সকাল থেকেই আকাশটা মুখ কালো করে বসে আছে। দিনটাও থম ধরে আছে। একটা ঝিম ধরা দুশ্চিন্তায় হাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মাঠের ওপর মেঘগুলো এমনভাবে ঝুলে আছে যেন এই বুঝি ঝেঁপে বৃষ্টি আসবে। কিন্তু সেই বৃষ্টি আর আসে না। আইভান ইভানোভিচ আর বর্কিন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আইভান ইভানোভিচ পেশায় পশু সার্জন আর বর্কিন স্কুল-শিক্ষক।
মরার মাঠ দেখি শেষই হয় না! ওই দূরে মিরৌসকি গ্রামের বায়ু কল দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে পাহাড়ের সারি বিস্তীর্ণ হতে হতে গ্রামের পেছনে যে জায়গাটায় হারিয়ে গেছে, নদীটা এসে ঠেকেছে সেখানেই। জায়গাটা ওদের চেনা। শ্যামল তৃণভূমি, সবুজ উইলো বৃক্ষ, আর কতকগুলো খামারবাড়ি দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের ওপরে উঠলে আদিগন্ত মাঠ, টেলিগ্রাফ পোস্ট, আর রেলগাড়ি দেখা যায়! শুয়োপোকার মত গড়িয়ে গড়িয়ে চলা রেলগাড়ি। আবহাওয়া ভালো থাকলে দূরের শহরটাও দেখা যায় মাঝে মাঝে। ওরকম আবহাওয়ায় আইভান ইভানিচ আর বর্কিন মাঠ আর ঘাসের মধ্যে ডুবে যায়, গ্রামের সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়।
“আগের বার যখন এই এলাকায় এসেছিলাম, তখন কী যেন একটা গল্প শোনাবে বলেছিলে”, বর্কিন বললো।
“ও হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের গল্প বলতে চেয়েছিলাম”।
আইভান ইভানিচ লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো, পাইপে তামাক ঠেসে আগুন ধরালো। গল্প বলা শুরু করবে, এমন সময় ঝিরঝির বৃষ্টি নেমে এলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝিরঝির হয়ে গেলো ঝুমঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কাছেই কিছু কুকুর দু পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো।
“কোথাও থামা উচিৎ”, বর্কিন বললো, “আলিওখিনের বাড়ি কিন্তু কাছেই, যাবে নাকি?”
“চলো”।
খড় ভর্তি একটা মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলো ওরা, এরপর বামে মোড় নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলো। একটু পরেই রাস্তার দু পাশে পপলার গাছের সারি দেখা যেতে লাগলো। চোখে ভেসে এলো বাগান আর গোলাঘরের লাল ছাদ। নদীর পানি ঝিলিক দিয়ে উঠলো। অবশেষে খামারবাড়ি আর গোসলখানা দেখা গেলো। আলিওখিন তার বাড়ির নাম রেখেছে সোফিনো।
কারখানায় ঘানি টানার শব্দে বৃষ্টির আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। শক্তসমর্থ কিছু মরদ মাথার ওপর বস্তা নিয়ে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। সবদিক ভেজা, কাদামাখা, আর অস্বস্তিকর। নদীটাকেও দেখতে কেমন শীতল আর ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আইভান ইভানিচ আর বর্কিন ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। এতক্ষণ ধরে কাদায় হেঁটে এসেছে বলে পা দুটো আর নড়তে চাইছে না। তবু আরেকটু হেঁটে বাঁধ পার করে গোলাঘরে চলে এলো। একদম নিঃশব্দে; দেখে মনে হবে যেন দুজন একে অপরের সাথে রাগ করে আছে।
গোলাঘরগুলোর একটায় ঘ্যান ঘ্যান শব্দে মেশিন চলছে, ধুলো ছড়াচ্ছে সবদিকে। মেশিনের এক প্রান্তে স্বয়ং আলিওখিন দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, একহারা লম্বা গড়ন, লম্বা চুল। কৃষকের চেয়ে অধ্যাপক বা শিল্পী হলে বরং বেশি মানাতো। ঝুলকালিমাখা একটা শার্ট, কোমরবন্ধনী, আর প্যান্টের বদলে পায়জামা পরে আছে সে। শার্টটা কোনো একসময় সাদা ছিলো। জুতোজোড়াও কাদা আর খড় দিয়ে ঢেকে ময়লা হয়ে আছে। নাক আর চোখ ধুলো লেগে কালো একদম। সে আইভানকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে মনে হলো।
“বাসায় গিয়ে বসো, আমি এক্ষুণি আসছি”, সে বললো।
বেশ বিরাট বাসা, দু তলা। নিচতলায় তালা দেয়া দুটো রুম আছে, আলিওখিন ওখানেই থাকে। রুমগুলোর জানালা একদম ছোটো ছোটো, যেন খামারে কাজ করা কিশোরদের হাতের মাপে বানানো। খামারবাড়িটা বড় হলেও এমনিতে বেশ সাদামাটা। পুরো ঘর জুড়ে পাউরুটি, ভোদকা, আর চামড়ার গন্ধ। কোনো অতিথি না এলে ওর বৈঠক কক্ষটা ব্যবহার করা হয় না, বোঝাই যায়। বৈঠকখানার দেয়ালে অনেকগুলো ছবি টাঙানো, সোনালি ফ্রেম দেয়া। ছবিগুলো থেকে আলিওখিনের পূর্বপুরুষরা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা কাজের মেয়ে এসে আইভান ইভানিচ আর বর্কিনকে বসতে বললো। মেয়েটাকে দেখে দুজনই থমকে গেলো, একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। কী সুন্দর মেয়ে রে, বাবা!
“তোমরা আসাতে কী যে খুশি লাগছে”, আলিওখিন প্রায় ওদের পেছন পেছন বৈঠক কক্ষে ঢুকলো। “ও, পেলাজিয়া, তুইও এখানে? আমার বন্ধুদেরকে নতুন জামাকাপড় দে। আর আমিও কাপড় পাল্টাব। কিন্তু আগে গোসল করবো। কয় মাস আগে গোসল করেছিলাম, ভুলেই গেছি! আর তোমরা কেউ আমার সাথে গোসলখানায় যাবে নাকি? ততক্ষণে আমাদের জিনিসগুলো রেডি হয়ে যাবে।”
সুন্দরী পেলাজিয়া তোয়ালে আর সাবান নিয়ে এলো। কী স্নিগ্ধ একটা মেয়ে! আলিওখিন অতিথিদেরকে গোসলখানার দিকে নিয়ে গেলো।
“আসলেই অনেকদিন গোসল করা হয়নি। আমাদের গোসলখানা কিন্তু বেশ! বাবা আর আমি দুজনে মিলে বানিয়েছিলাম। কিন্তু গোসল করার সময় করে উঠতে পারি না কেন যেন!”
সে সিঁড়িতে বসে সাবান-পানি দিয়ে চুল আর ঘাড় ঘষতে লাগলো। বাদামী রঙের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর চারপাশে। “হে হে, দেখলে তো! বলেছিলাম না, অনেকদিন গোসল করা হয়নি!” বলে সে আবার সাবান মাখতে লাগলো আর আশেপাশের পানির রঙ কালির মত গাঢ় নীল হয়ে গেলো।
আইভান ইভানিচ গোসলখানার ছাউনি থেকে বেরিয়ে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিল, বৃষ্টির মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগলো। পাখির ডানার মত হাত দুটো ঝাপটে পানির মধ্যে ঢেউ তুলতে লাগলো। পুকুরের মাঝামাঝি গিয়ে ডুব দিলো, কিছুক্ষণ পর আরেক জায়গা থেকে তার মাথা উঁকি দিলো। সাঁতার, ডুব সাঁতার, চলতে লাগলো। সে পুকুরের তলার মাটি স্পর্শ করতে চাচ্ছিলো। “আহ, কী শান্তি!” সে আনন্দে আত্মহারা। “কী যে শান্তি!” সে গোলাঘরের দিকে সাঁতরে গেলো, অন্যদের সাথে কথা বলে ফিরে এলো, এরপর চিৎ হয়ে ভেসে রইলো। তার মুখে বৃষ্টির পানির মৃদু আঘাত উপভোগ করতে লাগলো। বর্কিন আর আলিওখিন জামাকাপড় পরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু ইভানিচ তখনো সাঁতার আর ডুব সাঁতার চালিয়ে যাচ্ছিলো, “শান্তি, কী যে শান্তি!”
“অনেক হয়েছে, এবার চলো”, বর্কিন চিৎকার করলো।
ওরা বাসায় ফিরে গেলো। আইভান ইভানিচ গল্পটা শুরু করার আগে ওপরতলার বৈঠক কক্ষের আলো জ্বালানো হলো। বর্কিন আর আইভান দুজনেই রেশমী কাপড়ের গাউন আর চপ্পল পরে আরাম কেদারায় বসলো। আলিওখিন পরিষ্কার শুকনো জামা আর চপ্পলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে পায়চারি করতে লাগলো। সুন্দরী পেলাজিয়া কার্পেটের ওপর মৃদু পায়ে, প্রায় নিঃশব্দে, চা আর নাস্তা রেখে গেলো। এতক্ষণে আইভান তার গল্প শুরু করলো। ওর বসার ধরনটা এমন যেন শুধু বর্কিন আর আলিওখিন নয়, দেয়ালে ঝুলতে থাকা ছবিগুলোর সবাই কান পেতে আছে।
“আমরা দুই ভাই। ভাইটা আমার দু’বছর ছোটো, ওর নিকোলাই ইভানিচ। আমি পড়াশোনার রাস্তা ধরলাম, পশু সার্জন হলাম। নিকোলাই উনিশ বছর বয়সেই রাজস্ব বোর্ডে চাকরিতে ঢুকলো। আমাদের বাবা ক্যাডেট হয়ে আর্মিতে ঢুকেছিলেন, অবসর নিয়েছিলেন বড় অফিসার হয়ে। ওনার নাম ছিল চিমশা হিমালয়স্কি। মৃত্যুর পর ওনার সম্মান আর সম্পত্তি দুটোই উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের কাছে চলে আসে। অবশ্য বাবার বেশ কিছু ধার ছিলো, সেগুলো মেটানোর জন্য সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো। কিন্তু বিক্রি করে দেয়ার আগে পর্যন্ত আমরা সেই গ্রামের বাড়িটাতেই ছিলাম। আমরা দুই ভাই এত বেশি বাইরে ঘুরতাম, যেন আমাদের ঘরবাড়ি বলতে কিছু ছিলো না। আমরা মাঠে আর বনে ঘুরে ঘুরে দিনরাত কাটিয়ে দিতাম, ঘোড়া দেখাশোনা করতাম, লেবু গাছের বাকল ছিঁড়তাম, মাছ ধরতাম, আরো কী কী যে করতাম! একবার যে নিজ হাতে মাছ ধরেছে, অথবা গ্রামের স্নিগ্ধ শরতের আকাশে এক ঝাঁক পাখিকে একই ছন্দে উড়তে দেখেছে, সে আর কোনোদিন শহুরে হতে পারবে না, গ্রাম ওর পিছু ছাড়বে না। আমার ভাই শহরে রাজস্ব বোর্ডের অফিসে মন খারাপ করে বসে থাকে। বছরের পর বছর একই জায়গায় বসো, একই কাগজে একই জিনিস লিখো, কাঁহাতক সহ্য করা যায়! সে দিন গুণতে থাকে, কবে সে গ্রামে ফিরে যাবে! আস্তে আস্তে ওর অবসাদ একটা জেদে পরিণত হয় – কোনো নদী বা হ্রদের ধার ঘেঁষে সে একটা খামারবাড়ি কিনবেই কিনবে।
“আমার ভাইটার মন ভালো, ওকে ভালোওবাসি অনেক। কিন্তু একটা খামারবাড়িতে নিজেকে আটকে ফেলার ইচ্ছাটা কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি। একটা প্রবাদ আছে না, ‘মানুষের আর লাগে কী? সাড়ে তিন হাত জমি’।? কিন্তু সেটা তো লাশের জন্য লাগে, মানুষের জন্য না! অনেক পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ জমিজমা কিনতে বলে, ভিটেমাটি কিনতে বলে। কিন্তু ঘুরেফিরে সাড়ে তিন হাত জমিতে এসে থামে। শহর ছেড়ে দিয়ে অথবা জীবনযুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে একটা খামারবাড়িতে নিজেকে আটকে ফেলা তো জীবন না। এ তো অলসতা, স্বার্থপরতা, হাল ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করা। সাড়ে তিন হাত না, পুরো খামারবাড়িও না, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাইলে লাগবে গোটা পৃথিবী, পুরো মহাবিশ্ব, যেখানে সে প্রাণখোলা স্বাধীনতায় তার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আর গুণগুলো প্রকাশের সুযোগ পাবে।
“আমার ভাই, নিকোলাই, অফিসে বসে বসে ভাবতো, কবে সে তার নিজের খামারে চাষ করা সবজির স্যুপ খেতে পারবে, কবে সেই স্যুপের গন্ধ পুরো খামারে ম-ম করবে। ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে না, ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে খাবে, ওখানেই সূর্যের আলোর কম্বলে ঘুমিয়ে যাবে। উঠোনে বসে মাঠ আর বনের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেবে। অবসরে সে শুধু চাষবাষের ওপর বই পড়তো আর সেখান থেকে দেখে দেখে পঞ্জিকাতে জরুরি তারিখগুলো দাগাতো। পত্রিকাও পড়তো, কিন্তু শুধু জমি বিক্রির বিজ্ঞাপনগুলো। অমুক জায়গায় এত এত একর চাষের জমি আর ঘাসজমি বিক্রি হচ্ছে, সাথে ইয়া বিশাল খামারবাড়ি, এত বড় বাগান, গোলাঘর, এই বড় পুকুর, পাশে নদী! গন্ধরাজের ঝোপ, ফুল, ফল, পাখির বাসা, পুকুরের মাছ, এসবের স্বপ্ন দেখতো। বিজ্ঞাপনের সাথে স্বপ্নগুলোও একটু একটু বদলে যেত, কিন্তু সবগুলো স্বপ্নেই একটা আমলকির ঝোপ থাকতো। যে বাড়িই হোক, যে বাগানই হোক, আমলকির ঝোপ ছাড়া সে ওই জায়গাগুলো চিন্তা করতে পারতো না।
“ও বলতো, ‘গ্রামে জীবন কাটানোর একটা সুবিধা আছে। নিজের বারান্দায় বসে চা খাও, খেতে খেতে নিজের হাঁসগুলোকে নিজের পুকুরে সাঁতার কাটতে দ্যাখো! কোথাও কোনো বাজে গন্ধ নেই। আর আমলকি খাও!’
“সে নিজে নিজে ভিটেমাটি আর খামারবাড়ির নকশা করতো। আর এই জিনিসগুলোই নকশায় থাকতো- গোলাঘর, কুঁড়েঘর, সবজির বাগান, আর আমলকির ঝোপ। সে একদম গরীবদের মত থাকতো, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতো না, ভিখারিদের মত কাপড়চোপড় পরতো। আর জমানো সব টাকা নিয়ে ব্যাংকে রাখতো। একদম কিপ্টে কিসিমের লোক ছিলো। ওকে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যেতো। ওকে ছুটি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে আসার জন্য টাকা দিতাম, সে ওগুলোকেও নিয়ে ব্যাংকে ঢোকাতো। একবার মাথায় কিছু একটার ভূত চাপলে সেটা নামানো মুশকিল!
“অনেক বছর এভাবেই কেটে গেলো। ওর বদলি হয়ে গেল আরেক অঞ্চলে। চল্লিশ বছর সে কাটিয়ে দিলো রাজস্ব বোর্ডে চাকরি করে, জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন পড়ে, আর ব্যাংকে টাকা জমিয়ে। একদিন শুনলাম, সে বিয়ে করেছে। আমলকির ঝোপওয়ালা বাড়ি কেনার জন্য সে এক অসুন্দর বুড়িকে নিয়ে করেছে। বুড়ির জন্য ওর মনে কোনো ভালোবাসা ছিল না। কিন্তু মহিলা টাকা পয়সাওয়ালা। সে এরপরেও কিপটের মত চলতো, বউকে আধ-খাওয়া রাখতো, বাকি টাকা ব্যাংকে ঢোকাত। মহিলা একসময় পোস্টমাস্টারের বৌ ছিলো, শৌখিন জীবনযাপন করতো। অথচ দ্বিতীয় জামাইয়ের ঘরে পোড়া রুটিও ঠিকমত খেতে পেত না। তিন বছরের মাথায়, মহিলা মারা গেলো। আমার ভাই এই ঘটনায় একবারের জন্যেও নিজেকে দোষ দেয়নি। টাকা আর মদ, এই দুই জিনিসের নেশা বড় খারাপ! আমাদের গ্রামে এক বেনিয়া ছিল। মরার সময় ব্যাটা মধু খেতে চাইলো। ওই মধু দিয়ে সে তার সব দলিল খেয়ে ফেললো। আরেকবার এক রেল স্টেশনে আমি কিছু গরুর পরীক্ষা করছিলাম। ওখানে ইঞ্জিনের নিচে পড়ে এক ঘোড়া বিক্রেতার পা কেটে গেলো। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ওকে ওয়েটিং রুমে নিয়ে গেলাম। সবদিকে রক্তারক্তি হয়ে কী যে একটা অবস্থা! আর পুরোটা সময় সে শুধু তার পায়ের খোঁজ করছিলো। কারণ, ওই পায়ের জুতার পঁচিশ রুবল আছে, সেটা উদ্ধার করতে হবে!
“আজাইরা কথা বলছো কিন্তু”, বর্কিন বললো।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে আইভান ইভানিচ আবার শুরু করলো, “বৌ মারা যাওয়ার পর, আমার ভাই আরেকটা বাড়ি খোঁজা শুরু করলো। ভালো জমিওয়ালা বাড়ি পাওয়া যে কী মুশকিল, তা তো জানোই। অনেকে চার-পাঁচ বছর তন্নতন্ন করে খুঁজেও শেষ পর্যন্ত নকল সোনা কিনে ফেলে। এক দালালকে ধরে আমার ভাই আরো কিছু ধারের ব্যবস্থা করলো, এরপর তিনশ একরের একটা সম্পত্তি কিনলো। খামারবাড়ি ছিলো, একটা কুঁড়েঘর ছিলো, হাঁটাহাঁটি করার জন্য বেশ জায়গাও ছিলো। কিন্তু কোনো ফলের বাগান ছিলো না, কোনো আমলকির ঝোপ ছিলো না, পুকুরও ছিলো না। পাশ দিয়ে একটা নদী ছিলো, কিন্তু নদীর পানির রঙ ছিলো কফির মত। কারণ, ওর জমিদারির এক পাশে ছিলো ইটের ভাটা, আরেকপাশে আঠা তৈরির কারখানা। কিন্তু আমার ভাই এসব নিয়ে মাথাই ঘামালো না। সে বিশটা আমলকির ঝোপ বানানো শুরু করলো আর ওখানেই নিজের তালুকের তালুকদার হয়ে বসে গেলো।
“গত বছর গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। ভাবলাম, একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি। চিঠিতে নিজের তালুকের নাম চিম্বারশভ কর্নার আর হিমালয়স্কি দুটোই লিখেছিলো। খুঁজে পেয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। কী গরম! বেশ কিছু ডোবা, বেড়া, সারি সারি নতুন দেবদারু গাছ দেখলাম। সবদিকেই অনেক অনেক গাছ। কোনটা যে রাস্তা, বলার উপায় নেই। কোথায় যে ঘোড়াটাকে বাঁধবো, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। দেখি, লাল রঙের একটা কুকুর, বেশ মোটা, শুয়োর সাইজের। আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে গিয়েও থেমে গেলো। নির্ঘাত আলসেমির জন্য। রান্নাঘর থেকে বাবুর্চি বের হয়ে এলো, খালি পা, সেও শুয়োরের মত মোটা। বললো, মালিক ভাতঘুম দিয়ে উঠেছেন, এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম, আমার ভাই বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। হাঁটু পর্যন্ত কম্বল টানা। চেহারায় বয়সের ছাপ, ওজন বেড়েছে, থলথলে হয়ে গেছে। গাল, নাক, ঠোঁট, সব কেমন যেন ঝুলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিলো, এখনই শুয়োরের মত ঘোঁতঘোঁত করে উঠবে।
“আমরা কোলাকুলি করলাম। প্রথমে কিছুক্ষণ আনন্দে কান্না করলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কান্না করলাম – যৌবন পার করে এসে এখন পাকা চুল নিয়ে মৃত্যুর দিন গুণছি, এই দুঃখে। সে কাপড় পরলো আর আমাকে ওর তালুক দেখাতে নিয়ে গেল।
‘তো, দিনকাল যাচ্ছে কেমন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আলহামদুলিল্লাহ, চমৎকার।’
“সে আর আগের সেই গরিব, ক্লান্ত সরকারি কর্মকর্তা নেই। সে এখন সত্যিকারের জমিদার, ওর হুকুমের দাম আছে। জায়গাটাতে ও মানিয়ে নিয়েছে মনে হচ্ছে। সে বেশ ভালোই খায়, আয়েশ করে গোসল সারে। ওর গায়ে মাংস আর চর্বি লেগেছে। ইতোমধ্যেই সে দুটো কারখানার সাথে মামলা করতে আদালতে গেছে। এলাকার গরীবরা তাকে ‘জমিদার সাব’ বলে সম্বোধন না করলে তার আত্মসম্মানে লাগে। নামীদামী জমিদারদের মত সেও দান-খয়রাত করে, কিন্তু বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। দান-খয়রাতের ধরন শোনো। গরীবদের সকল রোগ-শোক দূর করার জন্য সে সোডা আর ক্যাস্টর তেল বিলি করে। আর নিজের জন্মদিনে গ্রামের একদম মাঝখানে প্যানেল টেনে সবাইকে আধ বালতি ভোদকা বিতরণ করে। ওর মতে, এটাই নাকি করা উচিত! আহ, ভোদকার বালতি! জমিদারেরা একদিন এসব গরীবকে ধরে আদালতে নিয়ে যায় বিনা অনুমতিতে তাদের জমিদারিতে প্রবেশ করার জন্য, আবার পরের দিন কোনো ছুটির উসিলায় এদেরকে ভোদকা খাওয়ায়! গরীবরাও আবার ‘ইয়াহু’ বলে সেটা পান করে, মাতাল হয়ে জমিদারের জুতা চেটে দেয়। ভালো খেতে পারলে আর অলসতা করার মত বিলাসিতা থাকলে যে কোনো রাশিয়ানের মাথায় হামবড়া ভাব জেঁকে বসে। আমার রাজস্ব বোর্ডে চাকরি করে খাওয়া ভাই, যে আগে কোনোদিন কোনো ব্যাপারে মতামত পর্যন্ত দিতো না, এখন তার এমন ডাঁট যেন ‘আমি যা বলি, সেটাই আইন’। যেমন, ‘শিক্ষা জিনিসটা সবার দরকার, কিন্তু সবার পেটে সয় না’, অথবা ‘মৃত্যুদণ্ড জিনিসটা এমনিতে ক্ষতিকর, কিন্তু মাঝে মাঝে অবশ্য না হলেই নয়’। ‘আমি মানুষ চিনি, বুঝলে! কার সাথে কেমন করে চলতে হয়, সেটা আমি জানি। এরা সবাই আমাকে সমীহ করে। আমি আঙুল তুলবো, আর সাথে সাথে সেটা হয়ে যাবে’।
“এ ধরনের সব কথাই সে খুব জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব আর মুখে হাসি নিয়ে বলে। প্রত্যেক কথার মধ্যে ‘আমাদের মত অভিজাত লোকেরা’ অথবা ‘একজন অভিজাত লোক হিসেবে আমার মনে হয়’ টাইপের কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়। আমাদের দাদা যে কৃষক আর বাবা যে সাধারণ সৈনিক ছিলেন, সেটা আর তার মাথায় নেই। এমনকি আমাদের বংশের পদবী ‘চিমাচা হিমালয়স্কি’ নামটাও এখন তার কাছে ভরাট, আভিজাত্যপূর্ণ, আর শ্রুতিমধুর মনে হয়।
“ভাইকে নিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম, কিন্তু আমার আসল কথাটা আসলে আমার নিজেকে নিয়ে। ওর বাসায় মাত্র কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমার মধ্যে যে কী রকম একটা পরিবর্তন চলে এসেছিলো! সন্ধ্যার দিকে চা খাচ্ছিলাম, বাবুর্চি এসে প্লেটে করে বেশ অনেকগুলো আমলকি দিয়ে গেলো। বাজারের কেনা আমলকি না, ওর নিজস্ব বাগানের আমলকি। লাগানোর পর এই প্রথম এগুলো তোলা হয়েছে। নিকোলাই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো। এরপর মিনিট কয়েক টলটলে চোখ নিয়ে প্লেটের দিকে চেয়ে রইলো। উত্তেজনায় ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছিলো। এরপর সে একটা আমলকি মুখে পুরে বিজয়ীর বেশে আমার দিকে তাকালো। যেন কোনো ছোট বাচ্চা অনেকদিন অপেক্ষার পর নিজের প্রিয় খেলনা ধরার অনুমতি পেয়েছে।
” ‘কেমন, হুম?’ একটার পর একটা খেয়ে যেতেই লাগলো, আর বলতে লাগলো, ‘আহ, কী মজা! আরে, খেয়েই দ্যাখো না!’
“শক্ত, টক। কিন্তু পুশকিন সাহেব তো বলেই গেছেন, দশ হাজার সত্যির চেয়ে নিজের তৈরি আনন্দের মায়াজালকে আমরা বেশি ভালোবাসি। আমার চোখের সামনে তখন একজন সুখী মানুষ, ওর সারাজীবনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, তার জীবনের লক্ষ্য হাসিল হয়েছে, সে নিজেকে আর নিজের ভাগ্যকে নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট। কিছুটা দুঃখের মিশ্রণ ছাড়া আমি মানবজীবন জিনিসটা কল্পনা করতে পারতাম না। অথচ চোখের সামনে একজন সুখী মানুষকে দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন একটা হতাশায় ঢেকে গেলো। রাতে ঘুমাতে গিয়ে সেই হতাশাটা আরো ভালোভাবে জেঁকে ধরলো। ভাইয়ের পাশের রুমেই আমার জন্য বিছানা করে দেয়া হয়েছিলো। আমি ওর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ও ঘুমাতে পারছিলো না, বারবার শুধু আমলকির প্লেটের কাছে যাচ্ছিলো। আমি ভাবছিলাম, ‘পৃথিবীতে নিশ্চয়ই শত শত সুখী মানুষ আছে! এই সত্যিটা কত অদ্ভুত! এই দুনিয়ার দিকে তাকালে আমি ক্ষমতাবানদের অহংকার আর কিছু করতে না চাওয়ার প্রবণতা দেখি, দুর্বলদের পাশবিকতা আর অজ্ঞতা দেখি, ভয়ংকর দারিদ্র্য দেখি! চারিদিকে শুধু ঘন জনবসতি, কত মাতলামি, কত ভণ্ডামি, কত মিথ্যাচারিতা। অথচ প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা রাস্তায় শান্তি আছে, সুখী মানুষ আছে! পঞ্চাশ হাজার মানুষের এই শহরে একজনও এমন নেই যে সবকিছুর গায়ে লাথি মেরে দিন পাল্টানোর ডাক দেবে। হাজার হাজার মানুষ দিনের বেলা কাজে যাবে, বাজার করবে, খাবে, রাতে ঘুমাবে, উল্টাপাল্টা কথা বলবে, বিয়েথা করে বুড়ো হয়ে অবশেষে বাপ-দাদার পাশের কবরে শুয়ে পড়বে। এরা কোনোদিন দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত কাউকে দেখেও না, ওদের চিৎকার শোনেও না; এই সবই ওদের চোখের পর্দার অন্য পাশে চলতে থাকে। সব শান্ত, নিস্তব্ধ! শুধু মাঝে মাঝে কিছু সংখ্যা এসে বিদ্রোহ করে – এতজন পাগল হয়ে গেছে, এতজন রাস্তায় মাতলামি করেছে, এতগুলো শিশু দুর্ভিক্ষে মারা গেছে, এরকম। এরকম পরিস্থিতিই কিন্তু আমরা চাই। সুখী মানুষেরা নিজেদের সুখী ভাবতে পারে কারণ দুঃখী মানুষেরা নীরবে তাদের বোঝা বয়ে চলে। এই জিনিসটা আমাদের সবাইকেই সম্মোহিত করে রেখেছে। প্রত্যেকটা সুখী মানুষের দরজার সামনে একজনকে হাতে হাতুড়ি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া উচিত যার কাজ হবে মাঝে মাঝে দরজায় বাড়ি দেয়া আর ওদেরকে মনে করিয়ে দেয়া যে ‘দুনিয়াতে দুঃখী মানুষের সংখ্যা অনেক! তুমি বাপু যতই সুখী হও না কেন, একদিন না একদিন তোমার সুদিন শেষ হবেই। অসুখ-বিসুখ, দারিদ্র্য, জানমালের ক্ষতি, কিছু না কিছু আসবেই। সেদিন তোমাকে কেউ গোণায় ধরবে না। ঠিক যেমন এখন তুমি কাউকে গোণায় ধরো না’। কিন্তু দরজার বাইরে হাতুড়ি হাতে কেউ নেই। সুখী মানুষগুলো তাদের জীবন কাটায় নিশ্চিন্তে। দিনের ছোটোখাটো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়তো একটু বিরক্ত হয়, তবে সেটা বটগাছে বাতাস লাগার মত। বাকি সব একদম ঠিকঠাক!
“ঐ রাতে আমি বুঝতে পারলাম, আমি নিজেও আসলে সুখী, আমিও সন্তুষ্ট”, আইভান ইভানিচ তার বক্তৃতা চালিয়ে গেলো, “আমিও খেতে বসে অথবা শিকারে গিয়ে জীবন, ধর্ম, রাজনীতি, এসব নিয়ে মুখে মুখে আইন বানিয়েছি। আমিও বলেছি যে শিক্ষাই আলো, শিক্ষা দরকারি, কিন্তু সাধারণ মানুষদের জন্য ঐ একটু-আধটু লিখতে পড়তে পারলেই হলো। এটাও বলেছি যে বিপ্লব জিনিসটা নিঃশ্বাস নেয়ার মতই প্রয়োজনীয়, কিন্তু এখনই না। হ্যাঁ, এরকম কথা আমি প্রায়ই বলতাম, কিন্তু এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, “এখনই কেন নয়?’ “
আইভান ইভানিচ রাগের দৃষ্টিতে বর্কিনের দিকে তাকালো, “দেরিটা কিসের? কিসের অপেক্ষা? কী ভেবে আমরা চুপ করে যাই? সবকিছু নাকি একসাথে পাওয়া যায় না, সবকিছুর নাকি একটা উপযুক্ত সময় আছে। কিন্তু এই কথাটা কার? এটার প্রমাণ কী? তুমি আমাকে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম দেখতে বলতে পারো, কার্যকারণের অজুহাত দেখাতে পারো। কিন্তু আমাকে বলো দেখি, এটা কোন নিয়মের মধ্যে পড়ে যে আমি একটা চিন্তাশক্তিসম্পন্ন প্রাণী হয়ে একটা খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকবো যে একদিন খাল শুকাবে আর সেদিন আমি অন্য পাড়ে যাবো? বলো আমাকে, আমি কেন অপেক্ষা করবো? কেন খালের ওপর সেতু বানাবো না?
“পরের দিন বেশ ভোরে আমি ভাইয়ের খামারবাড়ি থেকে রওনা দিলাম। সেদিন থেকে শহর জিনিসটা আমার কাছে অসহ্য মনে হতে লাগলো। শহরের নির্ঝঞ্ঝাট নীরবতা আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। কারো জানালার দিকে তাকানোর কথা ভাবলেই আমার গা গুলিয়ে আসতে থাকে। তাকালে যদি গোল টেবিলে বসে চা খেতে থাকা কোনো সুখী পরিবার দেখে ফেলি, এই চিন্তা করলেই গা শিওরে ওঠে। এখন আমার বয়স হয়ে গেছে, এখন আমার মধ্যে কোনো কিছু পাল্টানোর শক্তি নেই। এখন আমি শুধু মন খারাপ করতে পারি, মনে মনে অভিযোগের তালিকা লম্বা করতে পারি। রাতে ঘুম আসে না, শুধু উল্টাপাল্টা চিন্তা আসে। আহা রে, যদি বয়সটা একটু কম হতো।”
আইভান ইভানিচ উত্তেজনায় রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করতে লাগলো, আর বলতে থাকলো, “ইস, বয়সটা যদি আরেকটু কম হতো।” হঠাত সে আলিওখিনের কাছে গিয়ে ওকে ঝাঁকি দিলো, প্রথমে এক হাত দিয়ে, এরপর দুই হাত দিয়ে।
“পাভেল কসটান্টিনিচ বলেছেন”, সে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললো, “সন্তুষ্ট হয়ে যেও না, হাল ছেড়ে নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে দিও না। যদি যুবক হও, ধনী হও, ক্ষমতাবান হও, তাহলে ভালো কাজ করা থামিয়ে দিও না। সুখ বলতে আসলে কিছু নেই, থাকা উচিতও না। জীবনের যদি কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই জরুরি বা মহৎ কাজ করে যাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে, ক্ষণস্থায়ী সুখের মধ্যে না। ভালো কাজ করা থামিও না।”
আইভান ইভানিচ কথাগুলো বলছিলো একটা করুণামিশ্রিত হাসি নিয়ে, যেন সে তার নিজের ব্যক্তিগত কোনো কাজে ওদের সাহায্য চাইছে। তিনজন রুমের তিন কোণায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। আইভানের গল্পে বর্কিনেরও মন ভরেনি, আলিওখিনেরও না। একপাশে জ্বলতে থাকা আগুনে দেয়ালে ঝুলতে থাকা ছবির মানুষগুলোকে জীবিত মনে হচ্ছিলো। আমলকি খাওয়া রাজস্ব অফিসের দপ্তরির গল্প শুনে দুজনই কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। দুজনেই ভেবেছিলো, আজ হয়তো কোনো মজাদার লোকের মজার কোনো গল্প শুনবে, কোনো নারীর মশলাযুক্ত কাহিনী শুনবে। রঙ-বেরঙের বাতি, পায়ের নিচে নরম কার্পেট, দেয়ালে ঝুলতে থাকা পূর্বপুরুষদের ছবি, আর সুন্দরী পেলাজিয়ার উপস্থিতি – সব মিলিয়ে এই আবহাওয়াটাই যে কোনো গল্পের চেয়ে ভালো মনে হলো ওদের কাছে।
আলিওখিনের বেশ ঘুম পাচ্ছিলো। কাজের জন্য ওকে কাল রাত দুটোয় উঠতে হয়েছিলো। এখন ঘুমে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তারপরেও সে কান খাড়া করে রইলো। অতিথিরা মজার কিছু বললে যাতে ছুটে না যায়। আইভান কী বললো, সেটা ঠিক কিনা অথবা জরুরি কিনা, সেটা নিয়ে ভাবাভাবির ধার দিয়ে গেলো না সে। ওরা গোলাঘর বা খড় নিয়ে কথা বলছে না, আলকাতরা বা কারখানা নিয়ে কথা বলছে না। এমন কিছু নিয়ে কথা বলছে যেগুলো তার দৈনন্দিন জীবনের জন্য একদমই অপ্রাসঙ্গিক। ব্যাপারটা ওর বেশ ভালো লাগছিলো। এমনটা চলতে থাকলে কিন্তু মন্দ হয় না।
“আচ্ছা, এবার ঘুমানো উচিত”, বর্কিন বললো, “শুভ রাত্রি, ভায়েরা।”
আলিওখিন শুভ রাত্রি জানিয়ে অতিথিদেরকে রেখে নিচতলায় চলে গেলো। বাকিরাও নিজ নিজ শোবার ঘরে চলে গেলো। প্রত্যেক রুমই বড়, প্রত্যেকটা রুমেই একটা করে নকশা করে কাটা কাঠের পুরনো বিছানা। রুমের এক কোণায় হাতির দাঁতের বানানো ক্রুশ ঝুলছে। প্রশস্ত শীতল বিছানা থেকে সুন্দরী পেলাজিয়ার লাগানো সুতি চাদরের মিষ্টি গন্ধ আসছে।
আইভান ইভানিচ নিঃশব্দে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
“হে খোদা, আমি পাপী, আমাকে মাফ করে দিও”, বিড়বিড় করতে লাগলো।
পাশের টেবিলের ওপরে রাখা পাইপ থেকে জ্বলন্ত তামাকের গন্ধ ছড়াতে থাকলো। পাশের রুমে বর্কিন অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাতে পারলো না, কারণ সে কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না যে গন্ধটা কিসের আর কোত্থেকে আসছে।
সারারাত জানালার গায়ে টুংটাং শব্দে বৃষ্টি একটানা আঘাত করে গেলো।