বার্নি স্যান্ডার্স, ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য লড়াই করছেন, এবং প্রায় সব কটা জরিপে তিনি এই মুহূর্তে (মার্চ, ২০১৬) আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। ২০১৫ সালের মে মাসে অনেকেই তাকে চিনতো না। তখন তিনি একজন সিনেটর ছিলেন কেবল। সেই মাসে তিনি মনোনয়নের জন্য নিজেকে হাজির করলেন, এবং দুর্দান্ত একটা বক্তৃতা দিয়ে অনেকের নজরে চলে এলেন। পুরো বক্তৃতাটা ৩৭ মিনিটের, সেটার কিছু অংশ আমি অনুবাদ করছি।
আজ, ছোট্ট এই অঙ্গরাজ্যটিতে দাঁড়িয়ে (যে অঙ্গরাজ্যটি আমাদের জাতিকে অনেক ভাবেই নেতৃত্ব দিয়েছে) আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নিজের মনোনয়নের ঘোষণা দিচ্ছি।
আজ, আপনাদের (যারা সামনে আছেন) এবং এই দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থনে, আমরা একটা বিপ্লব শুরু করতে যাচ্ছি; যে বিপ্লব আমাদের দেশটাকে পাল্টে দেবে – অর্থনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, এবং পরিবেশগতভাবে। আজ, আমরা এখানে জোর গলায় এবং পরিষ্কার করে বলার জন্য দাঁড়িয়েছি যে “ব্যাস, যথেষ্ট হয়েছে। এই মহান জাতি এবং এর সরকারের মালিকানা আমাদের সবার, সকল মানুষের; শুধু মুষ্টিমেয় কিছু বিলিয়নিয়ার, ওদের সুপার-প্যাক আর লবিইস্টদের নয়।”
ভাই ও বোনেরা, এখন আর ছোটো আকারে চিন্তা করার সময় নাই। এখন আর সেই পুরনো প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সময় নাই, জং লেগে যাওয়া ধারণাগুলোর জন্য কোনো সময় নাই। এখন সময় এসেছে লক্ষ লক্ষ কর্মজীবি পরিবারদের একত্র হবার, আমেরিকান গণতন্ত্রকে পুনর্জীবন দেয়ার, আমেরিকান মধ্যবিত্ত সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর। এখন সময় এসেছে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত করার, ওদের স্বাস্থ্য-উন্নতি-নিরাপত্তা-আনন্দ নিশ্চিত করার। এখন সময় এসেছে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার। এখন সময় পরিবেশকে রক্ষা করার এবং বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার।
প্রিয় আমেরিকাবাসী, আমাদের দেশ এখন যেসব ভয়াবহ সমস্যা মোকাবেলা করছে, (১৯৩০ এর) অর্থনৈতিক মহাপতনের পর তেমনটা আর করেনি। আর যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিটা সেই সমীকরণে যুক্ত করেন, তাহলে এখনকার পরিস্থিতি আরো অনেক বেশি খারাপ। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে আছি আমরা।
এই প্রচারণায় আমি আপনাদের কাছে কিছু শপথ করছি। আমি যে শুধু দেশের খেটে খাওয়া মানুষদেরকে রক্ষা করার জন্যেই যুদ্ধ করবো, তা নয়। রুখে দাঁড়াতে এবং বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত, এমন মিলিয়ন মিলিয়ন আমেরিকানদেরকে নিয়ে আমরা একটা বিপ্লব তৈরি করবো। আমরা এই প্রচারণাকে সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে যাবো, তাদের শহরের মিটিং-এ নিয়ে যাবো, প্রত্যেকের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বো, প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ, ওয়েবসাইটের নাম কিন্তু BernieSanders.com. এই সপ্তাহে আমরা যাবো নিউ হ্যাম্পশায়ার, আইওয়া, আর মিনেসোটাতে – আর এটা দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের জোর প্রচারণার শুরু কেবল।
একটা জিনিস খোলাসা করা দরকার। এই প্রচারণা বার্নি স্যান্ডার্সের জন্য নয়। এটা হিলারি ক্লিনটনের জন্যেও নয়, জেব বুশ বা অন্য কারো জন্যেও নয়। এই প্রচারণা আমেরিকান মানুষের প্রয়োজনের জন্য, যেসব ধারণা বা প্রস্তাব দিয়ে ওদের প্রয়োজন মেটানো যাবে সেগুলোর জন্য। আমি সারাজীবনে কোনো নেতিবাচক প্রচারণা চালাইনি, এবারও আমরা শুধু উদ্দেশ্যে এবং প্রয়োজনীয় বিতর্ক দিয়েই প্রচারণা চালাবো। কোনো রাজনৈতিক গুজব থাকবে না এখানে, কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ হবে না, অথবা চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে না। আমার বিশ্বাস, আমেরিকান জনগণ এটাই চায়, এবং এটাই ওদের প্রাপ্য। আশা করবো, অন্য প্রতিযোগীরাও এতে একমত হবেন। আশা করি, মিডিয়াও এই চর্চাতে সমর্থন করবে। রাজনীতিকে বেইসবল খেলা বা প্রাত্যাহিক নাটক মনে করা উচিৎ নয়। এখন আর সেসব ছেলেখেলার সময় নাই।
সামনের মাসগুলোতে আমি কী কী বিষয়ে বারবার আলোকপাত করবো, সেগুলো নিয়ে আসুন একটু আলাপ করি। এগুলো নিয়ে মোটা দাগে আমরা আলোচনা করবো। এবং এ সমস্যাগুলোকে সমাধান করে আগামী দিনে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।
(এরপর তিনি আয় এবং সম্পদের বৈষম্য, অর্থনীতি, সিটিজেনস ইউনাইটেড সংস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এটাকে ঠেকানোর জন্য কী কী করা যায়, চাকরি খাত, বেতন বৃদ্ধি, ওয়াল স্ট্রিটকে নতুন করে সাজানো, প্রচারণাতে টাকাপয়সার প্রভাবকে কমানো এবং ঢেলে সাজানো, সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা, এবং সমাজের বৈষম্যগ্রস্থদেরকে সুরক্ষা দেয়া, ইউনিভার্সিটিকে বেতনমুক্ত করে দেয়া, যুদ্ধ এবং শান্তি নিয়ে বললেন। কখনো সময় হলে এই অংশটুকুও অনুবাদ করার ইচ্ছে রইলো। তারপর……)
আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ জানেন, আমি এখান থেকে অনেক দূরের ভূ-খণ্ড (!) ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক শহরে জন্মেছি। আমার বাবা পোল্যান্ড থেকে এখানে এসেছিলেন। ওনার পকেটে কোনো টাকা ছিলো না, তেমন কোনো শিক্ষাও ছিলো না। আমার মা নিউ ইয়র্ক শহরেই হাই স্কুল (বাংলাদেশের এইচএসসি) শেষ করেছেন। আমার বাবা রঙ বিক্রয়কারী হিসেবেই প্রায় সারাজীবন কাটিয়েছেন। আমরা বেশ যথার্থ মধ্যবিত্ত। আমার বাবা-মা, ভাই এবং আমি ছোটো একটা ভাড়া বাসায় থাকতাম। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিলো- ছোটো সেই এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে ওঠার। উনি খুব কম বয়সে মারা গিয়েছিলেন, এবং ওনার স্বপ্ন কখনোই পূর্ণ হয়নি। সেই বাচ্চা অবস্থাতেই আমি বেশ কিছু উপায়েই বুঝেছিলাম- একটা পরিবারে টাকাপয়সার গুরুত্ব কতখানি! সেই শিক্ষাটা আমি কখনোই ভুলিনি।
আমেরিকা যে সুযোগের দেশ, আমি সেটা নিজের জীবন থেকেই দেখেছি। আমার বাবা-মা কখনোই ভাবেননি যে তাদের ছেলে আমেরিকার সিনেটর হবে; প্রেসিডেন্টের জন্য নির্বাচন করবে, সেটা তো দূরের কথা। কিন্তু আমার অনেক অনেক আমেরিকান ভাই-বোনের স্বপ্ন ও সুযোগকে গলা টিপে হত্যা করছে এমন এক অর্থনীতি যা শুধু ওপর মহলকেই সাহায্য করে।
যারা বলেন যে আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারবো না, তাদেরকে আমি বলি – দেখুন, ঠিক এই মুহূর্তে আমরা কোথায় আছি। এই মনোমুগ্ধকর জায়গাটা এক সময় একটা ঘিনঘিনে রেল জঞ্জালখানা ছিলো। এটার কোনো পাবলিক উদ্দেশ্য ছিলো না, এটা দেখতেও খুব জঘন্য ছিলো। মেয়র হবার পর, আমি বার্লিংটনের মানুষের সাথে মিলে কাজ করেছি। এবং এই জায়গাটাকে মানুষের জন্য উপযুক্ত এবং সুন্দর একটা দৃশ্যে পরিণত করেছি। আমরা আদালতে গিয়ে লড়াই করেছি। যুদ্ধটাকে নিয়ে গেছি আইনের কাছে, মানুষের কাছে। এবং বিজয় হয়েছে আমাদেরই।
এখান থেকে যে শিক্ষাটা পাওয়া যায়, তা হলো – যদি মানুষ একসাথে মুষ্টিবদ্ধ হয় এবং যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে এমন কিছুই নেই যা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা এমন একট দেশে বসবাস করতে পারি—
- যেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে সকলের অধিকার, কোনো বিশেষ সুবিধা নয়।
- যেখানে প্রত্যেক মা-বাবা নিজেদের সন্তানকে কম খরচে লালন-পালন করতে পারে এবং যে কোনো আয়ের যোগ্য ব্যক্তিই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারে।
- যেখানে বয়স্করা সম্মান এবং নিরাপত্তার সাথে জীবন কাটাতে পারে, যাতে ওদেরকে ওষুধ এবং খাবারের মধ্যে যে কোনো একটা বেছে না নিতে হয়।
- যেখানে দেশকে রক্ষাকারী প্রত্যেক যোদ্ধা তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা, সম্মান, এবং আর্থিক সুবিধা পায়।
- যেখানে প্রত্যেক নাগরিককে সমানভাবে দেখা হয়, তাদের জাতি-ধর্ম-শারীরিক প্রতিবন্ধকতা-যৌনসঙ্গীর চাহিদা যেমনই হোক না কেন। আমেরিকান হিসেবে এটা আমাদের জন্মগত অধিকার।
আমরা এমন একটা দেশ গঠন করতে পারি। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করবো আমার সাথে এই প্রচারণাতে যোগ দিতে যাতে এমন একটা ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারি যেটা আমাদের সবার জন্যেই উপযুক্ত হবে, শুধু ওপর মহলের গুটিকয়েক মানুষের জন্যে নয়।
ধন্যবাদ সবাইকে। লেইক চ্যামপ্লেইনের উপকূলে, চমৎকার এই দিনে এখানে আসার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। সবাইকেই স্বাগত জানাই।
পুরো বক্তৃতাটা এখানে দেখতে পারেন…
https://www.youtube.com/watch?v=oHHzTdu6Clw