Translation of The Cab Ride I’ll Never Forget by Kent Nerburn
অনুবাদ – শাহরিয়ার আরিফ, ফরহাদ হোসেন মাসুম
বিশ বছর আগে এমন একটা সময় এসেছিলো আমার জীবনে, যখন জীবিকার জন্য আমাকে ট্যাক্সি চালাতে হতো। জীবনটা খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো – জুয়াড়ির মত, অবিরাম ছুটে চলা পালহীন নৌকার মত। পাশার গুটির মত নতুন নতুন যাত্রীর মুখ- জীবনটা কে ভীষণ রোমাঞ্চকর করে তুলেছিলো।
কিন্তু কাজটা যে যাজকীয় কিছু একটা হয়ে উঠবে – পেশা হিসেবে নেয়ার আগে তা কখনোই ভাবিনি। আমি রাতের শিফটে চালাতাম। প্রতি রাতে আমার ক্যাবটি যেন গীর্জার এক কোণার ছোট্টো সেই কনফেশন রুমটাতে রুপান্তরিত হতো! যাত্রীরা হামাগুড়ি দিয়ে উঠতো, পেছনের সিটের অন্ধকারে নিজেকে সঁপে দিতো, আর আমাকে শোনাতো তাদের জীবনের কাহিনী!
আমি আর আমার যাত্রীরা ছিলাম রাতের ট্রেনে মুখোমুখি বসা আগন্তুকের মত, যেন কোনোমতে রাতটা কাটানোর চেষ্টা করছি। রাতের আঁধারে একে অন্যকে এমন সব গোপন কথা বলে ফেলতাম, দিনের আলোয় যেগুলো হয়তো কখনো লজ্জার বাধা পেরুতে পারতোনা। এমন অনেক লোকের সান্নিধ্যে এসেছি, যাদের জীবন কখনো আমাকে ভীষণ অবাক করেছে, কখনও ধন্য করেছে, হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে। কিন্তু কেউ অতটা ছুঁয়ে যেতে পারেনি, যতটা পেরেছে অগাস্টের কোনো এক উষ্ণ মধ্যরাতের সেই মহিলাটি।
কল টি এসেছিলো শহরের অপেক্ষাকৃত নির্জন প্রান্তের একটা চারতলা ইটের দালান থেকে। ভাবলাম, হয়তো কেউ পার্টি শেষে ঘরে ফিরতে চাইছে, অথবা এমন কেউ যে প্রিয়জনের সাথে এইমাত্র ঝগড়া করেছে, কিংবা কেউ হয়তো কোনো এক কারখানায় ভোরের শিফট ধরার জন্য শহরের শিল্প এলাকায় যেতে চাচ্ছে!
নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম, পুরো বাড়ি অন্ধকার। শুধু নিচ-তলার একটা জানালায় খানিক আলোর ছটা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্য যে কোনো ক্যাব চালক দু’এক বার হর্ণ বাজিয়ে কিংবা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেই চলে যেত। রাত ২.৩০ টায়, আলোহীন রহস্যময় বিল্ডিং-এ যাত্রী নিতে যাওয়া চালকের জন্য কতরকম খারাপ সম্ভবনাই তো ওঁত পেতে থাকতে পারে!
কিন্তু এই শহরে অভাব জিনিসটা, অনেককেই এমন পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে যে, তাদের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে এই ট্যাক্সিগুলো। খুব একটা বিপদের ঝুঁকি না থাকলে, আমি সবসময় যাত্রীদের দরজায় গিয়ে টোকা দিতাম। নিজেকে যুক্তি দিতাম, হয়তো আমার সাহায্য দরকার হতে পারে ওদের। আমার বাবা মা যদি একটা ক্যাব ডাকতেন, আমিও তো একজন ড্রাইভার থেকে ঠিক তেমনটাই আশা করতাম!
সে রাতেও, গাড়িটা পার্ক করে দরজায় গিয়ে নক করলাম। ভেতর থেকে একটা দুর্বল আর বয়স্ক নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো “এক মিনিট”। মেঝেতে ভারী কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর, দরজা ঠেলে একজন আশির ঘরের বয়েসের ছোটখাটো মহিলা এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। প্রিন্টের জামা আর পাতলা মুখাবরণ বিশিষ্ট পিলবক্স হ্যাটে তাঁকে একেবারে চল্লিশ-দশকের মুভির কোনো এক চরিত্র বলে মনে হচ্ছিলো। পায়ের কাছে নাইলনের ছোট্ট একটা স্যুটকেস। বুঝলাম, এটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দই পেয়েছিলাম আমি।
ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে মনে হলো, অনেকদিন ধরেই এটা খালি পড়ে ছিলো। সব আসবাবপত্র চাদর দিয়ে ঢাকা। ঘরের দেয়ালে কোনো ঘড়ি নেই, এদিক ওদিক নেই কোনো ছোটখাট সাজসরঞ্জাম, টেবিলেও নেই কোনো বাসনকোসন! শুধু এক কোণায় একটা বাক্স-ভর্তি কিছু ছবি আর কাঁচের পাত্র।
“আমার ব্যাগটা গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে, প্লিজ?” ঘোর ভাঙ্গলো বৃদ্ধার কথায়। “ততক্ষণ এখানে একটু একা থাকি। এরপর তুমি এসে আমাকে নিয়ে যেও, কেমন? খুব একটা শক্তি নেই আমার শরীরে”।
আমি স্যুটকেসটা গাড়িতে রেখে বৃদ্ধাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসলাম। তিনি আমার হাত ধরে, ধীর গতিতে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমাকে ধন্যবাদ দিতে থাকলেন কথায় কথায়।
বললাম “ও কিছু না। আমার মা থাকলে যেমন করতাম, যাত্রীদের সাথেও তেমনই করার চেষ্টা করি সবসময়”।
“তুমি অনেক ভালো ছেলে, বাবা”, ওনার কথা শুনে একটু লজ্জাই পেলাম।
গাড়িতে ওঠার পর, তিনি আমার হাতে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ দিয়ে বললেন, “আমাকে কি শহরের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?”
আমি জানালাম “অনেক ঘুরপথ হয়ে যাবে!”
“হোক! আমার তাড়া নেই তেমন। নিরাময় কেন্দ্রে যাচ্ছি আমি”।
রিয়ার ভিউ মিরর এ তাকালাম। অদ্ভুত আলোয় ওনার চোখ দুটো জ্বলছিলো। মৃদু কন্ঠে বললেন, “জানো, আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। ডাক্তার বলেছেন, আমার সেখানেই থাকা উচিত এখন। আমিও নাকি আর বেশিদিন বাঁচবো না”।
আমি আস্তে করে হাত বাড়িয়ে মিটার বন্ধ করে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কোন পথে যেতে চান বলুন”।
পরের দু’ঘন্টা আমরা পুরো শহর চষে বেড়ালাম। তিনি আমাকে একটি বিল্ডিং দেখিয়ে বললেন, এখানে তিনি এলেভেটর অপারেটর হিসেবে চাকরী করতেন একসময়। তিনি এবং তার স্বামী বিয়ের পর প্রথম যেই এলাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন, সেখানেও গেলাম আমরা। একটা ফার্নিচার গুদামের সামনে গাড়িটা থামাতে বললেন তিনি। এটি নাকি একসময় নাচের বলরুম ছিলো – একটা সময় নাকি খুব নেচেছেন এখানে!
মাঝে মাঝে তিনি আমাকে কয়েকটা ভবন কিংবা বিশেষ কিছু জায়গায় আস্তে আস্তে চালাতে বলেছিলেন। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে অন্ধকারে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে ছিলেন, কিচ্ছু না বলে, একদম নীরবে!
সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন দিগন্তের গায়ে তুলির মৃদু আঁচড় দিতে শুরু করেছে, তখন তিনি হঠাৎ বললেন, “হয়েছে! ক্লান্ত হয়ে গেছি। চলো, গন্তব্যের দিকে যাই”।
একেবারে নিঃশব্দে কাটলো বাকিটা পথ। একসময় তাঁর দেয়া ঠিকানায় এসে পৌঁছুলাম। ছোট একটা বাড়ি। বাইরে থেকে দেখতেই আশ্রম মনে হয়। বাড়ির গাড়িবারান্দা একেবারে শান-বাঁধানো দহলিজে গিয়ে মিশেছে। গাড়ি থামাতেই দুজন পরিচারক এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের উদগ্রীব আর একাগ্র চিত্তে বৃদ্ধার প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ্য করাই বলে দিচ্ছিলো, ওনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো তারা। বোধহয় আসার আগে ওদেরকে ফোনে জানিয়েছিলেন উনি।
আমি গাড়ির ট্রাংক খুলে ছোট্ট স্যুটকেসটা দরজার সামনে দিয়ে আসলাম। ততক্ষণে বৃদ্ধা একটা হুইলচেয়ারে বসে গেছেন।
পার্স খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, “কত হল তোমার?”
আমি বললাম, “লাগবে না”।
“কিন্তু তোমার তো চলতে হবে, তাইনা?”
“যাত্রী তো আছে আরো” আমি জবাব দিলাম।
হঠাৎ কিছু না ভেবেই, কেন যেন সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে বৃদ্ধাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম আমি! তিনিও তার দুর্বল হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। অনেক্ষণ। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “তুমি এই আধমরা বুড়িটাকে চমৎকার কিছু সময় উপহার দিয়েছো আজ। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, বাবা”
আমি শেষবারের মত তাঁর হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে, ভোরের আবছা আলো-আঁধারিতে, রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে দরজা বন্ধের শব্দ ভেসে এলো। যেন একটা জীবনেরই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো…… চিরতরে!
আমি সেই শিফটে আর কোনো যাত্রী নেইনি। অনেক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে এলোমেলো ঘুরলাম। ভীষণ অবসাদে মনটা এতটাই ছেয়ে গিয়েছিলো যে সারাদিন কারো সাথে কথাই বলতে পারিনি। ভাবতে লাগলাম, কী হোতো যদি ঐ বৃদ্ধা এমন একজন বদমেজাজী কিংবা অধৈর্য্য ড্রাইভারের পাল্লায় পড়তেন যে কোনোমতে তার শিফট শেষ করতে পারলেই বাঁচে! কী হতো, যদি সে এটাকে উটকো ঝামেলা মনে করতো? কী হতো, যদি আমি এতটা সময় দিতে রাজী না হতাম? অথবা একবার হর্ণ বাজিয়েই চলে আসতাম! কী হোতো যদি আমার মন মেজাজ ভালো না থাকতো? আর বৃদ্ধার সাথে কথাই না বলতাম? এমন কত কত মুহূর্ত হয়তো মিস করেছি আমার জীবনে! এমন কত মুহূর্ত হয়তো বোঝার আগেই আমাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে।
আমরা ধরেই নিই যে আমাদের জীবন প্রতিনিয়ত অসাধারণ কিছু মুহূর্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কিন্তু জীবনের সত্যিকারের অসাধারণ মুহূর্তগুলো হয়তো, মনের অজান্তেই, খুব সাধারণ কিন্তু মোহনীয় বেশে লুকিয়ে হঠাৎ এসে হাজির হয়! যখন সেই বৃদ্ধা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন যে আমি তাকে চমৎকার কিছু সময় উপহার দিয়েছি – আমার মনে হয়েছিলো, হয়তো আমার জন্মই হয়েছে তাঁকে শেষবারের মত গাড়িতে চড়িয়ে শহর দেখানোর জন্য। তবে এত কিছুর মাঝেও যে কথাটা আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো- আমার জীবনে এর চেয়ে মূল্যবান কোনো কাজ বোধহয় আমি কখনো করিনি!
Original story by Kent Nerburn –
Shamanno shomoi khorocher upojog je eto bishal & darun hobe vabte parini! Oshonkho Dhonnobaad.
মানবিকতাবোধ নিয়ে লেখা। ভালই লেগেছে।
গল্পটি চমৎকার। লেখকের আত্মবিশ্বাস এটিকে সবলীলভাবে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু অনুবাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, শেষ প্যারাতে এই (মূহুর্ত্বকে) বানানটি ভুল ।
ঠিক করে দেয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।