১৯১১ সালের নভেম্বর, মাদামোয়াজেল মেরি কুরি তাঁর দ্বিতীয়বারের নোবেল বিজয়ী (রসায়নে) হওয়া থেকে মাত্র ১ সপ্তাহ দূরে ছিলেন। ১৯০৩ সালে কুরি প্রথমবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী হন, এবং দ্বিতীয়বারের মত নোবেল বিজয় তাকে দুর্লভ সম্মান এনে দিয়ে অতি-অসাধারণ এক এলিট শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে যে শ্রেণীর সবাই ২বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। এখনো পর্যন্ত মাত্র ৪ জন ব্যক্তি ২বার করে নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন। মাদাম কুরি তেজস্ক্রিয়তা সন্ধান পাওয়ার জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে ১৯০৩ সালে এবং বিশুদ্ধ রেডিয়াম আলাদা করবার জন্য রসায়নে ১৯১১ সালে নোবেল বিজয় করেন। যদিও বিজ্ঞানে তাঁর অসাধারণ অবদানের বিষয়েই সবার মনোযোগ দেওয়া উচিৎ ছিলো, সেটা না করে তখনকার মিডিয়া এবং অনেকেই মাদাম কুরির অতি সাধারণ ব্যক্তিগত জীবনের খবর নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিলো।
মাদাম কুরিকে বিধবা করে তাঁর স্বামী বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি ১৯০৬ সালে মারা যান। এর কয়েক বছর পরই মাদাম কুরি পিয়েরে কুরির পিএইচডি ছাত্র পল ল্যাঞ্জেভিন এর সাথে রোম্যান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পল যদিও বিবাহিত ছিলো, কিন্তু সে তার স্ত্রীর থেকে আলাদা (সেপারেশন) থাকতো। মাদাম কুরির সাথে সম্পর্ক পলের বৈবাহিক জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আসন্ন সমস্যার কাছে অবশ্য এই অশান্তি কিছুই মনে হবে না।
মাদাম কুরি, পল ল্যাঞ্জেভিনসহ আরো ২০ বিজ্ঞানীকে ১৯১১ এর শরতে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হয়, সেখানে সকলের প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। যখন মাদাম কুরি আর ল্যাঞ্জেভিন ব্রাসেলসে, তখন ল্যাঞ্জেভিনের স্ত্রী, মাদাম কুরী এবং ল্যাঞ্জেভিনের মধ্যকার বেশ কিছু প্রেমপত্র তৎকালীন মিডিয়ার কিছু লোকের হাতে পৌঁছে দেয়, যারা ল্যাঞ্জেভিনের স্ত্রীর প্ররোচনায় মাদাম কুরিকে দুষ্ট সংসার-বিনষ্টকারী নারী হিসেবে সমগ্র ফ্রান্সের কাছে তুলে ধরে।
মাদাম কুরি যখন ফ্রান্সে তার বাসায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন আচমকাই (হ্যাঁ, আচমকাই! কারণ তখন ফেইসবুক, হোয়াটসেপ বা ভাইবার ছিলো না বা সবার টেলিফোন নাম্বারও সবার কাছে থাকতো না।) সংবর্ধিত হন একদল ক্ষুব্ধ জনতার দ্বারা যারা তাঁর বাড়ি ঘিরে রেখেছিলো। বাড়ির ভেতরের তাঁর ছোট দুই মেয়ে (৭ এবং ১৪) আতংকে কাঁপছিলো।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, এলবার্ট আইনস্টাইন, যিনি মাদাম কুরির সাথে ব্রাসেলস কনফারেন্সে সম্প্রতি পরিচিত হয়েছে, তিনি ফ্রান্সের নির্বোধ কভারেজখোর মিডিয়ার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে, তাঁর নতুন বন্ধুকে উৎসাহ ও সাহস প্রদান করে (মাদাম কুরিকে) উষ্ণ একটি চিঠি লিখেন। মাদাম কুরিকে লেখা আলবার্ট আইনস্টাইনের চিঠিটা নিচে তুলে ধরা হলো। চিঠি লেখা দেখে বোঝা যায় আইনস্টাইন শুধুমাত্র সায়েন্সের প্রতি নয়, তাঁর বন্ধু ও কাছের মানুষদের প্রতিও যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিলেন। উনার চিঠি লেখার ভাষা দেখে উনার মেরি কুরির প্রতি উনার বন্ধুসুলভ উদ্বেগের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাগ, ২৩ নভেম্বর ১৯১১
পরম শ্রদ্ধেয় মিসেস কুরি,
তেমন মূল্যবান কিছু বলার নেই, তবু লিখছি বলে আমার ওপর হাসবেন না। কিন্তু জনগণ আপনার সাথে বর্তমানে যেভাবে আচরণ করবার সাহস করছে, তাতে আমি এতই ক্রোধান্বিত যে আমার অনুভূতি আপনাকে জানাতেই হলো। যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি যে আপনি সবসময়ই এইসব ইতর জনতাকে অবজ্ঞা করেন, তা ওরা আপনাকে চাটুকারের মত তোষামোদীই করুক আর আপনাকে রগরগে খবরের বস্তু হিসেবেই দেখুক না কেন।
আমি এটা না বলে পারছি না – আপনার মেধা ও মননে আমি যে কী পরিমাণ মুগ্ধ! এবং আপনার সাথে ব্রাসেলস ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ঐ সকল ঘৃণ্য সরীসৃপ প্রাণীগুলো ব্যতীত যেকোনো ব্যক্তিই আনন্দিত হবে আপনার এবং ল্যাঞ্জেভিনের মত ব্যক্তিত্বদের আমাদের মধ্যে পেয়ে। আপনাদের মত খাঁটি মানুষ যাদের সান্নিধ্যই বড় ধরনের প্রাপ্তি বলে আমি মনে করি। যদি নিম্নশ্রেণীর এসব কথায় আপনার মন খারাপ হয়, তাহলে ওসব ছাইপাশ না পড়লেই হয়। বরং যাদের রুচির জন্য মেরুদণ্ডহীনেরা এসব অতিরঞ্জিত এবং মনগড়া কথা ছড়িয়েছে, এগুলো তাদেরকেই পড়তে দিন।
আপনাকে, ল্যাঞ্জেভিনকে, আর পেরিনকে বিনীত শ্রদ্ধাসহ…
আপনাদেরই একান্ত
এ. আইনস্টাইনবিঃদ্রঃ আমি একটা মজার উপায়ে প্ল্যাংকের বিকিরণ ক্ষেত্রের দ্বি-পারমাণবিক অণুর গতির পরিসংখ্যানগত সূত্র বের করেছি। একটা শর্ত ছিলো যে, গঠনটার গতি স্ট্যান্ডার্ড মেকানিকসের সূত্রগুলো মেনে চলবে। এটা বাস্তবে কাজ করবে কিনা, সেটা নিয়ে আমার আশা প্রায় শূন্য যদিও।
সারমর্মঃ Haters Gonna Hate.