(ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মাশরাফির সাক্ষাৎকার “Inside the Tiger’s Den” এর অনুবাদ)
জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকেই আমি ক্রিকেট নিয়ে এতটা সংযুক্ত হয়ে ছিলাম যে আমি বুঝতেই পারিনি কোন উৎসব আসছে। গতকাল ম্যাচের পরে আমি সেহরীর জন্য উঠলাম এবং ভাগ্যক্রমে একটি দোকান খোলা ছিল যেখানে আমি আমার বাচ্চাদের জন্য কিছু শপিং করতে পেরেছি।
আহ! একটা নাভিশ্বাস ওঠা জীবন। তৃতীয় ম্যাচ শেষে আমি হঠাৎ করে অনুভব করি ঈদ চলে এসেছে এবং আমি আমার নিজের চমৎকার শহরটিতে ঈদ করতে যাচ্ছি। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের একটি স্বস্তির জায়গা আছে। অনেকে হয়তো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে জায়গাটি আমার নিজের বাড়ি। এটি আমাকে নতুন করে পুরোনো শক্তিতে উজ্জ্বীবিত করে।
কেউ যদি সত্যিকার অর্থে খেলা বোঝে তাহলে অবশ্যই তারা স্বীকার করবে গত কয়েক মাসে আমরা অসাধারণ কিছু সময় পার করেছি। এবং আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন, বিশেষ করে ২০১৫ সালটি। আমাদের কাছে—একদিনের ক্রিকেট, গত আট মাস ছিলো একটি স্বপ্নের মত,আমরাই এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি।
আমি অনুভব করি বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌছেছে যেখানে সময় এসেছে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। অবশ্য আমি এখনো বুঝতে পারছি না সাধারণ জনগণ এটি কীভাবে নিয়েছে। তারা যদি ক্রমাগত জয়ের আশা অব্যাহত রাখে তাহলে আমাদের জন্য এটি খুবই কঠিন হবে, কারণ আমাদের আরও অনেকদূর যাওয়া বাকি। এরপর আমরা একেরপর এক টি টুয়েন্টি খেলবো যেটি আমাদের জন্য সবসময় চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু তার আগে এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ—দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে চারটি টেস্ট ম্যাচ খেলা।
আমি আগেই বলেছিলাম—আমরা যদি বিশ্বকাপে ভালো করতে পারি তাহলে এটি আমাদের পরবর্তী সিরিজগুলো খেলতে সাহায্য করবে, কিন্তু আমি নিজেও ভাবিনি এটি আমাদের এতদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সত্যিকার অর্থে, অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেছে এই বলে যে—তামিম প্রতিবারই আউট হয়ে যাচ্ছে, সৌম্য তার সামর্থ্যের সবটুকু খেলতে পারছে না, কিন্তু আমরা সবাইকে উত্তরটা দিতে পেরেছি। ১৬ কোটি মানুষের ভিতর যদি ৫ কোটি মানুষ ক্রিকেট খেলা দেখে তাহলে তাদের ভিতর ১ কোটি মানুষ এক কথা বলবে,অন্য ৪ কোটি মানুষ অন্য কথা বলবে। তাই আপনাকে যদি সবার কথা শুনতে হয় তাহলে আপনি সামনে আগাতে পারবেন না। আমি অনুভব করি যে আমাদের ভালো ক্রিকেট খেলার প্রয়োজন ছিলো এবং আমরা সেটি করতে পেরেছি। তামিম এখনো শট খেলছে, সৌম্য স্বাধীনভাবে ব্যাট চালাচ্ছে, বোলাররা জানে কোথায় এবং কখন তাদের আক্রমণ করতে হবে। আমরা সবকিছু করেছি একটি নিয়মের মধ্যে থেকে।
আমি কখনোই আমার জীবনে কোন কিছুর জন্য পরিকল্পনা করিনি—পরীক্ষার জন্যও না, অথবা কোন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে কাপড় কেনার জন্যও না। আমি সবসময় শেষ মুহুর্তে যেটি সঠিক বলে মনে হয়েছে সেটি করেছি। তাই যখন আমি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেলাম তখন আমি সবসময় যেটি করতাম সেটিই করেছি। আমি সাফল্য, ব্যার্থতা, ভবিষ্যৎ অথবা অতীতের জন্য কখনোই চিন্তা করিনি। এগুলো নিয়ে আমি কখনোই ভাবিনি।
সবাই আমার আক্রমণাত্মক ক্যাপ্টেনসি নিয়ে আলোচনা করেছে। এই ব্যাপারটি নিয়ে আমার কাছে খুব সাধারণ একটি ব্যাখ্যা আছে। এখনকার সময়ে আমি লক্ষ্য করেছি ব্যাটস্ম্যানদের জন্য খেলাটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। শট খেলাটা তাদের একটি অভ্যাসে দাড়িয়ে গেছে। তারা কখনোই ডিফেন্ড করে খেলার চেষ্টা করে না, কারণ উইকেট এবং খেলার ফরমেট তাদের সহায়তা করে। আমি যেটি লক্ষ্য করেছি—ব্যাটস্ম্যানরা শট খেলবেই কিন্তু আপনি যদি তাদেরকে স্ট্রাইক রোটেট করতে না দেন তাহলে সেটি তাদের মধ্যে একটি চাপ তৈরী করবে। যখন তারা স্ট্রইক রোটেট করতে পারবে না তখন তারা বাধ্য হবে রিস্কি শট খেলতে। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করি ব্যাটস্ম্যানদের একধাপ উপরে চিন্তা করতে।
আমি সেটিই করি যেটি আমার মন আমাকে করতে বলে। বৃহঃস্পতিবার আমাকে বলা হয়েছিল মুস্তাফিজুর-কে নিয়ে আসতে, কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছি। কারণ আমার মন বলছিল বরং রিয়াদকে আনি। আমি সেটিই করেছি এবং রিয়াদ তার প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছে। সুতরাং, এগুলো ছিল হঠাৎ করে নেয়া সিদ্ধান্ত।
আমরা নয় থেকে আটে এসেছি এবং পরে আট থেকে সাতে উঠেছি এবং আমরা আরও উপরে উঠতে পারি। অন্ততপক্ষে আমাদের উচিৎ এই স্থানটি ঠিকভাবে ধরে রেখে সঠিক সময়ে আরও এগিয়ে যাওয়া। ক্রিকেট উত্থান পতনের খেলা, কিন্তু মূল জিনিষটি হচ্ছে ধৈর্যের সাথে আপনার নিজের জায়গাটি ধরে রাখা।
আমি সবাইকে অনুরোধ করবো খুব বেশী উত্তেজিত না হতে। আমাদের উচিৎ আমাদের প্রতিপক্ষকে সম্মান করা। একই সাথে আমাদের পরাজয়গুলোকে খুব রুঢ়ভাবে না নেওয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি যে দলটি এখন উন্নতি করছে দুই বা তিন বছর পরে এই দলটি যথেষ্ট পেশাদারিত্বের পরিচয় দিবে।
আমার ২০০ উইকেট নিয়ে আমি যদি আরো ১০০ টি ম্যাচ খেলতে পারতাম তাহলে আমি আরও গুরুত্বপূর্ণ বোলার হতে পারতাম। সম্ভবত আমাকে নিয়ে সবাই অনেক গর্বিত হত যদি আমি ৩০০ অথবা ৩৫০ উইকেট শিকারী কোন বোলার হতাম। আমি বিশ্বাস করি আমার দীর্ঘ সময় ধরে খেলার সামর্থ আছে, কিন্তু যদিও আমি বাংলাদেশের হয়ে ১৪ বছর ধরে খেলছি, তবুও আমি তিন থেকে চার বছর হারিয়েছি ইনজুরির কারণে।
আজ কিছু কথা পরিষ্কার করে বলি। আমরা সবাইকে বিনোদন দেই। আমরা প্রকৃতঅর্থে বীর নই। আমাদের সত্যিকার বীর হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা দেশের জন্য কোন কিছু বিসর্জন দিই নি। মুক্তিযোদ্ধারা দিয়েছেন। আমাকে ভূল বুঝবেননা—ক্রিকেট কিন্তু জীবনের সবকিছু নয়। আমরা শুধুমাত্র চেষ্টা করি আমাদের দেশের মানুষকে খুশী করতে।
আমাদের এখনো অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। আমাদের সামনে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় খেলা আছে। যদি আমরা সেখানে কিছু ম্যাচ জিততে পারি তখন আমরা বলতে পারবো আমরা যে কোন দলকে যে কোন জায়গায় হারানোর সামর্থ রাখি। তা স্বত্ত্বেও এই টিমের সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপারটি হচ্ছে এরা কখনোই কোনকিছু নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় না।
আমি আপনাকে এখন বলতে পারি তামিম একদিন ১০,০০০ রান করবে, সাকিব করবে ১০,০০০ রান, সাথে থাকবে ৪০০ উইকেট, মুস্তাফিজের থাকবে ৪০০ উইকেট এবং সৌম্যের ১০,০০০ রান। বাংলাদেশ সামনের দশ বছরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের প্লেয়ার বের করবে, যদি না টাকার মোহযুক্ত টি টুয়েন্টি লিগগুলো সবাইকে আচ্ছন্ন না করে।
আমি জানি না আমি কতদিন এইদলের সাথে আমার খেলা চালিয়ে যেতে পারবো। তবে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি—যখন আমি বুঝতে পারবো আমার দক্ষতা এবং ইচ্ছাশক্তি কমে আসছে, তখন আমি নিজে থেকেই সরে যাবো।
মূল সাক্ষাৎকারের লিঙ্কঃ ডেইলি স্টার