জীবন জীবনের মতই চলে। আর তাই, এমনকি হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর গণহত্যার পরেও, অধিকাংশ নগরবাসী তাদের মূল ঠিকানায় ফিরে এসেছে। ভালোবাসার চেহারাটা পুনরায় দেখার, মায়ের কোলের উষ্ণতাটুকু পাওয়ার, আর এর ভেতরের অন্তর্নিহিত শান্তিটুকু ফিরে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবার হয়তো অন্যান্যবারের তুলনায় বেশি।
তাই আমি কিছু দিন আমার পিতা মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সাথে কাটাতে খুলনার পথে পাড়ি জমালাম। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে বাস আসতে পাঁচ ঘণ্টা (প্রত্যাশিত ছিল!) লেগে গেল। তখন রাত দেড়টা। স্বভাবতই অত্যধিক জনবহুল একটি বাসস্ট্যান্ডে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাসে চড়ার আগে আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে আপনি প্রকৃতিরডাকে সাড়া দিয়েছেন কিনা। কারণ সামনে যে বাস ভ্রমণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তা নিতান্তই অনিশ্চিত সময়ের জন্য। তাই কল্যাণপুর বাস কাউন্টার এর একটি প্রক্ষালন গৃহ থেকেই আমার প্রচণ্ড আতঙ্ক শুরু হলো। অবস্থা যে কত খারাপ ও ভয়ানক ছিল, সেই বর্ণনা এড়িয়ে গেলাম। কারণ এতে আপনার নিশ্চিত বমি আসবে এবং আপনি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বমি করে যাবেন। তারপরও আমি খুশি যে সেখানে অন্তত ‘টয়লেট’ নামের একটা ‘দেয়াল ঘেরা’ স্থান ছিল। যেটা একটু আগে আমাকে দেখতে হলো এবং ঘ্রাণ নিতে হলো সেটা আরও কত খারাপ হতে পারে তা ভেবে ভ্রমণের সময় কম পানি পানের সিদ্ধান্ত নিলাম যাতে প্রস্রাবের বেগজনিত যে ব্যথা তা এড়াতে পারি। কে জানত যে কাহিনী মাত্র শুরু!
যেহেতু সময়টা রমজান মাসের মধ্যে, দয়াময় বাস চালক ও তত্ত্বাবধায়ক মানিকগঞ্জের কোথাও একটা রেস্তোরাঁর পাশে বাস থামানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। লোকজন গাড়ি থেকে নামলো ও প্রথমেই তারা যে জিনিসটা খুঁজতে লাগলো তা ছিল ওয়াশরুম। আমরা মহিলারা একজন স্টাফকে অনুসরণ করলাম যিনি আমাদেরকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলেন যে সেখানে একটা ওয়াশরুম আছে যা মহিলাদের জন্য ‘যথাযথ’। কিন্তু এই ‘যথাযথ’ দ্বারা তিনি কেবল ও কেবলমাত্র ‘দেয়াল ঘেরা’ স্থানকেই বুঝিয়েছেন কারণ বাকিসব ছিল অবর্ণনীয়। অনেকেই ভেতরের অবস্থা দেখে ফিরে এসেছিলো কিন্তু যার একবার প্রস্রাবের বেগ পেয়ে বসেছে সে বাংলাদেশের মধ্যে একটি দীর্ঘ ভ্রমণের পর ‘যথাযথ’ টয়লেট পেয়ে আর অপেক্ষা করার সাহস করতে পারছিলো না।
আমি একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ালেখা করতাম এবং ওখানকার টয়লেট আমাকে বাংলাদেশের সাধারণ শৌচাগার ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়েছিল। যাই হোক, এরপরআমি সরকারী কলেজে পড়েছিলাম, আর আমার সেই ভুল ধারণা ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। আমি কখনোই আমার কলেজের ওয়াশরুমে যেতে পারতাম না, এমনকি জরুরি অবস্থায়ও না। রাজধানী শহরে এই ব্যাপারগুলো অধিকতর খারাপ যেখানে এমনকি একটা ‘দেয়ালঘেরা’ স্থান দিতেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। আমরা এমন একটা রাজধানীতে বসবাস করি যেখানে প্রায় ৫০টি গণ শৌচাগার রয়েছে, যার ৮০ ভাগই প্রায় অকার্যকর অবস্থায়। আজকাল বেসরকারী-সরকারী অংশীদারের সুবাদে শহরে কিছু গণ ও ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার দেখা যায়। যাইহোক এই অত্যধিক ঘনবসতির শহরের তুলনায় এই সংখ্যাটা অতি সীমিত। সীমিত হলেও এই উদ্যোগটি প্রসংশার যোগ্য।
আমার হতাশা নিয়ে লেখার সময়ে, যে মহিলারা, বিশেষত শহরাঞ্চলে, এরকম দুর্দশায় ভোগে তাদের সংখ্যার কিছু উপাত্ত খুঁজেছিলাম; কারণ আমি এ ব্যপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম যে এই সংখ্যাটা ঢাকার গণ শৌচাগারের দুষ্প্রাপ্যতার বিবেচনায় আরো শোচনীয় হবে। আমি কোনো উপাত্ত না পেয়ে কিছুটা আতংকিত হলাম। বাংলাদেশে, ছেলেরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করে তার কারণে মেয়েরা প্রায়ই ছেলেদের জীবন যাপনের ওপর সহজেই হিংসা করার কারণ খুঁজে পায়। ঢাকা শহরে বসবাস করতে গিয়ে আমার ইচ্ছে করে আমি যদি ছেলে হতাম, আর এই ইচ্ছা হওয়ার একমাত্র কারণ যেখানে সেখানে যখন খুশি তখন প্রশ্রাব করার স্বাধীনতা পাওয়া!
মাঝে মাঝেই আমরা বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগ সুবিধার কথা বলি, কিন্তু শৌচকর্ম করার অধিকার একটি মৌলিক ব্যাপার আর প্রতিটি সভ্য শহরের উচিৎ তার নাগরিককে এ কর্ম সম্পাদনের সুযোগ প্রদান করা – ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুব কমই কথা বলি।
লিখেছেন – Anindita Hridita, ২২শে জুলাই
.