অন্য যে জগত হাতছানি দেয়

মূল রচনা The Other World That Beckons
লেখক— কার্ল সেগান

“কর্তৃত্বের প্রতি আমার অবজ্ঞার কারণে আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়তি খোদ আমাকেই কর্তৃত্বে পরিণত করেছে।” —আইনস্টাইন

আলবার্ট আইনস্টাইন ঠিক এক শতাব্দী আগে ১৮৭৯ সালে জার্মানির উল্‌মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে কোনো কালের অল্প সংখ্যক প্রতিভাধর মানুষের মধ্যে অন্যতম যিনি গতানুগতিক বিজ্ঞতার প্রতি নিগূঢ় আপত্তি জানানোর জন্য পুরাতন জিনিসকে নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমে বিশ্বকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। বহু দশক ধরে তিনি ছিলেন একজন সাত্ত্বিক ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, একমাত্র বিজ্ঞানী যার নাম সাধারণত মানুষ তৎক্ষণাৎ বলতে পারতো। কিছু মাত্রায় অন্তত অস্পষ্টভাবে হলেও জনসাধারণের দ্বারা তাঁর বৈজ্ঞানিক দক্ষতাকে উপলব্ধি করার কারণে; কিছু মাত্রায় সামাজিক বিষয়ে তাঁর সাহসিকতাপূর্ণ অবস্থানের কারণে; এবং কিছু মাত্রায় সাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বের কারণে আইনস্টাইন সারা বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন। অভিবাসী বাবা-মায়ের বিজ্ঞানানুরাগী সন্তান হিসেবে, কিংবা আমার মতোই মহামন্দার সময়ে বেড়ে ওঠা আইনস্টাইনের অর্জিত শ্রদ্ধা প্রমাণ করে যে, এমন বিজ্ঞানীর জন্য বৈজ্ঞানিক পেশা একেবারে আশাতীত ছিলো না। একজন বৈজ্ঞানিক রোল মডেল হিসেবে তিনি অবচেতনভাবে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আইনস্টাইন না থাকলে ১৯২০ সালের পরবর্তী সময়ের নবীন বিজ্ঞানীরা হয়ত বৈজ্ঞানিক কর্মোদ্যোগের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেই পারতেন না। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের যুক্তি আরো একশ বছর আগে বিকশিত হতে পারতো; কিন্তু অনেকের পূর্বাভাসসূচক অন্তর্দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও আপেক্ষিকতাবাদকে আইনস্টাইনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছে। তথাপি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের পদার্থবিদ্যা মৌলিকভাবে খুবই সহজ; আর দরকারী ফলাফলের অনেকগুলো হাই স্কুলের বীজগণিত দিয়ে এবং স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে নৌকার বৈঠা চালানোর গণনা থেকে প্রতিপাদন করা যায়। প্রতিভা ও শ্লেষ, তাঁর সময়ের বিচার্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগ, শিক্ষার প্রতি সম্যক দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতির মধ্যে সংযোগ এবং মোটের ওপর ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে আইনস্টাইনের জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

শৈশবে আইনস্টাইন তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অল্পই আভাস দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন,

“আমার বাবা-মা চিন্তিত ছিলেন কারণ আমি তুলনামূলভাবে দেরিতে কথা বলতে শুরু করেছিলাম, এবং এ জন্য তাঁরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমার বয়স তখন কম করে হলেও তিন তো হবেই!”

তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষকদের কথা স্মরণ করলে ড্রিল সার্জেন্টদের কথা মনে পড়ে যেতো তাঁর। আইনস্টাইনের যৌবনকালে বাগাড়ম্বরপূর্ণ জাতীয়তাবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনমনীয়তা ছিলো ইউরোপীয় শিক্ষার পরিচায়ক। তিনি শিক্ষার প্রাণহীন, যান্ত্রিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন। “মুখস্থ করে বকবক করার চেয়ে আমি সব ধরনের শাস্তি সহ্য করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম।” আইনস্টাইন সবসময় শিক্ষায়, বিজ্ঞানে ও রাজনীতিতে কঠোর নিয়মানুবর্তী লোকদের দারুণ অপছন্দ করতেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি একটি কম্পাসের রহস্য দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন। পরে তিনি আরো লিখেছিলেন,

“১২ বছর বয়সে আমি ইউক্লিডীয় সমতল জ্যামিতির একটি ছোট বইতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দ্বিতীয় বিস্ময়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম…এখানে কিছু প্রমাণ ছিলো, যেমন কোনো একটি ত্রিভুজের লম্বত্রয়ের একটি বিন্দুতে প্রতিচ্ছেদ সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চয়তার সাথে প্রমাণ করা যায়, যদিও এটি কোনোমতেই দৃষ্টিলব্ধ হয় না। এই স্বচ্ছতা ও নিশ্চয়তা আমার ওপর অবর্ণনীয় প্রভাব ফেলেছিলো।”

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান এমন গভীর চিন্তায় কেবল অসন্তোষজনক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো। আইনস্টাইন তাঁর স্বশিক্ষা সম্বন্ধে লিখেছেন,

“১২ থেকে ১৬ বছর বয়সে আমি ডিফারেন্সিশাল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের মূলনীতিসহ গণিতের উপাদানগুলোর সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলাম। এটি করতে গিয়ে আমার সেসব বই খোঁজার সৌভাগ্য হয়েছিলো যেগুলো কেবল যৌক্তিক কাঠিন্যে খুব যথাযথ ছিলো না, তথাপি মূল চিন্তাগুলোকে পরিষ্কারভাবে ও সারাংশরূপে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়েছে…চমৎকার নন্দিত বর্ণনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমগ্র ক্ষেত্রের দরকারী ফলাফল ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিলো, যেগুলো প্রায় গুণগত দৃষ্টিভঙ্গির সর্বত্র জুড়ে সীমাবদ্ধ…এই কাজ আমি রুদ্ধশ্বাস মনোযোগ সহকারে পড়েছিলাম।”

অধুনা বিজ্ঞানের জনপ্রিয়কারীরা স্বস্তি পেতে পারেন। আইনস্টাইনের কোনো শিক্ষক তাঁর প্রতিভাকে ঠাহর করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। মিউনিখ শহরের নেতৃস্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিউনিখ জিমনেসিয়ামের এক শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি কখনোই কোনো কিছুকে পূর্ণতা দিতে পারবে না, আইনস্টাইন।” আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৫ বছর তখন এক শিক্ষক তাঁকে স্কুল ছাড়ার জন্য জোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, “তোমার উপস্থিতি আমার প্রতি ক্লাসের সম্মানকে নষ্ট করে দেয়।” আইনস্টাইন এই পরামর্শকে সাগ্রহে গ্রহণ করে ইতালির উত্তরাঞ্চলে কয়েক মাস উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আইনস্টাইনের কৌতূহল ও নৈসর্গিক মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর বিস্ময় দ্রুতই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণাকে পরাস্ত করে এবং মাধ্যমিক স্কুলের ডিপ্লোমা ছাড়াই সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হয়েছিলেন। ফলে তাঁর ঘাটতি মেটাবার জন্য তিনি একটি সুইস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত হন এবং পরের বছর ফেডারেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। কিন্তু তখনও তিনি মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। নির্দেশিত পাঠ্যক্রমে তিনি বিরক্ত হয়ে যেতেন ও নিজের প্রকৃত কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য লেকচার রুম এড়িয়ে চলতেন। তিনি পরে লিখেছেন, “স্বভাবত এখানে বাধা ছিলো, পছন্দ করলে কিংবা না করলেও পরীক্ষার জন্য এই সমস্ত জিনিস মুখস্থ করতে হতো।”

তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান একাগ্র হয়ে ক্লাসে হাজির থাকতেন এবং আইনস্টাইনের সাথে নোট শেয়ার করতেন যে কারণে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। বহু বছর পরে গ্রসম্যানের মৃত্যুতে আইনস্টাইন লিখেছেন,

“আমাদের ছাত্র জীবনের কথা আমার মনে পড়ে। সে ছিলো নিখুঁত ছাত্র, আমি ছিলাম অগোছালো ও স্বাপ্নিক। শিক্ষকদের সাথে সখ্যতা ও সব কিছুর বোঝাপড়ায় সে ছিলো ভালো, আমি ছিলাম অন্ত্যজ, অতৃপ্ত ও অল্প প্রিয়। …তারপর আমাদের পড়াশোনার শেষে– জীবনের প্রারম্ভে খেই হারিয়ে ফেলে হঠাৎ সবার কাছে আমি অপাঙক্তেয় হয়ে গেলাম।”

গ্রসম্যানের নোটে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে আইনস্টাইন কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ফাইনাল পরীক্ষার পড়াশোনার

“এমন একটি ভীতিকর প্রভাব আমার ওপর ছিলো যে…পুরো এক বছর ধরে কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যার চিন্তাকে আমার কাছে অরুচিকর মনে হতো। …শিক্ষাদানের আধুনিক পদ্ধতি যে ইতোমধ্যে অনুসন্ধানের পবিত্র কৌতূহলকে পুরোপুরিভাবে স্তব্ধ করে দেয়নি সেটা অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, কারণ প্রারম্ভিক উদ্দীপনা বাদেও এই পলকা ছোট্ট গাছটির জন্য দরকারি স্বাধীনতা ছাড়া তা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। …আমি বিশ্বাস করি, ক্ষুধার্ত থাকুক কিংবা না থাকুক, একটি স্বাস্থ্যবান শিকারী পশুকে চাবুক মেরে বিরামহীনভাবে খেতে বাধ্য করা গেলে তাকে তার লোভ থেকে বঞ্চিত করা যায়।”

আমরা যারা বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত আছি, তাঁর এই মন্তব্য তাদের ভাবনার খোরাক যোগায়। পাঠ্যক্রম ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা জোর করে গেলানোর মাধ্যমে কত প্রতিভাধর আইনস্টাইনকে যে স্থায়ীভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই।

নৈমিত্তিক কাজ করে নিজের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে এবং আকাঙ্ক্ষিত পদগুলোতে উপেক্ষিত হবার পর মার্সেল গ্রসম্যানের বাবার হস্তক্ষেপে আইনস্টাইন বার্নে অবস্থিত সুইস পেটেন্ট অফিসে আবেদনপত্রের পরীক্ষক হবার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রায় একই সময়ে তিনি তাঁর জার্মান জাতীয়তা ত্যাগ করে সুইস নাগরিক হন। তিন বছর পর ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমিকাকে বিয়ে করেন।

তাঁর অন্যতম জীবনীকার ব্যানেশ হফম্যান লিখেছেন, পেটেন্ট অফিসে আইনস্টাইন “তাঁর দৈনন্দিন কাজগুলো দ্রুত দক্ষতার সাথে শিখেছিলেন যার ফলে তিনি তাঁর নিজের গোপনীয় হিসাবের জন্য মূল্যবান কিছু সময় বের করতে পেরেছিলেন, যা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলে তিনি অপরাধীর মতো ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতেন।” এমনই ছিলো মহান আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের জন্মকে ঘিরে পারিপার্শ্বিক অবস্থা। কিন্তু আইনস্টাইন পরবর্তীতে স্মৃতিকাতর হয়ে বলেছেন, পেটেন্ট অফিসটি “সেই নির্জন সাংসারিক স্থান যেখানে আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর ধারণাগুলোকে সৃষ্টি করেছিলাম।” তিনি তাঁর সহকর্মীদের অনেকবার বলেছেন যে, একজন বিজ্ঞানীর জন্য বাতিঘর রক্ষকের পেশা একটি উপযুক্ত স্থান হতে পারে কারণ কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় গভীর চিন্তার সুযোগ করে দিতে সক্ষম। তাঁর সহকর্মী লিওপোল্ড ইনফেল্ড বলেছেন,

“একাকীত্ব, বাতিঘরের জীবন আইনস্টাইনের জন্য সবচেয়ে উদ্দীপনাময় হতো যা তাঁকে অনেক বিরক্তিকর দায়িত্ব মুক্তি দিতে পারতো। আসলে এটিই হতো তাঁর জন্য আদর্শ জীবন। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক বিজ্ঞানী এর বিপরীতটা চিন্তা করেন। এটি আমার জীবনের অভিশাপ যে দীর্ঘ সময় ধরে আমি বৈজ্ঞানিক হালচালে ছিলাম না, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার মতো কাউকে আমি পাইনি।”

আইনস্টাইন এও বিশ্বাস করতেন যে, পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়ে টাকা কামানোর মধ্যে অসাধুতা আছে। তিনি যুক্তি সহকারে বলেছেন, অন্য কোনো সাধারণ ও সৎ শ্রমের মাধ্যমে নিজের ভরণপোষণ করা এবং অবসর সময়ে পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করা একজন পদার্থবিজ্ঞানীর জন্য ঢের ভালো। অনেক বছর পরে আমেরিকায় একই কথা বলার সময় আইনস্টাইন আনমনা হয়ে বলেছিলেন, তিনি প্লাম্বার হতে পছন্দ করতেন এবং অনতিবিলম্বে প্লাম্বার ইউনিয়নের সাম্মানিক সদস্যের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন।

সুইস পেটেন্ট অফিসে তাঁর অবসর সময়ের কাজের ফসল হিসেবে আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে জার্মানির নেতৃস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞান সাময়িকী Annalen der Physik এ চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। প্রথমটিতে প্রমাণ করা হয়েছে যে আলোর কণার পাশাপাশি তরঙ্গ ধর্ম আছে, এবং আগেকার বিভ্রান্তিকর আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেখানে কঠিন পদার্থ আলো দ্বারা উদ্ভাসিত হলে তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। দ্বিতীয়টিতে বাধাপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রাকৃতি কণার সাংখ্যিক “ব্রাউনীয় গতি” ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে অণুর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থটিতে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে এবং প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিলো বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণ যা খুব সচরাচর উদ্ধৃত হয় ও খুব কমই উপলব্ধ হয়।

এই সমীকরণ প্রকাশ করে যে পদার্থকে শক্তিতে ও বিপরীতভাবে শক্তিকে পদার্থে রূপান্তরিত করা যায়। শক্তি ও ভরকে কখনো সৃষ্টি ও ধ্বংস করা যায় না— যদিও শক্তি অথবা পদার্থের এক রূপকে অন্য রূপে রূপান্তরিত করা যায়, যাকে বিবৃত করার মাধ্যমে এটি শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিকে শক্তি ও ভরের সংরক্ষণশীলতা নীতিতে বিস্তৃত করা যায়। এই সমীকরণে শক্তি E হলো ভর m এর সমানুপাতিক। আদর্শ পরিস্থিতিতে ভর m থেকে mc পরিমাণ শক্তি নিষ্কাশিত করা যায়, যেখানে c হলো আলোর বেগ যা প্রতি সেকেন্ডে ৩০ বিলিয়ন সেন্টিমিটার। আলোর বেগকে কখনো বড় হাতের অক্ষর দিয়ে প্রকাশ না করে ছোট হাতের c দিয়ে প্রকাশ করা হয়। m-কে গ্রাম ও c-কে সেন্টিমিটার/সেকেন্ড দ্বারা পরিমাপ করা হলে E-কে শক্তির একক erg দ্বারা পরিমাপ করা হয়ে থাকে। এক গ্রাম ভরকে সম্পূর্ণরূপে erg-তে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় 1 x (3 x 1010)2 = 9 x 1020 ergs যা মোটামুটিভাবে এক হাজার টন টিএনটি (TNT)-র বিস্ফোরণের সমতুল্য। এভাবে অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ পদার্থে বিপুল শক্তি মজুদ থাকে, যদি শক্তি নিষ্কাশন করার উপায় আমাদের জানা থাকে। পারমাণবিক অস্ত্র ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে আইনস্টাইনের দেখানো শক্তিকে নিষ্কাশিত করার উদ্দেশ্যে আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত ও নীতিগতভাবে সন্দিগ্ধ প্রচেষ্টার সাধারণ পার্থিব দৃষ্টান্ত। একটি তাপ-পারমাণবিক অস্ত্র তথা একটি হাইড্রোজেন বোমা, m ভরের হাইড্রোজেন থেকে এক শতাংশেরও কম mc2 নিষ্কাশন করতে সক্ষম।

১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের চারটি গবেষণাপত্র একজন পদার্থবিজ্ঞানীর সারা জীবনের পুরো গবেষণাকর্মের চিত্তাকর্ষক ফসল। ২৬ বছর বয়সের একজন সুইস পেটেন্ট কেরানির এক বছরব্যাপী অতিরিক্ত সময়ের কাজ হিসেবে এটি সত্যি বিস্ময়কর। বিজ্ঞানের অনেক ইতিহাসবিদ ১৯০৫ সালকে annus mirabilis বা অলৌকিক বছর হিসেবে অভিহিত করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর আগে কেবল এমন আরেকটি বছর ছিলো: ১৬৬৬ সাল যখন ২৪ বছর বয়সী আইজ্যাক নিউটন বাধ্য হয়ে গ্রামে অন্তরীণ (বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে) থেকে সূর্যালোকের বর্ণালীগত (spectral) প্রকৃতির ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, ডিফারেন্সিয়াল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন এবং মাধ্যাকর্ষণের সর্বজনীন তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯১৫ সালে প্রথমবারের মতো সূত্রবদ্ধ হওয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব এবং ১৯০৫ সালের গবেষণাপত্রগুলো আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক জীবনের প্রধান কাজকে চিত্রিত করে। আইনস্টাইনের আগে পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত বিশেষ সুবিধাজনক প্রসঙ্গ কাঠামো (frames of reference), যেমন পরম স্থান ও পরম কালের উপস্থিতিকে ধরে নিতেন। আইনস্টাইনের শুরুটা ছিলো যে, সকল প্রসঙ্গ কাঠামো—স্থান, গতি ও ত্বরণ নির্বিশেষে সকল পর্যবেক্ষক—একই ভাবে প্রকৃতির মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলবে। প্রসঙ্গ কাঠামো নিয়ে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত ১৯ শতকের শেষ দিকে জার্মানিতে সোচ্চার জাতীয়তাবাদ ও উগ্র দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান এবং তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয়। আপেক্ষিকতাবাদ সেই অর্থে বহুল ব্যবহৃত নৃ-তাত্ত্বিক পরিভাষায় পরিণত হয়েছে এবং সমাজবিজ্ঞানীরা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের ধারণাকে গ্রহণ করেছেন: বিভিন্ন মানব সমাজ দ্বারা প্রকাশিত বিবিধ সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্ববীক্ষা, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন বিদ্যমান আছে এবং এগুলোর তুলনীয় ন্যায্যতা আছে।

প্রথম দিকে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে প্রশ্নাতীতভাবে সাধারণত স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আইনস্টাইন তাঁর কাজের প্রমাণ হিসেবে ইতিপূর্বে প্রকাশিত আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণাপত্রটি সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে আরো একবার শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা চালান। তিনি একে স্পষ্টভাবে একটি সার্থক গবেষণা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। একে দুর্বোধ্য বলে অগ্রাহ্য করা হয় এবং আইনস্টাইন ১৯০৯ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট অফিসে কর্মরত থাকেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশিত কাজগুলো আর অগোচরে থাকেনি। আইনস্টাইন সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী হতে পারেন এমন সম্ভাবনার কথা কয়েকজন ইউরোপীয় পদার্থবিজ্ঞানী ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। এরপরও আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে তাঁর কাজ বিতর্কিত ছিলো। একজন নেতৃস্থানীয় জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী একটি চিঠিতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পদে আইনস্টাইনের জন্য সুপারিশ করতে গিয়ে তাঁকে সত্যিকারের একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যদিও তিনি আপেক্ষিকতাবাদকে একটি প্রকল্পিত প্রমোদ ও ক্ষণিকের বিকার হিসেবে ইঙ্গিত করেছিলেন। (১৯২১ সালে প্রাচ্য ভ্রমণের সময় আইনস্টাইন আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ওপর লিখিত গবেষণাপত্র ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে অন্যান্য অবদানের জন্য তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ জানতে পারেন। তখনও আপেক্ষিকতাবাদকে এত বিতর্কিত মনে করা হতো যে একে বিশদভাবে উল্লেখ করা হতো না।)

ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাঁর বাবা-মা জাতিতে ইহুদী হলেও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতেন না। “ঐতিহ্যগত শিক্ষাযন্ত্র, রাষ্ট্র ও স্কুলের মাধ্যমে” আইনস্টাইন প্রথমে গতানুগতিক ধার্মিকতার সংস্পর্শে এসেছিলেন। তবে ১২ বছর বয়সে এর আকস্মিক সমাপ্তি  ঘটেছিলো:

“জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো পড়ে আমি অচিরেই বুঝতে পারলাম যে বাইবেলের অনেক গল্প  সত্য হতে পারে না। মিথ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুবকদেরকে প্রতারিত করার প্রভাবের পাশাপাশি নির্দিষ্টরূপে উগ্র যুক্তিবাদ ছিলো এর পরিণাম; এটি ছিলো এক হৃদয়বিদারক অনুভূতি। এই অভিজ্ঞতা থেকে সব ধরনের কর্তৃত্বের প্রতি সন্দেহ, যেকোনো সামাজিক পরিবেশে ক্রিয়াশীল বিশ্বাসের প্রতি এক ধরনের সংশয়ী মনোভাব গড়ে ওঠেছিলো—এই মনোভাব আর কখনো আমি ত্যাগ করিনি, যদিও পরে কার্যকারণ সংযোগের প্রতি আরো ভালো সূক্ষ্ম দৃষ্টির দরুন এর কিছু আসল তীব্রতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার ঠিক পূর্বে আইনস্টাইন বার্লিনস্থ সুবিখ্যাত কাইজার উইলহেলম ইনস্টিটিউটে প্রফেসরশিপের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। জার্মান সামরিকতন্ত্রের প্রতি বিরাগের তুলনায় তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের নেতৃস্থানীয় কেন্দ্রস্থলে থাকার অভিপ্রায় অল্প সময়ের জন্য আইনস্টাইনের মধ্যে প্রবলতর ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায় আইনস্টাইনের স্ত্রী ও দুই পুত্র সুইজারল্যান্ডে আটকা পড়ে যান, তাঁরা জার্মানিতে ফিরতে পারেননি। এই বাধ্যতামূলক বিচ্ছেদ কয়েক বছর পর তাদেরকে বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়; পুনরায় বিয়ে করার পরও আইনস্টাইন ১৯২১ সালে প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কারের পুরো ৫০,০০০ মার্কিন ডলার তাঁর প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের দান করেন। তাঁর প্রথম পুত্র পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন; দ্বিতীয় পুত্র আইনস্টাইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু ছোটকালে ত্যাগ করার কারণে পরবর্তী বছরগুলোতে তাঁকে দোষারোপ করে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছেন।

নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় প্রদানকারী আইনস্টাইন বুঝতে পারেন যে “শাসকশ্রেণী”র কুচক্রীপনা ও অযোগ্যতাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য বহুলাংশে দায়ী। অনেক সমকালীন ইতিহাসবিদ এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করে থাকেন। অন্য জার্মান বিজ্ঞানীরা যখন তাদের দেশের সামরিক অভিযানকে সল্লোসে সমর্থন করেছিলেন তখন আইনস্টাইন শান্তিবাদের পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। আইনস্টাইন যুদ্ধকে “একটি মহামারী মোহ” হিসেবে অভিহিত করে প্রকাশ্যে এর নিন্দা করেন। শুধুমাত্র সুইস নাগরিকত্ব থাকার কারণে তিনি কারাবরণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু একই সময়ে ও একই কারণে তাঁর বন্ধু দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে ইংল্যান্ডে কারাবরণ করতে হয়েছিলো। যুদ্ধ সম্পর্কে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জার্মানিতে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়নি।

যা-ই হোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরোক্ষভাবে আইনস্টাইনের নামকে অধিক পরিচিত করে তুলতে ভূমিকা রাখে। সারল্য, সৌন্দর্য ও শক্তিতে বিস্ময়জাগানিয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন এই প্রস্তাবের (proposition) বিশ্লেষণ করেছেন যে, দুটি ভরের নিকটবর্তী সাধারণ ইউক্লিডীয় স্থানের বিকৃতি সাধন ও বক্রীকরণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে মহাকর্ষজনিত আকর্ষণ ঘটে থাকে। যে সঠিকতার মাধ্যমে এই পরিমাণগত তত্ত্বটি পরীক্ষা করা হয়েছিলো, তার মাধ্যমে এটি নিউটনের সর্বজনীন মহাকর্ষ সূত্রকে পুনর্গঠন করেছিলো। কিন্তু পরবর্তী দশমিক স্থানে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিউটনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য অনুমান করেছিলো। বিজ্ঞানের ধ্রুপদী ঐতিহ্যে নতুন তত্ত্বগুলো পুরাতনগুলোর দ্বারা প্রমাণিত ফলাফলকে বজায় রাখে কিন্তু এক গুচ্ছ নতুন ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে দুটো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি নিষ্পত্তিমূলক পার্থক্য নির্দেশ করে। আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তিনটি পরীক্ষায় জড়িত ছিলো বুধ গ্রহের কক্ষপথের ঘূর্ণনে পূর্বের অনুসূর হতে গ্রহটির কৌণিক দূরত্ব, একটি বিশাল নক্ষত্রের বর্ণালী রেখার লোহিত অপসারণ (red shift), এবং সূর্যের নিকটবর্তী স্থানে নক্ষত্রের আলোর বেঁকে গিয়ে ভিন্ন পথে গমন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হবার আগে ব্রাজিলে ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে প্রিন্সিপ দ্বীপে পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নক্ষত্রের আলো ভিন্ন পথে সরে যায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ব্রিটিশ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিলো। নক্ষত্রের আলো ভিন্ন পথে সরে গিয়েছিলো; আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। দুটি দেশ যখন অদ্যাবধি যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলো তখন একজন জার্মান বিজ্ঞানীর কাজের সত্যতা প্রমাণের জন্য ব্রিটিশ অভিযানের প্রতীকতা জনসাধারণের শ্রেয়তর প্রবৃত্তিকে নাড়া দিয়েছিলো।

তবে একই সময়ে আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে জার্মানিতে প্রচুর অর্থায়নে একটি গণ-প্রচারাভিযান শুরু হয়। আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে বর্জন করার জন্য বার্লিন ও অন্যান্য স্থানে ইহুদী-বিরোধী গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। আইনস্টাইনের সহকর্মীরা এতে অবাক হন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাজনীতিতে এত ভীরু ছিলেন যে এই প্রচারাভিযানের বিরোধিতা করার সাহস তাদের ছিলো না। ১৯২০ এর দশকে ও ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে নাৎসীদের উত্থানের সময় আইনস্টাইন গভীর চিন্তার প্রতি তাঁর স্বভাবগত ঝোঁক থেকে বের হয়ে এসে প্রায়ই সাহসিকতার সাথে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে শুরু করেন। তিনি জার্মান আদালতে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। জার্মানিতে ও এর বাইরের রাজনৈতিক বন্দীদের (সাক্কো ও ভিজনেত্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্কটসবরো “বয়েজ” সহ) ক্ষমা প্রদানের জন্য তিনি আবেদন জানান। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর হবার পর আইনস্টাইন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে জার্মানি ছেড়ে চলে যান।

নাৎসীরা আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক কাজ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখকদের অন্যান্য বই জনসমক্ষে আগুন পুড়িয়ে ফেলে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক কীর্তির ওপর আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড যিনি তাঁর ভাষায় “আইনস্টাইনের গাণিতিকভাবে তালগোল পাকানো তত্ত্ব” এবং “বিজ্ঞানের এশীয় চেতনা”কে বর্জন করেছেন। তিনি আরো বলেছেন,

“আমাদের ফুয়েরার রাজনীতি ও জাতীয় অর্থনীতিতে এই একই চেতনাকে পরিহার করেছেন যা মার্ক্সবাদ নামে পরিচিত। এরপরও, আইনস্টাইনের ওপর অত্যধিক জোর আরোপ করার কারণে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে এই প্রভাব এখনো বজায় আছে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে একজন ইহুদীর বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসারী হওয়া একজন জার্মানের জন্য অশোভনীয় ব্যাপার। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যথাযথভাবে বললে, সম্পূর্ণরূপে আর্য-উদ্ভূত।… হাইল হিটলার!”

আইনস্টাইনের “ইহুদী” ও “বলশেভিক পদার্থবিজ্ঞান”-এর বিরোধিতায় অনেক নাৎসী স্কলার যোগ দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিখ্যাত স্টালিনবাদী বুদ্ধিজীবীরা আপেক্ষিকতাবাদকে “বুর্জোয়া পদার্থবিজ্ঞান” হিসেবে অভিহিত করে একে বর্জন করেন।

আইনস্টাইনের নিজের ইহুদী পরিচয়টি, ঐতিহ্যগত ধর্ম থেকে তাঁর অন্তর্নিহিত বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও, ১৯২০ এর দশকে জার্মানিতে ইহুদী-বিরোধী ডামাডোলের কারণে সামনে চলে আসে। এই কারণে তিনিও জায়নবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনীকার ফিলিপ ফ্রাঙ্কের মতে, সকল জায়নবাদী দল আইনস্টাইনকে স্বাগত জানায়নি কারণ তিনি বিজড়িত জটিল আবেগময় বিষয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের প্রতি অধিকতর প্রভাব বিস্তারকারী অনুরাগ হিসেবে– আরবদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে ও তাদের জীবনধারাকে বুঝার জন্য ইহুদীদের প্রচেষ্টার দাবি করেছিলেন। যাই হোক, জায়নবাদের প্রতি তিনি তাঁর সমর্থন অব্যাহত রাখেন, বিশেষ করে ১৯৩০ এর দশকে যখন ইউরোপীয় ইহুদীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্রোধ গোচরীভূত হতে শুরু করে। (১৯৪৮ সালে আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।)

জার্মানি ছাড়ার পর আইনস্টাইন জানতে পারেন যে নাৎসীরা তাঁর মাথার মূল্য ২০,০০০ মার্ক নির্ধারণ করেছে। (“এর দাম যে এত বেশি তা আমার জানা ছিলো না।”) তিনি নিউ জার্সির প্রিন্সটনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন যেখানে তিনি তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিকের পরিমাণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ৩,০০০ মার্কিন ডলারের প্রস্তাব দেন। ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধির মুখে বিস্ময়ের ছাপ দেখে তিনি ভেবেছিলেন যে বেশি চেয়ে ফেলেছেন এবং অপেক্ষাকৃত কম টাকার কথা বলেছিলেন। তাঁর পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিলো ১৬,০০০ মার্কিন ডলার, ১৯৩০ এর দশকে যা ছিলো অনেক টাকা।

আইনস্টাইনের মর্যাদা এত ঊর্ধ্বগামী ছিলো যে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে সম্ভাব্য জার্মান প্রচেষ্টাকে পেছনে ফেলার জন্য একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের কাছে চিঠি লেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য দেশান্তরিত ইউরোপীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা ১৯৩৯ সালে তাঁর দ্বারস্থ হন। যদিও আইনস্টাইন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করছিলেন না এবং পরবর্তীতে ম্যানহাটন প্রজেক্টে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিলো না, তবুও তিনি প্রারম্ভিক চিঠিটি লিখেছিলেন যা ম্যানহাটন প্রজেক্ট স্থাপনে পথ দেখিয়েছিলো। সম্ভবত, আর যাই হোক, আইনস্টাইনের আহ্বান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বোমা তৈরি করে ফেলতো। E=mc2 থাকা সত্ত্বেও বেকেরেল কর্তৃক তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার ও রাদারফোর্ড কর্তৃক পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের অনুসন্ধান— এগুলোর কোনোটিই আইনস্টাইনের মুখাপেক্ষী নয়— খুব  সম্ভবতঃ পারমাণবিক অস্ত্র বিকশিত করার পথ বাতলে দিতে পারতো। বহু দিন ধরে আইনস্টাইন নাৎসী জার্মানির যে আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করেন, সেই কারণে তিনি দুঃখের সাথে তাঁর শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু পরে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে নাৎসীদের অসমর্থ হবার কথা জানতে পেরে আইনস্টাইন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “আমি যদি জানতাম জার্মানরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সফল হবে না তাহলে বোমা নিয়ে কিছুই করতাম না।” ১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৫০ এর দশকের প্রথম দিকে ম্যাককার্থিজমের অন্ধকার সময়ে আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতার একজন জোরালো সমর্থক ছিলেন। হিস্টেরিয়ার উত্থিত জোয়ার প্রত্যক্ষ করার পর ১৯৩০ সালে জার্মানিতে একই রকম পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার অনুভূতি তাঁর মনে জেগে উঠেছিলো। তিনি হাউজের আন-আমেরিকান এক্টিভিটিজ কমিটিতে সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য সমর্থকদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের “কারাগার ও আর্থিক ক্ষতির জন্য…তাঁর দেশের স্বার্থে…তাঁর ব্যক্তিগত উন্নয়ন বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।” তিনি মনে করতেন যে “ব্যক্তিবিশেষের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এমন উদ্যোগে সহযোগিতা না করা একটি কর্তব্য। এটি বিশেষত নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সাথে জড়িত সকল তদন্তের ক্ষেত্রে খাটে…” এই অবস্থান নেওয়ার কারণে আইনস্টাইনকে পত্রিকায় ব্যাপক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিলো। আর ১৯৫৩ সালে সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থি এমন উপদেশ প্রদানকারী ব্যক্তিকে “স্বয়ং আমেরিকার শত্রু” অ্যাখ্যায়িত করে বিবৃতি দেন। প্রিন্সটনে অতিবাহিত বছরগুলোতে সবসময়ের মতো মননশীল জীবন নিয়ে আইনস্টাইনের গভীর আসক্তি ছিলো। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে একটি সাধারণ ভিত্তির ওপর সংযুক্ত করবে এমন একটি সম্মিলিত ক্ষেত্র তত্ত্বের ওপর তিনি দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর কাজ করেন; তবে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে সচরাচর বিবেচনা করা হয়। তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে সংঘবদ্ধভাবে বড় মাপের কাঠামো ও মহাবিশ্বের বিবর্তনকে বুঝার জন্য প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখে গিয়েছেন, এবং আজকের দিনে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সবল প্রয়োগ দেখতে পেলে আনন্দিত হতেন। তাঁকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধার সাথে অধিষ্ঠিত করা হতো তা কখনো তিনি বুঝে উঠতে পারেননি এবং আদপেই অনুযোগ করেছিলেন যে তাঁর সহকর্মীরা ও প্রিন্সটনের গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা তাঁকে বিরক্ত করার ভয়ে আগে থেকে না জানিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো না।

তবে তিনি লিখেছেন:

“নারী ও পুরুষের সাথে সরাসরি সম্বন্ধের প্রতি আমার ইচ্ছার ঘাটতি চোখে পড়ার মতো হলেও সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে আমার আবেগপূর্ণ আগ্রহ রয়েছে। আমি একমাত্র সাজ পরিহিত কোনো ঘোড়া নই যাকে ঘোড়ার গাড়ি ও দলগত কাজের জন্য আলাদা করা হয়েছে। আমি কখনো মনেপ্রাণে দেশ বা রাষ্ট্র, আমার বন্ধু মহল এবং এমনকি আমার নিজ পরিবারের অংশ ছিলাম না। এই সকল বন্ধন সবসময় এক ধরনের অস্পষ্ট নিঃসঙ্গতার সংসর্গে আছে, আর নিজের মধ্যে ডুবে থাকার বাসনা দিনকে দিন আরো বেড়েছে। এমন নিঃসঙ্গতা অনেক সময় বেদনাদায়ক মনে হয়, কিন্তু অন্য মানুষের সহানুভূতি ও বোঝাপড়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমি আফসোস করি না। এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে আমি অনেক কিছু খুঁইয়ে ফেলি, কিন্তু অন্যদের প্রথা, মতামত ও কুসংস্কার থেকে স্বতন্ত্র প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে আমি নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নিই এবং এমন পরিবর্তনশীল ভিত্তির উপর আমার মনের শান্তিকে স্থাপন করার জন্য প্রলুব্ধ হই না।”

সারা জীবন জুড়ে তাঁর প্রধান অবসরকালীন বিনোদন ছিলো বেহালা বাজানো ও নৌকায় ভ্রমণ করা। এই বছরগুলোতে আইনস্টাইনকে ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা বুড়ো হিপ্পির মতো দেখাতো। তিনি তাঁর সাদা চুলগুলোকে বেড়ে উঠতে দিয়েছিলেন, আর গণ্যমান্য সাক্ষাতপ্রার্থীদের আতিথ্য প্রদর্শনের সময়ও স্যুট ও টাইয়ের পরিবর্তে সোয়েটার ও লেদার জ্যাকেট পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। পুরোদস্তুরভাবে কোনো রকম ভণ্ডামি ও ভণিতা ছাড়া তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন, “আমি সবার সাথে একই ভাবে কথা বলি, হোক সে ব্যক্তি কোনো ময়লাওয়ালা কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট।” জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন খোলামেলা, সবসময় সফলতার সাথে না হলেও মাঝেমধ্যে জ্যামিতির সমস্যা নিয়ে হাই স্কুলের ছাত্রদের সাহায্য করার ইচ্ছা পোষণ করতেন।

ধর্মের বিষয়ে আইনস্টাইন অন্য অনেকের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বারবার তাঁকে ভুল বুঝা হয়েছে। আমেরিকায় আইনস্টাইনের প্রথম ভ্রমণের সময়ে, বোস্টনের কার্ডিনাল ও’কনেল আপেক্ষিকতাবাদকে “নাস্তিকতার ভয়ানক অপচ্ছায়া” হিসেবে সতর্ক করেন। নিউ ইয়র্কের এক ইহুদী ধর্মগুরু এতে ভীত সতস্ত্র হয়ে আইনস্টাইনকে তারবার্তায় জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?”  আইনস্টাইন তারবার্তায় উত্তর দেন, “আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি সকল সত্তার ঐকতানে নিজেকে প্রকাশিত করেন। আমি সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না যিনি মানুষের ভাগ্য ও কর্ম নিয়ে ভাবিত”— এই অধিকতর কৌশলী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সময়ের ধর্মতাত্ত্বিকরা গ্রহণ করে থাকেন। আইনস্টাইনের ধর্মবিশ্বাস ছিলো সত্যিকার অর্থে খুবই অকৃত্রিম। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি মৌলিক নীতি নিয়ে তিনি গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেন: তা হলো পদার্থের সবচেয়ে মৌলিক পর্যায়ে কণাগুলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে এক প্রকার অনিশ্চিত আচরণ করে। আইনস্টাইন বলেছেন: “ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না।” আবার অন্য জায়গায় তিনি বলেছেন, “ঈশ্বর কৌশলী কিন্তু তিনি বিদ্বেষপরায়ণ নন।” প্রসঙ্গত আইনস্টাইন এমন প্রবচনের প্রতি এত অনুরক্ত ছিলেন যে ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বোর একবার তাঁর দিকে ফিরে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, “ঈশ্বর কী করবেন তা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন।”

কিন্তু অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করতেন যে একমাত্র আইনস্টাইন-ই ঈশ্বরের অভিপ্রায় সম্পর্কে জানেন। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের অন্যতম একটি নীতি হচ্ছে কোনো ভৌত বস্তু আলোর গতিতে এত দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে না। আলোর এই প্রতিবন্ধকতা অনেকের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করেছে, যারা মনে করেন যে মানুষের চূড়ান্তভাবে অসাধ্য কিছু নেই। তবে আলোর সীমাবদ্ধতা বিশ্বের অনেক কিছু আমাদের সহজে ও মসৃণভাবে বুঝতে সাহায্য করে যেগুলো আগে রহস্যময় মনে করা হতো। যা-ই হোক, আইনস্টাইন যেখান থেকে নিয়েছেন সেখানে কিছু দিয়েছেনও বটে। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের কতিপয় ফলাফলকে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিপরীতে স্বজ্ঞাবিরুদ্ধ (counterintuitive) মনে হয় কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে তা খুব সামান্যই উপলব্ধি করা যায়, আলোর কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করা গেলে এগুলো শনাক্তকারী কায়দায় উদ্ভূত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ফলাফল হচ্ছে আমরা পর্যাপ্তভাবে আলোর গতির যত কাছাকাছি যেতে পারবো ততই আমাদের হাতঘড়ি, আমাদের পারমাণবিক ঘড়ি, আমাদের জৈবিক বার্ধক্য তথা সময় মন্থর হয়ে আসবে। পরিণামস্বরূপ আলোর গতির খুব কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণকারী কোনো মহাকাশযান যেকোনো দুটি স্থানের মাঝে, দূরত্ব যতই হোক, গ্রহ থেকে নয় বরং মহাকাশযান থেকে হিসাব করলে যেকোনো সুবিধাজনক স্বল্প সময়ে ভ্রমণ করতে পারবে। এভাবে আমরা হয়তো কোনো এক সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ভ্রমণ করতে পারি এবং মহাকাশযান থেকে হিসাবকৃত সময় অনুসারে কয়েক দশকের মধ্যে ফেরত আসতে পারি। কিন্তু পৃথিবী থেকে হিসাব করলে অতিবাহিত সময় দাঁড়াবে ৬০ হাজার বছর, আর আমাদের বিদায় জানানো বন্ধুদের মধ্যে খুব কমজনই আমাদের প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিকে স্মরণ করবে।

আইনস্টাইন শেষ জনহিতকর কাজ হিসেবে বার্ট্রান্ড রাসেল এবং অন্য আরো বিজ্ঞানী ও স্কলারদের সাথে যোগ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করানোর জন্য বিফল প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর মতে, পারমাণবিক অস্ত্র আমাদের চিন্তাপদ্ধতি ব্যতীত আর সবকিছু পরিবর্তন করেছে। শত্রুতাপূর্ণ রাষ্ট্রে বিভক্ত এই পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রকে তিনি মানবজাতির টিকে থাকার পক্ষে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ হিসেবে দেখেছেন। “আমাদের বেছে নিতে হবে”, তিনি বলেছেন, “পারমাণবিক হাতিয়ার বর্জন অথবা সর্বজনীন ধ্বংস।… জাতীয়তাবাদ একটি শিশুসুলভ ব্যাধি।… এটি মানবজাতির জন্য ছোঁয়াচে রোগস্বরূপ। আমাদের স্কুলের বইগুলো যুদ্ধকে মহিমান্বিত করে এর ভয়াবহতাকে আড়াল করে রাখে। এগুলো শিশুদের শিরায় শিরায় ঘৃণার আবেশ ছড়ায়। আমি যুদ্ধের চেয়ে বরং শান্তির শিক্ষা দেবো। আমি ঘৃণার চেয়ে বরং ভালোবাসার শিক্ষা দেবো।”

১৯৫৫ সালে মারা যাবার নয় বছর আগে, ৬৭ বছর বয়সে আইনস্টাইন তাঁর সমগ্র জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য সম্বন্ধে বলেছেন, “এই বিশাল বিশ্ব আমাদের মনুষ্য প্রজাতি থেকে স্বাধীনভাবে, অন্ততপক্ষে আংশিকভাবে, আমাদের পরিদর্শন ও চিন্তাশক্তির সাহায্যে উপলব্ধি করার ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের সামনে এক বৃহৎ, শাশ্বত প্রহেলিকা হয়ে দৃশ্যমানতার ঊর্ধ্বে তার অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজমান ছিলো। এই বিশ্বকে নিয়ে গভীর ধ্যান এক রকমের মুক্তির হাতছানি দিয়েছে… এই স্বর্গের পথ ধর্মীয় স্বর্গের মতো আরামদায়ক ও প্রলোভনদায়ক ছিলো না; কিন্তু এটি নিজেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করেছে, আর এটি বেছে নেওয়ার কারণে আমি কখনো আফসোস করিনি।”

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *