শক্তিমান বর্তমান – অনুবাদকদের কথা

(১)

ছোটবেলা থেকেই আমার বিষণ্ণতার বাতিক ছিল। কোনো কাজ না থাকলে নির্জন কোন স্থান খুঁজে গাঢ় বিষণ্ণতার মাঝে হারিয়ে যেতে পছন্দ করতাম। তবে চামড়ার ফুটবল নিয়ে খেলা যতটা মজার, সে জায়গায় লোহার বল নিয়ে খেলা ততটাই কষ্ট। খেলতে খেলতে পা রক্তাক্ত হয়ে গেলেও  এই খেলা থামানোর কোন উপায় নেই। বড় হবার সাথে সাথে আমার বিষণ্ণতা ওজনে আরো ভারী হতে থাকলো। আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে ধরেই নিয়েছিলাম, এই বৃত্তের পরিধির মাঝে কোন ফাঁকফোকর নেই,এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।

আমার জীবনে খুব খারাপ একটা সময়ে এই বইটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। শেষপর্যন্ত অনুবাদের মাধ্যমে এই বইটা আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আমি অবদান রাখতে পারছি, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। বইটা আমার মত অনেক মানুষদের সাহায্য করবে বলে আমার ধারণা।

পুরো বইতে আসলে মূলত একটা ব্যাপারকেই তুলে ধরা হয়েছে, ‘Introspection’, ‘নিজেকে দেখা’। যদিও অনেক বেশি ‘আধ্যাত্মিক’ ভাব নিয়ে বইটা লেখা হয়েছে, তবে প্রবল বস্তুবাদী কারো জন্যেও বইটা পড়তে সমস্যা হবার কথা না। কারণ, ‘নিজেকে ভেতর থেকে দেখার’ মাঝে কোন ‘ভুগিচুগি’ অথবা কোন জ্যোতিষীর তারা গণনার কোন সম্পর্ক নেই। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাইকোলজির বেশিরভাগ তত্ত্বই যদিও এখন বাতিল হয়ে গেছে, ফ্রয়েড তার রোগীদের চিকিৎসায় ছিলেন অতিমাত্রায় সফল। ফ্রয়েডের সাইকোথেরাপির মূলেও ছিল ‘Introspection’। বর্তমান সময়ের সাইকোথেরাপির একটা প্রধান শাখা ‘Cognitive behavioral therapy (CBT)’ এর মূল ধারণাও এটাই। নিজের চিন্তা, আবেগ, এবং নানা মনো-দৈহিক অবস্থাকে ‘নিরপেক্ষ’ দর্শকের বা পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দেখা।

Introspection এর নানা পদ্ধতির মাঝে পার্থক্য আছে। এই বইয়ে যেটা উল্লেখিত হয়েছে তা মূলত বুদ্ধ দর্শনের Introspection এর পদ্ধতিরই পুনরাবৃত্তি।

একার্ট সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থ দিয়ে নতুন কিছু শব্দকে ব্যবহার করেছেন। অনুবাদের সময় অনেক খুঁজেও সেরকম দুটো শব্দের মনমত বাংলা প্রতিশব্দ পাই নি। তাই মূল বইয়ের আগে দুটি শব্দকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করছি।

অহং – বইয়ে মূল ইংরেজি প্রতিশব্দ ছিল ‘Ego’। ইগো বা অহং বলতে লেখক এক মিথ্যা/অলীক সত্তাকে বুঝিয়েছেন, যা আদতে আপনি নন,কিন্তু আপনি এটাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। এই শব্দকে আলাদা করে উল্লেখ করলাম কারণ, ইংরেজিতে ‘ইগো’ শব্দের যা অর্থ, বাংলায় ‘অহং’ আসলে সেই অর্থকে পুরোপুরি ধারণ করেনা, এই বইয়ের কনটেক্সটে তো আরো নয়।

কষ্টসত্তা – মূল ইংরেজি প্রতিশব্দ ছিল ‘Pain body’। ডিকশনারিতে এই শব্দটা পাবেন না, কারণ এটা লেখকের নিজের সুবিধার্থে বানানো নতুন শব্দ। তবে এই পেইন বডি বা কষ্টসত্তা জিনিসটা প্রায় আমাদের সবার জীবনেই আছে, সম্ভবত আপনারও। অতীতের কোন গভীর দুঃখ স্মৃতির মাঝে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে, আর বর্তমানের অভিজ্ঞতার সাথে সেই পুরনো স্মৃতির কোন সংযোগ খুঁজে পেলেই তা আবার নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু করে। মানুষের গভীরে এই জড় হয়ে থাকা দুঃখকেই লেখক বলেছেন ‘pain body’, বাংলায় আমরা যার অনুবাদ করেছি ‘কষ্টসত্তা’।

– সাফাত হোসেন

(২)

ইংরেজিতে Catechism বলে একটা শব্দ আছে, এটার মানে হচ্ছে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা। প্লেটো এই টেকনিক ব্যবহার করেছিলেন, সক্রেটিস এর শিক্ষাগুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য। এই বইতেও একার্ট টোলে কথোপকথনের মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়গুলোর পক্ষে-বিপক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এই কথোপকথনটা কিন্তু মূলত নিজের সাথেই। একটা অংশ আরেকটার বিরোধিতা করে। তাই ইংরেজির ‘you’ কে আমরা বাংলায় “তুমি” ব্যবহার করেছি। নিজেকে নিজে ‘আপনি’ বলার কোনো মানে হয় না।

একার্ট শব্দ নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করে দিয়েছেন। শব্দগুলো কিসের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেটা দেখতে বলেছেন। তার এই বইতে কিছু কিছু শব্দ নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়। অহং আর কষ্টসত্তা শব্দ দুটো নিয়ে সাফাত বলেছে। মন, অস্তিত্ব, অবিসংবাদী, নির্বাণ, আর অচেতনতা নিয়েও কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছি। একার্ট Mind শব্দটা ব্যবহার করেছেন নেতিবাচক অর্থে, যেটার বাংলা আমরা করেছি ‘মন’। ওনার মতে, মন হচ্ছে একটা কৃত্রিম সত্তা, যে আপনাকে বিভ্রমের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। ওনার টেক্সটে, Being একটা ইতিবাচক শব্দ, যেটার বাংলা আমরা ‘অস্তিত্ব’ লিখেছি। ওনার ভাষায়, অস্তিত্ব হচ্ছে আপনার গভীরের প্রকৃত সত্তা। ওনার manifested world কে আমরা বলেছি দৃশ্যমান বস্তুজগত আর Unmanifested কে আমরা লিখেছি অবিসংবাদী জগত। তাই, বইতে যখন দৃশ্যমান বস্তুজগত আর অবিসংবাদী জগত পড়বেন, বুঝে নেবেন যে এগুলোকে একার্ট বিপরীতার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘নির্বাণ’ শব্দটা আমরা লিখেছি ‘enlightenment’ এর বাংলা হিসেবে। এটা দিয়ে বৌদ্ধ দর্শনের নির্বাণের কথাই বলা হচ্ছে, কোনো ধর্মের সাথে এটাকে যুক্ত করা হয়নি। উনি যেটাকে unconsciousness বলেছেন, যেটাকে আমরা অচেতনতা লিখেছি, অনেক সাইকোথেরাপিস্ট হয়তো সেটাকে subconsciousness বলবেন। কিন্তু ঐ যে, শব্দের ব্যবহারিক প্রয়োগটাই দেখতে হবে, আর এই বইয়ের জন্য সেটা একটু আলাদা। অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা ওনার শব্দগুলোর ওপরে নিজেদের রঙ চড়াতে যাইনি।

একার্ট একই কথা বারবার বলেছেন। প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্নভাবে বললেও পাঠকের কাছে ব্যাপারটা পুনরাবৃত্তি বলে মনে হতেই পারে। আমি নিজেও চেষ্টা করেছি, বারবার বলা কথাগুলোর গঠনের মধ্যে ভিন্নতা আনতে। তবু, বারবার বলা এই কথাগুলোর মূল সুর এক। তাহলে কেন উনি এতোবার একই জাতীয় কথা বললেন? কারণ একটাই, উনি ঐ মূল কথাটা পাঠকের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে চেয়েছেন। বইয়ের এক অংশে উনি এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা বলেছেন যিনি তার ২০ বছরের সাধনালব্ধ শিক্ষা একটি লাইনে বলে দিয়েছিলেন। এই পুরো বইয়ের হাজার হাজার লাইনের সারাংশও একটি লাইনে বলে দেয়া সম্ভব। সেই সারাংশটি যাতে কোনোভাবেই আপনার চোখ এড়াতে না পারে, একার্ট সেই ব্যবস্থা করেছেন।

ফেসবুক গ্রুপ অনুবাদকদের আড্ডা-তে, সাফাত হোসেন প্রথম এই বইটা অনুবাদের প্রস্তাব দেয়। বইটা আমার পড়া ছিলো না, তাই প্রথমদিকে কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু বারংবার বলে, প্রায় জোর করেই পড়ালো আমাকে বইটা। ওকে ধন্যবাদ জানাই। বইয়ের বেশ কিছু অংশের সাথে আমি একমত নই, আবার অনেকগুলো কথা আমি অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। কিন্তু একার্টের লেখা, আমার কথার মত অগোছালো নয়। বইটা পড়ে অভিভূত হয়েছি এবং এটা অনেকের কাজে আসবে মনে করেছি বলেই অনুবাদের কাজটা বাস্তবায়ন করেছি। আশা করি, আমাদের প্রয়াস আপনাদের ভালো লাগবে। আদর্শ প্রকাশনীকে ধন্যবাদ, আমাদের প্রয়াস আপনাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

 – ফরহাদ হোসেন মাসুম

|| লেখক পরিচিতি || শক্তিমান বর্তমানের ভূমিকা || প্রথম অধ্যায় || সংগ্রহ করুন ||

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *