শক্তিমান বর্তমানের ভূমিকা

|| লেখক পরিচিতি || অনুবাদকদের কথা || সংগ্রহ করুন ||

The Power of Now এর ভূমিকা

অনুবাদ – সাফাত হোসেন
সম্পাদনা – ফরহাদ হোসেন মাসুম

আমার জীবনে অতীতের গুরুত্ব নেই, অতীত নিয়ে আমি খুব কমই চিন্তা করি। তবে এই বইটি শুরু করার আগে খুব অল্প কথায় বলতে চাচ্ছি, কিভাবে আমি একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক হলাম, আর কিভাবে এই বইটির জন্ম হলো।

02. onubadokder adda

আমার জীবনের প্রথম ত্রিশটি বছর কেটেছে অবিরাম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আর দুশ্চিন্তার মাঝে। মাঝে মাঝেই হানা দিতো আত্মহত্যার ইচ্ছা। আমার উনত্রিশতম জন্মদিনের কিছুদিন পর এক মধ্যরাতে তীব্র ভয় আর অস্বস্তির মাঝে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। তখনকার সেই দিনগুলোতে প্রায়ই আতংকিত অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। তবে এবারের আতংকের তীব্রতা যেন অতীতের সকল অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেলো। রাতের নীরবতা, অন্ধকার ঘরের আসবাবপত্রের আবছা অবয়ব, দূরে ছুটে চলা চলন্ত ট্রেনের শব্দ – সবকিছু এতো অচেনা, এতো অসহনীয়, আর এতো অর্থহীন মনে হতে লাগলো যে জগতসংসারের প্রতি আমার এক তীব্র বিতৃষ্ণা জন্ম নিলো। তবে সবকিছুর চেয়ে আমাকে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিলো আমার নিজের অস্তিত্ব। এই অসীম দুঃখ-যাতনার মাঝে জীবনের মানে কোথায়? আর কতদিন এই অপার দুঃখের বোঝা আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে? আমি তখন ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য, অস্তিত্বহীনতার জন্য এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে ক্রমশ তা আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো।

“আমি আর এক মুহূর্তও এই আমার সাথে বেঁচে থাকতে পারবো না।” – ঘুরেফিরে বারবার এই চিন্তাটাই আমার মাথায় আসছিলো। তখন হঠাৎ করেই মাথায় মাথায় খেলে গেলো অদ্ভুত এক চিন্তা, “আমি কি একজন না দুইজন? যদি আমি আমার সাথে বেঁচে থাকতে না চাই, তাহলে নিশ্চয়ই আমার মাঝে দুইজন আমি রয়েছেঃ ‘আমি’ আর ‘অন্য আমি’, যার সাথে আমি বাঁচতে চাই না।”

“এরকমও তো হতে পারে”, আমি ভাবলাম, “এদের মধ্যে শুধু একজনই আসলে সত্যিকারের আমি।”

আচমকা এই অদ্ভুত উপলব্ধি আমার চেতনাকে এত তীব্রভাবে নাড়া দিলো যে আমার মন স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমি সম্পূর্ণ সজাগ থাকা সত্ত্বেও আমার মন হয়ে পড়লো চিন্তাশূন্য। আমার মনে হলো একটা তীব্র শক্তির বলয় যেন ধীরে ধীরে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চলেছে তার ভিতরে। এক তীক্ষ্ণ আতংকের অনুভূতি আমায় গ্রাস করলো, আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। শুনতে পেলাম আমার বুকের ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে, “বাধা দিও না”। আমি অনুভব করলাম এক অপার শুন্যতা যেন আমাকে তার ভিতরে শুষে নিচ্ছে। এই শূন্যতা যেন বাইরের পৃথিবীর নয়, আমার নিজের ভেতরের। হঠাৎই আমার সমস্ত ভয় আর আতংক উবে গেলো, আমি সেই শূন্যতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। এর পরেই আমি জ্ঞান হারালাম।

জানালা দিয়ে আসা পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভাঙলো। আমার মনে হলো, এরকম কোনো শব্দ আমি আগে কোথাও শুনিনি। আমি বন্ধ চোখেই দেখতে পেলাম এক অপূর্ব ঝলমলে হীরের অবয়ব। হ্যাঁ, একটা হীরে যদি কখনো শব্দ করে, সেই শব্দ এরকমই হবে মনে হয়। আমি চোখ খুললাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছিলো সকালের প্রথম সূর্যের আলো। কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই আমি অনুভব করলাম, এতদিন যতটুকু দেখেছি, এই সূর্যের আলোর ফোঁটা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। পর্দার ফাঁক দিয়ে যে নরম রোদ ঘরে আসছিলো, আসলে সেটা ছিলো বিশুদ্ধ ভালবাসা। আবেগে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলাম। আমি চিনতে পারলাম আমার সেই আগের ঘরটিকে, কিন্তু আমার মনে হলো এ ঘরের কোন কিছুই যেন আমি আগে কখনো ভাল করে দেখিনি। সবকিছু এত পবিত্র মনে হচ্ছিলো যেন মাত্রই এই পৃথিবীতে এসেছে। আমি হাতে তুলে নিলাম একটা পেন্সিল, একটা খালি বোতল, বিস্ময় নিয়ে অনুভব করলাম সবকিছুর প্রাণ আর অসীম সৌন্দর্য। সেদিন আমি শহরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে অবাক বিস্ময়ে অনুভব করলাম পৃথিবীর প্রাণময়তা, যেন আমি সদ্যই এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি।

পরের পাঁচ মাস আমি বুঁদ হয়ে রইলাম এক গভীর শান্তি আর আনন্দের মাঝে। তারপর এর তীব্রতা যেন একটু কমে এলো, এর কারণ হয়তো সেটাই সবসময়ের জন্য আমার স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো। আমি তখনো প্রতিদিনের সব কাজ করতাম। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝে ফেলেছিলাম। আর তা হলো – আমি যা পেয়েছি, পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে এর চেয়ে বেশি দেয়ার সামর্থ্য রাখেনা। আমি জানতাম, আমার মধ্যে খুব বড় একটা কিছু ঘটে গেছে, কিন্তু আমি তখন একেবারেই জানতাম না সেটা আসলে কী ছিলো।

এর কয়েক বছর পর যখন আমি আধ্যাত্মিক দর্শনের উপর পড়াশুনা করলাম, আধ্যাত্মিক গুরুদের সাথে সময় কাটালাম। তখন আমি বুঝতে পারলাম, পৃথিবীতে সবাই যা খুঁজছে তা আমি ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছি। তখন বুঝতে পারলাম, সেই রাতের দুঃখ কষ্টের অসহনীয় যন্ত্রণা আমার চেতনাকে বাধ্য করেছিলো আমার দুঃখী আর ভীত সত্তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, যা আসলে স্রেফ মনের কল্পনা ছিলো। আমার চেতনা এই অলীক, মিথ্যা কষ্টের সত্তাকে এমনভাবেই ত্যাগ করেছিলো যে সেই সত্তা সাথে সাথেই চুপসে গেছে; একটি বাতাস ভর্তি খেলনার ছিদ্র খুলে দিলে যেমন সেটি চুপসে যায়। তারপর রইলো শুধু আমার প্রকৃত সত্তা, সদা জাগ্রত আমিত্ব, চেতনার বিশুদ্ধ রূপ, যা জগতের মায়ায় আটকে যায় নি।

পরবর্তীতে আমি চাইলেই সেই সময়হীন এবং মৃত্যুহীন অস্তিত্বে ফিরে যেতে পারতাম। যে চেতনাকে শুরুতে শূন্যতা মনে হয়েছিলো, আমি সেই চেতনাতেই পূর্ণমাত্রায় সজাগ থাকতে পারতাম। আমি এমন এক তীব্র সুখ আর পবিত্রতার অনুভূতিতে ডুবে থাকতাম যে তা আমার প্রথমদিনের অভিজ্ঞতাকেও ছাড়িয়ে যেতো। এরপর এমন একটা সময় এলো, যখন কিছু সময়ের জন্য এই পৃথিবীতে আমার জাগতিক সম্পদ বলতে আর কিছুই থাকলো না। আমার কোনো সম্পর্ক ছিলোনা, চাকরি ছিলোনা, বাড়ি বা বলার মত কোন সামাজিক পরিচয়ও ছিলোনা। পার্কের বেঞ্চে বসে আমি প্রায় দু বছর কাটিয়ে দিলাম, সাথে ছিলো এক প্রখর সুখানুভূতি।

কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতাও একসময় চলে যায়। সেই অভিজ্ঞতাও চলে গেলো! কিন্তু সাথে রয়ে গেলো এক শান্তির পরশ, যা আর কখনোই আমাকে ছেড়ে যায়নি। মাঝে মাঝে এটা তীব্র হয়ে উঠতো, অনেকটা যেন ধরাছোঁয়ার সীমানার মধ্যেই। আমার আশেপাশের মানুষগুলোও সেটা অনুভব করতো। অন্যসময় সেটা থাকতো পর্দার পেছনে, দূর থেকে ভেসে আসা এক সুরের মত।

এরপর মানুষ মাঝেমাঝে আমার কাছে এসে বলতো, “তোমার যা আছে, সেটা আমিও চাই। সেটা দাও, অথবা দেখিয়ে দাও কিভাবে পেতে হয়।”

আমি তখন তাদের উত্তর দিতাম, “সেটা তোমার এখনই আছে। তোমার মন সবসময় অনেক শব্দ করে, তাই তুমি সেটা বুঝতে পারো না।” সেই উত্তরগুলোই পরবর্তীতে তোমার হাতের এই বইটাতে পরিণত হয়েছে। কিছু বোঝার আগেই এই পৃথিবীতে আবার একটি পরিচয় পেয়ে গেলাম; হয়ে গেলাম একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক।

সত্য, তোমার গভীরেই নিহিত

আমার এই অর্জিত জ্ঞানের যতটুকু ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব, তার সারাংশ রয়েছে এই বইয়ে। গত দশ বছরে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় অসংখ্য মানুষ আর আধ্যাত্মিক অন্বেষণে নিবেদিত ছোটো ছোটো দলের সাথে কাজ করেছি। গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা মেশানো ধন্যবাদ জানাচ্ছি সেই লোকগুলোকে, নিজেদের ভেতরের পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর জন্য; তাদের জটিল প্রশ্নগুলোর জন্য, আর ধৈর্য ধরে উত্তরগুলো শোনার জন্য। তারা না থাকলে এই বইটির জন্ম হতো না। সংখ্যায় ওরা কম, তবে সুসংবাদ হচ্ছে, এই আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক মানুষগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। তারা এমন এক ক্রান্তিলগ্নে পা দিয়েছে, যেখান থেকে তারা মুক্তি পেয়েছে যুগ যুগ ধরে মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে বয়ে চলা মানসিক যাতনার বৃত্ত থেকে।

যারা নিজের ভেতরে বড় ধরনের রূপান্তরকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত, তাদের জন্য এই বইটি একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। এও আশা করি যে আরো অনেক পাঠক, যারা হয়তো একে তাদের জীবনে পুরোপুরি ধারণ আর অনুশীলন করার জন্য এখনই প্রস্তুত নন, তাদের কাছেও বইটি অনেকাংশে সঠিক মনে হবে। এই বইটি পড়ার সময় তাদের ভেতর যে বীজ বপিত হবে, হয়তো পরবর্তী কোন সময়ে তা মিশে যাবে মানুষের আলোকিত সত্তার সাথে,যা রয়েছে প্রত্যেক মানুষের ভেতরে। তারপর আচমকা সেই বীজ মাটি ফুঁড়ে তাদের ভেতরে জীবন্ত হয়ে উঠবে।

এই বইটি বর্তমান অবস্থায় এসেছে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বিভিন্ন সেমিনার আর মেডিটেশন ক্লাসে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে, ব্যাক্তিগতভাবে পরামর্শ প্রদান করার মাধ্যমে। তাই আমি এই বইটি প্রশ্ন-উত্তরের কাঠামোতেই রেখেছি। সেইসব ক্লাস আর সেমিনারগুলোতে আমি প্রশ্নকারীদের মতই অনেক কিছু শিখেছি আর গ্রহণ করেছি। ক্লাস আর সেমিনার থেকে প্রায় কিছু প্রশ্ন আর উত্তর প্রায় হুবহু এই বইয়ে উদ্ধৃত করেছি। অন্য প্রশ্নগুলো শ্রেণীবিভাগ করা। আমি সবচেয়ে বেশিবার আসা প্রশ্নগুলো সম্মিলিত করে একটি প্রশ্নের আকারে দিয়েছি। একইভাবে, অনেক উত্তরের সারাংশ মিলিয়ে সেই প্রশ্নের একটি উত্তর বের করেছি। অনেকসময় এই লেখার মধ্যে দিয়েই এমন সব উত্তরের জন্ম হয়েছে, যেটা আগে বলা যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। কিছু অতিরিক্ত প্রশ্ন সম্পাদক যুক্ত করেছেন, কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য।

খেয়াল করলে দেখতে পাবে, এই বইয়ের শুরু থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সমস্ত কথোপকথনের দুটি স্তর রয়েছে।

একটি স্তরে তোমার ভেতরের মিথ্যা সত্তার প্রতি আমি তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছি। আমি আলোকপাত করেছি মানুষের চেতনার প্রকৃতি, এর দূষিত রূপ, আর এর সবচেয়ে সাধারণ অভিব্যাক্তিগুলোর প্রকাশের উপর; ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যকার যুদ্ধের উপর। এই সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক, কারণ যতক্ষণ না তুমি মিথ্যাকে মিথ্যা বলে চিনতে পারছো – তোমার মিথ্যা সত্তাকে মিথ্যা বলে চিনতে পারছো, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভেতর কোন স্থায়ী রুপান্তর হওয়া অসম্ভব। ততক্ষণ তুমি বারংবার সেই মায়াময় ভ্রান্তির মাঝেই ঘুরপাক খেতে থাকবে, যার অর্থ হল অবধারিত দুঃখ আর বেদনা। এই স্তরে আমি তোমাকে আরো দেখাবো, কিভাবে মিথ্যাকে নিজের প্রকৃত সত্তা থেকে দূরে রাখতে হয়, মিথ্যাকে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যায় পরিণত না করতে হয়। কারণ, এভাবেই মিথ্যা নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে।

আরেকটি স্তরে আমি তোমাকে বলবো, তোমার চেতনার এক মহৎ রূপান্তরের কথা – যা কোন সুদূর ভবিষ্যত থেকে হাতছানি দেয়া আশার আলো নয়। বরং, যা তুমি এখনই পেতে পারো – তোমার পরিচয় যাই হোক, আর তুমি যেখানেই থাকো না কেন। তুমি দেখবে, কিভাবে তুমি নিজেকে মনের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে আলোকিত চেতনায় পদার্পণ করতে পারো; কিভাবে তুমি সেটা প্রতিদিনের জীবনে ধরে রাখতে পারো।

বইয়ের এই স্তরটিতে অনেক শব্দ আছে, যেগুলো তেমন কোন অর্থ বহন করে না। বরং সেগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে তারা তোমাকে এই নব-চেতনায় পদার্পণ করার সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। বারবার আমি তোমাকে বর্তমানের সেই তীব্র সজাগ অনন্ত চেতনার স্তরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবো, যাতে তুমি আলোকিত হবার অনুভূতি পাও। যতক্ষণ সেই অভিজ্ঞতাটা না হচ্ছে, ততক্ষণ তোমার কাছে অনুচ্ছেদগুলো কিছুটা পুনরাবৃত্তিমূলক মনে হতে পারে। কিন্তু যখন সেই অনুভূতি হবে, আমার বিশ্বাস, তুমি তখন আবিষ্কার করবে যে সেই কথাগুলোর মাঝে অনেক বেশি আধ্যাত্মিক শক্তি সুপ্ত রয়েছে। এরপর থেকে হয়তো সেই অনুচ্ছেদগুলোই এই বইয়ের মধ্যে তোমার সবচেয়ে পছন্দের অংশে পরিণত হবে। তাছাড়া, প্রত্যেক মানুষই তার ভেতরে এক সুপ্ত আলোকিত সত্তার বীজ বহন করে। তাই আমি প্রায়ই তোমার চিন্তাশীল সত্তারও গভীরে যে সত্তাটা লুকিয়ে আছে, তাকে ডেকে আনবো। সেই পরম সত্তা সাথে সাথে সত্যকে চিনে নেয়, সত্যের সাথে একাত্ম হয়, আর তা থেকে শক্তি অর্জন করে।

কিছু নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদের শেষে এই যতিচিহ্নগুলো (===) থাকবে। এগুলো তোমার জন্য একটি নির্দেশনা। হয়তো সেই অনুচ্ছেদগুলো পড়া শেষ হলে তুমি কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে, ওপরে আলোচিত সত্যগুলো উপলব্ধি করতে চাইবে। হয়তো এই বইয়ের কিছু অংশে তুমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে থেকেই বিরতি নিতে চাইবে। বইয়ের শুরুর দিকে কয়েকটা শব্দের অর্থ তোমার কাছে কিছুটা অস্পষ্ট মনে হতে পারে, যেমনঃ ‘অস্তিত্ব’ (being) অথবা ‘বর্তমানে উপস্থিতি’ (presence)। কিন্তু পড়ে যেও। পড়ার সময় নানা প্রশ্ন আর আপত্তি তোমার মনে আসতে পারে। হয়তো সেগুলোর উত্তর বইয়ের পরবর্তী কোনো একটা অংশেই পাবে। তোমার কাছে সেইসব প্রশ্ন হয়তো গুরুত্বহীনও হয়ে যেতে পারে, যদি বইটি পড়ার সময় তুমি নিজের গভীর সত্তায় পদার্পণ করো।

শুধু তোমার মনকে ব্যবহার করে বইটি পড়ো না। পড়ার সময় খুব সজাগ হয়ে লক্ষ্য রেখো, ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছো কিনা, মনের গভীর থেকে কোন কিছুকে চিনতে পারছো কিনা। আমি তোমাকে এমন কোন কিছুই বলব না যা তুমি তোমার মনের গভীরে ইতোমধ্যেই জানো না। আমি শুধু সেটাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে পারি,যা তুমি ভুলে গেছো। তোমার প্রতিটি কোষ থেকে তখন বিচ্ছুরিত হবে সুপ্রাচীন সেই সদাজাগ্রত জ্ঞান।

মন সবসময়ই চায় তুলনা আর শ্রেণীবিভাগ করতে। তবে এই বইটি বেশি সহায়ক হবে, যদি তুমি অন্য কোনো দর্শনের সাথে এর শব্দগুলোর তুলনা না করো। নইলে বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। “মন”, “আনন্দ”, এবং “চেতনা” – এরকম কিছু শব্দের অর্থ আমি এমনভাবে ব্যবহার করেছি, যা হয়তো অন্যান্য ক্ষেত্রে এই শব্দগুলোর প্রচলিত অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শব্দ নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। একেকটা শব্দ সিঁড়ির একেকটা ধাপ মাত্র, অতিক্রম করার সাথে সাথেই এদের ত্যাগ করতে হবে।

যখন আমি যীশু, বুদ্ধ, A Course in Miracles, অথবা অন্য কোনো দর্শন থেকে কোন উক্তিকে ব্যবহার করবো, তখন তা কোনভাবেই তাদের মাঝে তুলনা করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং এটা দেখানোর জন্য যে সকল আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূল চেতনা আসলে একই, যদিও তার রূপ ভিন্ন। এই আধ্যাত্মিক শিক্ষার কিছু রূপ – যেমন, প্রাচীন কিছু ধর্মে তাদের তুচ্ছ বিষয়গুলোকে এমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, এর মাঝে তাদের আধ্যাত্মিক চেতনা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই এগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ আর মানুষের কাছে ধরা পড়ে না। তাদের সেই আধ্যাত্মিক রূপান্তরের ক্ষমতা তাই হারিয়ে গেছে। তাই, আমি যখন সেই প্রাচীন ধর্মগুলো থেকে অথবা অন্য কোনো দর্শন থেকে উক্তি উল্লেখ করবো, সেটা হবে অপেক্ষাকৃত গভীর অর্থকে প্রকাশ করার জন্য। তাদের সেই আধ্যাত্মিক রূপান্তরের ক্ষমতা পুনর্জীবিত করার জন্য; বিশেষ করে সেই ধর্ম বা দর্শনের অনুসারীদের ক্ষেত্রে। আমি তাদের বলবো – সত্য অন্বেষণের জন্য তোমাকে আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাকে দেখানোর সুযোগ দাও, কিভাবে নিজের গভীরে ডুব দিয়েই তুমি মুক্তির সন্ধান পেতে পারো।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ শব্দ-উপমা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি, যাতে তা আরো বেশি বর্ণ-গোত্রের মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারে। এই বইটিকে তাই বর্তমান সময়ে সেই আদি ও অনন্ত আধ্যাত্মিক দর্শনের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা সকল বর্তমান ধর্মের মূল সুর। এই সুর কোনো এলিয়েন উৎস থেকে নেয়া হয়নি, এর জন্ম হয়েছে তোমার ভেতরের সেই একক উৎস থেকে, যা চিরকালের জন্যই সত্য। তাই, এর মাঝে কোন তত্ত্ব নেই। আমি সব কথা বলবো আমার ভেতরের অভিজ্ঞতা থেকে। যদি আমি কখনো টেবিল চাপড়ে জোর দিয়ে কোনো কথা বলি, সেটা শুধু মানসিক বাধার আস্তরণ ভেঙ্গে তোমার ভেতরে পৌঁছানোর জন্যই। যেখানে আমার মতো তুমিও ইতোমধ্যেই সত্যকে জানো, যেখানে তুমি সত্যের দেখা পাওয়ামাত্রই চিনে ফেলতে পারো। তখন তোমার মাঝে এক উল্লাস আর প্রচণ্ড জীবন্ত অনুভূতি হবে। তোমার ভেতরে কিছু একটা বলে উঠবে, “হ্যাঁ, আমি জানি এটা সত্যি।”

||শক্তিমান বর্তমানের প্রথম অধ্যায়||

3 thoughts on “শক্তিমান বর্তমানের ভূমিকা

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *