‘জর্জ, আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম সন্তান নেব না। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল। মার্জি সন্তান চায়, এদিকে আমি চাই না। এই কঠিন যুগে সন্তান নেয়া যায় না। মার্জি ছিল বোকার হদ্দ। সে সন্তান নেবেই। একদম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। জর্জ, তুমি তো জানো মেয়েরা কেমন হয়। কীভাবে যে বিচ্ছিরি কা-টা ঘটে গেল, আমি জানি না।’ বলল অ্যালফি।
জর্জ জানালার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না।
উপরতলায় থেকে দুর্বল কণ্ঠে কে যেন চিৎকার করে উঠল। অ্যালফির আগে জর্জ দরজার কাছে পৌঁছে গেল। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুনতে লাগল। এই চিৎকারকে যাত্রী বোঝাই ট্রেনের শব্দের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
‘উপরে যাবে না?’ বলল জর্জ।
‘না যাওয়াই ভাল। গিয়ে তো কিছু করতে পারব না।’
প্যাসেজে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ওরা রূমে ফিরে এল। আবার নতুন করে চিৎকার শোনা যেতেই দু’জন শক্ত হয়ে গেল।
ওদের মাথার ওপরে এক দরজা খুলে গেল, আলো এসে পড়ল সিঁড়িতে। ধীর স্থির ভারি পদক্ষেপে কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একটু পর সিঁড়ির মাথায় ডাক্তারকে দেখা গেল। তোয়েলা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ব্যাক্তির দিকে এগোলেন তিনি।
তাকে আসতে দেখে লোক দুটো চুপচাপ রূমের দিকে পা বাড়াল। ডাক্তারও তাদেরকে অনুসরণ করে রূমে ঢুকে দরজাটা আধ খোলা রেখে দাঁড়ালেন। তাঁর কপালের একটা রগ দপদপ করছে। অবশ্য চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি একঘেয়েমিতে ভুগছেন, একদম নিরুত্তাপ।
‘আপনার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না’ অ্যালফিকে জানালেন ডাক্তার। হাতে থাকা তোয়েলাটা খুব সাবধানে ভাঁজ করতে শুরু করলেন তিনি। ‘আপনার স্ত্রীর সন্তান নেয়া উচিত হয়নি। তার যোনি খুবই সরু। মনেহয় না বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারব। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বিপদজনক।’
জর্জ ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই ডাক্তার তার দিকে চট করে তাকালেন। ‘আরে ভাই, এত হতাশ হওয়ার কী আছে? আপনাদের দিকটাও তো ভাবতে হবে। বাচ্চা গেলে বাচ্চা পাবেন কিন্তু স্ত্রী তো আর ফিরে পাবেন না।’ দ্রুত বললেন তিনি।
মুখে হাত দিয়ে জর্জ বসে পড়ল। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল অ্যালফি।
ডাক্তার বললেন, ‘বলুন, আমি এখন কী করব?’
অ্যালফি এখন জর্জের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ডাক্তার তাঁর চিকন হাত দিয়ে অ্যালফির বাহু ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমার কথা শুনতে পাননি?’
মাথা ঘুরাল অ্যালফি। তার চোখে কোন ভাষা নেই। একদম শূন্য। ‘আপনার কাজ সম্পর্কে আপনিই ভাল জানেন। যেটা ভাল হয় করুন।’ ধীরে ধীরে বলল সে।
‘আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি,” বললেন ডাক্তার। ‘আমি বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি কিন্তু…’
মাথা নাড়ল অ্যালফি। ‘হ্যাঁ, বুঝেছি। মার্জিকে বাঁচান। বাচ্চাকে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। বেঁচে থাকলে আবার বাচ্চা নিতে পারবে। আপনি মার্জিকে বাঁচান।’
ডাক্তার ওদের দু’জনের দিকে কঠোর কিন্তু হতভম্ব একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উপর তলায় চলে গেলেন।
‘দেখা যাচ্ছে, কোন কিছু গড়বড় হয়নি।’
‘না, হয়নি। অ্যালফি, আমরা এটা করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তেমন কিছু ভাবিনি পর্যন্ত। মার্জি মা হতে চাচ্ছিল আর আমি মার্জিকে চাচ্ছিলাম। এর বাইরে আর কিচ্ছু না। ঈশ্বরের দিব্যি, অ্যালফি, বিশ্বাস করো। ব্যাপারটা ঘটে আমরা যখন নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম তখন। তোমার আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। খুব বিচ্ছিরি একটা কা- করেছিলাম আমরা। সত্যি কথা বলছি, পরে আমার এটা নিয়ে অনুতাপ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তুমি ওকে সন্তান দেবে না বলে জেদ ধরে ছিলে; সে কিন্তু একটা সন্তানই চাইছিল আর কিছু নয়। দেখ, আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাব। এটা নিয়ে আর কিছু করার নেই। সে তোমার, তোমারই ছিল, তোমরই থাকবে। ¯্রফে নদী, চাঁদ, রোমাণ্টিক আবহাওয়া আর তার সন্তান চাওয়ার কারণে ব্যাপারটা হয়েছে। অ্যালফি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ তো?’ একটানা বলল জর্জ।
অ্যালফি টেবিলের কিনারে আস্তে করে বসে পড়ল। ওর কেমন যেন অসুস্থ লাগছে। পৃথিবীর অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে সে মার্জিকে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছে। তাই ও চায়নি মার্জি মারা যাক। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে আশ্চর্য হলো- মার্জি আর জর্জের ব্যাপারটায় ওর কোন অনুভূতি হচ্ছে না। মার্জি একটা সন্তান চেয়েছিল, স্বামী হিসেবে ওর উচিত ছিল ব্যাপারটা বোঝা। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আর ভেবে কী লাভ? ইস! ও যদি সেদিন স্ত্রীর সাথে জর্জকে মাছ ধরতে নদীতে না পাঠাত তাহলে এসব কিছুই ঘটতে পারতো না। আমি একটা আস্ত রামছাগল, নিজেকে গালমন্দ করল অ্যালফি। আমার উচিত ছিল স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করা। যা-ই হোক, মার্জি সুস্থ হয়ে উঠুক। ব্যাপারটা দেখবে সে। ন্যাড়া বেলতলা একবারই যায়। একই ভুল দু’বার করবে না অ্যালফি।
জর্জ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। তুমি বোসো, দেখি কি হয়।’ বলল অ্যালফি। হঠাৎ করে তার ভেতরে এক পৈশাচিক আনন্দ খেলা করতে লাগল এই ভেবে যে, বাচ্চাটা মরতে যাচ্ছে। আহ, শান্তি! নতুন করে শুরু করার সুযোগ থাকছে তার।
জর্জ আবার চেয়ারে বসল। বলল, ‘তুমি একটা অদ্ভুত লোক। খুব সহজেই কথাটা বলেতে পারলে।’
ওরা চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। কেউ কোন কথা বলল না। ব্যাপারটা নিয়ে যতই চিন্তা করতে লাগল ততই নিজের উপর রাগ বাড়তে থাকল অ্যালফির। হয়তো সন্তান নিলে মজাই হত। এত ভয়ের কী আছে? বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য একটু বেশী পরিশ্রম করতে হবে, এই যা। পরিশ্রম করলেই ওদের তিনজনের ছোট পরিবার বেশ ভালই চলে যাবে। চাইলে জর্জও ওদের সাথে থাকতে পারে। না, থাক। জর্জকে রাখা যাবে না। জর্জকে দেখা হয়ে গেছে। এরপর সে না থাকাটাই নিরাপদ। এমন না যে, জর্জ থাকলে অ্যালফি মাই- করবে। কিন্তু মার্জি করবে। জর্জকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তার জায়গায় আসবে ওদের নতুন অতিথি।
দরজা খুলে ডাক্তার ভেতরে ঢুকলেন। ওরা দু’জন তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ডাক্তারের মুখ একদম ভাবলেশহীন। তিনি বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, অবস্থা ভাল নয়।’ তাঁর মুখের একটা রগ এখনও দপদপ করছে, ঠিক আগেরবারের মতো। ‘আপনার স্ত্রী খুবই হতাশ হয়ে পড়েছে, বুঝতেই তো পারছেন।’
অ্যালফি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ‘ও কি বাঁচবে না…?’
ডাক্তার শ্রাগ করলেন। ‘বেশীক্ষণ নয়। সে দেখা করতে চাচ্ছে…’
ডাক্তারের কথা শুনে অ্যালফি পা বাড়াল কিন্তু ডাক্তার তাকে থামিলে দিলেন। ‘আপনার সাথে নয়। জর্জের সাথে।’ বললেন ডাক্তার, জর্জের মুখের দিকে কৌতুহলপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি চলুন।’
ডাক্তার আর জর্জ দ্রুত পা চালিয়ে রূম থেকে চলে গেল, রূমটায় একা রয়ে গেল অ্যালফি।
——————————————————————–
মূল উৎস
Story: Vigil
Book: Get a Load of This by James Hadley Chase (1941) [ Short Story Collection ]