জেমস জয়েসের গল্পঃ এরাবি

Pozdneev_Staraya_Plocshad_Tolkuciy_Rynok

নর্থ রিচমণ্ড সড়কটা একটা নিঝুম কানা গলি। শুধুমাত্র ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স স্কুলের ছুটির সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য কোলাহলে জেগে উঠতো, তারপর আবার ডুবে যেতো নির্জনতায়। গলির কানা মাথায় এক খণ্ড চৌকো জমিতে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা দোতলা বিচ্ছিন্ন বাড়ি, পরিত্যক্ত। নিজেদের ভেতরের বাস করা আভিজাত্যে সজাগ বাদ বাকি বাড়িগুলো বাদামি শান্ত চেহারা নিয়ে একে অন্যের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকতো।

আমাদের বাড়ির আগের ভাড়াটিয়াটা ছিলো একজন পাদ্রি। পেছনের ড্রয়িং রুমেই তিনি মারা যান। দীর্ঘদিনের বদ্ধ বাসি বাতাসে ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলো সবগুলো ঘর। রান্না ঘরের পেছনের ঘরটা ছিলো পুরনো অকেজো ছেঁড়া কাগজপত্রে ঠাসা। ঐসব জঞ্জালের মধ্যেই আমি কিছু পেপার কভারের বই খুঁজে পেয়েছিলাম। বইয়ের পাতাগুলো স্যাঁতস্যাঁতে আর কুঁচকানো। বইগুলো ছিলো – ওয়াল্টার স্কটের দ্যা অ্যাবট, দ্যা ডেভউট কমুনিকেন্ট, এবং দ্যা মেমরি অব ভিদক। শেষ বইটাই আমার প্রিয় ছিলো, কারণ ওটার পাতাগুলো ছিলো হলদে। বাড়ির পেছনের জঙ্গল সদৃশ বাগানের মাঝখানে ছিলো একটা আপেল গাছ আর এলোমেলো কিছু ঝোপঝাড়, যার নিচেই আমি মরা ভাড়াটিয়ার ফেলে যাওয়া জং ধরা একটা সাইকেল পাম্পার পেয়েছিলাম। পাদ্রি মানুষটা বড় পরোপকারী ছিলো। তাঁর সকল অর্থকড়ি সে দান করে গিয়েছিলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর ঘরের সব আসবাবপত্র দিয়ে গিয়েছিলো নিজের বোনকে।

শীতের ছোট দিনগুলিতে রাতের খাবার সেরে উঠার আগেই ঘোর সন্ধ্যা নেমে আসতো। রাস্তায় যখন বাড়িগুলোর সাথে দেখা হতো, তখন তাঁদেরকে দেখে খুব বিষণ্ণ মনে হতো। মাথার উপরের আকাশের রঙটা সদা-পরিবর্তনশীল বেগুনী রং ধারণ করতো যার দিকে ক্ষীণ আলোয় মিটি মিটি জ্বলা লণ্ঠন তুলে ধরতো স্ট্রীট ল্যাম্পগুলো। শীতের ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের গায়ে এসে হুল ফোটাতো। শরীর উত্তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা খেলেই যেতাম। নিঝুম রাস্তার নীরবতায় প্রতিধ্বনিত হতো আমাদের হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ। আমরা খেলতে খেলতে বাড়িগুলোর পেছনে কাদা থকথকে অন্ধকার চোরা গলিতে ঢুকে পড়তাম, যেখানে কঠিন চেহারার উপজাতিদের কুটির থেকে তাদের হাতের দস্তানা নিয়ে দৌড় দিতাম। বাড়ির পেছনে অন্ধকারে ডুবে থাকা বাগানগুলো ভরে উঠতো কয়লাখনির পোড়া গন্ধে। গন্ধটা অন্ধকার বেয়ে বেয়ে সেই জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াতো যেখানে গাড়োয়ান ঘোড়াগুলোর শরীরে হাত বোলাতো অথবা ঘোড়ার সাজ পরানোর টুং টাং আওয়াজে সঙ্গীত বেজে উঠতো। যখন আমরা রাস্তায় ফিরে আসতাম, রান্না ঘরের জানালা চুঁইয়ে আলোয় আলোয় ভরে উঠতো এলাকাটা। চাচাকে রাস্তার বাঁকে দেখলেই আমরা নিরাপদে ছায়ায় লুকিয়ে থাকতাম উনি ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত। অথবা যদি মানগানের বোন ঘরের বাহিরে তাঁকে চা খেতে ডাকতে আসতো, আমরা মেয়েটাকে রাস্তার ছায়া থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। সে কি দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভিতরে যাবে সেটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম;  যদি দাঁড়িয়ে থাকতো, আমরা নিজেদের ছায়া ছেড়ে মানগানের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা শুরু করতাম। আধ খোলা দরজার আলোয় তাঁর অবয়ব দেখেই বোঝা যেতো সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যখন সে ভাইয়ের অবাধ্যতায় তাঁর সাথে খুনসুটি করতো, আমি পাশের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখতাম। সে নড়ে উঠলেই তাঁর জামায় ঢেউ খেলে যেতো, এবং তাঁর চুলের নরম বেণীটা এপাশ থেকে উপাশে দুলতে থাকতো।

প্রত্যেক সকালেই আমি সামনের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে তাঁর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পর্দাটাকে টেনে ইঞ্চিখানেক নিচে নামিয়ে রাখতাম যাতে আমায় দেখা না যায়। যখনি সে দরজার ধারটায় আসত, আমার হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠত। আমি দৌড়ে হলের দিকে যেতাম, বইগুলো হাতে নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতাম। পুরো সময়টা আমার চোখ সেঁটে থাকতো তাঁর বাদামী অবয়বে, আর যেই আমাদের পথ আলাদা হওয়ার জায়গাটা চলে আসতো, আমি দ্রুত পদে তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। এমনটা প্রতিদিন সকালেই ঘটতো। দুয়েকটি মামুলি শব্দ বিনিময় ছাড়া তাঁর সাথে আমার তেমন কোনো কথাই হয়নি, তারপরও তাঁর নামটা  যেন আমার শরীরের প্রতিটা রক্ত কণাকে বশ করে ফেলতো।

যেসব জায়গায় প্রেম-ভালবাসার চিন্তা মাথা থেকে ছুটে পালায়, সেখানেও তাঁর অস্তিত্ব আমাকে সঙ্গ দিতো। শনিবারের সন্ধ্যাগুলোতে চাচী যখন কেনাকাটা করতে বাজারে যেতো, তাঁর সাথে জিনিসপত্র বহন করার জন্যে আমাকেও যেতে হতো। আলোকোজ্জ্বল রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম। রাস্তাগুলোতে মাতাল লোকজনের ঠাসাঠাসি ছিলো, কোথাও মহিলারা দর কষাকষি করছিলো, শ্রমিকেরা অভিশাপ ছুঁড়ে দিচ্ছিলো, দোকানী ছেলেগুলোর উগ্র প্রার্থনা সঙ্গীত শোনা যাচ্ছিলো। এবং ভেসে আসছিলো ভিক্ষুকদের নাকি সঙ্গীতের সুর যেখানে উঠে আসতো তাঁদের জন্মভূমির দুঃখ দুর্দশার কথা অথবা তাঁরা গান গাচ্ছিল জনপ্রিয় হিরো রোসাকে নিয়ে। এই সমস্ত কোলাহলগুলো এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে আমার জন্যে জীবনের একটা একক অনুভুতিতে রুপ নিয়েছিলঃ আমি কল্পনা করতাম যে আমি নিরাপদে আমার পানপাত্র হাতে নিয়ে যাচ্ছি একদল শত্রুর ভিড়ের মধ্য দিয়ে। অদ্ভুত সব প্রার্থনায় তাঁর নাম আমার ঠোঁটের ডগা কাঁপিয়ে তুলতো। প্রার্থনাগুলো নিজেও বুঝতাম না যদিও। প্রায়ই আমার দুচোখ জলে ভরে উঠতো (আমি জানতাম না কেন), এবং কখনও কখনও মনে হতো হৃদপিণ্ড থেকে একটা বানের স্রোত এসে আমার বুক ভাসিয়ে দিবে। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব কমই ভাবতাম। আমি জানতাম না আদৌ আমি তাঁর সাথে কখনও কথা বলতে পারবো কিনা; আর যদি পারিও, কিভাবে তাঁর কাছে আমি আমার গভীর দ্বিধান্বিত অনুভূতি প্রকাশ করবো! কিন্তু আমার শরীরটা যেন একটা হার্প আর তাঁর কথা, অঙ্গভঙ্গিরা যেন আঙ্গুল হয়ে সে হার্প-এর তারগুলোয় সুর বাজিয়ে যায়!

এক সন্ধ্যায় আমি পেছনের ড্রয়িং রুমটায় গিয়েছিলাম যেখানে পাদ্রি মারা গিয়েছিলো। সেদিন সন্ধ্যাটা ছিলো অন্ধকার বৃষ্টিস্নাত। বাড়িতে কোন শব্দ ছিলো না, ছিলো শুধুই শুনশান নীরবতা। জানালার ভাঙ্গা কাঁচের ভেতর দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির আঘাত হানার আওয়াজ, বৃষ্টি ফোঁটার সরু সুঁইগুলো বিরামহীন খেলে যাচ্ছিলো মাটির সিক্ত বিছানায়। একটা দূরবর্তী বাতি অথবা আলোকিত জানালা জ্বলজ্বল করছিলো আমাকে লক্ষ্য করেই। এইটুকু দেখতে পেরেই আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সব কয়টি ইন্দ্রিয় যেন আড়ালে গা ঢাকা দিতে চাইছিলো, এবং মনে হচ্ছিলো যেন আমি তাঁদের কাছ থেকে ছিটকে সরে যাচ্ছি। আমি দুহাতের তালু একসাথে চেপে ধরে রাখলাম, কেঁপে ওঠার আগ পর্যন্ত। আমার ভেতর থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসলোঃ আহ প্রেম! আহ ভালোবাসা! অনেকবার।

অবশেষে একদিন সে কথা বললো আমার সাথে। যখন সে আমার দিকে প্রথম শব্দগুলো ছুঁড়ে দিলো, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী উত্তর দেবো! সে জানতে চাইলো, আমি এরাবিতে যাচ্ছি কিনা। ভুলে গেছি সেদিন আমি উত্তরে কী বলেছিলাম।

‘বাজারটা কিন্তু বেশ জমকালো’, সে বলছিলো। সে যেতে খুব আগ্রহী।

‘তাহলে যাচ্ছ না কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

কথা বলার ফাঁকে সে তাঁর হাতের কব্জির রূপালী ব্রেসলেটটা ঘুরাচ্ছিলো। বললো, সে যেতে পারবে না, কারণ ঐ সপ্তাহে তার আশ্রমে একটা অনুষ্ঠান ছিলো। তার ভাই আর অন্য দুটি ছেলে ক্যাপ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলো, আমি একলা দাড়িয়ে ছিলাম রেলিং-এর ধারে। সে আমার দিকে ঝুঁকে একটা গজাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো। বিপরীত দিক থেকে আসা ল্যাম্পের আলোয় তাঁর ঘাড়ের শুভ্র রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো তাঁর এলোমেলো চুল, রেলিং-এর উপরে রাখা তাঁর হাত। আলোটা পড়ছিলো তাঁর জামার এক পাশে, দেখা যাচ্ছিল তাঁর পেটিকোটের সাদা বর্ডার। দেখা যাচ্ছিলো, সে দাঁড়িয়ে আছে প্রশান্ত একটা ভঙ্গি নিয়ে।

‘তুমি গেলে খুব ভালো হতো’, সে বললো।

‘আমি যদি যাই’, বললাম আমি, ‘তোমার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসবো’।

ঐ সন্ধ্যার পর কত আজগুবি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো আমার ঘুমে, আমার জাগরণে! ইচ্ছে করছিলো মাঝখানের ক্লান্তিকর দিনগুলিকে মুছে ফেলি। স্কুলের কথা মনে আসতেই বিরক্ত লাগতো। রাতে শোবার ঘরে এবং দিনে ক্লাসরুমে তাঁর ছবিই ঘুরেফিরে ভেসে উঠতো আমার আর জোর করে পড়ার চেষ্টা করা বইয়ের পাতার মাঝখানে। ‘এরাবি’ শব্দটার প্রতিটা বর্ণ আমায় টেনে নিয়ে গিয়েছিলো একটা গভীর নীরবতায় যেখানে আমার বিলাসী আত্মাটা আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিলো। শনিবার রাতে আমি বাজারে যেতে ছুটি চাইলাম চাচীর কাছে। চাচী শুনে খুব বিস্মিত হলেন এবং ভাবলেন আমি যেন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার না হই। ক্লাসে আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। আমি খেয়াল করছিলাম শিক্ষকের চেহারাটা ধীরে কোমল থেকে কঠিন হচ্ছে এবং তিনি আশা করছিলেন আমি যেন অলস না হয়ে যাই। আমি আমার এলোমেলো চিন্তাগুলোকে গোছাতে পারছিলাম না। জীবনের কোনো গুরুতর কাজেই আমার ধৈর্য ছিলো না যা এখন আমার আর আমার ইচ্ছার মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের এইসব কাজকে মনে হচ্ছিলো ছেলেখেলা, কদাকার একঘেয়ে ছেলেখেলা।

শনিবার সকালে আমি চাচাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি সন্ধ্যায় বাজারে যাচ্ছি। চাচা হলের মুখে দাড়িয়ে কি যেন একটা ভাবছিলেন আর টুপির ব্রাশ খুঁজছিলেন। আমাকে সংক্ষেপে গা-ছাড়া ভাবে উত্তর দিলেন,

‘হ্যাঁ, বেটা, আমি জানি’।

যেহেতু তিনি হলের ভেতরে ছিলেন তাই আমি জানালার পাশটায় যেতে পারছিলাম না মেয়েটাকে দেখতে। আমি মন খারাপ করে বাড়ি ছেড়ে স্কুলের দিকে হাটা শুরু করলাম। বাতাসটা ছিলো নিষ্ঠুরভাবে কর্কশ এবং আমার হৃদপিণ্ডটা ইতিমধ্যেই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যখন ডিনারে গেলাম তখনো চাচা ফেরেনি। তখনো হাতে বেশ সময় ছিলো। বসে বসে ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, ঘড়িটার টিক টিক শব্দে বিরক্তি ধরে গিয়েছিলো। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙ্গে বাড়ির উপরের তলাটায় গেলাম। সেখানকার ঠাণ্ডা, খালি, অন্ধকার ঘরগুলো আমাকে মুক্তি দিলো। আমি গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে এঘর থেকে ওঘরে ঘুরতে থাকলাম। সামনের জানলাটা দিয়ে দেখলাম আমার সঙ্গী সাথীরা রাস্তার উপর খেলছে। তাদের হৈ- হুল্লোড় এর অস্পষ্ট, ক্ষীণ আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিলো। আমি জানালার শীতল কাঁচে কপালটা ঠেকিয়ে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটার অন্ধকার বাড়িটার দিকে। আমি বোধহয় সেখানে ঘণ্টাখানেক এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিছুই দেখলাম না, শুধু কল্পনায় সেই বাদামী আলোকাবৃত্ত অবয়ব ছাড়াঃ ল্যাম্প লাইটের আলো আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর কাঁধের ভাঁজ, রেলিং এর উপরে রাখা হাত, আর জামার বর্ডার।

যখন আবার নিচতলায় নেমে আসলাম, দেখলাম মিসেস মারসার আগুনের পাশে বসে আছে। তিনি একজন বয়স্ক, বাচাল কিসিমের বিধবা মহিলা। তাঁর স্বামী ছিলো একজন মহাজন। তিনি কোন এক ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পুরনো স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতেন। চায়ের টেবিলে তাঁদের গাল গল্প আমাকে সহ্য করতে হয়েছিলো। খাওয়ার সময়টা আরও ঘণ্টাখানেক বাড়ানো হয়েছিলো, তখনো চাচা বাড়ি ফেরেনি। মিসেস মারসার চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালেনঃ তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন যে তিনি আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারছেন না। আটটা বেজে গেছে। তিনি বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চান না, কারণ রাতের হাওয়াটা তার শরীরে সয় না। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি আঙ্গুল মটকাতে মটকাতে ঘরের এপাশ ওপাশ ঘুরতে থাকলাম। চাচী আমায় বললেন,

‘আজ রাতে মনে হয় তোমার বাজারে না গেলেই ভালো হয়’।

রাত ন’টায় বাইরে হল ঘরের দরজায় চাচার চাবির আওয়াজ কানে আসলো। শুনতে পেলাম সে নিজের সাথে নিজে কথা বলছে, শুনতে পেলাম তাঁর রাখা ওভার কোটের ভারে স্ট্যান্ডটা দুলছে। এই আওয়াজগুলো শুনেই আমি বুঝতে পারতাম কী হচ্ছে। চাচার খাওয়ার মাঝখানেই আমি তাঁর কাছে বাজারে যাওয়ার জন্যে টাকা চাইলাম। উনি ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে বসে আছেন।

‘মানুষজন এখন বিছানায়, সবাই ইতোমধ্যেই এক দফা ঘুমিয়ে ফেলেছে’, তিনি বললেন।

আমি হাসতে পারলাম না। চাচী জোর গলায় চাচাকে বললেন,

‘তুমি টাকাটা দিয়ে ওকে বিদায় করো না কেন? তুমিই তো দেরি করালে’।

চাচা বিষয়টা ভুলে যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে তিনি ঐ পুরানো প্রবাদে বিশ্বাস করেন,

‘অল ওয়ার্ক এন্ড নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয়।’

তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি, যখন আমি দ্বিতীয়বারের মত তাঁকে বললাম, তখন তিনি জানতে চাইলেন আমি ‘দ্যা এরাবস ফেয়ারওয়েল টু হিজ স্টিড’ সম্পর্কে কিছু জানি কিনা। যখন আমি রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম, চাচা ঐ বইয়ের শুরুর লাইনগুলি চাচীকে আবৃত্তি করে শুনানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

আমি হাতে একটা দুই শিলিং এর কয়েন শক্ত করে ধরেছিলাম যখন বাকিংহাম সড়কে বড় বড় পা ফেলে ষ্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় ক্রেতাদের ভিড় আর চোখ ধাঁধানো আলো আমাকে মনে করিয়ে দিলো আমার যাত্রার উদ্দেশ্য। আমি একটা বিচ্ছিন্ন ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে গিয়ে বসলাম। দেরি করতে করতে সহ্য সীমা অতিক্রমের পর ট্রেনটি ধীরে ধীরে স্টেশন ত্যাগ করলো। ট্রেনটা বিধ্বংস ঘরবাড়ি আর চকচকে নদীর উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগুচ্ছিলো। ওয়েস্টল্যান্ড রো স্টেশনে একটা মানুষের জটলা এসে বগির দরজায় ধাক্কাচ্ছিলো; কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাঁদেরকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো যে এটা শুধুমাত্র বাজারের জন্য বিশেষ ট্রেন। আমি ফাঁকা কামরাটায় একলা বসে রইলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেনটা একটা কাঠের প্লাটফর্মের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় নেমে একটা আলোকিত ঘড়িতে দেখলাম দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকী। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটি ভবন যার গায়ে সেই যাদুময় নামটি দৃশ্যমান।

আমি ছয় পেনির কোনো প্রবেশদ্বার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ভয় পাচ্ছিলাম বাজার বন্ধ হয়ে গেলো কিনা। দ্রুত একটা ঘূর্ণায়মান দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম, শ্রান্ত চেহারার একটা লোককে একটা শিলিং ধরিয়ে দিয়ে। ভেতরে ঢুকেই নিজেকে একটা বিশাল হল ঘরে আবিষ্কার করলাম। সবগুলো দোকানই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। হল ঘরের বেশীরভাগ অংশই ছিলো অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমি টের পেলাম এখানে একটা নীরবতা বিরাজ করছে, যেন প্রার্থনার পরে চার্চে ঝুলে থাকা নীরবতা। আমি ভয়ে ভয়ে হেঁটে বাজারের কেন্দ্রে চলে গেলাম। খোলা দোকানগুলোর সামনে কিছু লোক তখনো ভিড় করছিলো। একটা পর্দার উপরে রঙিন বাতি দিয়ে লেখা ছিলো ‘ক্যাফে শ্যান্টেন’। দুটো লোক একটা ট্রে-এর উপর পয়সা গুণছিলো। আমি কয়েনগুলোর পড়ার ঝনঝন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

অনেক কষ্ট করে মনে করলাম আমি এখানে কেন এসেছি। একটা দোকানে গিয়ে কিছু চীনামাটির ফুলদানি আর ফুল আঁকা চায়ের কাপের সেট নেড়েচেড়ে দেখলাম। দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা যুবতী মেয়ে দুটো যুবক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলো আর হাসছিলো। আমি তাঁদের ইংরেজির উচ্চারণ-ভঙ্গি লক্ষ্য করছিলাম এবং তাঁদের কথোপকথন অস্পষ্টভাবে শুনছিলাম।

‘না, আমি কখনোই এমন কথা বলিনি।‘

‘হ্যাঁ, বলেছো।‘

‘না, বলিনি।‘

‘সে (মেয়েটি) এ কথা বলেছিলো না?’

‘হ্যাঁ, আমি ওকে বলতে শুনেছি।‘

‘হুম, এখানে একটা… কিন্তু আছে!’

আমাকে দেখে মেয়েটি এগিয়ে এসে জানতে চাইলো আমি কিছু কিনতে চাই কিনা। তাঁর কণ্ঠে কোনো উৎসাহ ছিলো না। মনে হচ্ছিলো কোনো রকম কর্তব্যের খাতিরে সে আমাকে জিজ্ঞেস করছে। দোকানের দরজার দুই দিকে অল্প আলোয় দণ্ডায়মান দুটি মাটির বয়ামের উপর দৃষ্টি ফেলে আমি মিনমিনিয়ে বললামঃ

‘না। ধন্যবাদ আপনাকে’।

যুবতী মেয়েটি একটা ফুলদানির অবস্থান পরিবর্তন করে আবার সেই যুবক দুটির কাছে ফিরে গেলো। ওরা আবার আগের বিষয় নিয়েই কথা বলা শুরু করলো। মেয়েটি কথার ফাঁকে এক-দুবার তাঁর কাঁধের উপর দিয়ে চোখ ফেলেছিলো আমার উপর। আমি দোকানটার সামনে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরাঘুরি করলাম, যদিও জানতাম এখানে থাকাটা নিরর্থক। মনে হলো, ওর দোকানের পণ্যগুলির প্রতি আমার আকর্ষণটা ছিলো সত্যিই। আমি ঘুরে আস্তে করে বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাতে থাকা দুটি পেনি ছেড়ে দিলাম পকেটে থাকা ছয়টি পেনির ভিড়ে। গ্যালারির এক পাশ থেকে একজন চেঁচিয়ে বললো যে সব আলো নিভে যাবে। হল ঘরের উপরের অংশটা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেছে।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে থেকে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম আত্ম অহংকারে তাড়িত ও উপহাস্য একটা জীব হিসেবে; এবং আমার চোখ দুটো জ্বালা করছিলো নিদারুণ ক্ষোভে আর যন্ত্রণায়।

মূলঃ এরাবি— জেমস জয়েস

5 thoughts on “জেমস জয়েসের গল্পঃ এরাবি

প্রত্যুত্তর দিন শরিফুল ইসলাম প্রতিউত্তর নাকচ করে দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *