নীল ডিগ্রাস টাইসনঃ হোয়াইট হাউসের অনুরোধে, নিচের ছবিটা নিয়ে আমি আমার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করলাম। ছবিটা আজই রিলিজ করা হয়েছে, চাঁদে প্রথমবারের মত মানুষের পদচিহ্ন আকাঁর ৪৬ বছর পূর্তিতে।
পৃথিবী!
ক্লাসরুমের গোলকে যেমন দেখি, পৃথিবীটা তেমন কোনো দণ্ডের ওপর দাঁড় করানো, রঙ দিয়ে আলাদা করা রাষ্ট্রগুলো বা সীমারেখাগুলো দিয়ে তৈরি নয়। বরং আমরা পৃথিবীকে সেভাবেই দেখি, যেভাবে এই কসমস আমাদেরকে দেখায়ঃ নীল সমুদ্র -শুষ্ক ভূমি -শ্বেতশুভ্র মেঘ -মেরুর বরফ! সূর্যের আলোয় স্নাত একটা গ্রহ; প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর, অন্ধকারের পাটাতনে ভেসে থাকা একটা গ্রহ।
১৯৭২ সালে, যখন নাসা’র এপোলো ১৭ এর নভোচারীরা প্রথমবারের মত পৃথিবীর গোটা একটা গোলার্ধের ছবি তুলেছিলেন, তখন এ ধরনের চমৎকার একটা দৃশ্য উপভোগ করেছিলাম আমরা। এটাকে নীল মার্বেল বলা হতো। মহাকাশ নিয়ে করা এই প্রোগ্রামগুলো আমাদেরকে পৃথিবীর এমন অবিসংবাদিত কিছু ছবি দিয়েছে, যেগুলো দেখে আমরা প্রকৃতির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসি; নতুন করে চিন্তা করি আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
নিঃসন্দেহে, সময়টা খুব নাজুক ছিলো। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র খুব দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যে ছিলো। তখন একই সাথে দুটো যুদ্ধ চলছিলো – দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে উত্তপ্ত এক যুদ্ধ; আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শীতল যুদ্ধ। এছাড়াও ছিলো নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ক্যাম্পাসে ঝামেলা, গুপ্তহত্যা, আরো অনেক কিছু। আর এমন একটা সময়েই আমরা চাঁদে যাত্রা করেছি, সেখানে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থেমেছি, পেছনে ফিরে তাকিয়েছি, এবং যেন পৃথিবীকে প্রথমবারের মত আবিষ্কার করেছি।
১৯৭০ সালে, প্রথমবারের মত “ধরিত্রী দিবস” পালন করা হয়েছিলো। একই বছরে, দুই দলের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো পরিবেশ প্রতিরক্ষা সংস্থা (Environmental Protection Agency বা EPA) এবং জাতীয় সামুদ্রিক এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন (National Oceanic and Atmospheric Administration বা NOAA)। ১৯৭২ সালে কীটনাশক ডিডিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো, পাশ করা হয়েছিলো বিশুদ্ধ পানিসংক্রান্ত আইন (Clean Water Act). এক বছর পর, বিপদাপন্ন প্রাণীসংক্রান্ত আইন (Endangered Species Act) বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো, Catalytic Converter (অতি দূষিত গ্যাসকে কিছুটা কম ক্ষতিকর বানানোর জন্য যন্ত্র) বাজারে ছাড়া হয়েছিলো, সীসাযুক্ত দূষিত গ্যাস নির্গমনের জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছিলো। আমরা যে সবাই একই নৌকার যাত্রী, আমরা সবাই যে এই গ্রহে একই ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবো – এগুলো যেন তারই সরল স্বীকারোক্তি!
অনুতাপের বিষয়টা হচ্ছে, আমরা এখনো বেশ নাজুক সময়ের মধ্য দিয়েই চলছি। কিন্তু এখন আমাদের হাতে যে শুধু এই বাসস্থানটার ছবি আছে, তা নয়। আমাদের কাছে আছে এই গ্রহটার পুংখানুপুংখ তথ্য; আমরা এগুলো সংগ্রহ করছি প্রতিদিন ১৩ বার করে। আর এই সংগ্রহকার্য চালাচ্ছে Deep Space Climate Observatory (DSCOVR); এটা একটা স্পেস ক্যামেরা এবং টেলিস্কোপ যাকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিলো, পৃথিবী থেকে মিলিয়ন মাইল দূরে স্থাপন করা হয়েছিলো শুধু এই উদ্দেশ্যেই।
এখন আমরা সূর্যের প্রভাবে মহাশূন্যের আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখতে পারবো। পাশাপাশি দেখতে পাবো আমাদের ওজোন, এরোসল, উদ্ভিদ, আগেয়গিরির ছাই, পৃথিবীর আলোক প্রতিফলন ক্ষমতা – এই সবগুলোর মাত্রা, অত্যন্ত উচ্চ রেজ্যোল্যুশনের ছবিতে। আর ঠিক এই ধরনের উপাত্তই এই মুহূর্তে আমাদের প্রজাতির দরকার; ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে সকল সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।
এই ধরনের মুহূর্তগুলো আমাদের মধ্যে নতুন করে আত্মবিশ্বাস যোগায় – আমরা হয়তো শেষ পর্যন্ত দায়িত্ববান তত্ত্বাবধায়ক হতে পারবো – নিতে পারবো নিজেদের নিয়তির দায়িত্ব, সেই ভঙ্গুর গ্রহটার দায়িত্ব যাকে আমরা ‘পৃথিবী’ নামে ডাকি।
নীল ডিগ্রাস টাইসন
আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, নিউ ইয়র্ক সিটি
মূল ইংরেজি বক্তব্য, পড়ুন এখানে