রোগ নির্মূলকরণ

যখন একটি রোগ একটি অঞ্চলে ছড়ানো বন্ধ হয়ে যায়, এটা ধরে নেওয়া হয় যে এটা সেই অঞ্চল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাপক টিকাদান কার্যক্রমের ফলে পোলিও ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

যখন একটি বিশেষ রোগ সারা বিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে, এটা নির্মূল হয়েছে বলে ধরা হয়। আজ পর্যন্ত, মানুষের একটি মাত্র সংক্রামক রোগ নিশ্চিহ্ন হয়েছে*। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দশকের পর দশকের চেষ্টার পর ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন গুঁটি বসন্ত নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। যে রোগ একসময় আক্রান্ত রোগীদের ৩৫% কে মেরে ফেলত এবং বাকিদের অন্ধ বা শরীরে ক্ষত চিহ্ন রেখে যেত, সমন্বিত চেষ্টার ফলে বিশ্ব সেই রোগ থেকে রক্ষা পায়।

গুঁটি বসন্ত নির্মূলকরণ করা সম্ভব হয়ে হয়েছিল যথার্থ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে- গুঁটি বসন্ত আক্রান্ত নতুন রোগীদের দ্রুত সনাক্তকরণ এবং বলয় টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে। বলয় টিকাদান কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে- কোন মানুষ যদি গুটি বসন্তের রোগির সন্নিকটে চলে আসে কোনভাবে তাকে সনাক্ত করা এবং তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকাদান করা, সফলভাবে রোগটাকে কোণঠাসা করে ফেলা এবং সেটা যাতে আরও ছড়িয়ে পরতে না পারে তা প্রতিরোধ করা। গুটি বসন্তের সর্বশেষ ‘প্রাকৃতিক’ সংক্রমণ দেখা যায় ১৯৭৭ সালে সোমালিয়াতে। নানা কারণে গুটি বসন্ত নির্মূলকরণের জন্য উপযুক্ত ছিল।

প্রথমত, এই রোগটি চোখের সামনেই দৃশ্যমান ছিল। গুঁটি বসন্ত আক্রান্ত রোগীর শরীরে যে গুঁটি হত, তা সহজেই বোঝা যেত। এছাড়াও, সংক্রমণ এবং রোগের লক্ষণ প্রকাশ এর মাঝে সময়ের ব্যবধান কম বলে, এই রোগটি স্বাস্থ্য কর্মীরা না দেখার আগে সাধারণত বেশি দূরে ছড়াতে পারত না।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্মীরা আক্রান্ত স্থানে গুঁটি বসন্ত আক্রান্ত রোগীদের ছবি দেখিয়ে কিংবা এই রকম গুঁটি আক্রান্ত মানুষের ব্যাপারে প্রশ্ন করে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের সন্ধান পেতেন।

দ্বিতীয়ত, শুধু মানুষই গুঁটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয় এবং এই রোগ সংক্রমিত করতে পারে। কিছু রোগের বাহক থাকে পশু, অর্থাৎ মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীরা সেই রোগে সংক্রমিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পীত জ্বর মানুষকে যেমন সংক্রমণ করে, বানরকেও ঠিক তেমনি সংক্রমণ করে। যদি পীত জ্বর ছড়াতে সক্ষম একটি মশা সেই রোগে আক্রান্ত একটি বানরকে কামড়ায়, সেই মশা মানুষের মাঝেও এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারবে। তাই এমন যদি করা হয়, যে পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীকে পীত জ্বরের বিরুদ্ধে টিকাদান করা হয়, এই রোগের নির্মূলকরণ নিশ্চিত নয়। এই রোগ বানরের ভিতর তখনও বিদ্যমান থাকতে পারে, এবং তা মানুষের মাঝে আবার পুনরাবির্ভাব ঘটাতে পারে যখন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাবে। (প্রকৃতপক্ষে পীত জ্বরের পশু বাহকের আবিষ্কার গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে হাতে নেওয়া পীত জ্বরের নির্মূলকরণের চেষ্টাকে লাইনচ্যুত করে।) এদিকে, গুঁটি বসন্ত কেবলমাত্র মানুষকে সংক্রমণ করে। অর্থাৎ, মানবজাতি ছাড়া তার লুকানোর আর কোন জায়গা নাই।

একই সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যারা গুঁটি বসন্ত হওয়া স্বত্বেও বেছে গিয়েছিলেন, তাদের দেহে আমৃত্যু এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়। বাকিদের জন্য টিকাদান ছিল  কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের টিকাদান কর্মীদের প্রসিক্ষন দিত, যাতে তারা বহু মানুষকে অল্প সময়ে টিকাদান করতে পারতেন।

গুঁটি বসন্ত নির্মূল হওয়ার ফলে আশার সঞ্চার হয়, যে অন্যান্য রোগগুলোর ক্ষেত্রেও তা করা সম্ভব। অনেক সম্ভাব্য নাম উঠে আসেঃ পোলিও, মাম্পস এবং ড্রাকানকুলিয়াসিস ( গিনি ওয়ার্ম রোগ)। এছাড়াও ম্যালারিয়ার কথা চিন্তা করা হয়, যার সংক্রমণের হার বহুলাংশে অনেক দেশে কমে যায়। ম্যালারিয়া আমাদের রোগ নির্মূলকরণ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, তারপরও ম্যালারিয়া আক্রান্ত হলে তা রোগীর দেহে আমৃত্যু প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয় না (গুঁটি বসন্ত বা অন্য রোগগুলো যা দেয়)। একাধিকবার ম্যালারিয়া আক্রান্ত হওয়া সম্ভব, যদিও একাধিকবার সংক্রমণ রোগীর দেহে আংশিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জন্ম দেয়। এছাড়াও, অনেক আশাবাদী উদ্যোগ নেওয়া হলেও, কার্যকর ম্যালারিয়ার টিকা এখনও তৈরি করা সম্ভব হয় নাই।

অন্যান্য রোগগুলোর জন্য মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন পরীক্ষার। যেমন পোলিও, যদিও ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে হ্রাস পেয়েছে বা নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় এখনও তা রয়ে গিয়েছে কারণ (অন্যান্য কারণ রয়েছে) অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তিতে শনাক্ত করার মত লক্ষণ প্রকাশ করে না। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি অগোচরে রয়ে যেতে পারেন এবং ভাইরাস অন্যদের মাঝে ছড়াতে পারেন। যদিও দৃশ্যমান লাল দাগ বা র‍্যাশ তৈরি করে, হাম একইভাবে সমস্যা তৈরি করে কারণ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ এবং র‍্যাশ সৃষ্টি হওয়ার মাঝে ভালোই সময়ের পার্থক্য রয়েছে। র‍্যাশ আবির্ভাবের পূর্বেই রোগী রোগটি ছড়াতে সক্ষম হয়ে যান এবং তারা যে রোগাক্রান্ত এটা কেউ বুঝে উঠার পূর্বেই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন।

অনেকে ধারণা করে থাকেন গিনি ওয়ার্ম নামক রোগ নির্মূলকরণের দ্বারপ্রান্তে। ২০১৪ সালে এই রোগে আক্রান্ত মাত্র ১২৬ টি রোগী সনাক্ত করা হয়েছে, তাও আবার ৪ টি দেশ থেকে; শাদ (১৩), ইথিওপিয়া (৩), মালি (৪০), দক্ষিণ সুদান (৭০)। এদিকে ২০০৮ সালে ‘কার্টার সেন্টার ইন্টারন্যাশনাল টাস্ক ফোরস ফর ডিজিজ ইরাডিকেশন’ আরও ছয়টি রোগকে নির্মূলযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেঃ লসিকানালীর ফাইলেরিয়াসিস (গোদ রোগ), পোলিও, হাম, মাম্পস, রুবেলা এবং শূকরের ফিতাকৃমি রোগ।

* রিনদারপেস্ট নামক গবাদিপশুর একটি রোগও  মূলত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে নির্মূল করা হয়েছে।

সূত্রঃ Disease Eradication.

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *