোষের শক্তি সঞ্চয় করার উপায় যদি কেবল ATP উৎপাদনই হয়, তাহলে এটি কেবল একটি অনুই তৈরি করতে পারবে; একইভাবে দুইটি নতুন ATP তৈরি করতে তার খরচ হবে ২০ টাকা। সুতরাং, একটি ATP থেকে কেবল একটিই ATP তৈরি হবে এবং বাকি ৫ টাকা তাপ হিসেবে অপচয় হবে। প্রাণ ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ভেন্টের ভেতরকার আদি-প্রাণের ক্ষেত্রে এটা কোন বিষয়ই না। ভেন্টের মধ্যকার তরলে নানারকম সক্রিয় অনু ছিল, যেমন- মিথাইল সালফাইড, যার থেকে তৈরি হতো অ্যাসিটাইল ফসফেট, এ যুগেও কিছু ব্যাক্টেরিয়া আছে যারা ATP এর বদলে একে ব্যবহার করে। আরও বড় কথা হচ্ছে, প্রাকৃতিক প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট এই শক্তি-উৎসের সম্পূরকরূপে স্বতঃস্ফুর্তভাবে তৈরি করেছিল ATP-এর আরেকটা আদি রূপ – পাইরোফসফেট।
পাইরোফসফেটের প্রকৃতি অনেকটা ATP-এর মতোই এবং অনেক ব্যাক্টেরিয়া ও আর্কিয়া আছে যারা ATP-এর পাশাপাশি একেও ব্যবহার করে থাকে। পাইরোফসফাটেজ নামের একটা সরল এনজাইম ব্যবহার করে ব্যাক্টেরিয়াগুলো এর উৎপাদন ত্বরান্বিত করে। শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাওয়া ফ্রান্সের মার্সেইতে অবস্থিত ইন্সটিটিউট অভ স্ট্রাকচারাল বায়োলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজিতে কর্মরত উল্ফগ্যাং নিটশ্কের সঙ্গে পরিচালিত এক গবেষণায় রাসেল দেখিয়েছেন যে এ যাবৎ পরিচিত সবচেয়ে আদিম কিছু কোষের মধ্যে এই এনজাইম খুঁজে পাওয়া যায়, ব্যাক্টেরিয়া-আর্কিয়া বিভাজনের দুই পাশেই – বয়সের হিসেবে যাদের জন্ম সৃষ্টির ঠিক শুরুতেই।
অর্থাৎ, সমস্ত প্রাণের যে সাধারণ পূর্বপুরুষ, সেটি শক্তি উৎপাদন করতো প্রাচীন ভেন্টের প্রাকৃতিক প্রোটন গ্রেডিয়েন্টকে ব্যবহার করে। এই ভেন্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে এরপর মাত্র একটি পদক্ষেপই দরকার ছিল – শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়াটিকে উল্টো করে দেয়া।
কেমিঅসমোসিসের কল্যাণে কোষ সামান্য পরিমাণ শক্তিও – ধরুন ঐ ৫ টাকা – সঞ্চয় করে রাখতে পারে, অন্যথায় যেটি হেলায় নষ্ট হতো। একই রাসায়নিক বিক্রিয়া এভাবে বারবার সংঘটিত হতে পারে, প্রতিবার ঝিল্লীর মধ্য দিয়ে একটু একটু করে প্রোটন উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। কিছু কেনার জন্য আমরা যেভাবে একটু একটু করে সঞ্চয় করি, ঠিক সেভাবে প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট একসময় একটি পাইরোফসফেট বা ATP তৈরির জন্য যথেষ্ট আকার ধারণ করে। এর ফলে কোষগুলো বিকশিত হয় এবং একসময় ভেন্টের নাগপাশ ছিঁড়ে মুক্ত হয়।
বাস্তবিকই প্রতীয়মান হয় যে, মিচেলের অদ্ভূত ধারণাই প্রাণ সৃষ্টির অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কেমিঅসমোসিস ছাড়াই কেবল শর্করা ভেঙে পাওয়া শক্তি কোষের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট, তথাপি, গ্লাইকোলাইসিস নামক এ প্রক্রিয়ায় জটিল সব পাথওয়ে এবং প্রচুর পরিমাণ শর্করার প্রয়োজন পড়ে, যার কারণে প্রথম প্রাণের ক্ষেত্রে এটি শক্তির প্রধান উৎস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
রাসেল ও মার্টিনের আঁকা এ চিত্রপট সত্যিই চমকপ্রদঃ প্রাণিজগতের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ মুক্তভাবে বিচরণকারী কোন স্বাধীন কোষ ছিল না, বরং এটি ছিল আদি জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটকরূপে কাজ করা বুদবুদের মতো আয়রন-সালফার ঝিল্লীর গোলকধাঁধায় পূর্ণ রন্ধ্রযুক্ত এক শিলা। হাইড্রোজেন ও প্রোটন গ্রেডিয়েন্টের শক্তিতে চালিত, জৈব পদার্থে ভরপুর এই প্রাকৃতিক প্রবাহ চুল্লী জন্ম দেয় আদি-প্রাণ, যার থেকে উদ্ভূত হয় প্রথম জীবিত কোষ – তাও একবার নয়, দু’বার, জন্ম নেয় ব্যাক্টেরিয়া ও আর্কিয়া।
অনেক ব্যাপারেই আমরা এখনো বিশদ জানি না, এমনকি কোনরকম সন্দেহের ঊর্ধ্বেও হয়ত কখনো প্রমাণ করা সম্ভব হবে না যে, প্রাণ ঠিক এ প্রক্রিয়াতেই বিবর্তিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এ ধারণার স্বপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। পৃথিবীর সমগ্র প্রাণিজগতের জ্ঞাত বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে এ দৃশ্যপট যেমন মানানসই, তেমনি সম্ভাব্যতার নিরীখেও খুবই যুক্তিসঙ্গত – এবং তা মিচেলের অসামান্য তত্ত্বটিকে জীববিজ্ঞানের ঠিক কেন্দ্রে তার ন্যায্য অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে।
পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির দশটি ধাপ
প্রাণ যদি অ্যালকালাইন হাইড্রোথার্মাল ভেন্টেই বিবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে খুব সম্ভবত এটি নিম্নোক্তভাবে ঘটেছিলঃ
১. সমুদ্র তলদেশের সদ্যসৃষ্ট শিলায় পানি চুঁইয়ে প্রবেশ করে, যেখানে এটি খনিজ, যেমন – অলিভিনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় অংশ নেয় এবং উৎপন্ন করে হাইড্রোজেনপূর্ণ উষ্ণ ক্ষারীয় তরল, সালফাইড এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান। হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট থেকে এ উষ্ণ তরল নিঃসৃত হয়।
২. অতীতে মহাসাগর ছিল অম্লীয় এবং দ্রবীভূত আয়রনে ভরপুর। নিঃসৃত হাইড্রোথার্মাল তরল যখন এই সাগরজলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন এ থেকে তৈরি হয় অতিক্ষুদ্র রন্ধ্রসমৃদ্ধ কার্বনেট শিলা এবং আয়রন-সালফারযুক্ত বুদ্বুদের ‘ফেনা’।
৩. এই বুদ্বুদের ভেতরে হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় সরল জৈব অনু, যেমন- মিথেন, ফরমেট ও অ্যাসিটেট। কিছু বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এই আয়রন-সালফার খনিজ যেটাকে এ যুগেও অনেক প্রোটিনের কেন্দ্রস্থলে দেখতে পাওয়া যায়।
৪. অ্যালকালাইন ভেন্টের তরল ও অম্লীয় সাগরজলের মাঝখানে যে তাড়িৎরাসায়নিক গ্রেডিয়েন্ট তৈরি হয়, তার থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অ্যাসিটাইল ফসফেট ও পাইরোফসফেট উৎপন্ন হয়। এরা ঠিক ATP-এর মতোই, জীবিত কোষের শক্তির যোগান দেয়াই যে রাসায়নিকের কাজ।
৫. ভেন্টের রন্ধ্রে তাপীয় স্রোতের দ্বারা অপেক্ষাকৃত বড় অনু, যেমন- নিউক্লিওটাইড ঘণীভূত হয়, যার থেকে গঠিত হয় আরএনএ ও ডিএনএ – নিশ্চিত করে আরএনএ জগৎ এবং এ থেকে ডিএনএ ও প্রোটিনের জগতে বিবর্তনের আদর্শ পরিবেশ।
৬. স্নেহজাতীয় অনুগুলো আয়রন-সালফারের ফেনার চারিদিকে আবরণ তৈরি করে এবং গঠন করে কোষসদৃশ বুদ্বুদ। এ বুদ্বুদের কোন কোনটির ভেতর তৈরি হয় আত্ম-প্রতিরূপ সৃষ্টিকারী অনুর সমষ্টি – প্রথম জৈব কোষ। অবশ্য প্রথম দিককার আদি-কোষগুলো সম্ভবত কিছুটা অধরা প্রকৃতির ছিল, এরা ভেন্টের মধ্যেই মিলিয়ে যেত, আবার পুনর্গঠিত হতো।
৭. পাইরোফসফেট তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করা এনজাইম পাইরোফসফাটেজের বিবর্তনের ফলে আদিকোষগুলো অ্যালকালাইন ভেন্টের তরল ও অম্লীয় মহাসাগরের মধ্যকার গ্রেডিয়েন্ট থেকে শক্তি আহরণ করার ক্ষমতা লাভ করে। অনেক ব্যাক্টেরিয়া ও আর্কিয়ার মধ্যেই এ এনজাইম এখনো দেখতে পাওয়া যায়।
৮. কিছু আদিকোষ অ্যাসিটাইল ফসফেট ও পাইরোফসফেটের সঙ্গে সঙ্গে ATP-ও ব্যবহার করতে শুরু করে। ATP সিনথেজ নামক এনজাইমের বিবর্তনের সাথে সাথে তাড়িৎরাসায়নিক গ্রেডিয়েন্ট থেকে শক্তি নিয়ে ATP-এর উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও নিখুঁত হয়ে ওঠে। আজকের সমস্ত প্রাণিজগতেই একে দেখতে পাওয়া যায়।
৯. ভেন্টের মূল অক্ষ থেকে দূরে যেখানে প্রাকৃতিক তাড়িৎরাসায়নিক গ্রেডিয়েন্ট অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সেখানে অবস্থিত আদিকোষগুলো নিজেদের স্বতন্ত্র গ্রেডিয়েন্ট থেকে ATP উৎপাদন শুরু করে।
১০. আদিকোষগুলো যখন তাদের নিজেদের তাড়িৎরাসায়নিক গ্রেডিয়েন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়ে ওঠে, সে মুহূর্তেই ভেন্টের সঙ্গে তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কোষগুলোর ভেন্ট থেকে বের হয়ে আসার এ ঘটনাটি দুইবার ঘটে, এক ক্ষেত্রে জন্ম নেয় ব্যাক্টেরিয়া এবং অন্য ক্ষেত্রে আর্কিয়া।
মূলঃ নিক লেন, ‘দ্যা ক্রেড্ল অভ লাইফ‘,
১৭ অক্টোবর, ২০০৯ তারিখে নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত