চোখের সামনেই ঘটছে বিবর্তন! (পর্ব ২)

পর্ব ১ঃ এখান থেকে পড়তে পারেন।

যখন আমরা চিন্তা করি, কীভাবে সত্যিই সলিড প্রমাণ পাওয়া যাবে যে, একটা প্রজাতি থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে আরেকটা প্রজাতি এসেছে?, তখন ফসিল রেকর্ড ছাড়া গতি নেই!

“যদি তুমি ফসিল রেকর্ডের দিকে তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে একটা নির্দিষ্ট গঠন বেশ কিছুকাল রাজত্ব করেছে, এবং এরপর এসেছে আরেকটা নির্দিষ্ট গঠন, যেটা কিনা আগেরটার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন”, বলেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক স্টিভ জোন্স।

তাহলে এই দুই গঠনের মধ্যে আমরা সম্পর্ক বের করবো কীভাবে? ভালো প্রশ্ন! আর এখানেই আসবে ট্রানজিশনাল ফসিলের কথা।

যতই আমরা নতুন নতুন ফসিল আবিষ্কার করতে লাগলাম, ততই পেতে থাকলাম ট্রানজিশনাল ফসিলের ভাণ্ডার। “ট্রানজিশনাল” শব্দটার অর্থ “এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়”। তাই ট্রানজিশনাল ফসিল হলো, পূর্বপুরুষ থেকে নতুন প্রজাতি উদ্ভূত হওয়ার আগে, অর্থাৎ এক প্রজাতি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা প্রজাতি সৃষ্টি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে যে প্রজাতিগুলো বিচরণ করতো, তাদের ফসিল। প্রচলিত ভাষায় এদেরকে বলা হয় “মিসিং লিংক” (যদিও বিজ্ঞানীরা “মিসিং লিংক” বিশেষণটি ব্যবহার করেন না এবং অন্যদেরও ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করেন)।

কোনো একটি পূর্বপুরুষ এবং তা থেকে উদ্ভূত নতুন প্রজাতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বুঝা যায় ট্রানজিশনাল ফসিল থেকে। এই ফসিলগুলোর মধ্যে দুই প্রজাতিরই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন, আর্কেওপ্টেরিক্স ডাইনোসরের ফসিল একটি ট্রানজিশনাল ফসিল। এটি প্রমাণ করে, আধুনিক পাখির পূর্বপুরুষ ছিল ডাইনোসর। এই সূত্র ধরেই আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম, মুরগি এসেছে ডাইনোসর থেকে।

Archaeopteryx lithographica, জার্মানিতে পাওয়া আধুনিক পাখির ট্রানজিশনাল ফসিল
Archaeopteryx lithographica, জার্মানিতে পাওয়া আধুনিক পাখির ট্রানজিশনাল ফসিল

ডাইনোসর যে পাখির পূর্বপুরুষ, এই ধারণার ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়েছে যখন ২০০০ সালে চাইনিজ একাডেমী অফ সায়েন্সের বিজ্ঞানী জিয়াং জু এবং তার দল আবিষ্কার করেন ক্ষুদ্রাকৃতির ডাইনোসর মাইক্রোর‍্যাপ্টরের (Microraptor) ফসিল। সেটা থেকে জানা গেলো, আধুনিক পাখির মত এই ডাইনোসরটিরও পাখা ছিল, এবং সে সম্ভবত উড়তেও পারত!

মাইক্রোর‍্যাপ্টরের ফসিল
মাইক্রোর‍্যাপ্টরের ফসিল

তবে সব কথার বড় কথা, ধৈর্য আর দক্ষতা থাকলে চোখের সামনে নতুন একটি প্রজাতির বিবর্তন দেখাও সম্ভব!

অন্তত ৪০ বছরের গবেষণা শেষে নিউজার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর পিটার এবং রোজমেরি গ্রান্ট-এর অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। তারা বিজ্ঞানের সেই ছোট্ট দলের সদস্য, যারা নিজ চোখে প্রজাতির বিবর্তন দেখেছেন। ১৯৭৩ সালে শুরু হওয়া তাদের গবেষণাটা ছিল গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের “ড্যাফনে মেজর” দ্বীপের ফিন্‌চ পাখির উপর। জ্বী হ্যাঁ, এই সেই বিখ্যাত ফিন্‌চ পাখি, যার ঠোঁটের আকৃতি পরীক্ষা করে চার্লস ডারউইন বিবর্তনের উদাহরণ টেনেছিলেন। গ্রান্ট দম্পতি এ দ্বীপে দেখেছেন প্রাকৃতিক নির্বাচন, Hybridization (ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন), ভিন্ন প্রজাতির সাথে প্রজননের (interbreeding) কারণে একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, এবং একটা নতুন প্রজাতি বিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা।

২০১৪ সালে প্রকাশিত “40 Years of Evolution” বইয়ে গ্রান্ট দম্পতি তাদের একটা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন। ১৯৮১ সালে বাচ্চা একটি গ্রাউন্ড ফিন্‌চ পাখি ড্যাফনে মেজর দ্বীপে আসে, যে ছিলো ড্যাফনে দ্বীপের আদিবাসী ফিন্‌চ পাখিদের তুলনায় বড় আকৃতির। খুব সম্ভবত সে সান্তা ক্রুজ দ্বীপ থেকে এসেছিলো। দম্পতি পাখিটির নাম রাখেন “দা বিগ বার্ড”। জীন পরীক্ষা করে দেখা যায়, পাখিটি fortis এবং fortis-scandens প্রজাতির মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। সে যখন পরিপক্ক হলো, তখন তার গায়ে চকচকে কালো পালক দেখা দিলো। এটিও ড্যাফনে দ্বীপের নেটিভ ফিন্‌চ পাখিগুলোর তুলনায় ভিন্ন এক বৈশিষ্ট্য এবং বিগ বার্ড গানও গাইত অন্যরকম সুরে। বিবর্তনের ভাষা অনুযায়ী, সে ছিল অত্যন্ত “ফিট” একটা পাখি এবং ১৩ বছরের জীবনে সে ড্যাফনে দ্বীপের মোট ৬ টি স্ত্রী ফিনচের সাথে মিলিত হয়ে ১৮ টি সন্তানের বাবা হয়। স্ত্রী ফিনচের মধ্যে কিছু ছিলো fortis-fortis-scandens হাইব্রিড প্রজাতির, কিছু ছিলো fortis প্রজাতির। এদের সাথে প্রজননের মাধ্যমে বিগ বার্ডের নতুন একটি বংশ শুরু হয়, যে বংশের সন্তানরা বাবার মতো ভিন্ন সুরে গান গায়।

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাচ্চা বয়সের দা বিগ বার্ডকে, নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে চকচকে কালো পালকওয়ালা পরিপক্ক বিগ বার্ডকে
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাচ্চা বয়সের দা বিগ বার্ডকে, নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে চকচকে কালো পালকওয়ালা পরিপক্ক বিগ বার্ডকে

তবে গ্রান্ট দম্পতি বিগ বার্ডের এই নতুন বংশধারাকে একটা নতুন প্রজাতি হিসেবে অভিহিত করতে চাননি।

তারা ভাবছিলেন, “নতুন বংশধারাটি মাত্র কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করেছে। এমনও হতে পারে, তারা খুব দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে! আর বংশের সদস্যরা inbreeding-এর মাধ্যমে তাদের “স্বতন্ত্রতা” নষ্ট করে কিনা, বা inbreeding-এর ফলে ফিটনেস সমস্যায় ভুগে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায় কিনা, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা কতদিন অপেক্ষা করবো?”

হতে পারে গ্রান্ট দম্পতির “দা বিগ বার্ড”-এর বংশধরেরা শুধুমাত্র আলাদা গান গাওয়ার মতো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এর চেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন প্রকৃতিতে দেখা যায় না।

সেটা কীরকম?

জানার জন্য চলুন ঘুরে আসি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রিচার্ড লেন্সকি-এর গবেষণাগার থেকে। তিনি যে গবেষণাটি করছেন, সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিবর্তন পরীক্ষণের সাথে জড়িত। এই পরীক্ষণের কাজ হল, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কীভাবে একটি প্রজাতি বিবর্তিত হয়, সেটা প্রমাণ করা।

কিছু আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমেই যে বিবর্তনের সূচনা হয়, এটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর তর্ক হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু কয়জনই বা ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন?

এই পরীক্ষাটি করার জন্যেই ১৯৮৮ সালে লেন্সকি একটি মাত্র Escherichia coli ব্যাকটেরিয়া নেন যেটি নিজের বেশ কিছু ক্লোন উৎপন্ন করে। ক্লোনগুলো থেকে উৎপন্ন হওয়া একই রকম বংশধরদের নিয়ে লেন্সকি মোট ১২ সেট কালচার তৈরি করেন। বেড়ে উঠা এবং বংশবৃদ্ধি করার জন্য তো ব্যাকটেরিয়াগুলোর গ্রোথ মিডিয়াম দরকার, তাই না? সেজন্য সেটগুলোকে রাখা হয় গ্লুকোজ লিমিটেড মিডিয়ামে, যেখানে গ্রোথ মিডিয়াম হিসেবে সাইট্রেটকেও (citrate) রাখা হয়েছিলো।

বলে রাখা ভালো যে, অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কার্বনের উৎস হিসেবে E. coli সাইট্রেটকে শোষণ করে কোষের ভেতর নিতে পারে না, অর্থাৎ হজম করতে পারে না। তাই সাধারণভাবে এরা সাইট্রেটকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। কিন্তু লেন্সকি গ্লুকোজের পরিমাণ এমন রাখতেন যেন সেটা দুপুরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। তবে গ্লুকোজ ফুরিয়ে গেলেও সাইট্রেট কিন্তু থেকে যেতো। কারণ সেগুলো কেউ গ্রহণ করতো না।

আসলে লেন্সকি দেখতে চাচ্ছিলেন, খাদ্যের অভাবে পড়ে ব্যাকটেরিয়াগুলো সাইট্রেটকে গ্রহণ করার মতো সামর্থ্য অর্জন করে কিনা।

Escherichia coli ব্যাকটেরিয়া

৩০,০০০ প্রজন্ম পার হয়ে গেলেও কোনো ব্যাকটেরিয়া সাইট্রেটকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি। তবে ধামাকা বিবর্তনটি ঘটে ৩১,৫০০ প্রজন্মে এসে। এ সময় ১২ টার মধ্যে একটা পপুলেশনে সাইট্রেট ব্যবহারকারী ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভব ঘটে। বলা ভালো, ঐ পপুলেশনের ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে মিউটেশন ঘটে। এর ফলে তাদের দেহে CitT নামক একটি “antiporter” প্রোটিন তৈরি হয়। এই প্রোটিনের সাহায্যে ওরা কোষঝিল্লি ভেদ করে সাইট্রেটকে কোষাভ্যন্তরে নিয়ে যেতে, হজম করতে সক্ষম হলো। আর যখনই এই ক্ষমতার উদ্ভব ঘটলো, তখনই ঐ ক্ষমতাধারীদের সংখ্যা ধুউমমম করে বেড়ে গেলো। সাথে বাড়ল ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে বিচিত্রতা।

অনেকদিন অপেক্ষার পর ঘটা এই ইউনিক বিবর্তন হয়ত প্রচণ্ড দুর্লভ একটা মিউটেশনের কারণে ঘটেছে, অথবা এমনও হতে পারে, এটা খুব সাধারণ একটা মিউটেশন। গবেষকরা আবার ঐ পপুলেশনের বিভিন্ন প্রজন্ম পরীক্ষা করেছেন, বিবর্তনের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন (১২ টা সেট থেকেই ৭৫ দিন পর পর অর্থাৎ ৫০০ প্রজন্ম পর পর কিছু স্যাম্পল ফ্রিজ করে রাখা হয়। এগুলো ব্যবহার করেই আবার প্রথম থেকে মিউটেশন ঘটার ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব)। ঘটিয়ে দেখেছেন যে, প্রথম ১৫,০০০ প্রজন্মে কোনো Cit+ মিউট্যান্ট (যারা সাইট্রেট হজম করার ক্ষমতা লাভ করেছে) জন্মায়নি। তবে পরবর্তী প্রজন্মগুলোয় Cit+ মিউট্যান্ট জন্মানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলো, এবং ২০,০০০তম প্রজন্মে এসে সম্ভাব্য কিছু মিউটেশন ঘটলো। এর ফলে Cit+ মিউট্যান্ট জন্মানোর হার বেড়ে গেলো, যদিও সেটা উচ্চহারে ঘটছিলো না। আর ৩১,৫০০ প্রজন্মে এসে Cit+ মিউট্যান্ট জন্মানোর হার এতই বেড়ে গেলো যে, তারা ঐ মিডিয়ামের একটা strain বাদে বাকি সব strain-এর ব্যাকটেরিয়াকে সংখ্যার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেলো।

চলবে।

মূল প্রবন্ধঃ How do we know that evolution is really happening?

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *