(এটা ‘চার্লি চ্যাপলিন’ অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর’-এর একদম শেষের দৃশ্যের একটা ভাষণ। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন মূলত সাইলেন্ট মুভির অভিনেতা। তাঁর বাক-হীন অভিনয় দেখে সবাই উচ্চস্বরে কণ্ঠ ছেড়ে হাসতো। কিন্তু সেই অভিনেতা যখন হানাহানি আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে তাঁর কণ্ঠ ছেড়েছিলেন, পুরো দুনিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এটা সেই ঐতিহাসিক ভাষণের বাংলা অনুবাদ, যেটা তিনি দিয়েছিলেন সিনেমাটার একদম শেষে, পুরো মানব জাতির উদ্দেশ্যে।
****************************************************************************
আমি দুঃখিত! আমি কোনো সম্রাট হতে চাই না। ওটা আমার কাজ নয়। আমি শাসন করতে কিংবা দখল করে নিতেও চাই না কাউকে। যদি সম্ভব হয়, আমি চাই সবাইকে সহযোগিতা করতে, হোক সে ইহুদি কিংবা অন্য কেউ, কালো কিংবা সাদা। আমরা সবাই চাই আসলে একে অপরকে সহযোগিতা করতে, মানবজাতি ওভাবেই তৈরি। আমরা বাঁচতে চাই একে অপরকে আনন্দে রেখে, অন্যকে কষ্টে রেখে নয়। আমরা চাই না একে অপরকে ঘৃণা ও অপমান করতে।
এই পৃথিবীতে সকলের জন্যেই পর্যাপ্ত স্থান আছে। এই ধরণী বিপুল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ আর সবারই দেখভাল করতে সক্ষম। বেঁচে থাকাটা হতে পারে স্বাধীন এবং সুন্দর। কিন্তু আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। লোভ মানুষের আত্মাকে বিষাক্ত করে তুলেছে, পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে ঘৃণার চাদরে, আমাদেরকে টেনে নিয়ে গেছে দীনতা ও রক্তপাতের দিকে।
আমরা গতি অর্জন করেছি, কিন্তু বেঁধে ফেলেছি আমাদের মনকে। যন্ত্ররা আমাদের প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিয়েও ফেলে রেখেছে অভাবের ভেতরে।
আমাদের জ্ঞান করে তুলেছে আমাদের হতাশাবাদী। চতুরতা করে তুলেছে কঠিন এবং রূঢ়। আমরা খুব বেশী ভাবি অথচ অনুভব করি খুব কম। যন্ত্রের থেকেও বেশী প্রয়োজন আমাদের মানবতা। চতুরতার থেকেও বেশী দরকার আমাদের মমতা এবং ভদ্রতা। এই গুণগুলো ছাড়া জীবন হয়ে উঠবে হিংস্র আর হারিয়ে যাবে সবকিছু।
বিমান এবং রেডিও আমাদের সবাইকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এই আবিষ্কারগুলো চিৎকার করে বলছে মানুষের ভালোবাসার কথা, তাদের ভ্রাতৃত্ব-বোধের কথা, তাদের একতার কথা। এমনকি এই মুহূর্তেও আমার কণ্ঠ গিয়ে পৌঁছাচ্ছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। লক্ষ লক্ষ হতাশাগ্রস্ত নারী, পুরুষ আর শিশুদের কাছে, যারা এমন এক ব্যবস্থার শিকার যেখানে মানুষ আরেক নির্দোষ মানুষকে নির্যাতন ও বন্দী করে। যারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছো, তাদের বলছি, “নিরাশ হয়ো না”।
যে দুর্ভোগ আমাদের আজ পোহাতে হচ্ছে, সেটা লোভের পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা মানবজাতির উন্নতিতে ভয় পায় তাদের তিক্ত মনের কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের মনের ঘৃণা এক সময় মিলিয়ে যাবে, সেই স্বৈরশাসক মারা যাবে, আর মানুষের থেকে যে ক্ষমতা সে কেড়ে নিয়েছিলো- সেটা ফিরে যাবে সাধারণ মানুষের হাতে। ফলে যতদিন মানুষের মৃত্যু ঘটবে, ততদিন স্বাধীনতার কখনো বিনাশ ঘটবে না।
সৈনিকেরা, পশুদের হাতে তোমাদের তুলে দিও না। সেই সব মানুষদের হাতে যারা তোমাকে তাচ্ছিল্য করে, ক্রীতদাস করে, নিয়ন্ত্রণ করে তোমার জীবন; তোমাকে বলে চলে- কী করতে হবে, কী ভাবতে হবে, কী অনুভব করতে হবে; যারা তোমাকে চরিয়ে বেড়ায়, বাছ-বিচার করে খাওয়ায়, গবাদিপশুর মতো তোমাকে গণ্য করে, খরচের খাতায় থাকা জিনিসের মতো ব্যবহার করে। তোমাদের তুলে দিও না সেই সব অপ্রকৃতস্থ মানুষের হাতে। যন্ত্র মানবদের হাতে, যাদের মগজ যান্ত্রিক আর হৃদয়ও যান্ত্রিক। তোমরা যন্ত্র নও। তোমরা গবাদিপশুও নও। তোমরা মানুষ। তোমাদের হৃদয়েও আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তোমরা তো কাউকে ঘৃণা করো না। শুধু ভালোবাসা বঞ্চিতরাই ঘৃণা করে। ভালোবাসা বঞ্চিত ও অপ্রকৃতিস্থরা।
সৈনিকেরা, দাসত্বের কারণে লড়াই কোরো না। লড়াই করো স্বাধীনতার জন্যে। সেইন্ট লুকের সপ্তদশ অধ্যায়ে বলা আছে, “ঈশ্বরের সাম্রাজ্য রয়েছে মানুষেরই ভেতরে”। শুধু একটা মানুষের ভেতরে নয়, শুধু একদল মানুষের ভেতরে নয়, বরং তোমাদের সবার ভেতরে; তোমার ভেতরেও। তোমাদের মানুষদেরই আছে ক্ষমতা, যন্ত্র তৈরির ক্ষমতা, সুখ তৈরির ক্ষমতা। তোমাদেরই আছে এই জীবনটাকে মুক্ত ও সুন্দর করার ক্ষমতা, জীবনটাকে এক অসাধারণ অভিযান বানানোর ক্ষমতা। তাহলে চলো গণতন্ত্রের খাতিরেই আমরা সেই ক্ষমতাটাকে ব্যবহার করি। চলো আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই!
এসো আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়তে লড়াই করি, এক সুন্দর পৃথিবী যা মানুষকে দেবে কর্মের সুযোগ, শিশুদের দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর বয়স্কদের দেবে নিরাপত্তা। এসব দেবার ওয়াদা করেই পশুরা উঠেছিলো ক্ষমতার শিখরে। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেছিলো। তারা কখনোই সেই ওয়াদা পূর্ণ করেনি, কখনো করবেও না। স্বৈরাচারেরা মুক্ত করেছে শুধু নিজেদেরকেই, আর ক্রীতদাস বানিয়েছে জনগণকে। এখন এসো আমরা একত্রে লড়াই করি সেই ওয়াদা পূরণে। এসো একসাথে লড়াই করি পৃথিবীটাকে মুক্ত করতে; সমস্ত জাতীয় সীমানার, সমস্ত লোভের, সমস্ত ঘৃণার এবং অসহনশীলতার ইতি টানতে। এসো একসাথে লড়াই করি একই লক্ষ্যের পৃথিবী গড়তে, এমন এক পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান ও উন্নয়ন মানুষকে নিয়ে যাবে সুখী জীবনের দিকে।
সৈনিকেরা! গণতন্ত্রের নামে এসো: আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হই!
(সমাপ্ত)
মন্তব্য “বেশী” নয় “বেশি” হবে।
এই চিন্তাগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক
Charlie the great – a humanist-anti imperialist-A communist too.