দ্য ডেথ ডিস্ক- মার্ক টোয়েইন

কর্নেল ম্যাফেয়ার যৌথ বাহিনীতে তার র‍্যাঙ্কের সবচেয়ে কমবয়সী অফিসার। বয়স মাত্র ত্রিশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি একজন সুদক্ষ সৈনিক। কারণ তিনি তার মিলিটারি জীবন শুরু করেছিলেন সতেরো বছর বয়সে। বহু যুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। সেসব যুদ্ধের ময়দানে শৌর্য, সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে, ধাপে ধাপে তিনি অর্জন করেছেন প্রশাসনের মানুষদের মাঝে উঁচু স্থান। কিন্তু এখন তিনি বিশাল এক সমস্যার মাঝে পড়ে গিয়েছেন। তার ভাগ্যাকাশে দেখা গিয়েছে কালো মেঘের আনাগোনা।

‘তোমার চোখের জল মুছে ফেল। অন্তত অ্যাবির জন্য আমাদের হাসিখুশি থাকতে হবে।’

কোঁকড়া চুলের, ছোটখাট গড়নের একজনকে রাতের পোশাকে দেখা গেল ধীরে ধীরে দরজার কাছে আসতে। তারপর একছুটে সে তার বাবার কাছে চলে গেল। তার বাবা তাকে ব্যাকুলভাবে একবার, দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারের মত চুমো দিল।

‘কি করছ, বাবা, তোমার আমাকে এভাবে চুমো খাওয়া উচিত নয়। তুমি দেখি আমার চুল আউলে দিবে।’
‘ওহ, ভুল হয়ে গেছে। আমাকে কি করতে হবে অ্যাবির জন্য যেন সে আমাকে ক্ষমা করে দেয়?’
‘আহ… আমাকে একটা গল্প বল: ভয়ঙ্কর একটা গল্প। নার্সের কাছে শুনেছি মানুষের নাকি সবসময় ভাল সময় থাকে না। সত্যিই কি তাই, বাবা? সে এটাই বলেছিল।’

‘এটা  … সত্য সোনা। সমস্যা প্রত্যেকের জীবনেই আসে।’

‘তাহলে আমাকে এটা নিয়েই গল্প বল বাবা। আমাদের কাছে বল, যেন আমরা ভয়ে শিহরিত হই, কেঁপে উঠি। মা, আমার হাত ধরো, আমাকে ঝড়িয়ে ধরো, গল্প শুনে যদি ভয় পাই।’

‘ঠিক আছে, বলছি…. একদা সেখানে ছিল তিনজন কর্নেল এবং…’

‘ঠিক তোমার মতো বাবা? ওহ, আমি জানি গল্পটা আমার খুবই ভাল লাগবে!’

‘হ্যাঁ, অ্যাবি, ঠিক আমার মতো। আর তারা যুদ্ধের ময়দানে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অপরাধ করেছিল।’

‘এটা কি … ভঙ্গ  … এটা কি খাবার কোন জিনিস?’

‘না সোনা, এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জিনিস। তারা তাদের প্রতি দেওয়া আদেশ ঠিক মত পালন করেনি। কথা ছিল, তারা একটি আক্রমণের ভান করবে, যেন যৌথ বাহিনী এ সময় পিছু হটতে পারে। কিন্তু তা না করে, তারা সত্যি সত্যিই আক্রমণ করে বসে এবং হারিয়ে দেয় শত্রুদের। এ ব্যাপারটা লর্ড জেনারেলকে খুবই হতাশ করে। লর্ড ক্রমওয়েল তাদের বিচারের জন্য লন্ডনে নিয়ে যেতে আদেশ করেন। দোষ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’

‘মহান জেনারেল ক্রমওয়েল, বাবা? আমি তাঁকে দেখেছি — আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সে তার বিশাল সাদা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল, সে তখন আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল! আমি তাকে মোটেও ভয় পাই না!’

‘লর্ড জেনারেল কর্নেলদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাবার অনুমতি দিয়েছিল। যেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে তারা পরিবারের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে পারে।’

‘বাবা, গল্পটা কি সত্যি?’

‘হ্যাঁ সোনা, …এটা…’

‘বাহ, ভাল! কিন্তু মা তোমার এভাবে কাঁদা উচিত নয়। দেখে নিও, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বাবা, গল্পটা বলতে থাকো।’

‘প্রথমে তারা বিচারের জন্য তাদের তিনজনকে টাওয়ারে নিয়ে গেল। মিলিটারি কোর্ট তাদের দোষী পায় এবং গুলি করে মারার শাস্তি দেয়।’

‘হত্যা বাবা? কি ভয়ংকর! তারা কি আমাকে তাদের বিদায় জানাতে দিবে?’

‘তুমি তাদের একজনকে পারবে, সোনা…’

‘আমি জানি, তারা যা করেছে, তুমি হলেও তাই করতে। তাই এটা ভুল হতে পারে না!’
‘হ্যাঁ সোনা। সত্যি বলতে, কোর্ট মনে করেছিল তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছিল। তাই তাদের ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু লর্ড ক্রমওয়েল রাজী হলেন না। পরে চাপাচাপি করায় তিনি তিনজনকে নিজেদের মধ্যে একজনকে মৃত্যুর জন্য বেছে নিতে বললেন। কিন্তু তারা রাজী হলেন না, কারণ তারা ভাল করেই জানতেন এটা আত্মহত্যার সামিল, যা মহাপাপ। এর ফলে তিনজনই মৃত্যুর মুখোমুখি হলেন।’

জানালার বাইরে  হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। মা-বাবা দুজনেই চমকে উঠে বসলেন।

সামনের দরজায় কেউ সজোরে করাঘাত করলো। ‘দরজা খুলুন! লর্ড জেনারেলের নামে দরজা খুলুন।’

‘সৈন্য! ওহ, তাদের আমার খুব ভাল লাগে! আমি তাদের ভিতরে নিয়ে আসছি!’
সৈন্যবাহিনী মার্চ করে সোজা ভিতরে আসলো, তারপর কর্নেলকে অভিবাদন জানালো। কর্নেল মা-মেয়ে দু’জনকেই গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন, আর তারপরই আদেশ আসলো,’টাওয়ারের দিকে এগিয়ে চলুন!’

পরদিন সকালের কথা, অ্যাবির মা তখনো বিছানাতেই ছিলেন, শোকে বিহ্বল তিনি। একটু পরেই অ্যাবিকে শীতের পোশাক পরিয়ে বাইরে খেলতে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

অন্যদিকে টাওয়ারে লর্ড জেনারেল তখনো হিমশিম খাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলেন না কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

‘আরেকবার ভেবে দেখবার জন্য তাদের আমরা বারবার বলেছি। আমরা তাদের অনুনয় করেছি, কিন্তু টলাতে পারিনি! তারা কিছুতেই নিজেদের মধ্যে লটারি করবে না!’

‘তাদের সবাই মারা যেতে পারে না! তাহলে তাদের জন্য লটারিটা অন্য কেউ করবে! যাও, টাওয়ারের সামনে দিয়ে প্রথম যে শিশুটি যাবে তাকে নিয়ে এসো।’

বলতে গেলে অফিসারটিকে টাওয়ারের দরজা থেকে বেরও হতে হলো না, সাথে সাথেই সে অ্যাবিকে তার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসলো। লর্ড জেনারেল, দুর্ধর্ষ ব্যক্তিক্তের অধিকারী এই লোকটির নাম শুনলে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান, পরাশক্তিরা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। সেই লোকটিকে দেখামাত্র অ্যাবি গিয়ে তার কোলে চড়ে বসলো, তারপর তার দিকে তাকিয়ে হাসলো!

‘আমি তোমাকে চিনি। তুমি লর্ড জেনারেল। আমি তোমাকে আগেও দেখেছি। সব্বাই তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু আমি পাইনি… কারণ তুমি দিকে তাকিয়ে হেসেছিলে। তোমার মনে আছে, তাই না? আমি আমার লাল ফ্রকটা পরেছিলাম আর…’

‘আমার ছোট্ট সোনা, আমার বলতে লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু তুমি জানো তো…’

‘আমি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, … মানে আমার বাসা, আর… তোমার কি কিছুই মনে নেই? যাই হোক — আমি তোমাকে ঠিকই মনে রেখেছি!’

‘এবার আমি সত্যিই লজ্জিত। এখন আর আমি তোমাকে কখনো ভুলব না সোনা। তুমি আমাকে আমার নিজের মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছ।’

‘তুমি কি তাকে খুব ভালবাসতে?’

‘হ্যাঁ, সোনামণি। তার অনুরোধ আমার জন্য ছিল আদেশ। এখন তোমার ক্ষেত্রেও তাই হবে। তুমি যা বলবে আমি তা মানবো!’

অ্যাবি খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল।

‘সৈন্য! আমি সৈন্যদের ডাকছি! … হুম, অ্যাবি তাদের দেখতে চায়!’
‘তুমি তাদের অবশ্যই দেখতে পাবে সোনা। তবে আগে তোমার জন্য একটা কাজ আছে।’

অ্যাবির হাতে তিনটি ছোট ডিস্ক তুলে দিলেন জাতির প্রধান, প্রত্যেকটিই মোম দিয়ে সিল করা। এর মধ্যে দু’টি সাদা। আর একটি উজ্জ্বল লাল, যে কর্নেল এটা পাবে তার জন্য এটা মৃত্যুর দূত।

‘ওহ, লালটা কি সুন্দর! এগুলো কি আমার জন্য?’

‘না সোনা, এগুলো অন্যদের জন্য। অফিসার, পর্দাটা ওঠাও। ওই যে ওখানে তিনজন লোক দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি তাদের দেখতে পাচ্ছ? তাদের প্রত্যেকে একটা করে ডিস্ক পাবে তোমার কাছ থেকে।’

অ্যাবি সতর্কতার সাথে বন্দীদের দিকে এগিয়ে গেলো। এরপর তার মুখ উচ্ছাসে ভরে উঠলো।

‘এদের একজন তো আমার বাবা! সবচেয়ে সুন্দরটা তারই পাওয়া উচিৎ!’
সে উল্লাসের সাথে সামনে এগিয়ে গেলো এবং তাদের খালি হাতে ডিস্কগুলো দিয়ে দিল। তারপর সে কাছ থেকে তার বাবার হাত দেখলো এবং হাসিমুখে তার দিকে তাকালো।

‘দেখো বাবা, তুমি কি পেয়েছ! আমি তোমাকে এটা দিয়েছি!’
কর্নেল তার মৃত্যুদূতরুপী উপহারটির দিকে এক ঝলক তাকালো। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে তার নিষ্পাপ, ছোট্ট মৃত্যুদণ্ডদানকারীকে জড়িয়ে ধরল —- সৈন্যরা, অফিসাররা, এমনকি লর্ড জেনারেল পর্যন্ত জায়গায় জমে গেলেন। তাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হল, চোখ জলে ভরে উঠলো, আর তারা সেই জল নির্লজ্জের মত মুছেও ফেললেন। অবশেষে কোর্টের অফিসার এই নীরবতা ভঙ্গ করলেন।

‘এটা করতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমাকে আমার দায়িত্ববোধ যা আদেশ করছে তা করতেই হবে।’

‘কি আদেশ করছে?’
‘আমাকে … আমাকে অবশ্যই … তাকে নিয়ে যেতে হবে, মা।’

‘তাকে নিয়ে যাবে? না … তাকে আমার মা’র প্রয়োজন। আমি আমার বাবাকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি!’

অ্যাবি তার বাবার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে লর্ড জেনারেলের দিকে দৌড়ে গেল।

‘তাদের আটকাও! আমার মা অসুস্থ আর বাবাকে মা’র প্রয়োজন। আমি ঐ সৈন্যকে এই কথা বলেছি, কিন্তু সে শুনছে না। ———- আমি তোমাকে আদেশ করছি! তুমি আমাকে বলেছিলে আমি যা বলব তুমি তা অবশ্যই করবে!’
‘আহ, ঈশ্বর আমাকে সহায়তা করুন!’
তার প্রবীণ, অমসৃণ মুখে স্নেহের আভা দেখা গেল, সে তার পিচ্চি জ্বালাতনকারীটার মাথায় হাত রাখলেন।

‘হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার না বুঝে করা প্রতিশ্রুতির জন্য দুর্ঘটনাটা হলো না! অফিসার, তার আদেশ পালন করো! সে আমার প্রতিনিধিত্ব করছে! বন্দীদের … ক্ষমা করা হলো!’

মূল গল্প-
The Death Disk, লেখক- Mark Twain
লিঙ্ক- The Death Disk.

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *