[লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। এছাড়াও তিনি একজন তত্ত্বীয় ও দার্শনিক সেনা-অফিসার ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২০ আগস্ট তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় “হিডেন প্রাইজ” শিরোনামে তৎকালীন সরকারের কর্মকান্ড কটাক্ষ করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধে তিনি জাতির দুর্দশার অবস্থা বর্ণনা করে কর্তৃপক্ষের প্রতি নিজের হতাশা ব্যক্ত করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯ মার্চ ১৯৭২ তারিখে ২৫ বছর মেয়াদি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অনেক গোপন শর্ত আছে বলে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন সেগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে।
ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় এরূপ বিতর্কিত প্রবন্ধ লিখে তিনি সেনাবাহিনীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার প্রভাবে সমগ্র ঢাকা ব্রিগেড সরকারি সমালোচনায় মুখর হয়ে যায়। এমনকি সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কাও দেখা দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব জিয়াউদ্দিনকে ঢাকা ব্রিগেড থেকে সেনাসদরে বদলির আদেশ দেন এবং মইনুল হোসেনকে তার স্থলে বসান। এর কিছুদিন পর জিয়াউদ্দিন ছুটির দরখাস্ত করেন এবং ছুটিতে চলেও যান। এরপর তিনি আর কখনো আর্মিতে ফিরেন নি। পরে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন।
মইনুল হোসেন ও জিয়াউদ্দিন ভালো বন্ধু ছিলেন। তারা দুইজন সেনানিবাসের স্কুল রোডে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন। মইনুল হোসেন যখন জিয়াউদ্দিনকে প্রবন্ধে লিখিত তথ্যের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন— উত্তরে জিয়াউদ্দিন জানান, জেনারেল ওসমানী তাকে ওইসব তথ্য সরবরাহ করেছেন।]
হিডেন প্রাইজ
আজকে আমি মুক্তিযোদ্ধা (বিশেষ করে) এবং সাধারণ জনগণদের যা অবগত করতে চাই তা তাদেরকে জানানো যথাযথ বলে মনে করি এবং যা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা দেশের মানুষের জন্য তীব্র যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের রাস্তায় বর্তমানে উদ্দেশ্যহীন, প্রাণহীন, আত্মাহীন চেহারা পরাধীন মন নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। সাধারণত, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর “নতুন উদ্দীপনা” জনগণদের পরিচালিত করে এবং দেশ শূন্য থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। সবার জন্য জীবন বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু জনগণ সেটাকে অভয়ে মুখোমুখি করে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ হয় ভিক্ষা করছে বা দুঃখের গান গাচ্ছে বা কোনো সচেতনতা ছাড়াই ভুল পথে চিৎকার করছে। দেশটাকে নিম্নোক্ত অসংখ্য অসংলগ্ন অংশে ব্যবচ্ছেদ করা যাবে:
১। বুদ্ধিজীবীগণ অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে “চুলচেরা বিশ্লেষণে” ব্যস্ত
২। যারা অল্প হলেও পড়ালেখা করেছে তারা স্বয়ংধ্বংসী সমালোচনার রোগে আক্রান্ত। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন উপায়ে সবাইকে দোষাচ্ছে।
৩। যাদের অর্থাভাব রয়েছে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে জীবন ভালোভাবে চালানোর। কিন্তু তারাও অস্থিতিশীলতা অনুভব করছে
৪। প্রশাসনের কর্তারা একটি বাহুল্য ও অবৈজ্ঞানিক সিস্টেম চালনা করার চেষ্টা করছে যা আসল উন্নয়ন দাবিয়ে রাখছে
৫। ক্ষমতাবানরা ইতোমধ্যে জাতীয় সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করে নিয়েছে এবং জাতির ‘পুরষ্কার’ রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে
৬। ক্ষুধার্ত ও গরীবরা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে এবং ভিক্ষা চাচ্ছে একে অপরের কাছে। তথাকথিত বন্ধ রাষ্ট্র দরদ দেখাচ্ছে এবং বঞ্চিতদেরকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে
এই দেশ রসাতলের অতি সন্নিকটেই পৌছে গিয়েছে। সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে, গর্বে সঞ্চারিত হয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। গর্বের প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য যে, আমাদের ঔদ্ধতের কি হয়েছে? আমাদের কি গর্ব করার মত আদৌ কিছু ছিলো? আমরা কি সেটা হারিয়ে ফেলেছি নাকি লুকিয়ে রয়েছে? বর্তমানের আমাদের সকল ভাবমূর্তি গোপন চুক্তিতে লুকায়িত রয়েছে। আমাদের গর্ব করার মতো ছিলো ২৬শে মার্চ। গোপন চুক্তির প্রস্তাবকদের অবশ্যই আমাদের গর্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা এই চুক্তি সম্বন্ধে জ্ঞাত তাদেরকে প্রকাশ্যে এই বেইমানি স্বীকার করতে হবে। যারা করবে না তারা জনগণের শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু। এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কিছুই আমাদের শত্রুতুল্য।
বঙ্গবন্ধু যদি সত্যিই জনগণকে ভালোবাসে তাহলে সে এটা গোপন রাখবে না। সে কেনো ভয় পাবে? আমরা তার অনুপস্থিতিতেই ‘৭১ সালে যুদ্ধ করেছি এবং জয়ী হয়েছি। যদি দরকার পরে আমরা আবার যুদ্ধ করবো। কোনো কিছুই আমাদের কে হারাতে পারবে না। আমরা ধ্বংস হবো কিন্তু হারবো না।
তথ্যসূত্র
১। Colonel M. Ziauddin, “Hidden Prize”, Holiday, August 20, 1972.
২। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০