বিজ্ঞান ও প্রাত্যহিক জীবন একই সূতোয় গাঁথা। —রোজালিন্ড এলসি ফ্রাঙ্কলিন। (১৯২০- ১৯৫৮)
মাঝারি উচ্চতা, ঘন কালো এলোমেলো অগোছালো চুল, তবে ফ্রাঙ্কলিনের অসাধারণ চমকপ্রদ বিস্ময়কর কালো নেশাতুর চোখ তাঁর প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। অধিকাংশ যুবক সহকর্মী প্রেমে পরতেন এই বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের। —-রেমন্ড গসলিন। (পিএইচডি’র ছাত্রাবস্থায় রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের সহযোগী ছিলেন।)
রোজালিন্ডের বিজ্ঞানযাত্রা’র গপ্পো
রোজালিন্ড এলসি ফ্রাঙ্কলিন ইংল্যান্ডের লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার বেশ স্বচ্ছল ছিলেন এবং সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিলো। ফ্রাঙ্কলিনের বাবা বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তাঁর সুদূরপ্রসারী পড়াশোনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য কলেজের শিক্ষকতা করেন। রোজালিন্ড অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী ছিলেন, মাত্র পনেরো বছর বয়সে সে ঠিক করে ফেলেন যে তিনি ভবিষ্যতে একজন বিজ্ঞানী হবেন। তাঁর বাবা এই অনুরাগের পেছনে ছুটতে সর্বদাই তাঁকে অনুৎসাহিত করতেন; কেননা উক্ত সময়কালে একজন মেয়ে হিশেবে বিজ্ঞানের শাখায় বিচরণ ও বিজ্ঞান’কে পেশা হিশেবে বেছে নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো।
যাইহোক, তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডে যে গুটিকয়েক বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিল সেন্ট পলস গার্লস স্কুল যেখানে মূলত পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যা পড়ানো হতো, সেখান থেকে তুখোড় ফলাফল কোরে পরবর্তিতে রোজালিন্ড ১৯৩৮ সালে ক্যামব্রিজের নিউনাম কলেজে রসায়নবিদ্যা পড়তে যান।
নিউনামে স্নাতক শেষ করার পর, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন একটি গবেষণার জন্য বৃত্তি পেয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তিনি এখানে রোনাল্ড জর্জ রেফোর্ড নরিশের গবেষণাগারে উল্লেখযোগ্য কোনো ধরণের সাফল্য ছাড়াই একটি বছর কাটান। ফ্রাঙ্কলিনের কাজের বেশ প্রশংসাও করেছেন নরিশ, তবে নরিশ তাঁর মেয়ে শিক্ষার্থীদের’কে শেখানোর ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন ছিলেন। যখন ব্রিটিস কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ এসোসিয়েশন (CURA) থেকে সহকারী গবেষক পদে কাজের জন্য ফ্রাঙ্কলিন ডাক পান তখন তিনি নরিশের ফেলোশীপ ছেড়ে সেখানে চলে যান।
CURA তখনই মাত্র কিছুদিন আগেই যাত্রা আরম্ভ করেছিল সুতরাং সেখানে গবেষণা কর্মের জন্য কোনো বাধাবাধ্যকতা ছিলোনা, কোনো কঠোর নিয়মকানুনও তেমন একটা ছিলোনা বললেই চলে। এমন একটি কর্মক্ষেত্রই ফ্রাঙ্কলিন খুঁজছিলেন যেখানে তিনি স্বাধীনভাবে নিজের গবেষণা চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি CURA’তেই ছিলেন এবং এই সময়ের ভেতর কয়লার ভৌত গঠনের ওপর বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন।
এরপর ফ্রাঙ্কলিন পরবর্তী বিজ্ঞান যাত্রায় প্যারিসে পৌঁছান। তাঁর এক পুরোনো বন্ধু তাঁকে মার্সেল ম্যাথিউয়ের সঙ্গে পরিচয় করান। মার্সেল তখন ফ্রান্সের অধিকাংশ গবেষণার প্রধান হিশেবে দায়িত্বে থাকতেন। মার্সেল ফ্রাঙ্কলিনের পূর্বের গবেষণার কাজে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে Laboratoire Central des Services Chimiques de l’Etat (কেমিক্যাল ল্যাব),এ গবেষক(chercheur) হিশেবে দায়িত্ব নিতে বলেন, ফ্রাঙ্কলিন সাদরে তাঁর এই বিজ্ঞানের যাত্রা পথের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক মেরিং এর সাথে কাজ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে রঞ্জন-রশ্মি বিচ্ছুরণ (X-ray diffraction) পদ্ধতি শেখেন।
১৯৫১ সালে লন্ডনের কিংস কলেজ ফ্রাঙ্কলিন’কে তিন বছরের একটি বৃত্তি প্রদান করেন গবেষণার জন্য। তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তিনি কিংস কলেজের রঞ্জন-রশ্মি কেলাসবিদ্যা (X-ray crystallography) বিভাগের শুরুর দিকের যাত্রা পথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইতিমধ্যে মরিস উইলকিন্স কিংস কলেজে রঞ্জনরশ্মি স্ফটিকবিজ্ঞানের/কেলাসবিদ্যার সাহায্যে ডিএনএ সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ফ্রাঙ্কলিন যখন কিংস কলেজে আসেন তখন উইলকিন্স কদ্দিনের জন্য বাইরে ছিলেন এবং আসার পর তিনি ভাবলেন ফ্রাঙ্কলিনকে হয়তো তাঁর সহযোগী হিশেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। উইলকিন্স তারপর থেকে কখনোই ফ্রাঙ্কলিনকে তাঁর সহকর্মী ভাবতে পারেননি এবং এভাবেই এই সম্পর্কের বৈরী সূচনা হয় আর শেষ অবধিও এমনই থেকে যায়।
রেমন্ড গসলিন নামক এক ছাত্রের সাথে যৌথভাবে গবেষণার মাধ্যমে ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ কেলাসের সূক্ষ্ম-সূত্রের (crystallized DNA fibers) দুই সেট উচ্চমানের(high-resolution) ছবি ধারণ করতে সক্ষম হোন। ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ’র দুটি আলাদা ফাইবার ব্যবহার করেন, যার মধ্যে একটি ছিল অন্যটির থেকে অধিক হাইড্রেটেড (পানি শোষক)। এর সাহায্যেই ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ’র সূক্ষ্ম তন্তুগুলোর প্রাথমিক মাপ অনুমান করেন এবং তাঁর অনুমেয় মাপটি সম্ভবত একটা হেলিক্যাল(স্ক্রু’র মতো পেঁচানো) ধর্মী গঠন ছিলো যার বাহিরের অংশে ছিল কয়েকটা ফসফেট।
তারপর ফ্রাঙ্কলিন তাঁর তথ্য উপাত্তগুলো কিংস কলেজের একটি লেকচার হলে উপস্থাপন করেন এবং সেই লেকচার হলে শ্রোতাদের ভেতর জেমস ওয়াটসনও উপস্থিত ছিলেন। এই বিষয়ে পরবর্তীতে ওয়াটসন তাঁর লিখিত বই ”ডাবল হেলিক্স”এ উল্লেখ করেন যে, সে সেই লেকচার থেকে ফ্রাঙ্কলিনের কাজের ফলাফল সম্পর্কে তেমন কিছুই পুরোপুরি ভাবে ফ্রান্সিস ক্রিককে বলতে পারেননি কেননা সে খুব ভালো কোরে মনোযোগ দেননি লেকচারের ওপর এবং কোনো কিছু লিখেও রাখেননি হলে বসে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ক্রিক এবং ওয়াটসনও ডিএনএ’র গঠন বের করার কাজ করে যাচ্ছিলেন একই সময়ে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবোরেটরিতে। রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন অবশ্য জানতেন না এই একই সময়ে ক্রিক, ওয়াটসন এবং তাঁর কলেজেই উইলকিন্স উক্ত বিষয়ের ওপর গবেষণা করছিলেন এবং মূলত কখনোই সে সত্যিকার অর্থে তাঁদের সাথে সংযুক্তও ছিলেন না এই কাজের নিমিত্তে। এদিকে দুইবার নোবেল জয়ী (১৯৫৪ ও ৬২) বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিং‘ও ডিএনএ গঠনের সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি ট্রিপল হেলিক্স মডেল দাঁড় করান, তাঁর ছেলে পিটার পাউলিং এই বিষয়ে ওয়াটসনকে খবরাখবর দিয়েছিলেন, পিটার ক্যামব্রিজের ছাত্র ছিলেন তখন। কিংস কলেজের সেই উইলকিন্সই আবার ফ্রাঙ্কলিনের তথ্যগুলো এবং ছবিগুলো ওয়াটসন ও ক্রিককে দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সুতরাং ওয়াটসন ও ক্রিকের কাছে বেশ কিছু নতুন তথ্যও ছিলো তাঁদের নিজস্ব গবেষণার বাইরেও। এই তথ্য এবং ছবিগুলো একটা থ্রি-ডি গঠন নির্দেশ করছিলো যেটা পরবর্তীতে ওয়াটসন ও ক্রিক ডিএনএ গঠনের থিওরি লেখা ও মডেল দাঁড় করানোর সময় ব্যবহার করেন।
১৯৫৩ সালেই ফ্রাঙ্কলিন দুটি গবেষণাপত্র বের করেন নেচার পত্রিকায় তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে। উইলকিন্সও একই বিষয়ের ওপর একই সালে দুটো পেপার ছাপান ন্যাচার পত্রিকাতেই। সবচে ভালো নির্দেশনা দিয়ে (ডাবল হেলিক্সের নিউক্লিক এসিড বেসগুলো জোড়ায় জোড়ায় সংযুক্ত হয়ে কী’করে ডিএনএ অনুলিপন ঘটতে সাহায্য করে এবং পাকানো মইয়ের রূপ ধারণ করে) আবারো সেই ১৯৫৩ সালেই ন্যাচার পত্রিকাতেই ওয়াটসন ও ক্রিকও রিসার্চ পেপার বের করেন। একই বছর মোট পাঁচটি গবেষণাপত্র বের হয় নেচারে, উক্ত বিষয়ের ওপর।
অতঃপর ফ্রাঙ্কলিন পূর্বের ল্যাব ছেড়ে ১৯৫৩ সালেই ব্রিকবেক ল্যাবে চলে আসেন এবং সেখানে টোবাকো মোজাইক ভাইরাসের গঠন নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। তিনি বেশ সংখ্যক পেপার বের বের করেন টোবাকো মোজাইক ভাইরাসের গঠনের ওপর। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সময়কালে সে প্রচুর গবেষণা করেন। শেষমেশ ওভারিয়ান ক্যান্সারে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯৫৮ সালে মারা যান এই অসাধারণ পরিশ্রমী গুণী বিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন।
১৯৬২ সালে ওয়াটসন, ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্সকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় ডিএনএ’র গঠন উদঘাটনের জন্যে। ডিএনএ গঠনের কাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়েই ছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, তবুও নোবেল কমিটির নিয়ম বিধির(মৃত্যু পরবর্তী নোবেল দেয়ার নিয়ম নেই।) কারণে ফ্রাঙ্কলিনকে নোবেল কমিটি থেকে এই পুরষ্কারটি দেয়া হয়নি তখন। অবশ্য তিনি সেক্সিজম ইন সায়েন্সের তথা পুরুষ প্রাধান্যের বিজ্ঞানের স্বীকার যেমনটা তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক নারী বিজ্ঞানীদের এই তোপে পড়তে হয়েছে বরাবরই।