মৃত্যু পরবর্তী স্তুতিঃ উত্তম কুমার’কে নিয়ে সত্যজিৎ।

উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ ভক্তি এবং তাঁর কাজ সম্বন্ধে জানাতে লেখাটা লেখেন বাঙলা ছবির জগতে একজন অন্যতম স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়।

মূলঃ কোলকাতা ক্রোমোজোম

আমি যখন প্রথমবার উত্তমকে রূপালী পর্দায় দেখি তখনো আমি সিনেমা বানানো শুরুই করিনি। আমি শুনেছিলাম একজন নতুন নায়কের উত্থান হয়েছে এবং আমি উদগ্রীব ছিলাম সে ঠিক কেমন তা দেখার জন্য। ঐ সময় হলিউডের নায়কেরা যেমন ক’রে লোকের প্রশংসায় টইটুম্বুর থাকতো ঠিক তেমন প্রশংসার কাতারে তৎকালীন বাঙলা সিনেমার নায়কেরা পৌঁছাতে পারেনি; যেমন- দুর্গাদাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, সৈগাল, ধীরাজ ভট্টাচার্য প্রমুখ।

উত্তম কুমার অভিনীত তিনটি সিনেমা আমি পরপর দেখি, সবগুলোরই পরিচালক ছিলেন অত্যন্ত গুণী এবং যোগ্য একজন মানুষ, নির্মল দে। প্রথম অভিব্যক্তি’টা নিঃসন্দেহে ভালই ছিল। উত্তম সুদর্শন ছিল, একটা কড়া উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ আচার-ব্যবহার কিন্তু ওর কাজে মঞ্চ তথা থিয়েটারের কোনো ছোঁয়া ছিল না। আর হ্যা ওর জন্য উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিলো।

উত্তমের সাথে কাজ করার সুযোগ আরো অনেক পরে হয়েছিল। ইতিমধ্যে উত্তম কুমার কিংবদন্তী পর্যায়ের কিছু একটা হয়ে গেছে। তখন অধিকাংশ বাঙলা সিনেমাতেই সে মূল চরিত্রে ছিল আর সাথে জুটি বাঁধতো সুচিত্রা সেন। এটা একটা রোম্যান্টিক জুটি ছিল, এই জুটির গ্রহণযোগ্যতার স্থায়িত্ব এবং বিস্তারের সমকক্ষ বিশ্বসিনেমায় খুব কমই দেখা যায়। উত্তম অবশ্যই একজন প্রকৃত হলিউড ধাঁচের তারকা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ উত্তম কি একজন অভিনেতাও ছিলেন?

এটি একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ। অভিনয়ে কাঁচা এমন হলিউড অভিনেতার উদাহরণ কমপক্ষে একটি হলে পাওয়া যায়, যে কিনা প্রথম ছবি মুক্তির পর শুধুমাত্র দর্শক সমর্থনের শক্তিতেই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে। গ্রেগরি পেক, তাঁর দাপট আজও বিদ্যমান, আমাকে বলা হতো একজন অভিনেতাকে সামলানো দরকার। কিন্তু সিনেমার সবচেয়ে অপ্রাসঙ্গিক অংশটুকুতেও উত্তম যে ধরনের দৃঢ়তার ছোঁয়া রাখতো তা পেক কখনোই করতে পারেনি।

আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম উত্তমের সাথে কাজ করার জন্যে আর ও’র সবকিছু মাথায় রেখে একটা গল্পও লিখে রেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এই চরিত্রটা’তে উত্তম খুব সহজেই খাপ খাইয়ে নিবে, একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক যিনি ফিল্মে সুযোগ পেয়েই অতি দ্রুত সাফল্যের শিখরে উঠে যায়। আসলে, এই অসচ্ছল জীবন থেকে হঠাত ধনী হয়ে ওঠা, এই গল্পটার সাথে উত্তমের নিজ জীবনের কিছুটা মিলও ছিল বটে।
উত্তম এই চরিত্রটা পছন্দ করে এবং রাজিও হয়ে যায় এটা করার জন্য যদিও সে বুঝতে পেরেছিলো এই চরিত্র করা অর্থই হচ্ছে তাঁর চিরচেনা জাঁকজমকপূর্ণ ধারার বাইরে গিয়ে কাজ করা অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও। কোনো ধরনের মেক-আপ ব্যবহার করা যাবে না, এই প্রস্তাবেও উত্তম রাজি হয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গুটি বসন্তের দাগ মুখে কিছুটা রয়ে যায় তা সত্ত্বেও সে রাজি ছিল।

বলতেই হবে, উত্তমের সাথে কাজ করাটা আমার সিনেমা জীবনের আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি যে উত্তমের অভিনয়ের ধাঁচ’টা অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তিগত। আমি অন্য ধাঁচের লোকের সাথেও কাজ করেছি যারা কিছুটা আবেগ বর্জিত কিন্তু অনেক বুদ্ধিখাটিয়ে কাজ করে, তাঁরা একটা পটভূমিকে চিড়ে তা নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক’রে যাতে চরিত্রটার সাথে একেবারে রক্তে মাংশে মিশে যেতে পারে। কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে এখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই যে এই সেরেব্রাল বা ব্রেইন খাটানো লোকটা ঐ সহজাত অভিনয়ের লোকটার থেকে অধিকতর বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে কি পারবে না।

আমার মনেই নেই এমন কোনো ঘটনা যেখানে আমি উত্তমের সাথে বসে গুরুগম্ভীর আলোচনা করেছি ওর সিনেমার চরিত্রটা নিয়ে! ওকে তেমন কিছু বলতেই হতো না। আর তারপরেও উত্তম ওর অপ্রত্যাশিত ছোট ছোট নিখুঁত কাজের মাধ্যমে আমাকে অনবরত চমকে দিতো এবং মুগ্ধ করতো যেগুলা সবসময়ই ঐ চরিত্রের শোভা আর ঐ মুহূর্তটার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে দিতো বহুগুণে। এই বিষয়গুলো দৃশ্যের মাঝে এতটা স্বাভাবিক দেখাতো যে মনে হতো এই স্বাভাবিকতা সে ভিনগ্রহ থেকে রপ্ত করে এনেছে। এর মধ্যে যদি কোনো গভীর ভাবনার যোগসূত্র থাকতো, তাহলে উত্তম ঐ সম্বন্ধে কোনো প্রকার কথাবার্তাই বলতো না। এই স্বতঃস্ফূর্ততার কথা ওর নিজের মধ্যেই রয়ে যেত।

আমি জানতাম উত্তম অনেক কাজ করেছে,তাও প্রায় ২৫০ টা ছবির কাছাকাছি। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি ঐ ছবিগুলার মধ্যে অন্তত ২০০ ছবির স্মৃতি ওর কাছে এখন অনেকটাই ঝাপসা, হয়তো একেবারেই ভুলেও গেছে। যখন গুণী অভিনয় শিল্পীদের কাজের সংখ্যা অন্যান্য গুণী লেখক বা পরিচালকদের কাজের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায় তখন এই বিস্মৃতি হওয়ার ঘটনাটা অনেকটাই অনিবার্য হয়ে পড়ে। এমনকি একজন সেরা তারকাও একসময় তাঁর তীব্রতা হারিয়ে ফেলে এবং খানিকটা নিস্তেজ হয়ে যায়; কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই তখন সে তাঁর উন্নতির প্রধান অস্ত্র ধীরে ধীরে অচল করে দেয় এবং নতুন পন্থার দিকে হাঁটতে থাকে যা তাঁকে তাঁর পূর্বের তেজ ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটা ঐ সব তারকাদের জন্য আরো ভয়াবহ যাদেরকে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে তাঁরা এঁটে আছে তাদের চিরাচরিত খ্যাতির ইমেজ নিয়ে অথবা হোঁচট খেয়ে থুবড়ে পড়ে আছে। আর হ্যাঁ এটা হবার পেছনে মূলে রয়েছে একই চরিত্র বারবার করা, নতুনত্বের অভাব।

তবে যা কিছুই হোক একজন শিল্পীকে কিন্তু সবসময় তাঁর সেরা কাজের মাধ্যমেই বিচার করা হয়। সে ভিত্তিতেই এবং একটা পূর্ণ বিস্তারের মধ্য দিয়ে উত্তমের প্রতিভার অত্যুত্তম উন্মেষ ঘটে, আর উত্তমের কাজে সাবলীলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আত্মবিশ্বাসের এক বিরল মিল পাওয়া যায়, এগুলা ওর অনন্য সাধারণ গুণ। এই বিরল গুণগুলোর একত্রে সমাহার অতো সহজেই পাওয়া যায় না এবং অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের অন্যকারুর পক্ষেই উত্তমের এই অবস্থান ছোঁয়া সম্ভব হবেনা।

****
“নায়ক” সিনেমাটাতে উত্তম কুমার আর শর্মীলা ঠাকুরের মধ্যকার প্রথম পরিচয়ের দৃশ্যে শর্মীলা  একটা বাহানায় উত্তমের কাছে তার এক কাজিনের জন্যে অটোগ্রাফ নিতে আসে (কিছুটা ইতস্তত হয়ে ব’লে ), তখন উত্তমের পকেটে একটি কলম ছিল যেটা ঠিক ঐ সময়টাতে সই করার জন্য রাখা ছিল, কিন্তু যখন কলমটি বের করলো সে দেখলো কালি আসছে না তখন সত্যজিৎ রায় “দৃশ্যটা কাট” বলবে বলবে ভাব আর ঐ সময়েই উত্তম কলমটা ঝাঁকাতে থাকে ডায়লগ বলার মাঝেই আর যেই দেখলো কালি নেই তখন পাশের গ্লাসে রাখা পানিতে নিব টা ভিজিয়েই সই করে দিল। সত্যজিৎ রায় উত্তমের এই সাবলীলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। একটা আর্টিকেলে সত্যজিৎ রায় বলেন কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এই দৃশ্যটাতে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা দেখানো কেবলমাত্র একজন অতি উচ্চমাত্রার তারকার দ্বারাই সম্ভব।
যারা সিনেমাটি দেখেননি তাদের জন্য নায়ক ছবির লিঙ্কটি দেয়া হলো। এখানে ক্লিক  করে দেখে নিন। আর উত্তম-শর্মীলার প্রথম দৃশ্যটি দেখতে লিঙ্কটির ১৯ঃ৩৫ মিনিটে চলে যান, উত্তমের সেই পারদর্শীতার একটি ঝলক দেখে আসুন।

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *