স্নায়বিক ? সত্যি!! খুবই, আমি খুবই স্নায়বিক ছিলাম এবং এখনো আছি। কিন্তু পাগল কেন বলবে তুমি ? অসুখটা আমার অনুভূতি গুলোকে ধ্বংস কিংবা নির্জীব করেনি বরং আরও তীক্ষ্ণ করেছে। সবার উপরে করেছে আমার শ্রবণ শক্তি। আমি স্বর্গ এবং পৃথিবীর সব কিছু শুনেছি। নরক সম্পর্কেও অনেক কিছু শুনেছি। তাহলে কিভাবে তুমি বলো আমি পাগল ? শোনো, এবং দেখো, কি প্রাঞ্জলতার সাথে আমি বর্ণনা করি সম্পূর্ণ গল্পটা।
এটা বলা খুবই দুরূহ যে ঠিক কখন ভাবনাটা আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে; কিন্তু যখন করেছে, এটা আমাকে দিন-রাত তাড়া করে ফিরেছে। লক্ষ্য সেখানে কিছুই ছিলনা, ছিলনা আবেগ। আমি ভালোবেসেছিলাম বৃদ্ধ লোকটিকে। তিনি কখনো আমাকে বিফল করেননি, কখনো অপমান করেননি। তার স্বর্ণের প্রতি আমার কোন লালসা ছিলনা। যার উপর ছিল, তা হলো তার চোখ ! হ্যা তার চোখ। তার একটা চোখ ছিল শকুনের চোখের মতন, হালকা নীল চোখ, যার উপর একটা পর্দার মতন। যখনই সেই চোখ আমার উপর পরতো, আমার রক্ত হীম হয়ে আসতো; আর তাই ধীরে ধীরে আমি মনস্থির করলাম আমি বৃদ্ধকে হত্যা করবো, এবং এই দৃষ্টি থেকে নিজেকে চিরতরে মুক্ত করবো।
তো, এই হচ্ছে সেই কারণ। আর তুমি আমাকে পাগল ভাবো ! পাগলেরা কিচ্ছু জানেনা। তোমার আমাকে দেখার দরকার ছিল। দেখা উচিৎ ছিল, কি ধীরতার সাথে আমি এগিয়েছি, এগিয়েছি সাবধানতার সাথে, কি দূরদৃষ্টতা আর ছলার সাথে আমি কাজটা করতে উদ্যত হয়েছিলাম।
আমি এর আগে কখনই বৃদ্ধ লোকটির উপর সাথে এতটা সদয় হইনি যতটা হয়েছিলাম তাকে হত্যা করার আগের সপ্তাহ জুড়ে। এবং প্রত্যেক রাতে, মধ্যরাতে তার দুয়ারের হুড়কা খুলেছি খুব সাবধানতায় ! এবং যখন নিজের মাথা ঢোকাবার মতন পর্যাপ্ত জায়গা করতে পেরেছি, আমি একটি লন্ঠন প্রবেশ করিয়েছি, এবং সব বন্ধ করে দিয়েছি যাতে কোন আলো বাইরে বেরুতে না পারে। এরপর আমি আমার মাথাকে প্রবেশ করিয়েছি। তুমি দেখলে নির্ঘাত হাসতে কি চতুরতার সাথে আমি আমার মাথাটাকে প্রবেশ করিয়েছি। আমি খুবই আস্তে আস্তে এটাকে প্রবেশ করিয়েছি, যাতে আমি বৃদ্ধের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাই। আমার প্রায় একঘন্টা সময় লেগেছে কেবল নিজের মাথাকে প্রবেশ করাতে সেই দুয়ারের ফাকা দিয়ে, যাতে করে আমি দেখতে পারি বৃদ্ধকে। হা !! পারবে কোন পাগল এত সাবধান হতে ? আর তারপর আমি, অত্যন্ত সাবধানতায় লন্ঠনের আঁচ কমিয়ে দিয়েছে, অত্যন্ত সাবধানতায় পাছে কোন শব্দ না হয়, আর এতটাই কমিয়ে দিয়েছে যাতে কেবল একটা মাত্র রশ্মি এসে পরে সেই শকুনী চোখে। আর এই কাজটা আমি করেছে সাত সাতটি দীর্ঘ রাতে। ঠিক মধ্যরাতে; কিন্তু আমি সবসময়ই সেই চোখজোড়া বন্ধ পেয়েছি; আর তাই কাজটা করা আমার জন্য অসম্ভব ছিল। কেননা বুড়ো লোকটা আমাকে উত্যক্ত করেনি, যেটা করেছে সেটা হলো এই বাজে চোখ। এরপর রোজ সকালে, যখন দিন শুরু হতো, আমি দৃঢ়তার সাথে তার কক্ষে যেতাম এবং সাহসিকতার সাথে কথা বলতাম তার সাথে, নাম ধরে ডাকতাম বলিষ্ঠ সুরে, এবং জিজ্ঞেস করতাম সে কিভাবে রাত কাটিয়েছে। বুঝতেই পারছো, সে এতই বয়স্ক যে সন্দেহ করবে, প্রত্যেক রাতে বারোটা নাগাদ আমি তার দিকে নজর রাখি।
অষ্টম রাতে, আমি আগের চেয়ে আরও অনেক সাবধান ছিলাম দরজা খোলার ব্যাপারে। ঘড়ির মিনিটের কাটা ঘোরার আগেই আমি আমার কাজটা সারলাম। সেই রাতের আগে আমার নিজের ক্ষমতার এবং পান্ডিত্যের ব্যাপ্তি আমি কখনো অনুভব করিনি। আমি ধরে রাখতে পারছিলাম না আমার বিজয়ের আবেগ-উল্লাস। আমি দরজা খুলছি, আস্তে আস্তে, আর সেই বৃদ্ধ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি আমার চিন্তা আর কর্ম সম্পর্কে, এ কথা ভাবতেই আমি মৃদু হাসলাম, এবং বোধয় সে এটা শুনে ফেললো; সে বোধয় বিছানায় নড়েচড়ে বসলো, যেন হকচকিয়ে গেছে। তুমি বোধয় ভাবছো এতে আমি পিছিয়ে এসেছি ?—কিন্তু না। তার ঘর ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার(সব কপাট ছিল বন্ধ, ডাকাতির ভয়ে) এবং আমি জ্ঞাত ছিলাম যে সে দেখতে পারবেনা তার ঘরের দরজা খোলা, এবং আমি ঠেলে গেলাম দরজাটাকে, খুবই অবিচলিতভাবে।
আমি মাথাটা প্রবেশ করিয়েছি এবং লুন্ঠন টা জ্বালাতে যাবো ঠিক তখনই আমার হাত ফসকে গেল টিনের বন্ধন থেকে, এবং বৃদ্ধটি তার খাটে ঘুরে উঠলো, কাঁদো স্বরে চ্যাঁচালো- “কে ওখানে?”
আমি অবিচল থাকলাম এবং কিছুই বললাম না। একঘন্টা যাবৎ আমি একটা পেশী পর্যন্ত নড়াইনি, আর এই সময়ের মধ্যে আমি তাকে খাটে শুয়ে পড়তেও শুনিনি। সে তখনো তার খাটে বসে ছিল, শুনছিল, ঠিক যেমনটা আমি করছিলাম, রাতের পর রাত, শুনছিলাম দেয়ালে মৃত্যু ঘড়ির শব্দ।
আমি কিঞ্চিত একটা গোঙানি শুনলাম, এবং আমি জানতাম এটা ভয়ের গোঙানি। এটা কোন ব্যাথার বা বিষাদের গোঙানি ছিলনা, না ! এটা ছিল প্রায় বাকরুদ্ধ এক ধরনের গোঙানি যা উঠে আসে আত্মার ভেতর থেকে যখন আমরা খুব অবাক হই ! আমি এই শব্দটার সাথে খুবই পরিচিত ছিলাম। অনেক রাতে, ঠিক মধ্যরাতে, যখন সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে, এই শব্দ আমার ভেতর থেকে উঠে এসেছে, গভীরতর হয়েছে এর প্রতিশব্দ, ভয় যা আমাকে বিপথগামী করেছে। আমি বলি আমি এটাকে খুব ভাল করে চিনি। আমি জানি বৃদ্ধটি ঠিক কেমন অনুভব করছে, এবং আমার মায়া জন্মায় তার জন্য, যদিও আমি মনে মনে খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমি জানতাম সে মৃদু সজাগ ছিল সেই প্রথম শব্দ শোনার পর থেকে, যখন সে বিছানায় নড়েচড়ে বসেছিল। তার ভয় তার মধ্যে বিকাশ লাভ করেছে তখন থেকেই। সে তার ভয়গুলোকে অমূলক ভাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু পারছেনা। সে নিজেকে বলছে “ এটা নিশ্চয়ই চিমনিতে হাওয়া লাগার শব্দ অথবা কোন ইঁদুর হয়তো মেঝেতে নড়াচড়া করছে” “অথবা হয়তো কোন ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ হবে”। হ্যা, সে নিজেকে এসব কল্পনার দ্বারা স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করছে; কিন্তু সব বিফলে যাচ্ছে। সব বিফলে যাচ্ছে তার; কারণ মৃত্যু, মৃত্যু সন্নিকটে আসছে তার, মৃত্যু তার কালো ছায়া ফেলেছে তার উপর, এবং মৃত্যু তার ভয় দিয়ে শিকারকে মুড়ে ফেলেছে। এটা সেই দুঃখজাগানিয়া অবোধ্য ছায়া যা তাকে অনুভব করাচ্ছে, যা সে দেখেনি বা শোনেনি, অনুভব করাছে তার ঘরে আমার মাথার অস্তিত্ব।
যখন আমি অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করলাম দীর্ঘ্ সময়, তাকে শুয়ে পড়তে না শুনে, আমি আরেকটু খুললাম দরজাটা, খুব সামান্য, লন্ঠনের আঁচটা সামান্য বাড়ালাম। এরপর আমি খুলে ফেললাম, তুমি ভাবতে পারবেনা কি চৌর্যতার সাথে, খুব সামান্য দৈর্ঘ্য, খুব অস্পষ্ট একটা রশ্মি, মাকড়শার একটা সুতোর মতন একটা রশ্মি গিয়ে পড়লো সেই শকুনী চোখের উপর।
চোখজোড়া চেয়ে আছে, বড় বড় করে চেয়ে আছে। আর আমি খুবই রাগান্নিত হয়ে গেলাম যখন ওটার উপর আমার দৃষ্টি গেল। খুব স্বতন্ত্রতার সাথে আমি দেখলাম, হালকা নীলাভ, অসহ্য একটা পর্দা এটার উপর যা আমার মজ্জা অবদি শীতল করে দেয়। যেহেতু আমি কেবল বুড়োর চোখের সোজাসুজি রশ্মিটা ফেলেছিলাম তাই তার মুখ বা শরীর কোন কিছুই আর দেখা যাচ্ছেনা।
এবার বলো, তুমি যেটাকে আমার পাগলামি বলছিলে সেটা আমার অনুভূতির অতি-স্বকীয়তা নয় ?? এখন বলি শোনো, এরপর আমার কানে এলো একটা সামান্য শব্দ, যেমনটা একটা ঘড়িকে তুলোয় মুড়ে দিলে আসবে। আমি সেই শব্দটার সাথেও পরিচিত ছিলাম। এটা ছিল বুড়োর হৃদস্পন্দনের শব্দ। এটা আমার প্রকোপ আরও বাড়িয়ে দিল, যেমনটা ড্রামের তাল সৈন্যদের উজ্জীবিত করে।
কিন্তু এরপরেও আমি নিজেকে আটকালাম এবং দাঁড়িয়ে রইলাম স্থির হয়ে। খুবই কম শ্বাস নিচ্ছিলাম আমি। আমি লুন্ঠনটাকে স্থির করে ধরে রেখেছি। আমি চেষ্টা করেছি রশ্মিটাকে কতটা অবিচল ধরে রাখা যায় সেই চোখের উপর। ইতমধ্যে সেই নারকীয় হৃদস্পন্দন বেড়ে গ্যাছে। এটা প্রতি মুহূর্তে দ্রুত আর জোরালো হচ্ছে। বৃদ্ধের ভয়টা বোধয় একটু বেশিই! শব্দটা আরও জোরালো হলো, প্রতি মুহূর্তে জোরালো হতে লাগলো! তুমি আমাকে খেয়াল করছো? আমি তোমাকে বলেছি, আমি স্নায়বিক, হ্যা আমি স্নায়বিক। এখন এই শেষ রাতে, সেই পুরোনো বাড়িটার ভয়াবহ নিরবতায়, এই জোরালো শব্দটাই আমাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্নায়বিক করে তুলেছে। এরপরেও কিছু সময় আমি নিজেকে দমিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিন্তু সেই হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলেছে, আরও বেড়ে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। আমি ভাবলাম হৃদপিন্ডটা বুঝি এবার ফেটে যাবে। আর ঠিক তখন অন্য আরেক দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে। আমি ভাবতে শুরু করি কোন প্রতিবেশি বোধয় এই শব্দ শুনে ফেলবে। বৃদ্ধ্যের সময় চলে এসেছে। খুব জোরে শব্দ করে, একপ্রকার লাফিয়ে আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। সে একবার কেঁদে উঠলো, এবং একবারই উঠলো। এক ঝটকায় আমি তাকে মেঝেতে নামিয়ে আনলাম এবং পুরো খাটিয়াটা তার উপর চাপিয়ে দিলাম। কাজ সম্পাদন হয়ে গেছে দেখে আমি হাসতে লাগলাম। কিন্তু এরপরেও অনেকক্ষণ যাবৎ সেই হৃদয় শব্দ করে গেছে মৃদু। সেটা অবশ্য আমাকে আর উত্তেজিত করেনি। এই শব্দ আর দেওয়াল ভেদ করে শোনা যাবেনা, কিছু দূরে তা মিলিয়ে যাবে। বৃদ্ধটি মারা গেছে। আমি খাটটিকে সরিয়ে দেহটি পর্যবেক্ষণ করলাম। হ্যা, সে পাথর হয়ে গ্যাছে, পাথরের ন্যায় মৃত হয়ে গ্যাছে। আমি তার বুকের উপর হাত দিলাম এবং কিছুক্ষণ ধরে থাকলাম। কোন স্পন্দন নেই। সে মৃত। এই চোখজোড়া আমাকে আর বিরক্ত করবেনা।
এরপরেও যদি তুমি আমাকে পাগল ভাবো, তুমি আর ভাববেনা যখন আমি বলবো মৃত দেহটা লুকোতে আমি কি কি করেছি। রাত সরু হতে শুরু করেছে এবং আমি তাড়াহুড়ো করে কাজ করছি কিন্তু নিঃশব্দে। প্রথমে আমি দেহটিকে টুকরো টুকরো করেছি। আমি মাথাটিকে কেটেছি দেহ থেকে, এরপর হাতগুলো এবং পা গুলো কেটেছি।
এরপর আমি মেঝে থেকে তিনটে তক্তা সরিয়ে ফেলেছি এবং সব সেখানে ফেলেছি। অতঃপর আমি তক্তাগুলোকে আগের জায়গায় রেখেছি খুব ধূর্ততার সাথে যাতে কোন মানব চক্ষু এমন কি তার নিজের চোখও কোন ভুল খুঁজে পাবেনা। ধোবার মতন সেখানে কিছুই ছিলনা, কোন দাগ ছিলনা, কোন রক্তের ছিটেফোঁটাও ছিলনা। আমি যার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করছিলাম, একটা জলাধার সবটা চুষে নিয়েছে, হা হা হা।
আমার কাজ শেষ হতে হতে ঘড়িতে চারটা বাজে। এখনো মাঝরাতের অন্ধকার চারিদিকে। যখন ঘড়ির ঘন্টার কাটাটা বেজে উঠলো, তখনই বাইরের দরজার কড়া নড়ে উঠলো। আমি খুবই হালকা মনে দরজা খুলতে বেরোলাম, আমার তখন আর কিসের ভয় !! তিনজন ব্যাক্তি এক এ এক এ প্রবেশ করলো, নিখুদ কোমলতায় দিল তাদের পরিচয়, পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে। খুব করুণ কান্নার শব্দ শুনেছে এক প্রতিবেশী রাতে। বাজে কিছু ঘটার সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশের নিকট তথ্য দেবার পর তারা ঘটনাস্থর তদন্ত করতে এসেছেন।
আমি হাসলাম, আমার তখন ভয় কিসের ? আমি তাদেরকে স্বাগতম জানালাম। আমি বললাম কান্নার শব্দটা আমার নিজের, স্বপ্নের ঘোরে। আমি বললাম, বৃদ্ধ লোকটি শহরে নেই। আমি পুরো বাড়িতে খোজ করেছি, ভালভাবে খোঁজ করেছি। আমি তাদেরকে নিয়ে গেলাম, অদূরেই, তার ঘরে, যেখানে দেখালাম বৃদ্ধের সম্পদ, অবিকল একইরকম আছে। আত্মবিশ্বাসের উদ্যমে আমি তাদের জন্য চেয়ার এনে দিলাম এবং আশা রাখলাম যেন তারা তাদের অবসাদ থেকে একটু বিশ্রাম নেন। এবং আমি, এক বন্য ঔদ্ধত্যে আমার চেয়ারখানা রাখলাম ঠিক সেই স্থানটাতে যেখানে আমি দেহটিকে পুঁতেছিলাম।
কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট হলেন। আমার ব্যবহার তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছে। আমি খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলাম। তারা বসে রইলো যখন আমি খুব আমুদে ভঙ্গিমায় তাদের সাথে গল্প করতে থাকলাম পরিচিত বিষয়ে। কিন্তু, কিছু বাদে, আমি আমাকে ফ্যাকাশে অনুভব করতে লাগলাম আর মনে মনে চাইলাম যেন তারা চলে যায়। আমার মাথা ব্যাথা করতে লাগলো, আমি অনুভব করতে লাগলাম যেন আমার কান বাজছে; এরপরেও তারা বসে রইলো আর গল্প করতে থাকলো। শব্দটা ক্রমশ আরও স্বতন্ত্র হতে থাকলো, এবং ক্রমশ আরও স্বতন্ত্র হতে থাকলো। আমি আরও খোলা মনে তাদের সাথে কথা বলতে থাকলাম যাতে এই অনুভূতিটা ভুলে থাকা যায়। কিন্তু এরপরেও শব্দটা ক্রমশ আকার পেতে শুরু করলো, ঠিক সেই মুহূর্ত পর্যন্ত যখন আমি বুঝলাম যে শব্দটা কেবল আমার কান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নেই।
কোন সন্দেহ নেই আমি তখন আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেলাম, কিন্তু আমি অনর্গল কথা বলে গেলাম, এবং আমি তা করলাম উচ্চস্বরে। এরপরও শব্দটা বাড়তে থাকলো এবং আমি কি করতে পারতাম? এটা ছিল খুব অল্প, নিস্তেজ, দ্রুত একটা শব্দ, ঠিক যেমনটা একটা ঘড়িকে তুলোয় মুড়ে দিলে হয়, তেমন। আমি নিশ্বাসের জন্য হাসফাস করছিলাম, কিন্তু তবুও কর্মকর্তারা সেটা শুনলেন না। আমি আরও দ্রুত কথা বলতে থাকলাম, তীব্রভাবে বলতে লাগলাম। কিন্তু শব্দটা অবিচলিত ভাবে ক্রমশ বাড়তে লাগলো। তারা যাচ্ছেনা কেন ?? আমি মেঝেতে শব্দ করতে থাকলাম জোরদর্পে, যেন আমি খুবই বিরক্ত মানুষের উপস্থিতিতে; কিন্তু শব্দটা ক্রমশ আরও বাড়তে লাগলো। হায় খোদা, কি করবো আমি ? আমি দোয়া করতে লাগলাম, প্রার্থনা করতে লাগলাম! আমি আমার চেয়ারটা নড়াতে থাকলাম, ঘষতে থাকলাম মেঝেতে, কিন্তু সেই শব্দটা সব কিছুকে ছাড়িয়ে ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। এটা আরও বাড়তে থাকলো, বাড়তেই থাকলো। এরপরেও লোকগুলো কেবল গল্প করে চলেছে আরামকরে এবং হাসতে হাসতে। এটা কি সম্ভব যে তারা শব্দটা শুনছে না? শক্তিমান বিধাতা! না, না! তারা শুনছে। তারা সন্দেহ করছে! তারা আমার সন্ত্রস্ত অবস্থার মজা লুটছে। আমি এটাই ভেবেছিলাম এবং ভাবছি। এই কষ্টের অনুভূতির চেয়ে অন্য যেকোন কিছুই ভাল ছিল! কোনকিছুই বরং সহনশীল ছিল এই অবজ্ঞ্যার হাসি থেকে। আমি এই হাসি আর এক মুহূর্তও নিতে পারছিলাম না। আমি অনুভব করলাম আমার চিৎকার করা উচিৎ অথবা মরে যাওয়া উচিৎ ! এবং আবার, এই এক্ষুণি, জোরে, আরও জোরে হচ্ছে সেই শব্দ।
“শয়তান!!” আমি গুংড়ে উঠলাম। “আর অভিনয় নয়! আমি আমার কার্য স্বীকার করছি, তক্তাগুলো সরিয়ে ফেলো! এখানে, হ্যাঁ এখানে! এ হচ্ছে তার অসহ্য স্পন্দিত হৃদয়।
মূল গল্প – The Tell Tale Heart এডগার এলান পো