শিশুকালে ফিরে যান। মনে পড়ে তখনকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস গুলো কী ছিলো? আপনি তখন অবাক হতেন, প্রশ্ন করতেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কী আছে ওখানে? কী আছে ঐ তারাদের পেছনে? কতদিন ধরে চলছে এসব? তখন আপনার মা বলতো, “এগুলো সবসময়ই ছিলো, আসছে, এবং থাকবে। কবে শেষ হবে কেউ জানে না।”
একটা বাচ্চা তখন অবাক হয়, বিস্মিত হয় আর উত্তেজিত হয়ে ভাবে যে এমন কিছু আছে যা কখনোই শেষ হয় না। তারপর বাচ্চাটা ‘সময়’ নিয়ে প্রশ্ন করে। ‘অনেক দিন আগে’টা ঠিক কতদিন আগে ছিলো? অবশ্য বাইবেল বলে, শুরুতে ঈশ্বর স্বর্গ, নরক আর দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। বাচ্চা আবার জিজ্ঞেস করে, “এইসব সৃষ্টি করার আগে ঈশ্বর কী করতো?” তখন কেউ একজন বলে, এই ধরনের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন যারা করে তাঁদের জন্যে ঈশ্বর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কিন্তু বাচ্চাটা ঈশ্বর নিয়ে ভাবতেই থাকে। তাঁর ভাবনাগুলো যেতে থাকে পেছনের দিকে, ঈশ্বরের আগে কী ছিলো, তাঁর আগে কী ছিলো, তারও আগে কী ছিলো!
সে দেখে যে শুরুর আসলে কোন শুরু নাই। সুতরাং একই ভাবে আপনি মৃত্যু নিয়েও চিন্তা করতে পারেন। ধরুন যে ঘুমাতে গেলেন কিন্তু আর কখনোই জেগে উঠলেন না। কখনোই না। ব্যাপারটা এমন হবে যে আপনার কখনোই কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। শুধু আপনার না, কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিলো না। ঠিক যেমন আপনার জন্মের আগে আপনার অস্তিত্বের কথা আপনি জানেন না এবং এই দুনিয়ার অস্তিত্বের কথাও জানতেন না। অস্তিত্বের এই পুরো বিষয়টাতে একটা বড় ধরনের ঘাপলা আছে। এইসব প্রশ্ন নিয়ে যখন আমরা গভীর ভাবে ভাবি, তখন আমাদের মনের মধ্যে এক ধরনের হাস্যকর অনুভূতির উদ্রেক হয়, সত্যিই হাস্যকর অনুভূতি। খেয়াল করলে দেখবেন, এই হাস্যকর অনুভূতিটা বাচ্চারা খুব পছন্দ করে। এই জন্যেই বাচ্চারা সব উদ্ভট কাজকর্ম করে। তারা যতটা জোরে সম্ভব ঘুরতে থাকে, তারপর হঠাৎ দেখতে পায় যে পায়ের নিচে মাটিও ঘুরছে। এবং বাচ্চারা মুখের বিভিন্ন ভঙ্গি তৈরি করে, তাঁদের শরীরটাকে যত উদ্ভট ভঙ্গিতে সম্ভব আঁকাবাঁকা করে পরীক্ষা করে। কারণ বাচ্চারা জানে যে শুরু থেকেই পৃথিবীটা বড় উদ্ভট।
সবাই জানে, আসলে কী ঘটছে। কিন্তু কেউই তা স্বীকার করে না। কারণ সবাইকে এই জিনিস স্বীকার না করার শিক্ষা দিয়েই বড় করা হয়েছে। কিন্তু আপনি খুব ভালো করেই জানেন, এই ব্রহ্মাণ্ডে কী চলছে। এখন বয়সকালে এসে আপনি যে তা জানেন এটা বুঝতে হলে আপনাকে আবার বাচ্চাকালে ফিরে যেতে হবে। আবার প্রশ্ন করা শুরু করতে হবে। খেয়াল করে দেখেন, আমরা এখনই স্বর্গে আছি। কারণ এই দুনিয়াটা একটা মহাশূন্যযান আর স্বর্গ হলো মহাশূন্য। চাইনিজরা এটাকে বলে ‘কুং’, জাপানিজরা ‘কু’—অর্থাৎ শূন্যগর্ভ। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি জানেন যে আপনার শরীরের (পরমাণুর) বেশীরভাগ অংশই ‘স্পেস’ অর্থাৎ শূন্য? যদি আপনার শরীরের সলিড জিনিসপত্র, যেমন হাড়-মাংস গুলোকে সংকুচিত করা হয় তাহলে এটা একটা পিনের মাথার চেয়েও ছোট হবে। আমরা আসলে বাতাস জাতীয় ফাঁকা বস্তু— শূন্য। আর এই শূন্যকে কেউ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, কেউ কল্পনাও করতে পারে না। কারণ স্পেস হলো ‘না থাকার অসীম হাহাকার (nothingness)’। আর এটাই এই ব্রহ্মাণ্ডের মূল ভিত্তি।
এই দুনিয়াটা একটা ‘বড় পাথর’, যেটা জীবন্ত প্রাণীতে ভরপুর। ঠিক যেমন আপনার কঙ্কালটা হলো বিভিন্ন কোষে ঘেরা কতগুলো হাড়। অবশ্য দুনিয়াটা হলো জিওলজিকাল। আর এই জিওলজিকাল দুনিয়াটা ‘মানুষ’ উৎপাদন করে। কিন্তু এখনো আমরা অনুধাবন করতে পারিনি যে, জন্ম-মৃত্যু, সাদা-কালো, ভালো-মন্দ, অস্তিত্ব আর অস্তিত্বহীনতা সবকিছুই একই কেন্দ্র থেকে উৎসারিত। তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক। আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে এই দুনিয়াটাকে বোঝার অনেক চেষ্টা করেছি, রহস্যগুলোকে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আর এই সব করেছি আমরা জগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি প্রতিটা বস্তুর গভীরে — মাংস, ইস্পাত, পাথর এইগুলো কিসের তৈরি? জানতে গিয়ে একদম এইসবের কেন্দ্রে চলে গেছি। এইসবের মধ্য দিয়ে আমরা একটা নির্দিষ্ট উপলব্ধিতে পৌঁছেছি।
উপলব্ধিটা হলো, সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা কোনটা- সেটা আসল ব্যপার না। ব্যপার হলো, এটা কোন মাপকাঠিতে ক্ষুদ্রতম? অর্থাৎ এটাকে কিসের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র বলছি সেটা। দেখেন, কোষ, অণু, পরমাণু, এদের সবাই বিভিন্ন মাপকাঠিতে বিভিন্ন স্বত্বায় বিদ্যমান। সুতরাং আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, ‘সবকিছু আপেক্ষিক’ এই কথা শুনলে যারা রেগে যায়, তাদের রাগের আসলে কোন কারণ নেই? আপেক্ষিকতা কোনো এলোমেলো মারপ্যাঁচ না যেখানে সবকিছু সব দিক থেকে এসে হারিয়ে যায়। বরং আপেক্ষিকতা হলো সবথেকে সুন্দর অবস্থান যেখানে প্রতিটা জিনিস প্রতিটা জিনিসকে আগলে রাখে। সুতরাং আপনি যদি এই মূলনীতিটা ধরতে পারেন এবং বুঝতে পারেন, তাহলে আপনি অনুভব করতে পারবেন যে আপনার আশেপাশের সবকিছুর সাথে আপনি একটা গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। এবং এখানেই আসল সৌন্দর্য! এটা এমন না যে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছেন ঐখানে কি আছে। ‘ঐখান’টা না থাকলে আপনি এখানে থাকতেন না। অর্থাৎ আপনি বাইরে যা দেখছেন আর ভিতরে আপনি যা দুইটাই একই চুম্বকের দুই মাথা অথবা একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ। একটা ছাড়া আরেকটার অস্তিত্ব নাই।
সর্বোপরি আমরা জীবজন্তু, শাকসবজি, পরিবেশ, খনিজ পদার্থ, আর আবহাওয়ায় ভরপুর একটা দুনিয়ার মাঝখানে বাস করি যেটা অত্যন্ত উচ্চমানের বোধশক্তি সম্পন্ন। আর দুনিয়ার এই ধীশক্তি আমাদের মগজে এসে কেন্দ্রীভূত আর ঘনীভূত হয়। অর্থাৎ পুরো ব্রহ্মাণ্ডের ‘বুদ্ধিমত্তা’ আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে বিদ্যমান।
যদি আপনার বাবার সাথে আপনার মায়ের দেখা না হতো, তাহলে কি আপনি দুনিয়াতে থাকতেন? অবশ্য, আপনার জায়গায় কেউ না কেউ থাকতোই। কারণ আপনার বাবা কারো না কারো দেখা পেতোই। সেই অন্য কেউটা কি আপনি হতেন? অবশ্যই হতেন। খেয়াল করেননি? আপনি শুধু আপনি হতে পারবেন ‘কেউ একজন’ হওয়ার মাধ্যমে। সবগুলো ‘কেউ একজন’ই আপনি, সবগুলো ‘কেউ একজন’ই আমি। এই ‘আমি’ই আপনার নাম। খেয়াল করে দেখেন, সবাই নিজেকে ‘আমি’ বলে। সবাই এই ‘আমি’টাকে একইভাবে অনুভব করে। সবাই ‘আমি’, সবাই ‘আপনি’।