কিছু মানুষ সবসময়ই থাকে যারা জানতে চায় ঘটনাটা কী নিয়ে? যারা এই প্রশ্ন করে এবং জানতে চায়, বুঝতে চায় ‘ব্যাপারটা কী’ তাদের জন্য:
‘এই যে অসংখ্য সরকারি কর্মচারী, সৈনিক, জেলার, পুলিশ চারপাশে শাসনযন্ত্রের হয়ে কাজ করছে, এরা কাজ করছে যন্ত্রের মত, মানুষের মত করে নয়। নীতিবোধ বা বিচারের ব্যাপারে কোন স্বাধীনতার চর্চা এখানে নেই। এরা এমন জড়বস্তুর মত কাজ করে যে, কিছু কাঠের পুতুল বানিয়ে ছেড়ে দিলেও বোধ করি কাজ একই হবে। নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে খড়ের পুতুলের চেয়ে বেশি সম্মান এরা পায় না। এদের দাম ঘোড়া বা কুকুরের চেয়ে বেশি না। তারপরও এদেরকে ভাল নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। আর বাকিদের মধ্যে আইন প্রণয়নকারী, রাজনীতিবিদ, উকিল, মন্ত্রী, অফিস প্রধান এরা কাজ করে নিজেদের মাথা খাটিয়ে। আর যেহেতু এরা নৈতিক বিভেদকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, তাই না চাইলেও এরা ঈশ্বরের মত আচরণ করে বসে। যা প্রকারান্তরে শয়তানের হয়ে কাজ করার মতই হয়ে যায়। আর কিছু আছে যারা বীর, দেশপ্রেমিক, শহীদ, কিংবা সংস্কারকের কাজ করে। এরা সংখ্যায় খুব অল্প, কিন্তু এরাই শুধু মানবিক বিবেচনাবোধ নিয়ে কাজ করে। স্বভাবতই এরা এই শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং এর শত্রু বলে চিহ্নিত হয়।’
হেনরি ডেভিড থোরোউ,
‘সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’
এই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এখন আমরা মাঝখান থেকে শুরু করব, শুরুর কথা পরে জানব। সমাপ্তি যথাসময়ে আসবে।
যাদের নজর রাখার কথা, তারা যদি ঠিকমত নজর রাখত, ব্যাপারটা এতদূর গড়াতো না। মাসের পর মাস বিচ্যুতিটা তাদের নজর এড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র যখন লোকটার পরিচিতি বাড়তে লাগল, বিখ্যাত হয়ে গেল এমনকি (সরকারি ভাষায়) ‘মানসিকভাবে অস্থির একদল লোকের’ কাছে নায়কের আসন পেয়ে বসল, শুধুমাত্র তখনই তারা টিকটকম্যান আর তার আইনসিদ্ধ যন্ত্রপাতির দ্বারস্থ হল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো ধারণা ছিল না ততক্ষণে বহুদিন আগে গত হয়ে যাওয়া একটা রোগের মত, প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বসে পড়া সমাজে চরম বাস্তবতা হিসেবে ওর নবজন্ম হয়েছে। এখন ওর অস্তিত্ব অনেক জোরালো।
ব্যক্তিত্ব জিনিসটাকে বহুদিন আগেই ছেঁকে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ও এখন আলাদা একটা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্তদের একটা অংশের কাছে এটা বিচ্ছিরি, বিদঘুটে, বিশৃঙ্খল, আর লজ্জাজনক একটা ব্যাপার। বাকিদের মধ্যে যাদের কাছে চিন্তাভাবনার চাইতে আনুষ্ঠানিকতা, যথার্থতার মূল্য বেশি, তারা পুরো ব্যাপারটা দেখে হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু নীচে, পাপ-পুণ্য, নায়ক-খলনায়কদের খেলাঘরে যারা থাকে, তাদের কাছে ও একজন নেপোলিয়ন, একজন রবিনহুড, একজন যীশু।
আর সম্পদশালী, ক্ষমতাবান বা অভিজাত উঁচু তলার মানুষদের কাছে ও ছিল ক্ষতিকর, বিপথগামী, মূর্তিমান একটা আতংক। সমাজের প্রতিটা স্তর ওকে জানত। তবে ওর কাজকর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ত উঁচু আর নীচুতলায়। তাই ওর সব কাগজ, ওর টাইম-কার্ড আর কার্ডিওপ্লেট সহ টিকটকম্যানের অফিসে পাঠানো হল।
টিকটকম্যান: মুখোশধারী, ছয় ফুটের উপর লম্বা, গম্ভীর ধরনের মানুষ। সবকিছু সময়মত চললে সে মৃমমম মৃমমম করে মৃদু আওয়াজ করে।
এমনকি চৌকো অফিসঘরগুলোতে, যেখানে ভয়ের বাস, সেখানেও সবাই তাকে আড়ালেই টিকটকম্যান বলে, কিন্তু সামনে কখনো না। মুখোশের আড়ালের লোকটা অসম্ভব ক্ষমতাবান। যে কারও জীবন থেকে মিনিট, ঘণ্টা, দিন, রাত, এমনকি বছর পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। এমন লোককে মুখোশের সামনে তো আর তার অপছন্দের নামে ডাকা যায় না। এরচেয়ে মাস্টার টাইমকিপার ডাকাটাই নিরাপদ।
‘আমার বাম হাতে ধরা টাইম-কার্ডের নামটা বলছে সে কী। সে আসলে কে এটা এই টাইম-কার্ড বলতে পারছে না।’ টিকটক-ম্যানের গলার স্বর নরম আর আন্তরিক শোনালো। ‘এমনকি আমার ডান হাতে ধরা কার্ডিওপ্লেটও সে আসলে কে তা বলতে অক্ষম। কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে বুঝতে হবে এই কী আসলে কে।’
সব কর্মচারীকে টিকটক-ম্যান জিজ্ঞেস করল, ‘কে এই হার্লেকুইন?’ নরম নয়, তার কণ্ঠটা এখন কর্কশ শোনালো। কর্মচারী, খোঁজদার, কাঠ জোগাড়ে, গুপ্তচর বা কমেক্সরা কখনো টিকটকম্যানকে একসাথে এত কথা বলতে শোনেনি। মিনিজরা অবশ্য টিকটকম্যানের আশেপাশে থাকে না তাই তাদের শোনার কথাও না। তবে সবাই আবিষ্কারের চেষ্টায় বেরোলো।
কে এই হার্লেকুইন?
হার্লেকুইন তখন শহরের উপরের তালারও উপরে বসে আছে। মধ্যযুগীয় ভাঁড়ের পোশাক ওর পরনে। আকাশ-তরীর প্ল্যাটফর্মের অ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো থেকে মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। (হুঁহ! আকাশ-তরী! তাড়াহুড়ো করে সুইযলস্কিডের পেছনে একটা টো-র্যাক লাগিয়ে দিলেই হল!) সিট থেকে মাথা বাড়িয়ে নীচের বাড়িঘরের দিকে তাকাল হার্লেকুইন।
কাছেই কোথাও যান্ত্রিক লেফট-রাইট-লেফট শোনা যাচ্ছে। দুপুর ২:৪৭ এর কর্মীরা টিমকিন রোলার-বিয়ারিঙের কারখানায় ঢুকছে। ঠিক এক মিনিট পরে আরও আস্তে রাইট-লেফট-রাইট শোনা গেল। ভোর ৫:০০ টার দল লাইন ধরে বাড়ি ফিরছে।
গালে টোল ফেলে এলফদের মত একটা বিশাল হাসি ওর মুখে খেলে গেল। লালচে চুল ভর্তি মাথাটা একটু চুলকে নিল। একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রস্তুত হল। বাতাসের দিকে ঝুঁকে আকাশ-তরীর জয়স্টিকটা সামনে ঠেলে দিল। আকাশ-তরী নীচে পড়তে শুরু করল। স্লাইডওয়াকের ওপর দিয়ে ভাসতে লাগল। পথচারীদের ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছে করেই আরও কিছুটা নামল। কানে আঙুল ঢুকিয়ে, জিভ বের করে, চোখ উল্টে বুগা-বুগা-বুগা করল। এক পথচারী হাতের সব জিনিস ফেলে ছড়িয়ে হোঁচট খেল। একজন কাপড় নষ্ট করল। এক মহিলা পড়েই গেল। তাকে তুলতে গিয়ে স্লাইডওয়াকটা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হল। নজর অন্যদিকে সরানোর ছোট একটা প্রচেষ্টা। তারপর ও বাতাসের সাথে হাওয়া হয়ে গেল। হি-হো।
টাইম-মোশন স্টাডি বিল্ডিং এর কোনাটা ঘুরল হার্লেকুইন। দেখল একদল কর্মী তখন স্লাইডওয়াকে উঠছে। উঠে সবাই লাইনধরে দাঁড়াল। বহুদিনের চর্চার ফলে কোন বিচ্যুতি ছাড়াই সবাই স্লো-স্ট্রিপে উঠে পড়ল আর (বাসবি বার্কলের ১৯৩০ এর এন্টিডিলুভিয়ান ছবির কোরাসের মত একটা কোরাস গাইতে গাইতে) এক্সপ্রেসস্ট্রিপে লাইন দিয়ে না ওঠা পর্যন্ত সামনে এগোতে থাকল।
প্রত্যাশায় ওর মুখে একটা দুষ্টুমীর হাসি খেলে গেল। ওর বাঁ পাটির একটা দাঁত নেই। আচমকা যাতে পড়ে না যায়, তাই কিছু হোল্ডিং পিন লাগানো আছে পেছনের কার্গোতে। আকাশ-তরী নিয়ে নেচে কুঁদে ও কর্মীদের দিকে এগোল। ওপর দিয়ে যেতে যেতে হোল্ডিং পিনগুলো খুলে ফেলল। এক্সপ্রেসস্ট্রিপের ওপর ঝড়ে পড়তে লাগল একশো পঞ্চাশ হাজার ডলার মূল্যের জেলি বিন।
জেলি বিন! নানা বর্ণের, নানা স্বাদের, নানা আকারের, নানা ধরনের জেলি বিন। বাইরে মুচমুচে আর ভেতরটা নরম মিষ্টি জিনিসগুলো টিমকিন কর্মীদের শক্ত হ্যাট আর পোশাকের ওপর ঘড়ে পড়তে লাগল। শৈশবের সব আনন্দের রঙ নিয়ে আকাশ ঢেকে সবার গায়ের ওপরে, পায়ের নীচে বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আহ জেলি বিন!
খুশিতে সব কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। অসংখ্য জেলি বিন স্লাইডওয়াকে ঢুকে পড়ে বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থার সৃষ্টি করল। শব্দে মনে হতো লাগল লক্ষ লক্ষ আঙুল মিলে তবলা বাজাচ্ছে। সবগুলো স্লাইডওয়াক বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন এদিক সেদিক ছিটকে পড়তে লাগল। তারপরও সবাই হাসছে আর ছেলেমানুষী রঙের জেলি বিন তুলে মুখে পুরছে। যেন আজ ছুটি, আনন্দের দিন, পাগলামীর দিন, হাসির দিন। কিন্তু …
এই কাজের পালায় সাত মিনিট নষ্ট।
কর্মীদের বাড়ি ফিরতে সাত মিনিট দেরি।
প্রধাণ শিডিউলেই ৭ মিনিটের গন্ডগোল বেধে গেল।
বিলি ব্যবস্থাও সাত মিনিট দেরি হল সাইডওয়াক বন্ধ থাকার কারণে।
ও লাইনের প্রথম ডোমিনোটাতেই একটা টোকা দিয়েছে শুধু, বাকিগুলো চিক চিক চিক করে নিজেরাই পড়ে গেছে এক এক করে।
পুরো সিস্টেমে সাত মিনিটের একটা গন্ডগোল বেধে গেল। আপাতদৃষ্টিতে খুবই তুচ্ছ একটা ব্যাপার। কিন্তু এই সমাজটা নিয়ম, একতা আর সময়ানুবর্তিতার ভিত্তিতে চলে। সবকিছু হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে। ঘড়িকে দেবতার মত সম্মান দিয়ে দেখা হয়। এই সমাজের জন্য এটা একটা বিরাট বিপর্যয়ই বলা চলে।
তো ওকে টিকটকম্যানের সামনে হাজির হতে বলা হল। সকল গণযোগাযোগ ব্যবস্থায় নির্দেশটা ছড়িয়ে দেয়া হল। ওকে ঠিক ৭:০০ টায় হাজির হতে বলা হয়েছিল। সবাইকে অপেক্ষায় রেখে ও সাড়ে দশটার দিকে হাজির হল। হাজির হয়ে গান ধরল। ভারমন্ট বলে একটা জায়গার (যে জায়গার নাম কেউ কখনো শোনেনি) জোছনা নিয়ে গান। গানটা গেয়েই আবার হাওয়া। যারা অপেক্ষা করছিল, তাদের শিডিউলে তো নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই গেল: কে এই হার্লেকুইন?
কিন্তু যে প্রশ্নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই কেউ জিজ্ঞেস করল না। এই হাস্যকার, দায়িত্বজ্ঞানহীন জোকারটা এই অবস্থানে আসল কিভাবে? যে অবস্থানে থাকলে দেড় লাখ ডলারের জেলি বিন দিয়ে অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক জীবনে তুলকালাম ঘটিয়ে দেয়া যায়?
হায়রে জেলি বিন! এই পাগলামীর কোন মানে হয়! আর দেড় লাখ ডলারের জেলি বিন কেনার টাকাই বা ও কোথায় পেল? (ওরা খরচের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। একদল সিস্টেম এনালিস্টকে সাথে সাথে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। সব চকলেটের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে গুনে দেখার জন্য। এই করতে গিয়ে এনালিস্টরা শিডিউলের পুরো একটা দিন পিছিয়ে গেছে।) জেলি বিন! জেলি…বিন? দাঁড়াও, এক মিনিট, গত একশো বছর ধরে তো জেলি বিন তৈরিই হয় না। ও জেলি বিন পেল কোথায়?
আরও একটা ভাল প্রশ্ন। প্রশ্নটার কোন সদুত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অবশ্য, ক’টা প্রশ্নেরই বা সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়?
মাঝখানের অংশ তো জানা গেল। এবার শুরুর কাহিনী। কিভাবে শুরু হল:
একটা ডেস্ক প্যাড। দিনের পর দিন যায়। ৯টায় চিঠি লেখা। ৯:৪৫ এ পরিকল্পনা বিভাগের সাথে সাক্ষাতের সময় নেয়া। ১০:৩০ এ জে. এলের সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা। ১১:৪৫ এ বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। ১২:০০টায় লাঞ্চ। তারপর এভাবেই চলতে থাকে।
‘মিস গ্রান্ট, আমি সত্যিই দু:খিত। আপনার সাক্ষাতের সময় ছিল ২:৩০। এখন বাজে প্রায় পাঁচটা। আপনি দেরি করে ফেলেছেন। নিয়ম তো নিয়মই। এই কলেজে এপ্লিকেশন জমা দেবার জন্য আপনাকে আবার সামনের বছর আসতে হবে।’ তারপর এভাবেই চলতে থাকে।
১০:১০ এর লোকাল ক্রেস্টহেভেন, গেলসভিল, টোনাওয়ান্ডা জাংশন, সেলবি আর ফার্নহার্স্টে থামে, কিন্তু রবিবার ছাড়া ইনডিয়ানা সিটি, লুকাসভিল বা কল্টনে থামে না। ১০:৩৫ এক্সপ্রেস গেলসভিল, সেলবি আর ইনডিয়ানা সিটিতে থামে, তবে রবিবার এবং ছুটির দিন ছাড়া। ঐ দিনগুলোতে থামে….তারপর এভাবেই চলতে থাকে।
‘আমি অপেক্ষা করতে পারিনি, ফ্রেড। ৩:০০টার ভেতর আমার পিয়েরে কার্টেনে থাকার কথা। তুমি বলেছিলে টার্মিনালের ঘড়ির নীচে ২:৪৫ এর মধ্যে থাকবে, কিন্তু তুমি ছিলে না তাই আমাকে একাই যেতে হয়েছে। তুমি সবসময় দেরি কর ফ্রেড। তুমি থাকলে আমরা একসাথে কাজটা নিতে পারতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা আমাকে একাই নিতে হয়েছে….’ তারপর এভাবেই চলতে থাকে।
প্রিয় মি. এবং মিসেস অ্যাটারলি: আপনাদের ছেলে জেরোল্ড নিয়মিত নিয়ম ভাঙছে। যেকোন প্রকারে ওর সময়মত ক্লাসে আসা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ওকে বের করে দেয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় থাকবে না। নি:সন্দেহে ও ভাল ছাত্র। আর সবার চাইতে ও বেশি নম্বর পায়। তারপরও, অন্য সব বাচ্চারা যেখানে সময়মত আসতে পারছে, সেখানে ও আসতে না পারলে তো ওকে রাখা সম্ভব হবে না তারপর যথারীতি এভাবেই চলতে থাকে।
৮:৪৫ এ না আসলে ভোট দেয়া যাবে না।
‘ভাল হোক বা খারাপ হোক তাতে কিছু যায় আসে না, চিত্রনাট্য আমার বৃহস্পতিবারই লাগবে।’
দুপুর ২:০০ টা হচ্ছে বেরোবার সময়।
‘দু:খিত। দেরি করে ফেলেছেন। চাকরিটা আরেকজন পেয়ে গেছে।’
২০ মিনিট সময় নষ্ট হবার কারণে তোমার বেতন কাটা গেছে।
‘খোদা! ক’টা বাজে? আমার যেতে হবে।’
তারপরও এভাবেই চলতে থাকে। টিক টিক করে সময় চলছে তো চলছেই। এভাবে একসময় সময়ের হিসাব রাখার বদলে সময় ধরে চলা শুরু করল সবাই। শিডিউলের দাস হয়ে গেল। শুরু করল নিয়মের বেড়াজালে বৈচিত্রহীন জীবনযাপন। সুচারুভাবে শিডিউল অনুসরণ করা উচিত, নাহলে নগরব্যবস্থায় কিঞ্চিত সমস্যা দেখা দেবে।
কিন্তু যখনই দেরি হওয়াটা কিঞ্চিত সমস্যার গন্ডী পেরোল, তখনই সমস্যা শুরু হল।
তখন এটা হয়ে গেল দোষ এবং তারপর অপরাধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হল এই বলে:
২৩৮৯ সালের ১৫ই জুলাই রাত ১২টা থেকে কার্যকরী হবে, সব নাগরিককে মাস্টার টাইমকিপারের কাছে তাদের টাইম-কার্ড আর কার্ডিওপ্লেট জমা দিতে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। আইনের ৫৫৫-৭-এসজিএইচ-৯৯৯ ধারার সাথে মিলিয়ে সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা হল। যার যার কার্ডিওপ্লেটে তার তার জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং –
ওরা যেটা করেছিল সেটা হল একটা সিস্টেম দাঁড় করানো, যা দিয়ে কাজের ভিত্তিতে জীবন থেকে সময় কাটা হবে। যেমন কেউ যদি ১০ মিনিট দেরি করে, তার জীবন থেকে ১০ মিনিট কেটে নেয়া হবে। একঘণ্টা দেরি হলে আরও বেশি। ধরা যাক একজন নিয়মিত দেরি করেই যাচ্ছে। সে হয়ত এক রবিবার রাতে মাস্টার টাইমকিপারের কাছ থেকে একটা বার্তা পাবে। সেখানে বলা থাকবে তার সময় শেষ, সোমবার দুপুরে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ করে দেয়া হবে। সে যেন অনুগ্রহ করে তার সব হিসাব চুকিয়ে ফেলে।
তো, অমানবিক মনে হলেও যৌক্তিক এবং খুবই সরল এই ব্যবস্থাটা (যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, টিকটকম্যানের অফিস তা খুব সাবধানে গোপন রেখেছে) চালু রাখা হয়েছে। এটাই একমাত্র যুক্তিযুক্ত উপায় ছিল। দেশের প্রয়োজনটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। শিডিউলও মেনে চলতেই হবে। আর ব্যাপারটাতো তখন একরকম একটা যুদ্ধই ছিল।
অবশ্য, যুদ্ধ কখনই বা ছিল না?
‘জঘন্য একটা ব্যাপার হল,’ প্রিটি অ্যালিসের কাছে ওয়ান্টেড পোস্টারটা দেখে মন্তব্য করল হার্লেকুইন। ‘জঘন্য রকমের মিথ্যা। এটাই কি বুনো পশ্চিম, যে একেবারে ওয়ান্টেড পোস্টারই ছেপে দিতে হবে!’
‘তুমি কি খেয়াল করেছ,’ অ্যালিস বলল, ‘তোমার কথায় প্রচুর বিভক্তি আর প্রত্যয়যুক্ত শব্দ ব্যবহার করছ?’
‘আমি দু:খিত,’ বিনয়ের সুরে বলল হার্লেকুইন।
‘দু:খিত হওয়ার কোন দরকার নেই। তুমি সবসময়ই ‘দু:খিত’। তোমার অপরাধের সংখ্যা এত বেশি, এভারেট।’
‘আমি দু:খিত,’ গালে টোল ফেলে আবারও বলল ও। তারপরের কথাটা অবশ্য বলার চিন্তা করেনি, ‘আবার বেরোতে হবে, আরেকটু কাজ আছে।’
কফিপটটা সজোরে কাউন্টারে নামিয়ে রেখে অ্যালিস বলল, ‘ঈশ্বরের দোহাই, এভারেট, একরাতের জন্যও কি বাড়িতে থাকতে পার না! মানুষকে বিরক্ত করার জন্য এই বিচ্ছিরি ক্লাউনের পোশাক পরে বেরোতেই হবে?’
‘আমি—,’ বলতে গিয়ে থেমে গেল। টুংটাং শব্দে ঘণ্টা বাজিয়ে লালচে বাদামী চুল ভরা মাথায় ভাঁড়ের টুপিটা বসাল। উঠে কফিপটটা কলের পানিতে ধুয়ে একটুক্ষণ ড্রায়ারে ধরে শুকিয়ে নিল। ‘বেরোতে হবে।’
অ্যালিস কোন উত্তর দিল না। শব্দতুলে ফ্যাক্স থেকে একটা কাগজ বেরোল। কাগজটা পড়ে হার্লেকুইনের দিকে ছুঁড়ে দিল। ‘যথারীতি, তোমারই ব্যাপারে। তুমিও একটা….অসহ্য।’
কাগজটা তুলে দ্রুত পড়ল। কাগজটা অনুযায়ী টিকটকম্যান ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিছু যায় আসে না, এমনিতেই ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমিও কিন্তু বিভক্তি আর প্রত্যয় কম ব্যবহার করো না।’
অ্যালিস তার সুন্দর চোখজোড়া আকাশের দিকে তুলে বলল, ‘তুমি আসলেই অসহ্য।’ হার্লেকুইন বেরিয়ে যেতেই দরজাটা পেছনে আস্তে করে একাই বন্ধ হয়ে গেল।
দরজায় টোকার শব্দ হতে বিরক্তির সাথে অ্যালিস উঠে গিয়ে দরজা খুলল। বাইরে হার্লেকুইন দাঁড়িয়ে আছে। ‘আমি সাড়ে দশটার দিকে ফিরব, ঠিক আছে?’
অ্যালিসের চেহারা বিষন্ন হয়ে গেল। ‘কেন একথা বলতে এসেছ আমাকে? কেন? তুমি জান তুমি দেরি করবে! তুমি জান! তুমি সবসময় দেরি কর। তা হলে বোকার মত কেন একথা বলতে এসেছ?’ অ্যালিস দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজার ওপাশে তখন মাথা নাড়ছে হার্লেকুইন। অ্যালিস ঠিকই বলেছে। ও অবশ্য কখনোই ভুল কিছু বলেনা। আমার দেরি হবে। সবসময়ই হয়। তা হলে বোকার মত এমন কথা ওকে কেন বলি?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে আরও একবার দেরি করার জন্য বেরিয়ে গেল হার্লেকুইন।
হার্লেকুইন রকেট আতশবাজি ছাড়ল। তাতে লেখা: ঠিক রাত আটটায় এ বছরের ১১৫তম আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংঘের সম্মেলনে আমি উপস্থিত থাকব। আশা করছি আপনারা সবাই আমার সাথে যোগ দেবেন।
লেখাগুলো আকাশে পরিষ্কার ভাবে ফুটে ছিল। কর্তৃপক্ষও ওর জন্য অপেক্ষায় ছিল। কর্তৃপক্ষের ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে ও ২০ মিনিট আগেই এসে হাজির। সবে তারা তখন ওকে ধরার জন্য মাকড়সার মত জাল লাগাচ্ছে। বুলহর্ণে বিকট শব্দ করে ও সবার পিলে চমকে দিল। ভয় পেয়ে কর্তৃপক্ষের লোকজন উল্টে নিজেরাই নিজেদের জালে আটকা পড়ল। অ্যাম্ফিথিয়েটারের মেঝে থেকে উপরে ঝুলতে ঝুলতে সবাই চেঁচামেচি করে হাত-পা ছুড়ছে। হাসতে হাসতে হার্লেকুইন বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল। এমনকি গুরুগম্ভীর সম্মেলনে আসা ডাক্তাররাও হাসতে লাগল। বারবার মাথা আর শরীর ঝুঁকিয়ে ডাক্তাররাও হার্লেকুইনের ক্ষমাপ্রার্থনা গ্রহণ করল। সময়টা সবারই খুব মজায় কাটল, তাদের ভাব দেখে মনে হল হার্লেকুইন বরাবরই এমন ভাঁড়ের পোশাক পরেই আসে। অবশ্য টিকটকম্যানের অফিস থেকে আসা লোকেদের কথা আলাদা। এরা বন্দরে থাকা কার্গোর মত ঝুলছিল।
(এবার শহরের অন্যপ্রান্তের একটা ঘটনা দেখা যাক। হার্লেকুইনের এখানকার কর্মতৎপরতার সাথে কোন সম্পর্ক না থাকলেও এতে হার্লেকুইনের মূল শক্তির জায়গাটা বোঝা যাবে। টিকটকম্যানের অফিস থেকে মার্শাল ডেলাহ্যান্টির হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার নোটিশ এসেছে। ধূসর রঙের পোশাক পরা কিছু লোক মার্শালের বৌয়ের কাছে দু:খ দু:খ মুখ করে নোটিশটা পৌঁছে দিয়েছিল। নোটিশটা খোলার আগেই মহিলা বুঝে গিয়েছিল এটা কিসের। এখন সবাই দেখলেই বুঝে ফেলে কিসের নোটিশ এসেছে। শব্দ করে শ্বাস টানল মহিলা। এমন ভাবে ধরল যেন ওতে বিষ আছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে এটা যেন ওর জন্য না এসে থাকে। মার্শের জন্য আসুক, নির্দয়ের মত ভাবল, চাইকি কোন একটা পিচ্চির জন্য আসুক, তবুও যেন এটা ওর জন্য না হয়। খুলে আবিষ্কার করল এটা মার্শের জন্য এসেছে। একই সাথে স্বস্তি আর আতংক ওকে পেয়ে বসল। কানের পাশ দিয়ে গুলিটা গেছে। ‘মার্শাল! শেষ নোটিশ, মার্শাল! ওহ ঈশ্বর! এখন কি করব মার্শাল, এখন আমরা কি করব! ওহ ঈশ্বর!’ সে রাতে ওদের বাড়িতে আতঙ্কের আবহটা পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছিল। চিমনি দিয়ে যেন উন্মাদনার গন্ধ বেরোচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না ওদের, একদম কিচ্ছু না।
(মার্শাল ডেলাহ্যান্টি অবশ্য পালানোর চেষ্টা করেছিল। পরের দিন যখন হৃদযন্ত্র বন্ধের সময় আসল, মার্শাল তখন জঙ্গলের দুশো মাইল গভীরে। টিকটকম্যানের অফিস থেকে ওর কার্ডিওপ্লেটটা মুছে ফেলা হল। দৌড়াতে দৌড়াতেই ওর হৃৎযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেল। মাটিতে পড়ে গেল মার্শাল। রক্ত আর মস্তিষ্কে পৌঁছতে না পারায় মারা গেল সে। মাস্টার টাইমকিপারের অফিসে রাখা সেক্টর ম্যাপ থেকে একটা আলো বন্ধ হয়ে গেল। একইসময়ে আবার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত জর্জেট ডেলাহ্যান্টির নাম সরকারী কোষাগারে তোলার জন্য সব তথ্য ফ্যাক্স করা হতে লাগল। এই হচ্ছে ব্যাপার। টিকটকম্যান যদি আসল নাম জানতে পারে, ঠিক এটাই ঘটবে হার্লেকুইনের ভাগ্যে। সুতরাং এটা মোটেই হাসির কোন বিষয় না। )
শপিং লেভেলে বৃহস্পতিবারের জন্য নির্ধারিত রঙের ভীড় জমে গেছে। মেয়েদের জন্য উজ্জ্বল হলুদ এবং ছেলেদের জন্য সবুজ রঙের জামা এবং বেলুনের মত প্যান্ট।
এলফের মত হাসি আঁকা মুখে বুলহর্ন সহ শপিং সেন্টারের নির্মানাধীন অংশের চূড়ায় হাজির হল হার্লেকুইন। ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে ও বলতে শুরু করল:
‘কেন তোমরা আদেশ শুনেই যাচ্ছ? পিঁপড়াদের মত তাড়াহুড়া করছ? সময় নাও! আরে একটু আয়েশ কর! সূর্যের আলো, বাতাস এগুলো উপভোগ কর। জীবনটাকে নিজের পছন্দমত চালাও। সময়ের দাস হয়ো না। টিকটকম্যানের খ্যাতা পুড়ি, একটু একটু করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভাল।’
এই পাগলটা কে? অধিকাংশ ক্রেতাই জানতে চায়, কে এই উন্মাদ। হায় হায়, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করা দরকার…
নির্মাণ শ্রমিকরা মাস্টার টাইমকিপারের কাছ থেকে জরুরি নির্দেশ পেল। ভয়ঙ্কর অপরাধী হার্লেকুইন নির্মানাধীন ভবনের উপরে আছে। তাকে ধরার জন্য শ্রমিকদের সাহায্য দরকার। কাজের শিডিউল এলোমেলো হয়ে যাবে বলে শ্রমিকেরা রাজি হচ্ছিল না। টিকটকম্যান সরকারের উপর তার প্রভাব খাটাল। শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে বুলহর্নঅলা পাগলটাকে ধরার ব্যপারে সাহায্যের নির্দেশ পেল। প্রায় জনা বারো শক্ত-পোক্ত শ্রমিক মাধ্যাকর্ষণরোধী প্লেটে চড়ে, হার্লেকুইনকে ধরার জন্য উপরের দিকে যাত্রা করল।
প্রাথমিক ব্যর্থতার পর (প্রথম চেষ্টার সময় হার্লেকুইনের সতর্কতার কারণে অবশ্য কেউ আহত হয়নি), শ্রমিকেরা আবার জড়ো হয়ে ওকে ধরতে গেল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ততক্ষণে হার্লেকুইন হাওয়া। যথারীতি লোক জমে গেল। তার ফলে কেনাকাটার সময়ের ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হল। এলোমেলো হয়ে গেল কেনাকাটার পুরো সিস্টেম। সিস্টেমের প্রয়োজনীয় কেনাকাটার সময়ও নষ্ট হল। দিনের বাকি সময়ে শিডিউল বজায় রাখার জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হল। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হল না। কেনাকাটা ত্বরান্বিত করতে গিয়ে আরও প্যাঁচ লেগে গেল। অতিরিক্ত পরিমাণ ফ্লোট-ভালভ বিক্রি হলেও যথেষ্ট পরিমাণ ওয়েগলার বিক্রি হয় না। তারমানেই হচ্ছে পপলি রেশিও একটা ধাক্কা খাবে। যেখানে স্টোর গুলোতে ৩/৪ ঘণ্টায় এক কেস করে স্ম্যাশ-ও দরকার হয়, সেখানে অনেকগুলো নষ্ট হতে থাকা কেস স্টোরগুলোতে জমতে থাকল। মালের চালান গুবলেট হয়ে গেল, এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে মাল চালাচালি ওলটপালট হয়ে গেল, এমনকি শেষপর্যন্ত সুইয্লস্কিডের কারখানায়ও এর প্রভাব পড়ল।
টিকটকম্যান গম্ভীর, শান্ত কিন্তু বিপজ্জনক সুরে বলল, ’ওকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত কারও ছুটি নেই!’
কুকুর, প্রোব, কার্ডিওপ্লেট ক্রসঅফ, টীপার, ঘুষ, স্টিকটাইটস, চাপ, ত্রাস, নির্যাতন, গুপ্তচর, পুলিশ, জোরজবরদস্তি খোঁজ, ফ্যালারন, ভাল থাকার প্রলোভন, হাতের ছাপ, বার্টিলন পদ্ধতি, ধূর্ততা, চাতুরী, বিশ্বাসঘাতকতা, রাউল মিটগং (কোন কাজে আসেনি অবশ্য), ফলিত পদার্থবিদ্যা, অপরাধবিজ্ঞান ইত্যাদি সব ওরা ব্যবহার করল।
আর কি আশ্চর্য: ওরা ওকে ধরেও ফেলল।
শেষ পর্যন্ত জানা গেল ওর নাম এভারেট সি. মার্ম। এর সম্বন্ধে বলার মত তেমন কিছু নেই। একটা লোক যার কোন সময়জ্ঞান নেই।
টিকটকম্যান বলল, ‘তোমাকে মাশুল দিতে হবে, হার্লেকুইন!’
ব্যঙ্গের হাসি হেসে হার্লেকুইন বলল, ‘মর তুই!’
‘তেষট্টি বছর, পাঁচ মাস, তিন সপ্তাহ, দুই দিন, বারো ঘণ্টা, একচল্লিশ মিনিট, ঊনষাট সেকেন্ড, দশমিক শূন্য তিন ছয় এক এক এক মাইক্রোসেকেন্ড পিছিয়ে আছ তুমি। তোমার বরাদ্দ থেকেও বেশি সময় তুমি খরচ করে ফেলেছ। তোমার হৃদযন্ত্র আমাকে বন্ধ করে দিতে হবে।’
‘আর কাউকে ভয় দেখা গিয়ে। তোর মত ভয় দেখানো লোকের সাথে এই মূর্খ দুনিয়ায় থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।’
‘এটাই আমার কাজ।’
‘বকোয়াজ। তোরা আসলে স্বৈরাচার। মানুষের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর বা দেরিতে এসেছে বলে তাকে মেরে ফেলার কোন অধিকার তোদের নেই।’
‘তুমি মানিয়ে নিতে পারছ না। তুমি এই সমাজের জন্য উপযুক্ত নও।’
‘আমাকে ছেড়ে দিয়ে দেখ আমার মুঠি তোর মুখের ভেতর মানায় কিনা।’
‘তুমি আর সবার মত আচরণ করছ না।’
‘সেটা কোন অপরাধ ছিল না।’
‘এখন হয়েছে। এই দুনিয়ায় বাস করতে শেখা উচিত ছিল তোমার।’
‘এই জঘন্য দুনিয়াটা আমার একদম পছন্দ না।’
‘সবাই তোমার মত করে ভাবে না। অধিকাংশই নিয়ম শৃঙ্খলা পছন্দ করে।’
‘আমি করি না, এবং আমার জানামতে অধিকাংশই করে না।’
‘ভুল। কি মনে হয়, আমরা তোমাকে কিভাবে ধরেছি?’
‘জানার কোন আগ্রহ নেই আমার।’
‘প্রিটি অ্যালিস নামের একটা মেয়ে আমাদের বলেছে তোমাকে কোথায় পাওয়া যাবে।’
‘মিথ্যা কথা।’
‘সত্যি কথা। তোমার আশেপাশে ও ওর সাহস বা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায় না। ও এই সমাজের একজন হতে চায়। নিয়ম মেনে চলতে চায়। তোমার হৃদযন্ত্রটা বন্ধ করেই দিতে হবে।’
‘তা হলে আমার সাথে তর্ক না করে তাড়াতাড়ি সে কাজটাই সেরে ফেল।’
‘উমমম… নাহ, তোমার হৃদযন্ত্র বন্ধ করব না আমি।’
‘তুই একটা গাধা!’
টিকটকম্যান আবারও বলল, ‘কিন্তু মাশুল তোমাকে দিতেই হবে হার্লেকুইন!’
‘মর তুই।’
এভারেট সি. মার্মকে ওরা কভেন্ট্রিতে পাঠাল। কভেন্ট্রিতে ওরা ওর মগজ ধোলাই করে দিল। “১৯৮৪” বইটাতে উইনস্টন স্মিথকে যেমন করা হয়েছিল, তেমন করেই। কিন্তু যারা করেছে, তারা জানেওনা বইটার কথা। পদ্ধতিটা অনেক পুরনো, সেটাই ওরা ব্যবহার করেছে। এবং এর অনেকদিন পর হার্লেকুইন গণযোগাযোগ মাধ্যমে হাজির হল। সেই ভাঁড়ের সাজসজ্জায়। দেখে মনেই হবে না মগজধোলাই করা কোন লোক। ও স্বীকার করল ও ভুল করেছিল। নিজেকে সমাজের একজন মনে করাটা আদপে খুবই ভাল একটা ব্যাপার। সময়মত আসব, সময়মত যাব ব্যস। পুরো এক সিটি ব্লকের সমান পাবলিক স্ক্রীনে ওকে দেখল সবাই। লোকটা আসলেই পাগল ছিল। এভাবেই যদি সব চলা উচিত, তো এভাবে চললেই হয়। সিটি হলে, বা এক্ষেত্রে টিকটকম্যানের সাথে লড়াই করলে তো আর খাওয়া জুটবে না। থোরোউ এর যে কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী এভারেট সি. মার্ম কোন কাজেই আসেনি। ওমলেট বানাতে গেলে যেমন প্রথমে কিছু ডিম নষ্ট হবেই। তেমনি যেকোন বিপ্লবে যাদের মারা যাওয়ার কথা না তাদের কিছু মারা যাবেই। অবশ্য কিছু করারও থাকে না, কারণ এটাই নিয়ম। তাতে সামান্য কোন পরিবর্তনও যদি আনা যায়, সেটাই লাভ। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে:
‘কিছু মনে করবেন না, স্যার, আপনাকে কিভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যার, আপনি স্যার তিন মিনিট লেট। শিডিউল একটু পিছিয়ে গেছে স্যার।’
অস্বস্তির একটা হাসি দিল টিকটকম্যান।
‘অসম্ভব!’ মুখোশের পেছন থেকে বিড়বিড় করে বলল টিকটকম্যান। ‘ঘড়ি ঠিক আছে কিনা দেখ।’ বলে মৃমমমম মৃমমমম করতে করতে অফিসে গিয়ে ঢুকল।
——————————————————————–
মূল গল্প – “Repent, Harlequin!” Said the Ticktockman by Harlan Ellison