কে তোমার প্রকৃত বন্ধুঃ ওশো রজনীশ

“প্রিয় ওশো আমার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনে সবসয় উদয় হয়, কে আমার ভাল বন্ধু?’ আপনি কি এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলবেন?”

তুমি আসলে ভুল জায়গা থেকে প্রশ্ন করেছো। কখনো নিজেকে জিজ্ঞেস কোরো না কে তোমার প্রকৃত বন্ধু? জিজ্ঞেস করো আমি কি কারো প্রকৃত বন্ধু হতে পেরেছি? এটাই হবে যথার্থ প্রশ্ন। কেন তুমি অন্যকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে- কেউ তোমার ভাল বন্ধু হোক আর নাই হোক।

প্রবাদ বাক্য আছে- সুসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবে এতে লালসা আছে। এটা বন্ধুত্ব নয়, ভালবাসাও নয়। তুমি নিজের উদ্দেশ্যে অন্যকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছো। কোনো মানুষই অপরের উদ্দেশ্যের জন্য নয়। প্রতিটি মানুষ তার নিজের জন্যই। কেন তুমি এতটা উদ্বিগ্ন হও যে কে তোমার ভাল বন্ধু।

নববিবাহিত এক দম্পতি ফ্লোরিডার দক্ষিণাঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে একটি বিষাক্ত র‍্যাটল স্ন্যাকের খামারের দেখা পেয়েছিলো। চারপাশ ঘুরে তারা খামারের মালিকের সাথে এক আলাপচারিতায় মগ্ন হলো।

নববিবাহিত তরুণীটিই জিজ্ঞেস করলো, আপনি একটা মারাত্মক পেশা বেছে নিয়েছেন। আপনাকে কি কখনো সাপে কাটেনি?’
খামারের মালিক বললো, ‘হ্যাঁ, কেটেছে। বেশ কয়েকবার সাপে কেটেছে। ‘
তরুণীটি আরো জোর দিয়ে বললো, ‘সাপে কাটলে কী করেন?’

‘আমি সবসময় একটা ধারালো ছুরি আমার কাছে রাখি। যখনি আমাকে সাপে কাটে ধারালো ছুরি দিয়ে সেই অংশটা কেটে বিষাক্ত রক্তটা বের করে নেই।’
‘কী? আচ্ছা যদি কখনো দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি সাপের খাঁচায় পড়ে যান তাহলে কী করবেন?’ তরুণীটি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
লোকটি বললো, তাহলে সেদিন আমি বুঝতে পারবো কে আমার ভাল বন্ধু।

—————-

কেন তুমি উদ্বিগ্ন হবে?
যথার্থ প্রশ্ন হচ্ছেঃ আমি কি কারো প্রকৃত বন্ধু হতে পারি? তুমি কী জানো বন্ধুত্ব কী? এটা হচ্ছে ভালবাসার সর্বোচ্চ রূপ। ভালবাসায় একটা উদ্দেশ্য থাকে, কিন্তু বন্ধুত্বে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়।

বন্ধুত্বে কোনো দেনা-পাওনা অবশিষ্ট থাকেনা। এটা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। বন্ধুত্ব মানে অন্যকে নিজের উদ্দেশ্য ব্যবহার করা নয়। এটা অন্যকে নিজের প্রয়োজন ব্যবহার করাও নয়। এটা কোনো কিছু ভাগ করে নেওয়ার প্রশ্ন। তোমার অনেক কিছুই আছে কিন্তু তোমার ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। তোমার গান, তোমার কৃতজ্ঞতা, তোমার ভাল লাগা, মন্দ লাগা। তাকে গুরুত্ব দেওয়া। এটা নয় যে সে তোমাকে কতটা গুরুত্ব দিলো সেই হিসেব করা। একজন বন্ধু সবমুহূর্তেই তার বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।

জানো, ভালবাসায় একধরনের লালসা আছে! তুমি জানলে বিস্মিত হবে সংস্কৃত শব্দ লোভ থেকেই ইংরেজী ‘love’ শব্দের উৎপত্তি। কিভাবে লোভ থেকে ‘love’ হলো এটা একটা ভয়ানক গল্প। সংস্কৃতে লোভ মানে লালসা। আর ‘love’ লালসা ছাড়া কিছুই নয়। ভালবাসার গভীরে লালসাই বিরাজ করে।

অন্যকে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে বন্ধুত্ব করা একটি ভুল পথে পা বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। বন্ধুত্ব পারস্পরিকতার বিষয়। তোমার যা কিছু আছে তা অপরকে জানানো। আর যে জানতে প্রস্তুত সেই তোমার বন্ধু। এখানে প্রয়োজনের কোনো প্রশ্ন উঠবেনা। এটা এমন কোনো প্রশ্নের বিষয় নয় যে তুমি বিপদে পড়বে আর তোমার বন্ধু এসে তোমাকে সাহায্য করবে। এটা চিন্তা করা অপ্রাসঙ্গিক। সে আসতেও পারে নাও আসতে পারে। যদি সে নাও আসে তাতে তোমার অনুযোগ থাকার কথা নয়। তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনা। যদি সে আসে তুমি কৃতজ্ঞ। যদি সে না আসে তাহলেও পুরোপুরি সঠিকভাবে বিষয়টিকে মেনে নাও। কেননা এটা তার সিদ্ধান্ত সে আসবে কি আসবে না। তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনা। তোমার কোনো ক্ষোভ থাকারও কথা নয়। তোমার তাকে এটা বলাও উচিত নয় যে- ‘যখন আমি বিপদে ছিলাম, তুমি আমাকে সাহায্য করোনি।’

বন্ধুত্ব কোনো বাজারি বিষয় নয়। বন্ধুত্ব এমন একটা বস্তু যা মন্দিরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, বাজারের সাথে নয়। কিন্তু তুমি এ ধরনের বন্ধুত্বের প্রতি মনযোগী নও। তোমাকে তা শিখতে হবে।

বন্ধুত্ব একটি মহৎ শিল্প। ভালবাসার ভিতর একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি আছে। বন্ধুত্বের মধ্যে তা নেই। বন্ধুত্ব সচেতনতার বিষয়। ভালবাসা সচেতনার বিষয় নয়। তুমি একজন নারীর প্রেমে পড়লে। কেন আমরা বলি মানুষ প্রেমে পড়ে? এই বাক্যটা লক্ষণীয় ‘প্রেমে পড়া’ এমন নয় যে তোমার মধ্যে প্রেম ছিলো না। কেউ প্রেমে পড়ে বলে না যে আমার প্রেম বেড়েছে। সবাই প্রেমে পড়ে। কেননা এটা সচেতনতা থেকে অবচেতনায় যাওয়া। বুদ্ধিমত্তা থেকে প্রবৃত্তিতে গিয়ে পড়া।

ভালবাসায় মানবিকতার চেয়ে পশুত্বই বেশি। বন্ধুত্ব পুরোপুরি মানবিক। বন্ধুত্বের জন্য জৈবিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। এটা সম্পূর্ণ অজৈবিক। তাই কেউ বন্ধুত্বে পড়ে না। বন্ধুত্ব বাড়ে। এর একটা আত্মিক মাত্রা আছে।

কিন্তু কখনোই জিজ্ঞেস কোরো না কে তোমার প্রকৃত বন্ধু? জিজ্ঞেস করো, আমি কি কারো প্রকৃত্ব বন্ধু হয়েছি? সবসময় তোমার নিজেকে নিয়ে বিবেচনা করো। আমরা সবসময় অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত। পুরুষ জিজ্ঞেস করে নারীটি তাকে ভালবাসে কি বাসে না। নারীও ভাবে পুরুষটি তাকে সত্যি ভালবাসে কি না। তুমি কিভাবে অন্যকে নিয়ে নিশ্চিত হবে? সেটা তো সম্ভব নয়। সে হয়তো হাজারবার বলবে যে সে তোমাকে ভালবাসে, চিরদিনের জন্য তোমাকে ভালবাসে, তবুও একটা সন্দেহ থেকে যায়। কে জানে সে সত্য বললো কি মিথ্যা! যদিও কোনো কিছুকে বার বার বললে আমরা ধরে নিই তা মিথ্যা। কেননা সত্যকে বার বার বলতে হয় না।

হিটলার তার জীবনী গ্রন্থে বলেছে, ‘সত্য আর মিথ্যের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে মিথ্যেকে বার বার উচ্চারিত করলেই তা সত্য হয়ে যায় যেনো তুমি ভুল যাও তা মিথ্যে’ তাই বিশেষজ্ঞরা বলে, বার বার বলো, এটা না ভেবেই যে, কে শুনলো আর কে শুনলো না।

শুরুতে কোকাকোলার বিজ্ঞাপনের জন্য বিলবোর্ডে একটি স্থির আলো ব্যবহৃত হতো। কোকাকোলা শব্দটিতে আলো জ্বলতো। পরবর্তীতে তারা খেয়াল করলো যদি আলোটা জ্বলে আর নিভে উঠে তাহলে তা আরো বেশি প্রভাব ফেলবে মানুষের মধ্যে। এবং আগে হোক আর পড়ে তা দর্শনকারীর মধ্যে একটা প্রভাব ফেলবে। আর এই পদ্ধতিটাই অবলম্বন করে সকল ধর্ম টিকে আছে। তারা একই মূঢ় বিশ্বাসকে পুনরাবৃত্তি করে চলছে। আর এই বিশ্বাস-ই মানুষের কাছে সত্য হয়ে উঠেছে। মানুষ তার জন্য মরতে প্রস্তুত হয়ে উঠে। কেউ এখনো জানে না স্বর্গ কোথায়। অথচ স্বর্গে যাওয়ার জন্য মরতে প্রস্তুত হয়ে উঠে।

মুসলীমরা বিশ্বাস করে যদি তুমি ধর্ম যুদ্ধে মৃত্যু বরণ কর তাহলে স্বর্গে যাবে। তাহলে তোমার সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে । এবং কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অপরকে হত্যা করছে আর তুমি ধরে নিচ্ছ তা সত্য।

গত বিশ শতাব্দী ধরে আমরা তাই দেখছি। এডলফ হিটলার বিশ বছর ধরে একটা বিষয় পুনরাবৃত্তি করেছে, সকল সমস্যার মূল ইহুদিরা এবং জার্মানের মত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দেশ তা বিশ্বাস করতে শুরু করলো। সাধারণ মানুষের কথা কী আর বলবো, মার্টিন হাইডেগারের মত একজন বড় দার্শনিকও হিটলারকে সমর্থন করেছে! মার্টিন হাইডেগারের এই বিশ্বাসের পিছনে মূল কারণঃ পুনরাবৃত্তি করা, পুরনরাবৃত্তি করে যাওয়া।

তুমি এরকম অন্ধ বিশ্বাস আর ধারণা নিয়ে বেঁচে আছো যার কোনো ভিত্তি নেই। এবং তুমি যদি এইভাবে বাঁচতে থাকো তুমি তাহলে তোমার অস্তিত্ব অন্ধকার দিয়ে আবৃত হয়ে থাকবে। তোমার একটা ভিত্তিগত পরিবর্তন চাই। তোমার নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন করো, অন্যকে নিয়ে নয়। অন্যের সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না, এবং তার কোনো প্রয়োজন নেই। কিভাবে তুমি অন্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হবে? এই মুহূর্তে তোমার কাউকে ভাল লাগতে পারে এবং ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে তাকে তোমার ভাল নাও লাগতে পারে। এখানে কোনো প্রতীজ্ঞা থাকতে পারে না। তুমি শুধু তোমাকে নিয়ে নিশ্চিত হতে পারো। এবং সেটা একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য। এবং তোমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যা হবার বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। শুধু বর্তমানের জন্য বাঁচো।

(দ্যা ওয়ে অফ দ্যা বুদ্ধা/ খন্ডঃ ছয়/ অধ্যায়ঃ ০২)

www.oshoworld.com

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *