“বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে”, কার্ল শান্ত স্বরে বললো, “আমার সময় প্রায় শেষ, অ্যান”।
“না”, আমি প্রতিবাদের সুরে বললাম, “ক্যান্সারকেও হার মানাবে তুমি। আগেও হারিয়েছো, এবারো হারাবে”।
সে আমার দিকে তাকালো। এই দৃষ্টি আমি হাজারোবার দেখেছি। আমাদের গত দুই দশকের প্রেমময় দাম্পত্য জীবনে একসাথে লেখালেখি করার সময়, তর্ক-বিতর্ক করার সময় কতবার যে ও আমার দিকে এভাবে তাকিয়েছে!
সন্দেহবাদ আর ঠাট্টায় মেশানো কণ্ঠে কার্ল বললো, “আচ্ছা, দেখা যাবে এবার কার কথা ফলে!”
স্যামের বয়স তখন পাঁচ বছর। সে বাবাকে শেষবারের মত দেখতে এসেছিলো। কার্ল তখন ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না, কথা বলতে পারছিলো না। সবটুকু শক্তি একত্র করে সে বললো –
“I love you, Sam”
স্যামও তার বাবাকে খুব আবেগ নিয়ে বললো “I love you, too, Dad”।
ডানপন্থী আর মৌলবাদীদের কল্পনায় যা-ই থাক, কার্ল মৃত্যুশয্যায় কোনো ধর্ম গ্রহণ করেনি, স্বর্গ বা পরকালে আশ্রয় খোঁজেনি। কার্লের কাছে সত্যের চেয়ে বড় কিছুই ছিল না। শুনতে ভালো লাগে কিন্তু আদতে মিথ্যে, এমন জিনিসগুলো কার্লের মন জয় করতে পারেনি কখনোই। মৃত্যুশয্যায় বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কাউকে কি খুব একটা দোষারোপ করা যায়? কিন্তু তেমন একটা সময়ে এসেও কার্ল বাস্তবতার সঙ্গ ছাড়েনি। দুজনের দৃষ্টি একে অপরের দিকে পড়তেই আমার মনটা হাহাকার করে উঠলো; আমরা দুজনই বাস্তববাদী, আর এই মুহূর্তের কঠিন বাস্তবতাটা হচ্ছে – আমাদের অসাধারণ দাম্পত্য জীবনটা শেষ হতে চলেছে।
আমাদের পরিচয় হয়েছিল নোরা এফ্রনের ডিনার পার্টিতে, ১৯৭৪ সালে, নিউ ইয়র্কে। হাতা গুটানো শার্ট, আর মুখে জগদ্বিখ্যাত হাসি – খুবই সুদর্শন ছিলো কার্ল। আমরা বেসবল আর পুঁজিবাদ নিয়ে আলাপ করেছিলাম। আমার মনে আছে, কোনো চেষ্টা করা ছাড়াই কার্ল আমার কথাগুলো শুনে হাসছিলো। কিন্তু কার্ল তখন বিবাহিত, আর আমারো আরেকজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। আমরা চারজন একসাথে আড্ডা দিতাম প্রায়ই। মাঝে মাঝে এমন হতো যখন শুধু আমি আর কার্ল আড্ডা দিচ্ছি, আর কেউ নেই। তখন চারপাশে একটা ভিন্ন আবহ এসে যেত, একটা চাপা অনুভূতি কাজ করতো। কিন্তু আমরা কেউই আমাদের আবেগের কথা প্রকাশ করতাম না, আকারে-ইঙ্গিতেও না। প্রশ্নই আসে না!

১৯৭৭ এর বসন্তে নাসা কার্লকে একটা বিশেষজ্ঞ দল বানাতে বললো, যাদের কাজ হবে ভয়েজার ১ আর ২ মহাকাশযানে করে কী বার্তা পাঠানো হবে সেটা ঠিক করা। সৌরজগতের গ্রহগুলোর ছবি তোলার পরে ভয়েজার দুটোই সৌরজগতের বাইরের দিকে চলে যাবে। অন্য জগতের প্রাণীদের কাছে বার্তা পাঠানোর এই একটা সুযোগ ছিল আমাদের কাছে। এর আগে কার্ল পায়োনিয়ার মহাকাশযানে করে বার্তা পাঠিয়েছিলো। ঐ প্রজেক্টে কার্লের স্ত্রী লিন্ডা সালজম্যান আর জ্যোতির্বিদ ফ্রাঙ্ক ড্রেকও ছিলেন। পায়োনিয়ারের ফলকটা ছিল মহাজাগতিক নাম্বারপ্লেটের মত। এবারেরটা আরেকটু বিস্তারিত, আরেকটু জটিল হবে। ভয়েজারের রেকর্ডে থাকবে মানুষের ষাটটি ভাষা আর একটি তিমির ভাষায় অভিবাদন, বিবর্তন নিয়ে একটা প্রবন্ধের রেকর্ড, পৃথিবী সাস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ১১৬টি ছবি। ইঞ্জিনিয়াররা বলছিলেন, সোনালি রঙের এই ফোনোগ্রাফ রেকর্ডগুলো এক বিলিয়ন বছর ধরে অক্ষত থাকবে।
১ বিলিয়ন বছর! ১ বিলিয়ন বছর আসলে কত দীর্ঘ? এক বিলিয়ন বছরে পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি এতই বদলে যাবে যে আমরা নিজেরাই নিজেদের পৃথিবীকে আর চিনতে পারবো না। এক বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিলতম প্রাণী ছিল ব্যাক্টেরিয়া। পারমাণবিক অস্ত্রের ছড়াছড়ির যুগে এক বিলিয়ন বছর পরে কী হবে, সেই চিন্তা করাটা বৃথা। আমরা যারা ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ডে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, তারা সবাই অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে কাজটার উদ্দেশ্য কতটা পবিত্র! নিজেদেরকে নূহের মত মনে হচ্ছিলো, কারণ মানবসভ্যতা হারিয়ে গেলেও আমাদের জাহাজে সংগ্রহ করা নিদর্শনগুলো টিকে থাকবে মহাকালের পথ পরিক্রমায়।
আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিলো চাইনিজ মিউজিক খোঁজার। বেশ কঠিন কাজ আমার জন্য! আমি কার্লকে ফোন করলাম, সে টুসনের (Tucson) একটা হোটেলে এসেছিলো বক্তব্য দেয়ার জন্য। কার্ল রুমে না থাকায় আমি তার জন্যে একটা মেসেজ রেখে দিলাম। ঘণ্টাখানেক পরে আমার ম্যানহাটনের বাসায় ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা ধরতেই অপর পাশ থেকে কার্ল বললো –
“রুমে ঢুকে একটা মেসেজ পেলাম, ‘অ্যানি কল করেছিলো’। হোটেল কর্তৃপক্ষ ভেবেছে, অ্যানি ওর স্ত্রী।
আমি মনে মনে আফসোস করলাম ‘ইস, কেন যে দশ বছর আগে কল করলাম না!”
একটু কৌতুকের ছলে বললাম, “ওই ব্যাপারে কথা বলতেই কল করেছিলাম… তুমি রাজি থাকলে বলো! আজীবন?”
“আজীবন”, কার্ল বেশ নিচু স্বরে বললো, “চলো, বিয়ে করে ফেলি”।
“আচ্ছা”, আমি বলেছিলাম।
আর ঐ সময়ে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম প্রকৃতির নতুন আইন আবিষ্কার করার রোমাঞ্চ কেমন হতে পারে। এটা ছিল একটা ইউরেকা মুহুর্ত, যেন কোন অমোঘ সত্য উন্মোচিত হয়েছিল তখন, এমন সত্য যা আগামী বিশ বছর ধরে বারবার প্রমাণিত হয়ে আসবে। তবে, এই সত্যের দায়িত্বও কম ছিল না। কার্লের জগতে, বিস্ময়ের জগতে একবার পা রাখলে অন্য কিছুতে কি আর মন ভরে? জুনের প্রথম দিন আমাদের ভালবাসার পবিত্র দিন। এরপর কখনো যদি আমাদের ঝগড়া হতো, তাহলে পহেলা জুনের কথা মনে করিয়ে দিলেই যে যার ভুল বুঝে নিতো।

আগে কোনো একটা মিটিং-এ আমি কার্লকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বিলিয়ন বছর পরের কোনো মহাজাগতিক সভ্যতা কী মানবমস্তিষ্কের স্পন্দনকে বিশ্লেষণ করতে পারবে?”
“কে জানে? বিলিয়ন বছর অনেক, অনেক দীর্ঘ একটা সময়” সে বলেছিলো, “যদি পারে, সেই আশায় করি না হয়”।
সেই টেলিফোন কলের দুই দিন পরে আমি নিউ ইয়র্কের Bellevue Hospital এর গবেষণাগারে গিয়ে আমার মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের স্পন্দনকে শব্দে রুপান্তর করে রেকর্ড করিয়ে নিয়ে আসি। এক ঘণ্টার এই বার্তায় আমি অনেকগুলো তথ্যের কথা চিন্তা করি, যা আমার মনে হয়েছে মহাবিশ্বের বাসিন্দাদের জানা উচিত। আমি শুরু করি পৃথিবীর ইতিহাস দিয়ে আর পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রাণের কথা ভেবে। আমি ভাবি পৃথিবী বদলে দেয়া আবিষ্কার আর মানবসভ্যতার ইতিহাসের কথা। আমি ভাবি আমাদের গ্রহের দারিদ্র্যের কথা, আমাদের সংগ্রামের কথা। শেষের দিকে আমি ভেবেছি আমার কথা, আর কার্লের সাথে প্রেমে পড়ার কথা।
কার্লের জ্বর বেড়ে গেছে। আমি ওকে আলতো করে চুমু দিলাম, ওর উত্তপ্ত গালে আমার গাল লাগিয়ে বসে রইলাম। ওর গালের উত্তাপ কেন যেন আমার দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিলো, অদ্ভুত! যেন ওর গালের সংস্পর্শে লেগে থাকলে ওর সত্তা আমার মাঝে চলে আসবে, স্পর্শের স্মৃতি হয়ে আমার মাঝে সে অমর হয়ে রইবে! আমি বুঝতে পারছিলাম না আর কী করা যায়! আমি কি কার্লকে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে বলবো? সে দু বছর ধরে কষ্ট করে যাচ্ছে, লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে! নাকি লাইফ সাপোর্ট খুলে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বলবো?
আমি ওর বোন ক্যারিকে ফোন করলাম। ক্যারি কার্লকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত কিছু যে করেছে! এমনকি নিজের অস্থিমজ্জাও দান করেছে! কার্লের ছেলে ডোরিয়ন, জেরেমি, নিকোলাস, আর নাতি টনিওকেও ডাকলাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আমরা সবাই মিলে থ্যাংকসগিভিং পালন করেছিলাম আমাদের ইথাকার বাসায়। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে ওটাই আমাদের সেরা থ্যাংকসগিভিং ছিলো। আমাদের সবার মাঝে একটা একতা এসেছিল, আমরা সবাই মিলে এক পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কার্লের কানের কাছে ফোনটা ধরলাম। একে একে সবাই ওকে বিদায় জানাবে, সে যাতে শুনতে পায়!

আমাদের লেখক/প্রযোজক বন্ধু লিন্ডা অবস্ট লস এঞ্জেলেস থেকে ছুটে এলো আমাদের কাছে। নোরা’র সেই ডিনার পার্টিতে লিন্ডাও ছিল, আর সেও কার্লের যাদুতে মোহিত হয়েছিল। আমাদের ব্যক্তিগত আর পেশাগত বিবর্তনের সাক্ষী সে। আমদের লেখা বই থেকে বানানো সিনেমা Contact-এর প্রযোজক সে। ষোল বছর ধরে সে আমাদের সাথে থেকে আমাদের কাজকে সিনেমায় রূপান্তরিত করেছিল।
লিন্ডা দেখেছে, আমাদের ভালবাসার সামনে অন্যদের ভালবাসা কীভাবে ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু সে এটা নিয়ে আমাদের প্রতি রুষ্ট ছিল না, বরং মুগ্ধ ছিল। এরকম ভালোবাসা তাহলে বাস্তবেও সম্ভব, এটা ভেবে সে অবাক হয়ে যেত। সে আমাকে Miss Bliss ডাকত। কার্ল আর আমি লিন্ডার সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম, আমরা হাসতাম, আর রাতের পর রাত বিজ্ঞান, দর্শন, সংস্কৃতি, সবকিছু নিয়ে আলাপ করতাম। সে পুরোটা সময় আমাদের পাশে ছিল, এমনকি আমি যখন বিয়ের পোশাক ঠিক করছিলাম তখনো! এখন কার্লকে চিরবিদায় জানানোর সময় এসেছে, এখনো সে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে!
সাশা (সাশা সেগান, কার্ল আর অ্যানের মেয়ে) আর আমি বেশ অনেকদিন ধরে পালা করে কার্লের কানে কানে কথা বলতাম। সাশা বলতো, সে তার বাবাকে কতটা ভালবাসে। বলতো, সে কীভাবে নিজের কাজেকর্মের মধ্যে তার বাবাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আর আমি কার্লকে বারবার বলতাম, “চমৎকার মানুষ তুমি, তোমার জীবনটাও চমৎকার! অনেক কিছু করেছো তুমি জীবনে। আমাদের ভালোবাসা নিয়ে আমার গর্বের কোনো শেষ নেই, আনন্দের কোনো সীমা নেই। তোমাকে বিদায় দিলাম, কিন্তু সেই গর্ব আর আনন্দ আমার সাথে রইলো। ভয় পেও না। পহেলা জুন! পহেলা জুন! আজীবন!”
আমি বসে বসে কার্লের বই সম্পাদনা করছি। ওর ছেলে জেরেমি স্যামকে কম্পিউটার চালানো শেখাচ্ছে, সাশা হোমওয়ার্ক করছে। ভয়েজার ১ ও ২ এই ক্ষুদ্র গ্রহের বার্তা, সঙ্গীত, আর ছবিগুলো নিয়ে সৌরজগত থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে; ঘণ্টায় চল্লিশ হাজার মাইল গতিতে আন্তঃনাক্ষত্রিক জগতের দিকে পাড়ি দিচ্ছে। আমাদের কল্পনাতেও নেই, এমন একটা নিয়তির দিকে ছুটছে। আমার চারপাশে শুভাকাঙ্ক্ষীদের চিঠি ভর্তি অনেকগুলো বাক্স, কার্লের মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে চিঠি এসেছে। অনেকেই কার্লকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তাদের মনকে জাগিয়ে তোলার জন্যে। অনেকে বলছেন কার্ল তাদের অন্ধবিশ্বাস আর মৌলবাদ থেকে ফিরিয়ে এনেছে, নিয়ে এসেছে বিজ্ঞান আর যুক্তির রাস্তায়। এই চিঠিগুলো আমাকে আনন্দ দেয়, শোক সহ্য করবার শক্তি দেয়। এগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, কার্ল বেঁচে আছে, কোনো অলৌকিক শক্তির সাহায্য ছাড়াই।
অ্যান ড্রুয়ান, ফেব্রুয়ারী ১৪, ১৯৯৭, ইথাকা, নিউ ইয়র্ক
Billions and Billions: Thoughts on Life and Death at the Brink of the Millennium