রাফিদা আহমেদ বন্যার ভলতেয়ার লেকচার

সবাইকে শুভেচ্ছা,
ঐতিহাসিক আর সম্মানজনক সংগঠন ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

আমার মৃত স্বামী ডঃ অভিজিৎ রায় এবং আমি – দুজনেই বাংলাদেশী আমেরিকান নাগরিক, দুজনেই মানবতাবাদী, দুজনেই বাংলাদেশের ইসলামী সন্ত্রাসের শিকার। অভিজিৎ আর আমি নিজেদের জন্মভূমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি, বার্ষিক বইমেলাতে অংশ নেয়ার জন্য। মেলাটা সারা দেশে বেশ বিখ্যাত। হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে, চলে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে!

ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে, যখন আমরা আলোয় মোড়ানো মেলার প্রাঙ্গণ ছেড়ে নিজেদের গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, অভিজিত আর আমার ওপর ইসলামী মৌলবাদীরা নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করলো। আমাদেরকে রাস্তার পাশেই বারংবার চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে। পুরো এলাকার চারপাশে অনেক পুলিশ অফিসার, ভিডিও ক্যামেরা, আর অনেক অনেক মানুষ ছিলো। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, পুলিশও দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা একজন তরুণ সাংবাদিকের কাছে কৃতজ্ঞ – সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, দ্রুত আমাদেরকে কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অভিজিৎ মারা গেলো। মাথার চারপাশে আর হাতে চারটা কোপের আঘাতে আমি আহত হয়ে পড়ে রইলাম, আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি কাটা পড়লো। দুটো হাতে, আঙ্গুলগুলোতে, আর শরীরে – সবখানেই আঘাত পেয়েছিলাম।  একাধিকবার সার্জারি করতে হয়েছে আমাকে, নার্ভ আর শিরাগুলোকে ঠিক করার জন্য। চার মাস চলে গেছে, এখনো আমার চিকিৎসা চলছে।

অভিজিৎ হয়তো এই চাপাতিধারী খুনীদের শিকারের তালিকায় সবচেয়ে পরিচিত মুখ ছিলো। কিন্তু সে-ই প্রথম নয়, শেষও নয়। ফেব্রুয়ারির শেষে তার মৃত্যুর পর, ইসলামী মৌলবাদীরা বাংলাদেশে আরো দুজন মানবতাবাদী ব্লগারকে খুন করেছে; প্রায় একই রকম পরিস্থিতিতে, তিন-চারজন মিলে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে। ব্লগার ওয়াশিকুর রাহমান বাবুকে খুন করা হয়েছে ৩০শে মার্চে। পথিকদের মধ্যে কয়েকজন দুজনকে ধরেছে – পুলিশদের কোনো কৃতিত্বই নেই এখানে।  খুনীরা বলেছে, ওরা কখনো ওয়াশিকুরের লেখা কোনো ব্লগ না পড়লেও মাদ্রাসার আদেশে ওকে খুন করেছে। এই দিকটা নিয়ে পরে আবার আসবো।

যাই হোক, এরপর ১২ই মে, অনন্ত বিজয়কে খুন করা হলো। অভিজিতের মত, অনন্তও বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে লিখতো। ওর একটা ম্যাগাজিন ছিলো, নাম-যুক্তি। ও আমাদের খুব আপন ছিলো। সে আমাকে দিদি ডাকতো। অনেকদিন ধরেই আমাদের সাথে কাজ করছিলো সে। যতদূর জানি, ওরা ৮ জন ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবী, ব্লগার, লেখককে আক্রমণ করেছে, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর শফিউল আলম (২০১৪ সালে), ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার (২০১৩ সালে), আসিফ মহিউদ্দিন (ব্যর্থ হামলা, ২০১৩ সালে), আর নিঃসন্দেহে প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ (২০০৩ সালে)।

এগুলো সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা। এবার অভিজিৎ, ওর কাজগুলো, ওর লেখাগুলো, আর ওর সাথে আমার জীবন নিয়ে দুটো কথা বলবো। এরপর, জিজ্ঞেস করবো – “কীভাবে ঘটনাটা এতোদূর গড়ালো?”

শুরু করার আগে, দুটো তথ্য দিয়ে রাখি। এক, বেশ কয়েক বছর ধরে বললেও ইংরেজি মূলত আমার দ্বিতীয় ভাষা। আমার কথায় বাংলাদেশি ইংরেজি আর ছোটোবেলায় যে আমেরিকান সিটকম দেখতে দেখতে বড় হয়েছি, তার একটা মিশ্র টান আছে। কানাডা, মিনেসোটা, আর সর্বোপরি সবচেয়ে বেশি টান আছে আমেরিকার দক্ষিণ অঙ্গরাজ্যগুলোর, যেগুলোকে “আদর” করে বাইবেল বেল্ট বলে। আমার কোনো কথা না বুঝলে প্লিজ সেটা নোট করে রাখুন, পরে যাতে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর দুই, আমি খুব এলোমেলো হয়ে আছি – আমার জীবনটা এলোমেলো, আমার চিন্তাগুলো এখনো এলোমেলো। মাত্র চারটা মাস গেছে অভিজিতের মৃত্যুর পর! সে আমার বন্ধু ছিলো, আমার সকল অপকর্ম, সুখ, দুঃখ, অসংখ্য খুনসুটি আর ভালোবাসার সঙ্গী ছিলো। সেটা নিয়েই এবার একটু বলি।

অভিজিৎকে আমি অভি ডাকতাম। সে বাংলায় প্রথমবারের মত মুক্তচিন্তার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম খুলেছিলো – মুক্তমনা, অর্থাৎ উন্মুক্ত চিন্তার অধিকারী – সেই ২০০১ সালে; যখন সে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে বায়োমেডিক্যাল ইনজিনিয়ারিং নিয়ে পিএইচডি করছিলো। মুক্তমনা শুধু একটা ব্লগ নয়, একটা প্ল্যাটফর্ম আর একটা কমিউনিটি। অন্যান্য মডারেটর, ব্লগার, আর লেখকদেরকে সাথে নিয়ে মুক্তমনা হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষাভাষীদের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী আন্দোলনের অপর নাম। এটা আমার জন্য একাধিক কারণে জরুরি। মুক্তমনার মাধ্যমেই ২০০২ সালে অভির সাথে আমার পরিচয় হয়। এরপর থেকে আমরা অধিকাংশ কাজ আর লেখা একসাথে চালিয়েছি। আমরা মানবতার নীতিতে একাত্ম হয়েছিলাম। আমরা নিজেদের মূল বিশ্বাস আর আদর্শ নিয়েও অনেকবার তর্ক করেছি, যা প্রকৃত মানবতাবাদীদের করা উচিৎ। নিজেদের লেখা নিয়ে বিতর্ক, বিশেষ করে মানবতাবাদের আর্থ-সামাজিক আর রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে বিতর্ক – সেগুলো এতো আবেগ দিয়ে করতাম যে আমাদের মেয়েটা মনে করতো আমরা বুঝি সবসময়েই ঝগড়া করি। ওর কয়েক বছর লেগে গিয়েছিলো এটা বুঝতে গিয়ে যে সবগুলো না হলেও বেশির ভাগই আসলে দর্শনগত বিতর্ক, দাম্পত্য কলহ নয়!

অভি নাস্তিক ছিলো, ব্লগার ছিলো, লেখক ছিলো, আর সর্বোপরি একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ছিলো যে জীবনের মহৎ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। অভিজিৎ বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছিলো। খুব ভালোবাসতো সে এটাকে। ওর শেষ বইটা ছিলো কিভাবে একদম শূন্য থেকে ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হলো তা নিয়ে। সে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে বই লিখেছিলো, সমকামিতার বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছিলো। আরেকটা বই লিখেছিলো বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসার ব্যাখ্যা নিয়ে। সে এমনকি নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে একটা সাহিত্য রচনা করেছিলো। কিন্তু ওর দুটো বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ আর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বেশি নজরে এসেছিলো। একদিকে, এই দুটো বই ওকে তরুণ আর প্রগতিশীল পাঠকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় করে দিয়েছিলো। অন্যদিকে, ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে ওর প্রতি ক্রোধ আর শত্রুতার জন্ম দিয়েছিলো।

আমরা বাংলায় লিখতাম, কারণ আমরা এই ভাষার মানুষদের মধ্যে বিজ্ঞান আর দর্শনের মূল ব্যাপারগুলো আর সর্বাধুনিক ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি জৈবিক বিবর্তন নিয়ে, ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ শিরোনামে একটা বই লিখেছিলাম কয়েক বছর আগে। অভি অসংখ্য প্রবন্ধ, ব্লগ লিখেছিলো। লেখালিখিই ওর প্যাশন ছিলো, ওর প্রাণ ছিলো। সত্যি বলতে, ও মুখের কথার চেয়ে লিখেই নিজের ভাব আরো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারতো। এমনকি, আমাদের ছোটো কিন্তু সুন্দর ১৩ বছরের জীবনে, আমার সাথে মৌখিক আলোচনায় ব্যর্থ হয়ে আমরা একে অপরকে চিঠি লিখতাম সবসময়ই!

যাই হোক, সে শুধু বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়েই লেখেনি, সব রকম কুসংস্কার, অন্যায়, অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক বিশ্বাস নিয়েই লিখতো। সমাজের যেখানেই অন্যায় আর অসহিষ্ণুতা দেখতো, সেটার প্রতিবাদ করতো। ওর লেখাগুলোই সেটার প্রমাণ। নারীর অধিকার (সে হাইপেশিয়াকে নিয়ে খুব মর্মন্তুদ একটা প্রবন্ধ লিখেছিলো) থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ, আবু ঘ্রাইবের অত্যাচার, গুজরাট আর প্যালেস্টাইনের হানাহানি, এমনকি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের সংখ্যালঘু আদিবাসীদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি – সব কিছু নিয়েই সে লিখেছিলো। বছরের শুরু দিকে, সে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনা চ্যাপেল হিলের গোলাগুলির বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলো; যে ঘটনায় ফেসবুকে নাস্তিকতা প্রচার করা একজন লোক এপার্টমেন্টে ঢুকে তিনজন ছাত্রকে খুন করেছিলো। অভি লিখেছিলো –

“নাস্তিকতা বলতে বোঝায় অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। আমার মনে হয়, এটা বলতে যে কোনো অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটা যুক্তিসঙ্গত ধারণা বোঝায়। কিন্তু যদি মানবতার জন্য আবেগ না থাকে, তাহলে নাস্তিক হওয়ার সাথে সাথেই সব রকম কুসংস্কার আর ঘৃণা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। আপনি ধার্মিক হন বা নাই হন, অসহিষ্ণুতা সবখানেই আছে। ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, অনেক অধার্মিক হৃদয়হীন স্বৈরশাসক আছে, যারা নিষ্ঠুরভাবে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। আমরা এখন জানি যে ক্রেইগ স্টিফেন হিকস নামে একজন আছে যে মুসলিমদেরকে ঘৃণা করে। এই অপরাধীদের জন্য কোনো সমবেদনা বা অজুহাত চলবে না।  চ্যাপেল হিলের ঘটনাটা অমানবিক, এবং যার সামান্যতম মূল্যবোধ আছে তারই এটার নিন্দা করা উচিৎ”।

ফ্রেডরিখ নীটশে যদি এখানে থাকতেন, তিনি হয়তো বলতেন অভিজিৎ বিজ্ঞানকে শিল্পীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলো আর শিল্পকে দেখেছিলো জীবনের দৃষ্টিতে। অর্থাৎ, বিজ্ঞান ওর জন্য আবেগের বিষয় ছিলো, অনুমান আর আশ্চর্য হবার বিষয় ছিলো। আর শিল্প কোনো বিমূর্ত বা ভিনগ্রহের বিষয় ছিলো না, বরং জীবনকে পাল্টে দেয়ার একটা শক্তির মত ছিলো।

অভি একজন সাধারণ মানুষ ছিলো। সেও ভুল করতো, ওর মধ্যেও অনেক ত্রুটি ছিলো। সে খুব বাজে গাইতো, পুরোপুরি বেসুরো। যে অর্থনৈতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলোতে বেশ ভড়কে যেতো, বাসায় বেশ উদ্ভটভাবে থাকতো। সে একজন পিতা ছিলো, আমাদের মেয়েটার আদর্শ ব্যক্তিত্ব আর বন্ধু ছিলো। কিন্তু সবার ওপরে, সে নিজের কাজ আর লক্ষ্যগুলো বেশ ভালো করে বুঝতো। সে জানতো যে প্রতিবাদ করার মাধ্যমে সে নিজেকে কত বড় হুমকির মুখে ফেলছে। সে নিজের একটা লেখায় বলেছিলো –

“যারা মনে করে যে কোনো রক্তপাত ছাড়াই বিজয় অর্জিত হবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। যে মুহূর্তে আমরা ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছি, তখন থেকেই আমরা নিজেদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছি”।

এখানেই চলে আসে মূল প্রসঙ্গটার কথা, এর গভীর ইতিহাসের কথা। কীভাবে আমরা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে এমন একটা জায়গায় চলে এলাম, যেখানে মানবতাবাদী আর ধর্মনিরপেক্ষদেরকে রাস্তাঘাটে কুপিয়ে হত্যা করা যায়।

আমেরিকার দক্ষিণ অংশে অনেকে আমার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় যখন আমি ওদেরকে বলি যে আমি বাংলাদেশে থেকে এসেছি। আমি জানি, আপনারা অমন নন। তবুও আপনাদের স্মৃতিটাকে একটু ঝালিয়ে নিই। বাংলাদেশ একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিলো যা ব্রিটিশরা শাসন করেছিলো প্রায় ২০০ বছর ধরে। ১৯৪৭ সালে কলোনিটাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো – ভারত আর পাকিস্তান। দ্রুতগতিতে বানানো এই সীমারেখাগুলো প্রধানত ইসলাম আর হিন্দুধর্মের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। আর নিঃসন্দেহে এই বিভাজনের জন্যেই ঘটেছিলো হাজার হাজার মৃত্যু আর লক্ষ লক্ষ মানুষের গৃহত্যাগ, বস্তুত মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ দেশান্তরের ঘটনা ঘটেছিলো তখন।

কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের ভাগাভাগিটাই একমাত্র ভাগাভাগি নয়। পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্ব অংশটাও পশ্চিম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো, মাঝে ছিলো হাজার মাইলের ভারতীয় ভূ-খণ্ড। দুই অংশে ছিলো ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিচয়। পূর্ব বাংলার মানুষদের মধ্যে বাঙালি আর মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে একটা সংঘাত ছিলো সেই শুরু থেকেই, এ অঞ্চলে ইসলাম আসার পর থেকেই। যাই হোক, বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের শেকড় ছিলো অনেক গভীরে প্রোথিত। আর বাঙালিদের ওপর শাসক পশ্চিম পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের জের ধরে সেই সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ অবশ্যম্ভাবী ছিলো।

তাই, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠলো বেশ দ্রুতই, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। যখন পাকিস্তানী সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বাদ দিতে চাইলো, তরুণ বাঙালিরা নিজের প্রাণ দিয়ে সেটার প্রতিবাদ করেছিলো। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে, ছাত্ররা রাজপথে রক্ত দিয়েছিলো – বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমুন্নত রাখার জন্য। আজ, তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে, আমরা ভাষা শহীদ দিবস (যেটাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালন করা হয়) হিসেবে পালন করি সেই জাতীয় বইমেলা এলাকাতেই, যেখানে অভিজিৎকে খুন করা হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত, ১৯৭১ সালে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু আর নয় মাসের হৃদয়বিদারক যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের খোলস চিরে একটা নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বেরিয়ে আসে, যার নাম বাংলাদেশ।

সদ্য গঠিত বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু বাস্তবে, কোনোটাই সফলভাবে কার্যকর করা হয়নি। দেশটাতে বিস্ময়করভাবে মুসলিম পরিচয় ফুটে উঠলো যখন ১৯৭৫ সালে ষড়যন্ত্র করে সরকারকে উৎখাত করা হলো। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রতিস্থাপিত হলো “সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস” দিয়ে; গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হলো স্বৈরাচারী সামরিক শাসন দিয়ে। তারপরেও, ১৯৮০ এর দশকে, আমরা যখন টিনেজার ছিলাম, তখন মনে হতো – বাঙালি মুসলিমরা বেশ উদার; অন্তত আজকের তুলনায়। কিন্তু রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে পাল্টে গেলো, ধর্মীয় মৌলবাদ বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

এই উত্থানের পেছনে মূল হোতা ছিলো একটা আন্তর্জাতিক ইসলামী দল জামাত-এ-ইসলামী। ওদের রাজনৈতিক ক্ষমতাই যে শুধু বাড়ছিলো, তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের সহায়তায়, ওরা একটা অর্থনৈতিক আর ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তুললো। ওদের হাত এখন পৌঁছে গেছে রাজনীতিতে, সমাজের সবচে ধর্মীয় রক্ষণশীল অংশগুলোতে। এই অর্থনৈতিক আর জনশক্তি নিয়ে ওরা সরকারকেও প্রভাবিত করতে পারে। আর আমাদের সবগুলো সরকার, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ হোক বা না হোক, সবাই এদের সামনে কোনো না কোনভাবে নিজেদের হাঁটু গেড়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এদেরকে দেশটির সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল বলা হয়। তবুও, রাজনীতির দোহাই দিয়ে এরা বারবার ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে মাথা নত করেছে, ওদের দাবি পূরণ করেছে, ওদের ইচ্ছায় সায় দিয়েছে। এগুলোকে ঘুষ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না, আর এ সবই শুধুমাত্র নিজেদের ভোট টিকিয়ে রাখার জন্য। গতবার ওরা ক্ষমতায় এসেছিলো বর্তমান ইসলামী দলটির যেসব প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলো। তাদেরকে সনাক্ত করা আর অভিযুক্ত করার ওয়াদা করে।

২০১০ সালে, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিলো। বিচারের রায় আসা শুরু হয়েছিলো ২০১২ এর শেষ আর ২০১৩ এর শুরুর দিকে। তখন ইসলামী দলের সদস্যরা চরম চাপের মুখোমুখি হয়েছিলো। ওদের ওপর থেকে ভোটার জনগণের সমর্থন কমে যাওয়া শুরু করেছিলো। ইসলামী দলের প্রবীণ সদস্যদেরকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী ঠাওরানো হচ্ছিলো। আর তখন মুসলিম মৌলবাদীরা নাস্তিকদের দিকে মনযোগ দেয়া শুরু করলো। যদি মুসলিম নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি দেয়া হয় (বাংলাদেশে এটাই যুদ্ধাপরাধের সাজা), তাহলে যেসব ধর্মনিরপেক্ষ আর নাস্তিকরা এই ন্যায়বিচারের পক্ষে ডাক দিয়েছে, তাদেরকেও একই পরিণতি বরণ করে নিতে হবে।

সূতরাং, মৌলবাদীরা গত কয়েক বছরে বেশ কিছু হিট লিস্ট বানিয়েছে যেখানে সেই বুদ্ধিজীবি, লেখক, ব্লগারদের নাম আছে যাদেরকে ওরা খুন করতে চায়, সেটাকে অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে চায়। ২০১৩ সালে ওরা একটা কুখ্যাত হিট লিস্ট প্রচার করলো, যাতে ৮৪ জন ব্লগারের নাম ছিলো। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে ওরা এই তালিকাটা সরকারের কাছে দিলো। বললো, এদেরকে যাতে ধর্মীয় অবমাননার দায়ে গ্রেফতার করা হয়, ফাঁসি দেয়া হয়। ওরা একটা নতুন ধর্মনিন্দাসূচক আইন প্রস্তাব করলো যা ভঙ্গ করলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আর এই আইনের (যা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী) আওতায় আনতে বললো ঐ ব্লগারদেরকে যারা নাকি ইসলামকে অবমাননা করেছে।

ওরা নিশানা ঠিক করে দিলো, যাতে প্রকৃত মুসলিমরা তাদেরকে হত্যা করতে পারে। এখানে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিলো কিভাবে আল-গাযালি সকল “প্রকৃত” মুসলিমকে অধিকার দিয়েছিলেন যাতে সেই মুসলিম দার্শনিকদেরকে হত্যা করতে পারে যারা এই ভাববাদী মতবাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা ধারণ করতেন। অন্যভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক মুসলিমেরা আর উগ্রপন্থীরা – দুই দলই তাদের বিরুদ্ধাচারণকারীদেরকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, তাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করছে, আর দেশের মধ্যে ত্রাসের সংস্কৃতি তৈরি করছে।

এই পর্যায়ে এসে হয়তো শেখ হাসিনা ওদেরকে শক্ত হাতে দমন করতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, “না, সবারই লেখালেখি করার, প্রশ্ন তোলার, সমালোচনা করার অধিকার আছে”। তা না করে উনি বললেন, “আমাদের নতুন কোনো ধর্মনিন্দাসূচক আইনের দরকার নেই,  কারণ ইতোমধ্যেই আমাদের একটা আইন আছে যাতে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। আর আমরা ব্লগারদেরকে সেই আইনের আওতায় মামলা করতে পারি। তাই, কর্তৃপক্ষের কাছে সেই ব্লগারদের তালিকা পৌঁছে দেয়া হলো। প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হলো তদন্ত করার জন্য। এরপর তালিকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করা হলো এবং আদালতে চালান করা হলো। তাদের মুক্তির জন্য নিরলস প্রচারণা চালিয়েছিলো অভিজিৎ।

গুণ্ডারা যা চায়, তাই যদি করেন, তখন কী ঘটে? কী ঘটে যদি আপনি উন্মত্ত দাবির কাছে মাথা নত করেন? শীঘ্রই লাখের ওপরে মুসলিম নেমে এলো ঢাকার রাস্তায়, যারা শুধু নাস্তিক ব্লগারদের কল্লা চেয়েই ক্ষান্ত হলো না, পাশাপাশি নতুন শিক্ষা আইন বাতিলের দাবি করলো যেটা মেয়েদের শিক্ষায় অনেক উপকার হতো। আর আবারো সরকার মাথা ঠেকলো। ২০১৩ থেকে মুসলিমপন্থীদের একের পর এক দাবি পূরণ করা হয়েছে, আর প্রথমদিকের আক্রমণের শিকার আহমেদ আর আসিফের আক্রমণকারীদেরকে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে, ২০১৩ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশোধনী।

প্রাক্তন রক্ষণশীল সরকার দ্বারা প্রণীত আইনটা আগে থেকেই বেশ নিপীড়ন চালাচ্ছিলো – যে কোনো বই, সম্প্রচার, বা ওয়েবসাইটকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিলো “ভুয়া বা অশ্লীল” (যদিও এগুলো একেক ব্যক্তির কাছে একেক রকম) তকমা লাগিয়ে; দমিয়ে দেয়া হচ্ছিলো যে কোনো অভিব্যক্তি যা তরুণসমাজকে “নষ্ট” করে ফেলতে পারে (নষ্টও বেশ আবছা একটা শব্দ, সক্রেটিসের বিরুদ্ধেও তরুণসমাজকে নষ্ট করে দেয়ার আরোপ ছিলো)। তদুপরি, যোগাযোগ আইন সেই সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছিলো যেগুলো ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করে বা করতে পারে। এই অকল্পনীয় আইন ভঙ্গ করলে দশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে, সাথে থাকতে পারে চড়া জরিমানা।

নিঃসন্দেহে বেশ কঠিন শাস্তি! কিন্তু মনে রাখবেন, এখনো আমরা ২০০৬ সালের আগের আইনটা নিয়েই কথা বলছি। আগের আইনে সকল দণ্ডবিধি ছিলো অবিচার্য। এই শব্দটা শুধু শ্রীলংকা, ভারত, বাংলাদেশ, আর পাকিস্তানের দণ্ডবিধিতেই পাওয়া যায়। এটার মানে হলো, এ ধরনের অপরাধে ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ব-অনুমতি ছাড়া কোনো পুলিশ অফিসার কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না, তদন্ত করতে পারবে না।

যাই হোক, ২০১৩ সালের সংশোধনীতে চারটা অংশকে তার বাইরে নিয়ে আসা হলো, অর্থাৎ প্রশাসনের কোনো পর্যবেক্ষণ করা লাগবে না এই ধর্মনিন্দাসূচক আইনের প্রয়োগ ঘটাতে। এই অপরাধে অভিযুক্তদেরকে জরিমানা দিয়ে ছাড়ানোর ব্যবস্থাও বাতিল করা হলো। যদিও ৫৭ নং ধারাটা অবিচার্য ছিলো না, তবুও পুলিশ কিভাবে যেন সেটাকে অবিচার্যের খাতায় নিয়ে এলো! কৌশলটা ছিলো এমন – অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওদেরকে (ব্লগারদেরকে) ৫৪ নং অবিচার্য ধারায় গ্রেফতার করা হলো, সাথে ৫৭ নং ধারাও অভিযোগের তালিকায় দিয়ে দেয়া হলো। এভাবেই, এই আইনটাকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হলো, যাতে যে কোন ধর্মনিন্দার অভিযোগেই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে।

অপপ্রচারের অভিযোগ ছাড়াও, দণ্ডবিধিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নিয়েও কিছু কথা ছিলো, যা শুধুমাত্র প্রকাশনা মাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য ছিলো। আর সেটার জন্য শাস্তি ছিলো দুই বছরের কারাদণ্ড। যেন ইতোমধ্যেই বাকস্বাধীনতার ওপর যথেষ্ট খবরদারি করা হয়নি। আর সংশোধিত ICT তো ইন্টারনেটে ধর্মের সমালোচনার অপরাধে ১৪ বছর জেলের ব্যবস্থা রেখেছেই। আরো হাস্যকর ব্যাপারটা হলো, অনলাইনে ধর্মের সমালোচনা করলে ১৪ বছরের জেল, আর প্রকাশনার মাধ্যমে করলে ২ বছর! অর্থাৎ, ফেসবুকে কোনো বন্ধুকে কিছু লিখলে যে সাজা পাবেন, তা জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় “নিন্দাসূচক” কিছু ছাপানোর চেয়ে ৭ গুণ বেশি! এই ICT আইনকে মুখ্য লেখক, ব্লগার, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার এবং অপব্যবহার করা যেতে পারে, এবং হয়েছেও। সেই উদাহরণ আমরা দেখেছি বহুবার।

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে ইসলামী মৌলবাদ ছড়িয়েছে – রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে, ক্রমবর্ধমান মসজিদ আর মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে (যেগুলোর প্রতিষ্ঠা আর অর্থ যোগান করে এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশগুলো)। মুসলিম মৌলবাদীরা অনেক মাদ্রাসাকেই ঘৃণা আর হিংসার বাণী ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে।

আর কী হলো আমার স্বামী অভিজিৎ বা ওয়াশিকুর রাহমান বা অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার পর? প্রায় কিছুই না! অভিজিৎকে যে অনলাইনে হুমকি দিচ্ছিলো, তাকে গ্রেফতার করা হলো। আর একটা অদৃশ্য অনলাইন গ্রুপ, যারা হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেছিলো, সেটাকে ব্যান করা হলো। পুরো সময়টাতে, সরকার বা পুলিশ কেউই আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। যেন তাদের কাছে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আজ সকালে শুনলাম যে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গত বুধবারে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদা শাখার ১২ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এদের সাথে নাকি অভিজিৎ সহ আরো বেশ কিছু লেখক আর মুক্তচিন্তকের হত্যার যোগাযোগ আছে। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করবো না, কারণ এটার ডিটেইলস এখনো জানতে পারিনি আমি।

উপসংহার

অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছে, আমাকে এতো প্রেরণা যোগায় কে? উত্তরটা হচ্ছে – পরিবার, বন্ধু, আর হাজার হাজার পরিচিত বা অপরিচিত মানুষদের আর পুরো মুক্তমনা গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সমর্থন আর সমবেদনা (যদিও মেনে নিচ্ছি যে আসলে আমি সমবেদনা পেতে খুব একটা পছন্দ করি না)। মুক্তমনার সঞ্চালক আর উপদেষ্টারা কাজের হাল ধরেছেন, এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অভিজিৎ শুধু লিখেই ক্ষান্ত হয়নি, পুরো সময়টাই সে আমাদের দেশে একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজে ব্যয় করেছে যাতে মুক্তচিন্তা আর বাক-স্বাধীনতার চর্চা করা যায়। কাবেরী গায়েন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক – ওনাকেও হুমকি দেয়া হয়েছিলো। অভিজিতের মৃত্যুর পর আমাকে উনি ব্যক্তিগতভাবে মেসেজ লিখে জানিয়েছিলেন –

“আমি জানি, লেখার বিরুদ্ধে দা ব্যবহার করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। তবু, অভিজিতের মৃত্যুর পর, নাস্তিক আর মুক্তচিন্তকদের পক্ষে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে যে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ছিলো, তা যেন উঠে গেছে। সবদিকে সবাই মুখ খুলছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ লিখছে, প্রতিবাদ সভা করছে, মিছিল করছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমরা সবাই জানি যে, দুনিয়াটা কখনো সরলরেখায় চলে না, বারবার মোড় নেয়, একবার পিছিয়ে যায়, আবার সামনে যায়। রাতারাতি কোনো পরিবর্তন ঘটে না”।

যখনই আমি নিজের ব্যক্তিগত ক্ষতির সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকি, তখনই আমার মনে পড়ে কেন আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে বলার মত একটা প্ল্যাটফর্ম দেয়া হয়েছে। আমার বেশ আরামদায়ক একটা জীবন আছে। বেশ ভালো কিছু বন্ধু আর পরিবারের সদস্য আছে যারা এই খারাপ সময়টায় আমার পাশে থাকবে। কিন্তু যাদের পক্ষে কোনো কণ্ঠ নেই? যাদের কোনো সংস্থা নেই? কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই? যখন হাজার হাজার নারী আর পুরুষকে উত্তাল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে পাচার করা হয়, যখন বাসের মত গণপরিবহনে মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়, যখন আইসিস-এর কসাইরা শিরচ্ছেদ করে, যখন মেয়েদেরকে যৌনদাসী হতে বাধ্য করা হয়, যখন বোকো হারাম শত শত তরুণীকে অপহরণ করে মধ্যযুগীয় স্টাইলে বিক্রি করে দেয়, যখন দারিদ্র্য আক্রান্ত দেশে হাজার হাজার শিশু না খেতে পেয়ে মারা যায় – আমি দেখি, ওদের কোনো কণ্ঠ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মুহূর্তে আমাদের একটা সামষ্টিক দায়িত্ববোধ আর সচেতনতা প্রয়োজন। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, আমাদেরকে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে হবে; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সংযোগগুলো ধরতে হবে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি,পশ্চিম বিশ্বে মানবতাবোধ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে – সেই সুপ্রাচীন এবং বীরোচিত গ্রীস থেকে, মধ্যযুগীয় পারস্য আর মুরের প্রভাব থেকে, রেনেসাঁর সময়ে সনাতন বিষয়গুলোর পুনর্জন্মে, নবজাগরণ আর আলোকিত হবার ধাপ থেকে, ফরাসী বিপ্লব থেকে, শিল্প বিপ্লব থেকে। কিন্তু বিশ্বের অনেক জায়গাতেই, এমনকি বাংলাদেশেও, এই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আর সামাজিক পরিবর্তনগুলোর হাওয়া লাগেনি। একবার ভাবুন তো, গত কয়েক শতাব্দীতে পশ্চিমা বিশ্বে যখন এই পরিবর্তনগুলো ঘটছিলো, তখন বাকি অঞ্চলগুলোতে কী হচ্ছিলো? ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশদের কলোনি! আফ্রিকাকে পদদলিত করে রেখেছিলো বেশ কিছু ইউরোপিয়ান জাতি! আদিবাসীদেরকে খুন করা হচ্ছিলো দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) আমেরিকাতে! এখানেও দাসত্ব আর বর্ণবাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো অনেক ক্ষমতাশালীরাই।

অর্থাৎ, সবখানে পটভূমি মোটেও একই ছিলো না। আর এজন্যেই, কিভাবে একেক দেশে একেক সংস্কৃতিতে মানবতাবাদ পৌঁছাতে হবে, সে নিয়ে আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। কলোনি-পরবর্তী কামালিজম (মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের মতবাদ)-এর মত করে যে কারো ওপর এটা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। আমাদেরকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে বিশেষ কিছু জাতির বিশেষ কিছু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিবর্তনের সূতোগুলো আগে একত্র করতে হবে।

যাই হোক, মাঝে মাঝে, বিশেষ করে গত কয়েক মাসে, আমি নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে ভেবেছি, আমার ক্ষতি নিয়ে ভেবেছি, আমার ক্রোধ নিয়ে ভেবেছি, যেগুলো আমার কাছে বাস্তব আর জরুরি তা নিয়ে ভেবেছি! এখানে অনেক বেশি “আমার, আমার, আমার” অনুভূতি ছিলো! আর ছিলো, এই ব্রহ্মাণ্ড আমার অনুভূতিগুলোর প্রতি কতটা যত্নহীন, কতটা উদাসীন, আর কতটা নির্বিকার! মানবিক মূল্যবোধ আর নির্বিকার ব্রহ্মাণ্ডের এই যে পার্থক্য – এটা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের প্রতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে আমরা আমাদের মনে এই বৈপরীত্যকে স্থান দেবো? আমার বিশ্বাস, তার উপায় দুটো!

এক, এটা বোঝার মাধ্যমে যে নির্বিকার ব্রহ্মাণ্ডের এই উদাসীনতা, আর মূল্যহীনতা, এই শূন্য থেকে নিক্ষেপ করা দৃষ্টি আসলে কিছুই না। কেবলই শূন্য! আর তাই, চিন্তার কিছুই নেই! যা বাকি থাকে, তা হলো – আমরা, আমরা নিজেরা! আমার চিন্তা আর অনুভূতি, আমার ক্ষতি বা আমার অর্জন, আমার জীবনের অর্থ – এগুলোই জরুরি, কারণ মূল্য আছে শুধু এগুলোরই। আর দুই, এগুলোর কোনো মানেই নেই যতক্ষণ না আমরা এই অনুভূতিটাকে মানব পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে না দিচ্ছি। অর্থাৎ, এটা শুধু আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে নয়, বরং একে অপরকে নিয়ে, প্রত্যেকটা পাচারকৃত দাস নিয়ে, প্রতিটি নিহত ব্লগার নিয়ে, প্রতিটি বিধ্বস্ত আর নিঃসঙ্গ মন নিয়ে – সবগুলোই জরুরি, সবগুলোই মূল্যবান!

আমরা এটা কাগজে-কলমে দেখেছি। কিন্তু এখনই, এই মুহূর্তেই আমাদের উচিৎ, হাজার রকম হিংসায় ভরা এই পৃথিবীতে, আন্তর্জাতিক সীমারেখা ভুলে গিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে একটু যত্ন আর সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া – সবার প্রতি, সকল মানুষের প্রতি – সম্পূর্ণরুপে, আত্মবিশ্বাসের সাথে, নৈতিক মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশে ওরা চাপাতির বিরুদ্ধে কলম দিয়ে লড়াই করছে। সবখানেই আমাদেরকে মৌলবাদ আর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে – আবেগ দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, সার্বজনীন মূল্যবোধ দিয়ে, আর সংঘর্ষের স্বরুপ গভীরভাবে উপলব্ধি করে। এটাই মানবতাবোধের জগতে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ!

সবাইকে ধন্যবাদ। – রাফিদা আহমেদ বন্যা

——————
এই লেখাটি ইতোপূর্বে মুক্তমনায় প্রকাশ করেছিলাম। 
ইংরেজি মূল বক্তব্য পড়ুন, মুক্তমনা ব্লগে
বন্যা আপার অনুবাদ ভার্সন, ওনার লেখা ভূমিকা সহ –
মুক্তমনা ব্লগে

1 thoughts on “রাফিদা আহমেদ বন্যার ভলতেয়ার লেকচার

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *