আপনার সন্তান আপনার কাছে কতটা মূল্যবান তা আমরা যেমন কখনোই বুঝবো না, ঠিক তেমনি আমার বোন আমার কাছে কতটা প্রিয় তা আপনারাও অনুধাবন করতে পারবেন না। আমি মোটেও চাই না আমার বোন সামাজিক কথিত প্রথায় নিজের স্বাভাবিক আচরণ লুকিয়ে রেখে ভেতর ভেতর আকাশসম যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে উঠুক। আপনিও অবশ্যই আপনার বোন বা আপনার মেয়ের ক্ষেত্রেও তা চান না। আসুন, আমরা মেয়েদের এই অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা “ঋতুস্রাব” কে অতিরঞ্জিত না করে, এই দিন গুলো যে অন্য আর চার পাঁচটা দিনের মতই স্বাভাবিক তা মন থেকে মেনে নেই (দুর্ভাগ্যক্রমে যারা এখনো মেনে নিতে পারিনি), আর তাদেরকে ঘিরে সমাজে প্রচলিত নোংরা মানসিকতাগুলো গুঁড়িয়ে ফেলি। উক্ত সময়ে যে কোনো প্রকার শারীরিক সমস্যায় ঝাড়ফুঁক না করে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। সমাজকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলুন। বিজ্ঞান চর্চা করুন। কুসংস্কারকে পুড়িয়ে গর্তে রেখে আসুন। সত্যকে গ্রহণ করে নিন।
আমাদের দেশে কিছু স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেক বিজ্ঞাপন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কি এরপরেও পুরোপুরি সচেতন হতে পেরেছি! বিজ্ঞাপনগুলো চলার সময় অধিকাংশ পরিবারেই কম বয়সী ছেলে সন্তানদের’কে বোঝানো হয় না এটা কিসের বিজ্ঞাপন, পরবর্তীতে তারা তাদের বন্ধুদের কাছে শুনে শুনে বড় হয় যে ঐ বিজ্ঞাপনটা ছিল মেয়েদের এক লজ্জাজনক ব্যাপার নিয়ে। মায়েরা এভাবেই নিজের মেয়েকে লজ্জার আঁচলে বেঁধে রাখে, বাবা’রাও অনেক দিনের পুষে রাখা ধারণার কারণে নিজ মেয়ের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে এ সম্পর্কে কখনোই কিছু বলে উঠতে পারে না। ধীরে ধীরে পরিবার থেকে সমাজে পৌঁছায়। তবে এখন অনেকাংশে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। ঐ দিন চলে আসবে খুব শীঘ্রই যেদিন সবাই ঋতুস্রাবের সময়টাতে মেয়েদের প্রতি অনেক যত্নবান হবেন, স্বাভাবিকতা’কে স্বাভাবিক ভাবেই সুদৃষ্টিতে দেখবেন।
বিবিসি নিউজের এশিয়া অঞ্চলের প্রতিবেদন
রুপা ঝা’র প্রতিবেদন
বিবিসি হিন্দি
“মাসিকের সময় আমার অনেক ভোগান্তি হয়েছে, কিন্তু আমার মেয়েকে আমি একটুও ভুগতে দিবো না। আমার সাথে এমন আচরণ করা হতো যেন আমি একজন অস্পৃশ্য ব্যক্তি। আমার স্পর্শে হয়তো তাদের পাপ হবে।”
“রান্নাঘরে ঢোকা আমার জন্যে নিষেধ ছিল, মন্দিরে যেতে পারতাম না, কারুর সাথে বসতেও পারতাম না।”
৩২ বছর বয়সী মঞ্জু বালুনি’র কন্ঠে একটা দৃঢ় সংকল্পের আঁচ ছিল। উত্তরাখান্দ, উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রত্যন্ত এই গ্রামে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। ভারতে সাধারণত মেয়েদের স্বাস্থ্যজনিত ব্যাপারে লোকজন কিছুটা নীরব ভুমিকা পালন করে, বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময়, এ সময়টাতে নীরবতা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ঋতুস্রাব নিয়ে চলতে থাকা অনেকদিনের ট্যাবুগুলো কিছু হাস্যকর লোককথার জন্ম দিয়েছে যেমনঃ এই সময় মেয়েরা অপবিত্র, নোংরা, অসুস্থ এমনকি অভিশপ্তও থাকে।
“উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত”
লোকে মনে করে মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় গোসল করা উচিৎ না এবং এ সময় তারা রক্তহীন্তায় ভুগে। একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে দেখান যে, ৭৫ শতাংশ শহুরে মেয়ে তাদের ঋতুস্রাব জনিত লজ্জার কারণে ন্যাপকিনগুলো কেনার পর বাদামী থলে কিংবা খবরের কাগজে সেগুলো মুড়িয়ে নেয়। তারা কখনোই ন্যাপকিন কিনে দেয়ার জন্য পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কিছুই বলে না।
আমি একটি নারী পরিবেশে বেড়ে উঠেছি কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃতির এই অন্যতম এক স্বাভাবিক ঘটনাটা নিয়ে আমরা কখনোই নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি কোনো কথা বলতে পারিনি। আমার মা বিছানার চাদর কেটে একটি বাক্সে লুকিয়ে রাখতো, আর সেগুলো তার চার মেয়ের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হতো। এই কাপড়ের টুকরোগুলো শুকানোটা ছিল এক বিশাল যুদ্ধে লড়াই করার মতো। আমার পরিষ্কার মনে আছে, পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়ে আমি অনেক উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত থাকতাম।
আমার বড় বোন আমাকে শিখিয়েছিলেন কেমন ক’রে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই দাগযুক্ত কাপড়গুলো অন্য কাপড়ের মাঝে চট জলদি ঢুকিয়ে ফেলতে হয়। এই কাপড়গুলো বাইরে রেখে রোদে শুকানোর ঝুঁকি তো আমরা কখনোই নিতাম না।
“মাত্রাতিরিক্ত নোংরা মনে করা”
মাসিকের সময় তারা একটা অনার্দ্র পরিবেশে থাকে, দুর্গন্ধ পুষে রাখে নিজেদের সাথে। অস্বাস্থ্যকর কাপড়গুলো তাদেরকে বারবার পড়ানো হয় যতদিন না মাসিক শেষ হয়।
পানির অভাবে এসব পরিষ্কার করাটা আরো বেশি কষ্টকর হয়ে যায় এবং একটি অস্বাস্থ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। ভারতীয় মহিলাদের কাছে এই গল্পটা প্রতিনিয়ত একই রকম ক’রে আবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রতি অনেক গবেষণায় দেখা গেছে মাসিকের সময় মেয়েদের ওপর এসব বেঁধে দেওয়া নিয়মগুলো তাদেরকে ভীষণ ক্ষতিকর রোগের দিকে ধাবিত করে। একটা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ভারতের প্রতি পাঁচজন বালিকার মধ্যে অন্তত একজন স্কুল ছেড়ে দেয়, কারণটা এই ঋতুস্রাব।
“মার্গদারশী” পনেরো বছরের একটি মেয়ে, উত্তরাকাশী নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে। সে স্কুলে যেতে বেশ পছন্দ করে, যদিও এই বিস্তৃত বন্ধুর পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে যাওয়াটা অনেক কষ্টের তবুও সে কখনো স্কুল কামাই দেয় না। তবে গত বছর তার যখন প্রথম বারের মত ঋতুস্রাব হয় তখন সে পড়াশুনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল।
“বড় সমস্যা ছিল এটার সাথে মানিয়ে চলা। এখনো অবশ্য একই অবস্থা। আমার লজ্জা লাগে, রাগ হয় এবং খুব নোংরা মনে হয় নিজেকে। তাই আমি ঋতুস্রাবের শুরুর দিকে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
“একটি মানবিক দিক”
মেয়েটি ডক্টর হতে চায় এবং জীববিজ্ঞান ক্লাসে যখন ঋতুস্রাব প্রক্রিয়াটা পড়ানো হয় তখন ছেলেদের হাসি দেখে সে আশ্চর্য হয়, কেন তারা এসময় ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে!
“এই বিদ্রূপ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি মনে করি এই সম্পর্কে কথা বলার সময় আমাদের আরো স্বচ্ছন্দ্য বোধ করা উচিৎ।”
গুঞ্জ নামক একটি এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা আনশু গুপ্তা মনে করেন সমস্যাগুলো নিহিত আছে এমন একটি জায়গায় যেখানে আমরা এই ব্যাপারটিকে নারী সম্পর্কিত বিষয় বানিয়ে ফেলেছি।
“এটা নারী সম্পর্কিত বিষয় নয়। এটা একটি মানবীয় বিষয় কিন্তু আমরা সেটাকে আলাদা করে অবলোকন করছি। অত্যন্ত ঘৃণিত, লজ্জাজনক এবং নীরবে সয়ে যাওয়া এই প্রথার মূল উৎপাটন করার জন্য আমাদের ভেতর থেকেই কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। এই বেড়াজাল ভাঙতে হবে।”
কিছু এনজিও ঋতুস্রাব সম্বন্ধীয় প্রচলিত লোককথা এবং নীরবতা ভাঙার জন্য লোকজনকে শিক্ষা দিয়ে আসছে নিয়মিত। “গুঞ্জ” এরকম একটি এনজিও।
বর্তমানে গুঞ্জ ভারতের ত্রিশটি প্রদেশের মধ্যে ২১ টিতে কাজ করছে।
এই এনজিও’টি ৭০ শতাংশ ভারতীয় মহিলা যাদের নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর ন্যাপকিন ব্যবহার করার সুযোগ নেই তাদের কাছে সুলভ মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দিচ্ছে। এই ন্যাপকিনগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অব্যবহৃত কাপড় থেকে তৈরি করা হচ্ছে।
“কাল্পনিক লোককথা’কে ভেঙে ফেলা”
অন্যান্য উঠতি উদ্যেগতারা ঋতুস্রাব নিয়ে এই ট্যাবুগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। চার ভারতীয় নাগরিক মেন্সট্রুপেডিয়া নামক এক ওয়েবসাইট চালাচ্ছে যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে “ঋতুস্রাবকে ঘিরে যাবতীয় কুসংস্কার গুঁড়িয়ে ফেলা আর স্বাভাবিক বোঝাপড়া” এ ওয়েবসাইটে তারা বয়ঃসন্ধি কাল, ঋতুস্রাব এবং স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নিয়ে নানা ধরনের কমিক্স বই এবং ছোট ছোট প্রবন্ধ বের করে। প্রতিমাসে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ তাদের ওয়েবসাইটটি পরিদর্শন করেন।”
তামিল নাড়ুতে স্কুল ছেড়ে দেয়া এক মেয়ে খুব সাধারণ যন্ত্র দিয়ে সুলভ মূল্যের স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানো শুরু করে। যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সুলভে এই কার্যক্রম প্রথম শুরু করেন তিনিও তাদেরই একজন। একজন মুরুগানাথাম বলেন স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির কাঁচামাল আমাদের খাস কামরা থেকেই বের করতে হবে।
ভারতে একজন মেয়ে হিসেবে তার সবকিছুকে ভাল চোখে দেখা এখনো অতটা সহজাত হয়ে ওঠেনি এবং এটা খুব দ্রুত বদলাবেও না। কিন্তু ধীরে ধীরে মেয়েরা তাদের জীবনযাত্রার ভারগুলো গ্রহণ করা শুরু করেছে। অধিকাংশ মেয়েই এখন আর মাসিকের সময় ঘরে বসে থাকে না, তারা বাইরে যেতে পারে, বিভিন্ন কাজ করতে পারে বা পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে পারে একই সাথে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে তারা কোনো ধরনের বিব্রতবোধ ছাড়াই ইদানীং এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করেছে।
খুব সুন্দর লিখা। সময়োপযোগী।
খুব সুন্দর একটা পোস্ট। ধন্যবাদ অনুবাদের জন্য।
পিরিয়ড নিয়ে আমি নিজেও লিখতে চাচ্ছিলাম। বিশেষ করে, আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে পিরিয়ডের সময় যে অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয় (একই কাপড় বারবার ব্যবহার করা, ঠিকমতো না ধোয়া, রোদে না শুকানো) এবং যে কুসংস্কারের শিকার মেয়েরা হয়, সেগুলো নিয়ে।