কোলরিজের কবিতা: বুড়ো নাবিকের গান (পঞ্চমাংশ)

প্রথম পর্ব।। দ্বিতীয় পর্ব।। তৃতীয় পর্ব।।চতুর্থ পর্ব

আহ ঘুম! একটা প্রশান্তির জিনিস,
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, সবাই তাঁকে ভালোবাসে!
সকল প্রশংসা ঐ মেরি কুইনের জন্যে!
সেই তো স্বর্গ থেকে পাঠিয়েছে এমন প্রশান্তির ঘুম,
যে ঘুম পিছলে ঢুকে পড়েছে আমার আত্মার অভ্যন্তরে।

ডেকের উপর খালি পাত্র গুলো,
অনেকক্ষণ ধরে এমনিই পড়ে ছিলো,
স্বপ্নে দেখলাম, পাত্র গুলো শিশির জলে ভরে গিয়েছিলো;
যখন জেগে উঠলাম, দেখলাম বৃষ্টি হচ্ছিলো।

সিক্ত হয়ে উঠেছিলো আমার দুটো ঠোঁট,
শীতল হয়ে উঠেছিলো আমার গণ্ডদেশ,
ভিজে ছুপছুপে হয়ে গিয়েছিলো আমার শরীরের পোশাক,
নিশ্চয়ই আমি স্বপ্নে জল গিলছিলাম,
এখনো আমার শরীর গিলে যাচ্ছিলো জল।

আমি নড়ে উঠলাম, কিন্তু শরীরের কোনো অঙ্গই অনুভব করলাম নাঃ
শরীরটা অনেক হালকা লাগছিলো— এতই হালকা লাগছিলো যে
মনে করলাম হয়তো আমি ঘুমের মধ্যেই মরে গিয়েছিলাম,
আর এই আমিটা ছিলাম আশীর্বাদপুষ্ট কোনো ভূত।

এবং কিছুক্ষণ পরেই একটা প্রবল বাতাসের আওয়াজ কানে আসলোঃ
বাতাসটা কাছে আসছিলো না;
কিন্তু তাঁর আওয়াজ কাঁপিয়ে তুলেছিলো জাহাজ গুলোকে,
আওয়াজটা খুব তীক্ষ্ণ আর শুষ্ক ছিলো।

উপরের বাতাসটা যেন প্রাণের জোয়ারে ফেটে পড়ছিলো!
আর দেখা যাচ্ছিলো শত শত অগ্নি-পতাকা,
তাঁরা ছুটাছুটি করছিলো এদিক-ওদিক!
এদিকে আর ওদিকে, ভিতরে আর বাহিরে,
মাঝখানে নেচে বেড়াচ্ছিলো ক্লান্ত তারা গুলো।

আর আগত বাতাসটা গর্জে উঠছিলো আরও জোরে,
জাহাজ গুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হোগলার মত,
একটা কালো মেঘের খণ্ড থেকে ঝরে পড়লো বৃষ্টি;
চাঁদটা দাঁড়িয়ে ছিলো তাঁর কিনারায়।
ঘন কালো মেঘটা ছিলো ফাটা আর স্থির,
চাঁদটা ছিলো তাঁর পাশেইঃ
বৃষ্টির ফোটা গুলো যেন উঁচু পাহাড় থেকে ছুড়া একেকটা তীর,
খাঁজ বিহীন বজ্রপাত ধেয়ে আসছিলো নিচে,
একটা ঢালু আর প্রশস্ত নদীতে।

প্রবল বাতাসটা কখনই পৌছুলো না জাহাজটার কাছে,
তবুও জাহাজটা এগিয়ে যাচ্ছিলো!
বজ্রপাত আর চাঁদটার নিচে,
মরা মানুষগুলো গুঙ্গিয়ে উঠলো।

তাঁরা গোঙালো, আড়মোড়া ভাঙ্গলো, সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো,
তাঁদের মুখে কোন কথা ছিলো না, তাঁদের চক্ষুগুলোও ছিলো স্থির;
কী অদ্ভুত ছিলো ব্যাপারটা!
এমনকি স্বপ্নেও এমন ব্যাপার বিশ্বাসযোগ্য নয়।
মরা মানুষগুলোকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা!

চালক নাবিকটা হাত দিলো জাহাজের হালে, চলতে থাকলো জাহাজ;
তখনো কোনো বাতাস বইছিলো না,
সবগুলো নাবিক মিলে আবার দড়ি টানতে শুরু করলো,
তাঁরা যেন অভ্যাসের বসে কাজ করে যাচ্ছিলো,
তাঁরা শরীরের অঙ্গ গুলো নাড়াচাড়া করছিল প্রাণহীন যন্ত্রের মত—
আমরা ছিলাম এক মৃত্যুবৎ নাবিক দল।

আমার ভাইয়ের ছেলের দেহটা
দাঁড়ালো এসে আমার পাশে, হাঁটুর সাথে হাঁটু মিলিয়েঃ
দেহটা আর আমি মিলে একটা দড়ি টেনে তুললাম,
কিন্তু সে আমাকে বললো না কিছুই।

‘তোমাকে আমার ভয় করে, বুড়ো নাবিক!’
শান্ত হও! হে বিয়ের অতিথি!
‘তাঁরা সেই সব আত্মা নয়, যারা পালিয়েছিলো যন্ত্রণায়,
যারা ফিরে এসেছিলো, তাঁরা ছিলো একটা আশীর্বাদপুষ্ট আত্মার দলঃ

যখন ভোর আসলো — তাঁদের বাহু গুলো ঝুলে পড়লো,
তাঁরা গুচ্ছ বদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো মাস্তুলটা ঘিরেঃ
তাঁদের মুখ থেকে ধীরে একটা মিষ্টি শব্দ বেরিয়ে আসলো,
এবং ছাড়িয়ে গেলো তাঁদের শরীর থেকে।

প্রতিটা মিষ্টি শব্দ ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়াচ্ছিলো,
তারপর তীব্র বেগে ছুট দিলো সূর্যের পানে;
শব্দটা ধীরে আবার ফিরে আসলো,
এখন একটা আরেকটার সাথে মিশে হয়ে গেলো একাকার।

মাঝে মাঝে আসমান থেকে একটা পতনের আওয়াজ,
শুনলাম ভরত পাখিটা গেয়ে উঠলো;
মাঝে মাঝে সবগুলো ছোট পাখি গুলো
কিভাবে ভরিয়ে তুলেছিলো সাগর আর বাতাসটা,
তাঁদের মিষ্টি কিচিরমিচিরে!

আর এখন মনে হচ্ছিলো এটা যেন বাদ্যযন্ত্র,
এখন যেন একটা একাকী বাঁশী;
আর এখন এটা যেন একটা পরীর কণ্ঠের গান,
যা স্বর্গগুলোকেও নিস্তব্ধ করে দেয়।

এটা থেমে গেলো; তবুও জাহাজ গুলো চলতে থাকলো,
একটা সুখকর আওয়াজ বেজেই যাচ্ছিলো বিকেল পর্যন্ত,
যেন একটা লুকানো ছোট নদী বয়ে চলছিলো কল কল ধ্বনিতে,
পত্র পল্লব জুন মাসে,
যেন ঘুমন্ত অরণ্যকে শোনাচ্ছিলো
একটা মিষ্টি নরম সুর।

বিকেল পর্যন্ত আমরা নীরবে জাহাজ চালিয়ে গেলাম,
তখনো পর্যন্ত কোনো বাতাস একটা নিঃশ্বাসও ফেলেনি,
ধীরে আর স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো জাহাজটা,
এগিয়ে যাচ্ছিলো নিম্নদেশ থেকে।

জাহাজের তলির নিচে নয় ফ্যাদম গভীরে,
কুয়াশা আর তুষারের দেশ থেকে,
ঢুকেছিলো আত্মাটাঃ এটা ছিলো সেই আত্মা
যে এগিয়ে নিচ্ছিলো জাহাজটা,
সবকটি পালের আওয়াজ থেমে গেলো বিকেলে,
আর জাহাজটাও স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।

মাস্তুলের উপরে ডানদিকটায় ওঠা সূর্যটা,
ঠাঁয় তাকিয়ে রইলো সাগরের পানেঃ
কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যে সে আবার নড়ে উঠলো
একটা ছোট্ট অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে—
সামনের দিকে আর পেছনের দিকে
একটা ছোট্ট অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে।

তারপর একটা অগ্রপদী ঘোড়ার মত,
সে হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে উঠলোঃ
সে রক্ত নিক্ষেপ করলো আমার মাথায়,
এবং আমি নিচে পড়ে গেলাম অজ্ঞানের মত।

কত সময় ধরে আমি এভাবে পড়েছিলাম,
আমি বলতে পারবো না,
কিন্তু তার আগেই আমার জীবন ফিরে আসলো,
আমি শুনলাম আর আত্মায় অনুভব করলাম,
বাতাসে দুইটা কণ্ঠের আওয়াজ।

‘এই কি সে?’ একটা কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘এটাই কি সেই লোক?’
যার তীরের আঘাতে পাখিটা মরেছিলো,
তাঁর নিষ্ঠুর ধনুক সে তাক করেছিলো,
নিরীহ অ্যালবাট্রসের উপর।

যে আত্মা নিজেকে ধরে রেখেছিলো
কুয়াশা আর তুষারের দেশে,
সে পাখিটাকে ভালোবেসেছিলো যে পাখি ভালোবেসেছিলো তাঁকে
যে বিদ্ধ করেছিলো তাঁকে তাঁর ধনুকের তীরে।‘

অন্য কণ্ঠটা একটু নরম প্রকৃতির ছিলো,
ঠিক মধুর ফোঁটার মতই নরমঃ
সে বললো, “লোকটা অনেক শাস্তি পেয়েছে
এবং সে আরও শাস্তি পাবে।“

পঞ্চমাংশের সমাপ্তি (চলবে…)

মূলঃ দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার — স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *