অর্থহীনতার দেয়াল- আলবেয়ার কাম্যু

প্রতিটি আবেগের নিজস্ব একটা জগৎ আছে, চমৎকার বা নিকৃষ্ট জগৎ। ঈর্ষার একটা জগৎ আছে, আছে উচ্চাকাঙ্খার, স্বার্থপরতার বা মহত্বের। গভীর আবেগ আর মহান কাজ একই রকম, এরা সাধারণ বিশ্লেষণের বাইরেও অনেক বেশি অর্থবহ। এসব আবেগকে চেনা যায় তাদের প্রতিফলনে, সে আলোতে তারা নিজেদের জগতকে আলোকিত করে। তাদের জগত মনের বানানো জগত, মনের আচরণ। এদের নির্ণয় করা যায় না, এরা ‘নিশ্চিতের’ মত অস্পষ্ট, ‘বর্তমানের’ মত ক্ষণস্থায়ী, সৌন্দর্য্যের অলংকারে মোড়া আর অর্থহীনতায় অনুপ্রাণিত।
.
অর্থহীনতা যে কোন সময়, যে কোন মোড়ে মানুষের সামনে হাজির হয়। অর্থহীনতা তার ভয়ানক নগ্নতায়, তার অনুজ্জ্বল আলোয় অধরা। তার এই চরিত্র চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। একজন মানুষকে হয়ত আমরা কখনোই সম্পূর্ণভাবে চিনতে পারি না, তার মধ্যে অহ্রাসযোগ্য কিছু থাকে যা আমরা কখনোই জানতে পারি না। কার্যত আমি মানুষ দেখি, তার আচরণে, তার কাজের সামগ্রিকতা দিয়ে তাকে চিনি। একইভাবে অযৌক্তিক আবেগও বিশ্লেষণযোগ্য না। আমি এদের ‘কার্যত’ বুঝি, এদের ‘কার্যত’ প্রশংসা করি, বুদ্ধির জগতে এদের প্রভাব দিয়ে, এদের সকল দিক দেখে, আবেগের জগতের সীমানা দিয়ে এদের আমরা চিনি। নিশ্চিতভাবে বলা যায় একজন অভিনেতাকে শতশতবার পর্দায় দেখেও আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন দাবি করতে পারি না। তার অভিনীত সকল চরিত্র দেখে অবশ্য আমি তাকে প্রথমবার দেখার চেয়ে ভাল চিনতে পারি। এতে কিছু সত্যতা আছে, আর এমন ভাবাটা ভুল না। এই আপার্তবৈপরীতা একটা নীতিগত কথা। এর একটা নীতি আছে। এখানে এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে মানুষ নিজেকে তার বিশ্বাস দিয়েই সংজ্ঞায়িত করে, আর একান্ত চিন্তার প্রেরণা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। আবেগের একটা নিন্মস্তর আছে, সেটা মনের সীমানার বাইরে, তবে কাজে আর আচরণে সেটা প্রকাশ পায়। আমি এখানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বলছি। তবে এই প্রক্রিয়াটা জ্ঞান লাভের না, বিশ্লেষণের। কারণ প্রক্রিয়া একটা আধিভৌত ব্যাপার, নিজের অজানায় প্রক্রিয়ারা এমন উপসংহারে যেতে পারে যা তার নিজেরও জানা ছিল না যে সম্ভব। একইভাবে যেমন গল্পের শেষটা শুরুতেই নির্ধারিত থাকে। এমন সম্পর্কীয়তা অনিবার্য। এখানে বর্নিত প্রক্রিয়া স্বীকার করে শতভাগ শুদ্ধ জ্ঞান লাভ অসম্ভব। কারণ জ্ঞানের ধরণ সীমিত, আর সেগুলো নির্দিষ্ট পরিবেশে নিজেকে উপস্থাপন করে।
.
হয়ত আমরা অর্থহীনতা আবিষ্কার করবো জীবনের শিল্প আর শিল্পের জগতকে হারানোর বিনিময়ে। অর্থহীনতার পরিবেশ ভাবনার শুরুতেই চলে আসে। শেষে আসে একটা অর্থহীন জগত আর এমন একটা মনোভাব যা এই জগতকে তার আসল রূপে দেখায়।
.
সকল মহান চিন্তা আর কর্মের সূচনা হাস্যকর হয়। মহান কর্মের জন্ম হয়, অনেক ক্ষেত্রেই, গুরুত্বহীনভাবে, রাস্তার মোড়ে বা রেস্তোরায়। অর্থহীনতাও এমনই। আর এমন শোচনীয় জন্মই অর্থহীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। কিছু ক্ষেত্রে ‘কী ভাবছো?’ প্রশ্নের উত্তরে ‘কিছুই না’ বলা হয়ত মানুষের ভণ্ডামির পরিচয় দেয়, যারা প্রেম করেছেন তারা জানেন। কিন্তু এই উত্তরটা যদি আন্তরিক হয়-মনের শূণ্যতা অলংকৃত দশা থেকে যদি এই উত্তর আসে, যদি প্রতিদিনের রুটিন ভেঙ্গে যদি এই উত্তর আসে, যদি মন পৃথিবীর সাথে যুক্ত হওয়ার পথের সন্ধান থেকে এই উত্তর আসে, এটাই অর্থহীনতার প্রথম চিহ্ন।
.
এই শুরুই একটা পতনের শুরু। জাগা, রাস্তা, চার ঘন্টার কাজ, খাওয়া, রাস্তা, চার ঘন্টার কাজ, খাওয়া, ঘুম, আর সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি- একই বৃত্তে ঘুরতে থাকা। কিন্তু একদিন মনে চলে আসে ‘কেন’, আর সব কিছু শুরু হয়। শ্রান্তিতে বিস্ময় জাগে। “শুরু হয়” এখানে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রান্তি যান্ত্রিক জীবনের বৃত্তের উচ্ছিষ্ট জিনিস, শ্রান্তি চৈতন্যের ইঙ্গিত দেয়। শ্রান্তি চৈতন্যের জন্ম দেয়, আর তার পরের ধাপেরও। পরের ধাপে মানুষ হয়ত আগের বৃত্তে ফিরে যায়, অথবা জেগে উঠে। এই জাগরণের ফলাফল দুইটা- আত্মহত্যা আর মুক্তি। শ্রান্তির মাঝে অসুস্থতা আছে। এই অসুস্থতা ভাল। এই অসুস্থতা চৈতন্যের চিহ্ন, শ্রান্তি ছাড়া চৈতন্য আসে না, আর চৈতন্য ছাড়া সবই মূল্যহীন। এই কথাগুলোতে নতুনত্ব কিছুই নাই। এই কথাগুলো সুস্পষ্ট, অর্থহীনতার শুরুতেই এগুলো বুঝা যায়। হাইডেগার বলেন ‘দুশ্চিন্তা সব কিছুর উৎস’।
.
সাধারণ, ঘটনাহীন জীবনে সময় আমাদের চালায়। কিন্তু একটা সময় আসে যখন সময়কে আমাদের চালাতে হয়। আমরা বাস করি ভবিষ্যতে। “আগামীকাল”, “ভবিষ্যতে”, “যখন পারো”, “বড় হলে বুঝবে”। এসব অসামঞ্জস্য সুন্দর, কারণ মৃত্যু আমাদের চালিকা। হঠাৎ করে মানুষ দেখে সে মধ্যবয়স্ক। সে নিজের বয়স বলে, কিন্তু একই সাথে সে নিজেকে সময়ের মাপে বিবেচনা করে। সে মেনে নেয় এই যাত্রায় সে মধ্যের অবস্থানে আছে, আর তার গন্তব্য হচ্ছে মৃত্যু। সময়ের মূল্য আর ভীতিতে সে বুঝতে পারে তার শত্রু আসলে কে। গতকাল যে আগামীকালের আশায় ছিল সে, তার উচিত ছিল তাকে ভয় পাওয়া। শরীরের এই বিদ্রোহই অর্থহীনতা*।
* এটা অর্থহীনতার সংজ্ঞা না।
এক ধাপ পরে জগতের অদ্ভুততা তাকে ঘিরে আসে, জগত তার ঘনত্ব বুঝিয়ে দেয়। পাথর আর মানুষের পার্থক্য আর অহ্রাসযোগ্যতা প্রকট হতে থাকে- প্রকৃতিতে আমরা কত ছোট আর অবহেলিত সে ভাবনা নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের পেছনে একটা অমানবিকতা আছে, পাহাড় আর গাছের সারিকে আমরা যে অর্থ দিয়েছি সেটা অসার- এসব কিছু আমাদের সামনে প্রকট হয়। এই জগৎ অদেখা স্বর্গের চেয়ে অচেনা লাগে তখন। জগতের হিংস্রতা আমাদের চোখে পড়ে, আর হাজার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ হঠাৎ করে আমরা দেখতে পাই। আমরা বাকরূদ্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য, আমরা এই জগৎকে যেভাবে চিনে এসেছি, সংজ্ঞায়িত করেছি সেটা মিথ্যা, এই উন্মোচন আমাদের সামনে চলে আসে। আমরা জানি না আমাদের কী করা উচিত। এই জগৎকে আমরা ভয় পাই কারণ এই জগৎ তার আসল রূপে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্যাসে মুখোশে লুকানো আসল চেহারা আমরা দেখি, এই জগৎ আমাদের থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। যেন চিরপরিচিতা এক নারী হঠাৎ অপরিচিত হয়ে যায়, যাকে আমরা ভালবাসতাম, আর আমরা তখন সেই অপরিচিতাকেই চাই। কিন্তু সে সময় এখনো আসে নি। জগতের এই আসল রূপ- অর্থহীনতা।
.
মানুষও অমানবিক হয়। স্বচ্ছতার বিশেষ সময়ে তাদের চলনের যান্ত্রিকতা, তাদের মূকাভিনয়ের নির্বুদ্ধিতা দেখা যায়। কাচের বাক্সে বন্দী টেলিফোনে কথা বলা লোকটার কথা আপনি শুনতে পান না, তার অবোধ্য মূকাভিনয় দেখেন আপনি বুঝতে চেষ্টা করেন সে কে, কী বলছে সে, আর তার অস্তিত্বের কারণ কী? নিজের অমানবিকতা আবিষ্কারে, সীমাহীন পতনে নিজেকে আবিষ্কার করে এই অস্বস্তি- অর্থহীনতা। আয়নার প্রতিফলনে দেখা পরিচিত চেহারার অপরিচিত লোকটা, ছবির ফ্রেমে পরিচিত কিন্তু ভীতিকর লোকটা- সেও অর্থহীনতা।
.
সবার শেষে আসি মৃত্যুতে, আর মৃত্যু নিয়ে আমাদের ভাবনায়। এ ব্যাপারে যা কিছু বলা সম্ভব তা সব বলা হয়ে গেছে। তবে এই বিষয়ে স্ফূর্তি এড়ানো উচিত। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে সবাই এমন ভাবে বাঁচে যেন মৃত্যু সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। কারণ মৃত্যুর অভিজ্ঞতা কেমন সেটা কেউই জানে না। জীবিত আর চেতন সত্ত্বা ছাড়া কোন অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব না। তাই অন্যের মৃত্যু নিয়ে কথা বলা সম্ভব না। এসব বিকল্প আর ভ্রম আমাদের মনঃপুত হয় না। প্রচলনের বিষাদ কখনো প্ররোচনা দিতে পারে না। মৃত্যুভীতির আসল কারণ ঘটনাটার গাণিতিক ধারণা থেকে আসে। ভীতির জন্ম হয় কারণ সমস্যাটা আগে আসে, সমাধান আসে পরে। আত্মার সম্পর্কে সকল কাব্যিক বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্যকে একসময় সত্য মনে করা হত। জড় শরীর যেখানে আঘাতের কোন চিহ্ন থাকে না- আত্মা সেটাতে নাই। এই ব্যাপারটা মৌলিক আর নিশ্চিতরূপে অর্থহীনতার জন্ম দেয়। এই ভাগ্যের আলোয় দেখলে জীবনকে গুরুত্বহীন মনে হয়। নৈতিক কোন শিক্ষা বা চেষ্টাই ভাগ্যের গাণিতিকতাকে স্বতঃলব্ধ ন্যায্যতা দেয় না।
.
আবারো বলি, এসব কথা নতুন না। এসব কথার শ্রেণীকরণ আর স্বতঃসিদ্ধতার আলোচনা আমার সীমানা। এসব কথা সাহিত্য আর দর্শনেই আছে। দৈনন্দিন আলাপে এসব কথার অনুপ্রেরণা দেখা যায়। এই কথাগুলো কিন্তু মৌলিক কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমার আগ্রহ, আবারও বলি, অর্থহীনতায় না, তার ফলাফলে। কেউ অর্থহীনতা বুঝে গেলে সে কী উপসংহারে যায়, এসব সত্য থেকে পালিয়ে কতদূর যাওয়া যায়? তাদের কি আত্মহত্যা করা উচিত, না সব কিছুর বিপরীতে বেঁচে থাকা উচিত? তার আগে স্বল্প চিন্তিত এই তালিকা নিয়ে কী বুদ্ধির জগতে প্রবেশ করার প্রয়োজন আছে!
.
মনের প্রথম কাজ হচ্ছে মিথ্যা থেকে সত্য আলাদা করা। চিন্তার শুরুতেই সাংঘর্ষিকতা দেখা যায়। এই সাংঘর্ষিকতা এড়ানোর চেষ্টা বৃথা। এরিস্টটল ছাড়া আর কেউ এর এত ভাল ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেন নি-
“এই ব্যাখ্যার হাস্যকর দিক হচ্ছে- এটা নিজেকেই খণ্ডন করে। ‘সবই সত্য’ এই দাবি এর বিপরীতের দাবিকেও সত্য বলে বিবেচনা করে। আর এভাবে সে নিজেই মিথ্যা হয়ে যায়। আবার ‘সবই মিথ্যা’ এই দাবি নিজেকেই মিথ্যা বলে। আমরা যদি বলি আমাদের দাবির বিপরীতের সকল দাবিই মিথ্যা বা সত্য, তবে আমরা অসীম সংখ্যক মিথ্যা বা সত্য দাবিকে মেনে নিচ্ছি। কারণ যে সত্য দাবি করে সে দাবি করে তার দাবি সত্য কারণ তার দাবি সত্য আর এভাবেই চলতে অসীম সংখ্যকবার দাবি চালানো সম্ভব।”
.
এই বৃত্তটা মনের বিশ্লেষণের অসীম পতনের শুরু মাত্র। এই ধাঁধার সারল্য একে অহ্রাসযোগ্য বানিয়ে দেয়। শব্দ আর যুক্তির কসরতের ভেতর দিয়ে বুঝার চেষ্টা জ্ঞানের একত্রীকরণের নামান্তর মাত্র। মনের হাজারও আকাঙ্খার মাঝে সবচেয়ে গভীর আকাঙ্খা নিজের জগতকে বুঝতে পারার, পরিচিত বস্তুর তুলনা দিয়ে চিনতে পারার, নিশ্চিত হয়ে জানতে পারার সমান্তরালে চলে। মানুষের কাছে জগতকে বুঝতে পারার অর্থ হচ্ছে জগতকে নিজের স্তরে নামিয়ে আনা, নিজের চিহ্ন দিয়ে একে চিহ্নিত করা। বিড়ালের জগত আর পিঁপড়ার জগত তাই আলাদা। ‘সকল চিন্তাই নরাত্বরোপী’ (anthropomorphic) এই স্বতঃসিদ্ধতার অর্থও তা-ই। একই ভাবে মন চিন্তাকে এর প্রাথমিক এককে নামিয়ে এনে বুঝা চেষ্টা করে তুষ্ট হয়। মানুষকে যদি বুঝানো যায় এই মহাজগত তার মত কষ্ট পায়, বা ভালবাসে, সে এই মহাজগতের সাথে একাত্মতা অনুভব করবে। চিন্তার প্রতিফলন আর তার অন্যান্য কর্মের সাথে চিন্তার স্থায়ী সম্পর্ককে যদি একটা মূলনীতিতে বেঁধে ফেলা যায় তবে মানুষ বুঝতে পারে এই বুদ্ধিবৃত্তিক জয়ের আনন্দ একটা নকল আনন্দ, ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না। একাত্মতার জন্যে এই নষ্টালজিয়া, পরম সত্যের জন্য মানুষের ক্ষুধা মানুষের মানবিক অবস্থায় অনুপ্রেরণা দেয়। এই নষ্টালজিয়ার অস্তিত্ব প্রমাণ করে না, কিন্তু, এই নষ্টালজিয়া সব সময় নিবৃত্ত হবে বা হওয়া উচিত। যদি এই দুটাকে মেলানো যায়, পারিমেনিডিসের মতই আমরাও একাত্ম লাভ করি, মনের অদ্ভুত দ্বিচারিতায় নিজেকে আবিষ্কার করি যেখানে আমরা দাবি করি আমরা একাত্মতা লাভ করেছি, এই একাত্মতা নিজেদের মধ্যকার পার্থক্য দেখানোর মাধ্যমে আমাদের দাবিকে ভুল প্রমাণ করে। এই ঘৃণ্য বৃত্ত আমাদের দুশ্চিতার কারণ, আমাদের হতাশার উৎস।
.
এগুলো স্বতঃসিদ্ধতা। আবারো বলি, এসব কথা বিস্ময়ের জন্ম দেয় না, কিন্তু এগুলো থেকে পাওয়া উপসংহার বিস্ময়কর। আরেকটা স্বতঃসিদ্ধ কথা আছে- মানুষ মরনশীল। এই কথা থেকে পাওয়া উপসংহারের ব্যপ্তি অগণিত। এই রচনার কেন্দ্রীয় ভাবটা বিবেচনা করুন- আমরা যা ভাবি আমরা জানি, আর আমরা যা আসলে জানি- এ দুইয়ের বিচ্ছেদ ঘটানো এই রচনার কেন্দ্রীয় ভাব। প্রায়োগিক সহমত আর পরীক্ষিত অজ্ঞতা আমাদের ভাবনার মূলে থাকে, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি এই ভাবনা আমাদের সকল জ্ঞানকে, আমাদের জীবনের পথকে তছনছ করতে দিতে পারে। এই সাংঘর্ষিকতা আমরাই বানাই, আর এরা আমাদের মধ্যে থাকা দ্বিচারিতাকে চোখের সামনে নিয়ে আসে। একাত্মতার প্রতি আমাদের নষ্টালজিয়া তখনই নিবৃত হয় যখন মন এই ভাবনার ব্যাপারে আশার জগতে নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু এই নিঃশব্দতা ভাঙ্গা প্রথম উচ্চারণ আশার জগতকে ধ্বংস করে দেয়। আশার অগণিত ভাঙ্গা টুকরা নিয়ে আমরা এই জগতকে বুঝতে চাই। মনের শান্তির জন্যে আবার আগের জগত বানানোর আগে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। শতশত বছরের দর্শন আর হাজারো দার্শনিকরা আমাদের সকল ক্ষেত্রে এই কথাই বলে গেছেন। পেশাদার যুক্তিবাদী ছাড়া বাকি সবাই জ্ঞানকে ভয় পায়। যদি মানব চিন্তার ইতিহাস লেখা হয়, সে ইতিহাস ভরা থাকবে খেদ আর অযোগ্যতায়।
.
কী বা কার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি ‘আমি একে জানি!’। আমার হৃদয় আমি অনুভব করি, আর তাই আমি বলতে পারি এটা আছে। এই পৃথিবীকে আমি দেখতে পাই, আর তাই আমি জানি এটাও আছে। এইটুকুই আমি নিশ্চিত হতে পারি, আর বাকি সব হচ্ছে বানানো। আমি যদি চেষ্টা করি স্বত্তাকে ধরার, বা সংজ্ঞায়িত করার বা সারমর্ম করার, সে পানির মতই আমার হাত থেকে বের হয়ে যায়। আমি এক এক করে আমার সকল দিককে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। গুণাগুণ, জন্ম, বেড়ে ওঠা, আকুতি আর নিশ্চুপতা, মহত্ব আর জঘন্যতা। কিন্তু সব কিছুকে যোগ করে আমাকে জানা যায় না। আমার সত্ত্বা আমার কাছেই রহস্যময় হয়ে থাকে। আমার অস্তিত্ব আর আমার গুণাগুণের মাঝের শূণ্যতাকে পূরণ করতে আমি ব্যর্থ। আমি নিজের কাছেই অপরিচিত। মনস্তত্ত্ব আর যুক্তিবিদ্যায় অনেক সত্য পাওয়া যায়, কিন্তু একটা পরম সত্য পাওয়া যায় না। সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ কথাটার মূল্য ‘সৎ পথে চলো’ এর মতই। এদের মধ্য দিয়ে একটা নষ্টালজিয়া আর অজ্ঞতা প্রমাণিত হয়। এসব চর্চা নিরস চর্চা। এরা ঠিক ততটাই নির্দিষ্ট যতটা এরা আনুমানিক।
.
আমি গাছকে চিনি এর কান্ডের রুক্ষতায়, পানিকে চিনি এর স্বাদে, ঘাসের গন্ধ, রাতের তারা- এসবকে কীভাবে আমি অস্বীকার করতে পারি? কিন্তু জগতের সকল জ্ঞানও আমাকে নিশ্চিত করে বুঝাতে পারে না যে এই জগত আমার। আমার কাছে এগুলো ব্যাখ্যা করা হয়, আমাকে শেখানো হয়। ভেঙ্গে আলাদা করে আমাকে বুঝানো হলে আমি বুঝতে পারি। সব শেষে আমাকে জানানো হয় শতরঙ্গী এই পৃথিবীকে অণু-পরমাণু আর তার পরে ইলেক্ট্রন প্রোটনে ভাগ করা যায়। এসব শুনতে ভাল লাগে, আমার জানার ইচ্ছা বাড়ে। আমাকে এসব কল্পনা করতে বলা হয়, এমন একটা অদৃশ্য জগত যেখানে সৌরজগতের মত ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আমি বুঝতে পারি এই ছবিটা কল্পনা। আপনার এসব কথা সত্য না কাব্যিকতা সেটা আমি জানি না। আমার কী রুষ্ট হওয়ার সুযোগ আছে? আপনি আপনার ধারণা পরিবর্তন করেছেন। বিজ্ঞান আমাদের ধারণা শিক্ষা দেয়, উপমা আর রূপকে ভরা, অনিশ্চিত শিল্প কর্মের ধারণা। আমার এত কিছু জানার প্রয়োজন ছিল না। সূর্যাস্তের সময়ের পাহাড় আমাকে আরো বেশি শিখিয়েছে। আমি আবার সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি যেখানে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞান দিয়ে জগতের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়, কিন্তু ব্যাখ্যা জেনে জগতকে বুঝা যায় না। আমি প্রশান্তিকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারি না। কিন্তু আপনি আমাকে শেখাচ্ছেন একটা ব্যাখ্যা যা সব কিছু বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু আমাকে কিছুই শিখাতে পারে না- আর একটা ধারণা যা আমাকে শিক্ষা দিচ্ছে কিন্তু কোন নিশ্চয়তা দিচ্ছে না- এ দুইয়ের মধ্যে একটা বেছে নিতে। নিজেকে না জানা আমি কীভাবে চিন্তা নিয়ে শ্রান্ত হবো, চিন্তা যা নিজেকে ভুল প্রমাণ করে? এই আকাঙ্খা আপার্তবৈপরীতার জন্ম দেয়। ভাবনাহীনতা, শিল্পহীনতা আর মারাত্মক ত্যাগ ছাড়া বিষাক্ত শ্রান্তি আসে না
.
তাই, বুদ্ধিমত্তাও আমাকে অর্থহীনতার শিক্ষা দেয়। আর এর প্রতিপক্ষ, অন্ধ যুক্তি বলে সে সব জানে শুধু প্রমাণের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে, আর শত শত দার্শনিকের পরে এরা কোন অগ্রগতি করতে পারে নি। এই জগতে এমন কোন আনন্দ নাই যা আমার ছোঁয়ার বাইরে। সার্বজনীন যুক্তি, নৈতিক অথবা প্রায়োগিক; নিশ্চয়তা, সব কিছু ব্যাখ্যা করার জন্যে শ্রেণীকরণ, মানুষ হাসানোর জন্যে যথেষ্ট। মনের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নাই। মনের অমোঘ সত্যকে এরা অস্বীকার করে। এই জগতে, তাই মানুষ লক্ষ্য খুঁজে। একগাদা অযৌক্তিকতায় সে নিজেকে ঘিরে রাখে, শেষ পর্যন্ত। মানুষ যখন পুনরায় নিজেকে আবিষ্কার করে, স্বচ্ছতায়, সে অর্থহীনতাকেও আবিষ্কার করে, পরিষ্কার এবং নিশ্চিত অর্থহীনতা। আমি বলেছি জগৎ অর্থহীন- তবে আমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। এই জগৎ যৌক্তিকতার ধার ধারে না, এতটুকুতেই আমার থেমে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অর্থহীনতা সেখানেই যেখানে অযৌক্তিকতা আর মানুষের স্বচ্ছতার আকাঙ্খা মুখোমুখি দাঁড়ায়। অর্থহীনতা জগৎ আর মানুষ দুইয়ের উপরই নির্ভরশীল। কারণ এখন এই অর্থহীনতাই এ দুয়ের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করে। এই দুই সত্ত্বার সাথে অর্থহীনতার সম্পর্ক দুইটি প্রাণীর মধ্যে ঘৃণার সম্পর্কের মত। এই লক্ষ্যহীন জগতে আমি এটাই শুধু নিশ্চিতভাবে জানি। এখানে আমাদের একটু থামা উচিত। আমি যদি অর্থহীনতাকে সত্য ধরি, যদি ভাবি অর্থহীনতা এই জগতের সাথে আমার সম্পর্ককে নির্ধারণ করে, বিজ্ঞানের মত স্বচ্ছতা নিয়ে এই দাবি করলে আমার সব কিছু উপরের অনিশ্চয়তার কাছে ছেড়ে দিতে হবে, ধরে নিতে হবে এই দাবিই নিজের সত্যতার প্রমাণ। আমি এসব বলছি ভদ্রতা থেকে। তবে আমার জানা দরকার, এমন অনিশ্চয়তার মরুভূমিতে চিন্তা বাঁচতে সক্ষম কী না।
****
আমি জানি এই জগতে চিন্তার আগমন হয়েছে। এখানে চিন্তা বেঁচেও ছিল। এখানে এসে চিন্তা বুঝতে পেরেছে তার আগের সকল কর্ম ভাসাভাসা জ্ঞানের উপর বানানো ছিল। আর তাই মানুষের চরিত্রের কিছু মৌলিকতাকে ন্যায্যতা দিয়েছে চিন্তা।
.
অর্থহীনতাকে চিনতে পারার সময় থেকে অর্থহীনতা একটা আসক্তির মত হয়ে যায়। কিন্তু এই আসক্তি নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব কী না- আসক্তির দেয়া শর্ত মেনে চলা সম্ভব কী না- মনকে একই সাথে মহিমান্বিত করে আর যন্ত্রণা দেয় এমন শর্ত মেনে বেঁচে থাকা যায় কী না- সেটাই প্রশ্ন। তবে এই প্রশ্ন শুরুতেই করার মত মৌলিক প্রশ্ন না। অর্থহীনতার পুরো অভিজ্ঞতার মৌলক ধারণা এই প্রশ্ন। এই প্রশ্নে ফিরে আসার সময় অনেক পড়ে আছে। আমাদের আগে এই মরুভূমিতে জন্ম নেয়া অনুপ্রেরণা আর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। এদের সাথে পরিচিত হলেই চলবে। অযৌক্তিকতাকে রক্ষা করা লোক চিরকালই ছিল। লজ্জাজনক ভাবনা বলতে যা বুঝায় তা সব সময়ই ছিল, সেটা কখনো বিলুপ্ত হয় না। র‍্যাশনালিজমের সমালোচনা বহুবার করা হয়েছে, এখন সেটা শুরু করার কোন অর্থ নাই। কিন্তু আমাদের সময়ে এই বৈপরীত্যের পূণর্জন্ম এমন ভাবে হয়েছে যে যৌক্তিকতা কোনভাবে এগিয়ে আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা যৌক্তিকতার কার্যকারিতা প্রমাণ করে না, অন্তত সেভাবে না যেভাবে যৌক্তিকতাবাদিরা চান। চিন্তার ইতিহাসের এই মোড়ে এই দুই চিন্তা ব্যবস্থা শুধু মানুষের একাত্ম আর স্বচ্ছতার নষ্টালজিয়ার আবেগকে স্পষ্ট করে, অর্থহীনতায় তার চারপাশের দেয়াল এগিয়ে আসতে থাকে।
.
কিন্তু যৌক্তিকতাবাদের উপর আক্রমন আমাদের সময়ে অনেক হিংস্র, আগে কখনোই এমন ছিল না। জরাথ্রুষ্টের “দৈবাৎ- এটাই জগতের সবচেয়ে বড় গুণ। আমি যখন বলেছি তাদের উপর কোন দৈবিক ইচ্ছার প্রয়োগ হয় না, আমি সকল কিছুকেই বুঝিয়েছি।” আর কিয়ের্কগার্দের “পীড়া মৃত্যু ঘটায়, আর তার পরে আর কিছুই নাই”-তে অর্থহীনতার গুরুত্ব আর যন্ত্রণাদায়ক বিষয়গুলো একে একে এসেছে। মানুষের এই অবস্থার গুরুত্ব ধর্মীয় আর অযৌক্তিকতার জন্যে মৌলিক। জেসপার থেকে হাইডেগার, কিয়ের্কগার্দ থেকে চেস্তভ, প্রপঞ্চবাদি (phenomenologist) থেকে শ্কেলার যুক্তি আর নৈতিকতার পেছনে নিজের স্বচ্ছতার আবেগে, নিজের পন্থায়, ছুটেছেন। যৌক্তিকতার পথকে বন্ধ করে সত্যের সন্ধানে নেমেছেন। আমি ধরে নিচ্ছি আমার পাঠক এদের কর্মের সাথে পরিচিত, আর এই লেখা পড়ার সময়েও এদের কর্ম আলোচনায় আছে। তারা যা-ই করেছেন- বা করতে চেয়েছেন- তার শুরু হয়েছে এই জগতের অভিজ্ঞতায়, সাংঘর্ষিকতা, যন্ত্রনা আর অসারতার অভিজ্ঞতায়। এই লেখায় বর্ণিত বিষয়গুলো তাদের মধ্যেও আছে। তারা যে উপসংহারে গিয়েছেন সেটা তাদের নিজেদের জন্যে আর আমাদের জন্যে মুখ্য। এদের গুরুত্ব এতই যে এদের আলাদা আলাদা করে দেখতে হবে। কিন্তু এখন আমরা তাদের পরীক্ষন আর ফলাফল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকব। আমরা তাদের ঐক্যমতের জায়গাগুলো দেখব। তাদের দর্শনের উপর মন্তব্য করা অযাচিত, অপরিপক্ক হবে, তবে তাদের দর্শনের প্রকৃতি আলোচনা করা যেতেই পারে।
.
হাইডেগার মানুষের অবস্থাকে নির্দয়, নির্মোহভাবে বিবেচনা করেছেন, উপসংহারে তিনি বলেছেন মানুষের অস্তিত্ব লজ্জার। উদ্বেগই হচ্ছে একমাত্র বাস্তবতা, যা সবাইকে একই সমানে নিয়ে আসে। যারা এই জগতের সাথে বেশি জড়িত, এর বিনোদনে মত্ত, তাদের উদ্বেগ কম। কিন্তু এই উদ্বেগ যদি স্বজ্ঞাজাত হয়, ভীতির জন্ম হয়- ভীতি থেকে হয় যন্ত্রনা। স্বচ্ছ মানুষের মন তখন যন্ত্রণা বুঝতে পারে। দর্শনের এই অধ্যাপক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেন- ‘মানুষের সসীম আর বদ্ধ চরিত্র মানুষের অস্তিত্বের চেয়েও প্রাচীন’। কান্টের কর্মের শুধু “শুদ্ধ যুক্তি” হাইডেগারকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি উপসংহারে বলেন- ‘যন্ত্রনায় ভরা মানুষকে এই জগত কিছুই দিতে পারে না’। উদ্বেগ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আর তিনি উদ্বেগ ছাড়া আর কিছুর প্রতি আগ্রহী না। তিনি উদ্বেগের কয়েকটা ধাপও তালিকাবদ্ধ করেছেন।
বিষন্নতা- যখন সাধারণ মানুষ নিজের উদ্বেগ কাটানোর চেষ্টা করে, কমাতে চেষ্টা করে।
ভীতি- যখন মানুষ মৃত্যু নিয়ে ভাবে।
তিনিও চৈতন্যকে অর্থহীনতা থেকে আলাদা করেন নি। মৃত্যুর ব্যাপারে চৈতন্য উদ্বেগের জন্ম দেয় আর “অস্তিত্ব নিজেকে চৈতন্যের আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে থাকে”। চৈতন্য যন্ত্রনার ভাষা, আর এটি অস্তিত্বকে ‘অজানায় হারিয়ে যাওয়া’ থেকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। সে কারণে ঘুমের চেয়েও মৃত্যুর জন্যে তৈরি থাকাটা বেশি জরুরি। অর্থহীনতায় ভরা জগতে দাঁড়িয়ে তিনি এর ক্ষণজীবিতার কথা বলেছেন। এই ধ্বংসস্তুপে চলার পথ খুঁজেছেন তিনি।
.
জেসপার তত্ত্ববিদ্যা (Ontology) অপছন্দ করতেন কারণ তিনি ভাবতেন মানুষ সরলতা হারিয়েছে। তিনি জানেন দৃশ্যমান এই খেলায় চিরস্থায়ী কিছু আমরা লাভ করতে পারব না। তিনি জানেন ব্যর্থতা মনের শেষ ধাপ। তিনি আধ্যাত্মিকতার জগতে গিয়ে এর সকল ব্যর্থতা আর ভুলের বর্ণনা দিয়েছেন। এই জগতে, জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার জগতে যেখানে শূণ্যতাই একমাত্র বাস্তবতা অনিরাময়যোগ্য অবসাদ একমাত্র কৌশল- সেখানে তিনি আরিয়াডনির সুতা খুঁজে গভীরতর তথ্য বের করতে চেয়েছেন।
.
চেস্তভ তার একঘেয়ে আর একই পন্থার কাজে দেখিয়েছেন যৌক্তিকতা সবসময়ই অযৌক্তিকতার কাছে হার মানে। দ্বিচারিতা আর সাংঘর্ষিকতা মানুষের মধ্যে ভরা, সেটা তিনি দেখেছেন। এই ব্যতিক্রমতা তার আগ্রহের বিষয়। দস্তয়েভস্কির অভিশপ্ত মানুষের অভিজ্ঞতা, নিৎসের চিন্তার অভিযাত্রা, হ্যামলেটের শাপ, ইবসেনের আভিজাত্য- সব দেখেছেন চেস্তভ, আর এসবের মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অপ্রতিকার্যের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইকে। তিনি যৌক্তিকতার যুক্তিকে অগ্রাহ্য করেছেন, চিন্তার অনুর্বর মরুভূমিতে নেয়া অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত তার কাজের বিষয় ছিল।
.
সবার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর কিয়ের্কগার্দ অর্থহীনতাকে শুধু আবিষ্কারই করেন নি, তিনি অর্থহীনতায় বেঁচে ছিলেন…তিনি নিশ্চিত করেছেন কোন সত্যই পরম সত্য না, বা তৃপ্তি দিতে পারে না, কারণ অস্তিত্ব ব্যাপারটাই অতৃপ্তির। ভাবনার জগতের এই ডন হুয়ান একই সাথে সাংঘর্ষিকও ছিলেন, তিনি লিখেছেন Discourse of Edification আর নিরাশাবাদী আধ্যাত্মিকতার মূলনীতি The Diary of the Seducer, তিনি স্বান্তনা, নৈতিকতা আর মূলনীতিকে অগ্রাহ্য করেছেন। চিন্তার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এগুলোকে বাদ দিয়েছেন তিনি, তিনি তার মনের পীড়াকে প্রশমিত করেন নি। তিনি বরং এই পীড়াকে জাগিয়েছেন, ক্রুশবিদ্ধ লোকের আনন্দকে তিনি প্রকাশ করেছেন- আর তার থেকে বের করেছেন স্বচ্ছতা, প্রত্যাখ্যান আর ছলনা জাতীয় শ্রেণীবিভাগ যা মানুষ লালন করে। মানুষের নতুন চেহারা কোমল, কিন্তু বিদ্রুপাত্মক, এই নৃত্যের পরে আসে মনের অর্থহীনতার চিৎকার যখন সে বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে শেখে…
.
অন্য এক জগতে, অন্য এক পথে, হাসের্ল আর প্রপঞ্চবাদিরা জগতকে যৌক্তিকতার মহাজাগতিকতা থেকে মুক্ত করে এর বিচিত্রতা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতার জগৎ তাদের হাতে অলংকৃত হয়েছে শুরুতেই। গোলাপের পাপড়ি, মাইলফলক, মানুষের হাত, ভালবাসা, আকাঙ্খা আর মহাকর্ষ একই সমান গুরুত্ব পেয়েছে তাদের কাছে। ভাবনা প্রয়োগ আর একত্রিকরণে ব্যবহৃত হয় নি, ভাবনা আর নষ্টালজিয়াকে মেটানোর কাজে লাগেনি তাদের দর্শনে। ভাবনা মানুষকে নতুন করে দেখতে শেখায়, মনোযোগ দিতে শেখায়, চৈতন্যকে নির্দিষ্ট করে। প্রৌস্টের মত নিজের গরীমায় বিবেচ্য হয়। কিয়ের্কগার্দ আর চেস্তভের চেয়ে বেশি ইতিবাচকভাবে হাসের্লের পন্থা চিরায়ত যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে, নিরাশাবাদকে উৎসাহ দেয়, ঘটনার বিস্তারকে ভাবনার জগতে খুলে ধরে- স্বত্বজ্ঞানকে খুলে দেয়- যার মধ্যে অতিমানবিকতা বা অমানবিকতা আছে। এই পথেই সকল বিজ্ঞান কাজ করে, অথবা কোন বিজ্ঞানই নাই। অর্থাৎ গন্তব্যের চেয়ে যাত্রা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের ভাবনা “বুঝার মনোভাব”, কোন স্বান্তনা নয়। আবারো বলি, এগুলো শুরুতে হয়।
.
কীভাবে কেউ এই দর্শনগুলোর মধ্যের মিল দেখে না? তারা কীভাবে না দেখে থাকে যে তাদের সিদ্ধান্ত আনন্দ বা দুঃখের সময়ে নেয়া সিদ্ধান্ত যেখানে আশার কোন প্রয়োজনই ছিল না? আমি সবই জানতে চাই, অথবা আমার কিছুই জানার প্রয়োজন নেই। মনের এই আকাঙ্খা শুনলে যুক্তি অসার হয়ে যায়। মন এই আকাঙ্খায় জাগে আর সাংঘর্ষিকতা আর অসারতা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না সেখানে। আমি অযৌক্তিকতা বুঝি না। পৃথিবী এমন অযৌক্তিকতায় ভরা। এই জগত যার সাধারণ-সার্বজনীন কোন অর্থ নাই, একটা বিরাট অযৌক্তিকতা। কেউ যদি একবার বলতে পারে “সব পরিষ্কার” তবে সবই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ একে অন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তারা বলে কিছুই পরিষ্কার না। সবই এলোমেলো, আর তারা স্বচ্ছতা আর জ্ঞানের নিশ্চয়তার দেয়ালে বন্দি।
.
এসকল অভিজ্ঞতাগুলো একে অন্যকে নিশ্চিত করে। মন, যখন তার সীমানায় পৌঁছায়, বিচার আর উপসংহার বানাতে বাধ্য। কিন্তু আমি চাই এই কৌশলটাকে উলটো থেকে শুরু করতে, শুরুটা হবে এই বুদ্ধিদীপ্ত যাত্রার উপসংহার থেকে, আর ধীরে ধীরে দৈনন্দিন কাজে এর প্রতিফলন আসবে। এই ভাবনা, অভিজ্ঞতা মনের মরুভূমিতে জন্ম নিয়েছে বলে আমরা এদের সেখানে ফেলে আসতে পারি না। আমরা কতদূর পৌঁছেছি সেটা বুঝতে এর প্রয়োজন আছে। মানুষ এই অবস্থায় অযৌক্তিকতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে তার মধ্যে আনন্দ আর যৌক্তিকতার প্রয়োজন অনুভব করে। অর্থহীনতার জন্ম এই চাহিদা আর মহাবিশ্বের নিঃশব্দ অনাগ্রহের মুখোমুখি হওয়ায়। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। এটা ধরে এগুতে হবে কারণ এর উপর নির্ভর করে জীবনের ফলাফল। অযৌক্তিকতা, নস্টালজিয়া, আর অর্থহীনতা জীবন নাটকের তিনটা চরিত্র, যে নাটকের শেষে সব যুক্তির মৃত্যু হয় যেন অস্তিত্ব টিকে থাকে।

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *