গোটা বিশ্ব জানে – ইউডোরা ওয়েল্টির ছোটো গল্প

মা বলল, তুই কোথায় ছিলি খোকা?
– কোথাও না মা
– ইস্‌, তোকে যদি এতোটা দুঃখী না দেখতাম খোকা। তুই চাইলে এখনি আমার কাছে ফিরে আসতে পারিস।
– পারবো না মা। আমাকে সাবিনাতে থাকতে হবে।

*****

সাবিনা ব্যাংকের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমি নিজের জামার হাতাগুলো নামিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুলো ক্ষেত দেখতে লাগলাম যতক্ষণ না পর্যন্ত তার শুভ্রতা আমাকে প্রায় ঘুমের জগতে নিয়ে গেলো এবং আমাকে এমনভাবে জাগিয়ে দিলো যেন আমার চেহারাতে আলোর ঝলকানি পড়েছে। দুগান চলে গেছে কয়েক মিনিট হলো। আমি নিজের গাড়িতে উঠে সেটাকে রাস্তায় নামিয়ে এগিয়ে গেলাম, জিনি এর ড্রাইভওয়েতে (সেখানেই দুগান গিয়েছে) চক্কর দিলাম, এবং আবার উল্টোদিকে চালাতে লাগলাম। আমি পাকা রাস্তার অপর প্রান্তে একটি তুলোর ক্ষেতে ফিরে এলাম, গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম, এবং একই ভ্রমণের পুনরাবৃত্তি করলাম। যেন সবাই প্রতিদিনই এমন করে!

রাস্তার এক কোণায় মেইডিন সামার্স দাঁড়িয়ে ছিলো, একটি ছোট রঙিন রুমাল নাড়ছিলো। প্রথম দিকে সে একজন অপরিচিতা ছাড়া আর কিছু ছিলো না – সেই সম্পর্ক অবশ্য শেষ পর্যন্ত পাল্টে গিয়েছিলো। আমি থামতে ভুলে গিয়েছিলাম। তখনই দেখতে পেলাম, রুমালটি কেমন যেন বিষণ্ণভাবে ধীরে ধীরে নিচে নামছে। আমি আবার গাড়ি ঘুরালাম, ওকে তুলে নিলাম।

সে জিজ্ঞেস করলো, “মেইন রোড ধরেই যাচ্ছো?”।

তার বয়স আঠারো। নিজের ব্যাপারে এই ধরনের তথ্যগুলো সে খুব জলদিই দিয়ে দেয়! সে বললো, “দ্যাখো! আমি প্রাপ্তবয়স্কা এবং নাগরিকত্বপ্রাপ্ত”, এবং আমার দিকে হাত দুটি তুলে ধরলো। তার হাতে ছিলো নতুন পশমি হাতমোজা – সেগুলো চকচক করছিলো। যেসব বিষয়ে শুনতে আমার আপত্তি নেই, পাশে বসে ওই ধরনের বিষয়ে মেইডিন কথা বলতে লাগলো – যেমন আইস প্ল্যান্ট, যেখানে সে বইগুলো রেখেছিলো। তার বস ফ্রেড কিলিগ্রু সাবিনাতে এমনভাবে কাজ করতো যেনো দেশ ও জুনিয়র কলেজের জন্য কাজ করে। মেয়েটা বলে চললো, ওটা নাকি তার প্রথম চাকরি, আর তার মা নাকি বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। চাকরিটা বেশ সহজ, একদম অন্য জগতের, এবং সুন্দর। তার ওপর মাঝে মাঝে ধূলিময় বাসের বদলে আমার সাথে এভাবে গাড়ি করে ফিরে যাওয়া! অবশ্য মাঝে মাঝে কিলিগ্রু সাহেব শেষ মুহূর্তে তাঁকে “জানো, কী হয়েছে?” টাইপের কিছু একটা বলে আরো কিছু কাজ গছিয়ে দিতেন; সে সময়গুলো ছাড়া আর কি!

সে বললো, “এখন ভাল্লাগছে। কিন্তু প্রথমদিকে তুমি আমাকে খেয়াল করোনি। তাই না, র‍্যান?”। আমি তাকে বোঝালাম যে আমার দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। তাকে দেখে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে। আমি অলস ভঙ্গিতে আরো কয়েকবার মূল রাস্তার এদিক-ওদিক গাড়ি চালালাম। প্রতিবারই একই লোকগুলো আমার গাড়ির দিকে হাত নাড়ালো; যেমন মিস ক্যালি হাডসন ও অন্যান্যরা, দোকানের দরজার সামনে দাঁড়ানো অথবা অন্য গাড়িতে চড়া লোকেরা। মেইডিন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাদের সকলকে জবাব দিচ্ছিলো – তাঁর ছোট নীল হাতমোজাটি ব্যস্ত ছিলো। তাদের আগ্রহ মূলত মেইডিনের দিকে না, অন্য আরেক দিকে। যাই হোক, সে আমাকে যেভাবে হাত নাড়িয়েছিলো, তাদের সেভাবেই হাত নাড়ালো।

“তুমি কি আজও গতকালের মতই ক্লান্ত? আজকেও কিন্তু ওরকমই গরম পড়ছে।”

এই কথাগুলো সবই সাবিনার অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে শোনা। পরপর চার/পাঁচ বিকেলে আমি তাকে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছি, মূল রাস্তার এদিক ওদিক কয়েক চক্কর ঘুরিয়েছি, তাকে কোকা-কোলা কিনে দিয়েছি এবং ওল্ড ম্যুরে ফর্ক্স এর কোনো এক যায়গায় তার বাসার কাছে নামিয়ে দিয়েছি। কখনোই তার মুখে আন্তরিক কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোনো রকম কথা শুনিনি। মেয়েটা আসলেই আন্তরিক; তার সঙ্গ ছিলো আমার একাকীত্বের অবসান।

সাধারণত আমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমার রুমে ফিরে যেতাম (বাসাটা মিসেস জাজ্‌ ও’লিয়েরি থেকে ভাড়া নেয়া), কিন্তু আজকে পাকা রাস্তার শেষের দিকে গিয়ে গাড়িটিকে ঘুরিয়ে স্টার্কদের বাসায় নিয়ে গেলাম। আমি আর সইতে পারছিলাম না। যতক্ষণ না আমরা সেখানে পৌঁছালাম এবং গাড়ি থামিয়ে আমি নেমে তাঁকে দরজা খুলে দিলাম, ততোক্ষণ পর্যন্ত মেইডিন কিছু বললো না।

সে বললো, “তুমি কি আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে চাও? না নিয়ে গেলেই খুশি হবো”। তার সব কথা একসাথে আমার উপর আঁচড়ে পড়লো। কথাগুলোর মধ্যে একধরনের কোমলতা ছিলো।

আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না, তাই বললাম, “হ্যাঁ, চলো গিয়ে জিনির সাথে দেখা করি। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।”

কর্নেল ওয়াটার্সও কিন্তু আমাকে প্রায় প্রতি বিকেলেই বলতেন, “খোকা, আমার সাথে বাসায় চলো”, আর বলতে বলতে মাথায় সেই বড় পানামা টুপিটি কষ্টেসৃষ্টে ঢোকাতেন, “আমাদের একটি পাখা তোমার দিকে তাক করে থাকার পরও তোমার আরামে না ঘুমানোর কোনো কারণ বুঝতে পারছি না। মেবলও তোমাকে যেতে বলে, ওর নাকি তোমার সাথে কিছু কথা আছে”। এবং তিনি যাওয়ার আগে দরজায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে যেতেন, এবং তাঁর ছড়িটিতে ভর দিতেন (ছড়িটি যেটি দুগান এবং আমি যৌথভাবে তাকে কিনে দিয়েছিলাম, যখন তিনি সভাপতি ছিলেন), মনে হতো যেনো তিনি আমাকে আয়েশের ছলে ধমক দিচ্ছেন। চালিয়েই যেতেন, যতক্ষণ না আমি “না স্যার” বলতাম।

মেইডিনের সাথে আমি শুকনো উঠোন থেকে প্রবেশ পথের ভারী ছাউনির নিচে গেলাম, সেখানে ক্রেইপ মার্টলের (এক ধরনের গুল্ম) ঝোপ থেকে অতি-উজ্জ্বল ফুলগুলো ঝুলছিলো। প্রথমেই আমার চোখে পড়লো জিনির মায়ের দিকে, তিনি নিজের বেডরুমের জানালাতে মুখ ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। তিনি আসলে দেখাতে চাইছিলেন যে র‍্যান্ডল ম্যাক্লেইনের সম্মানে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিলেন; সাথে কে না কে আসছে, সেটা যেন কোনো ব্যাপার না। ইস্টার সানডের দিন গির্জার সামনে ওনার মেয়ের সাথে বিচ্ছেদ করার দুঃসাহস দেখানোর পরও এখন র‍্যান একেবারে ঠিক তাঁর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, একেবারে বুক চিতিয়ে। আরেকদিকে তার মেয়ে জিনি, পুরো নাম ভার্জিনিয়া, যে একসময় এই র‍্যান্ডল ম্যাক্লেইনের সাথে একই বিছানায় ঘুমাতো, আর এই ম্যাক্লেইনই তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যাই হোক না কেন, এটা জিনির বাপের বাড়ি, জিনির প্রবীণ মা মিসেস স্টার্ক ও তার শাসন এখনো পরিবারটিকে টিকিয়ে রেখেছিলো। জানালার পর্দাটি এমনভাবে সরলো যেমনটি কোনো বিজয়ের অনুষ্ঠানে সরানো হয়।

“আমাকে স্টার্কদের বাড়ি থেকে কেউ কখনো ডাকেনি”, মেইডিন বললো; আমি মুচকিভাবে হাসতে শুরু করলাম। নিজেকে বেশ হালকা মনে হলো। কাছাকাছি কোথাও নিশ্চয়ই পদ্মফুল ফুটেছে। আমি পদ্মের গন্ধে ভেজা বাতাসে গভীর নিঃশ্বাস নিলাম। এতোটা গভীরভাবে যেন এরপর আমি আর বাঁচবো কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাইরে সদরকক্ষে জিনি দুই পা ছড়িয়ে আয়না দেখে দেখে চুলের খোঁপা খুলছিলো। খোঁপার কাঁটা তার পায়ের কাছে পড়ে গিয়েছিলো। তার পরনে ছিলো ছেলেদের শর্টপ্যান্ট। সে আমার দিকে চেয়ে বললো, “কেমন লাগছে, বলো তো?”। সে দাঁত বের করে এমনভাবে হাসলো যেন আমার জন্যই তৈরি হচ্ছিলো। সে আমার পেছনে তাকালো। সে দূরদর্শী ছিলো; সে মনে হয় জানতো যে এই গ্রীষ্ম আমার জন্য অসহ্য হয়ে উঠলেই আমি ফিরে আসবো, এবং খুঁজে পাওয়া মাত্রই এমন কাউকে নিয়ে আসবো যে আগের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে কিছুই জানে না।

আমার মনে আছে, মেইডিন তার হাতমোজার দিকে তাকালো, এবং ওগুলো পরে থাকবে বলেই ঠিক করলো। জিনি চিৎকার করে টেলিকে কিছু কোক আনতে বললো। দূরত্বের আবেশ আর একটি হালকা অনুভূতি আমাকে চেপে ধরলো। আমরা সবাই স্টার্কদের কক্ষের হালকা-পাতলা মাদুরের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম, ওটাতে এক পা ফেললেই কেমন যেন সব দুলে দুলে উঠছিলো। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা জিনির চুলসহ আমাদের সবাইকে আমি আয়নাতে দেখলাম। আমি নিজের ভিতরে আরেকটা কণ্ঠ শুনতে পারছিলাম। কণ্ঠটা আমাদের কাহিনী বয়ান করছিলো, ঘটে যাওয়া কাহিনীর একাংশ; জিনি এবং আমার কাহিনী। সেই কণ্ঠটা যেন মেইডিনের- পরিষ্কার, দ্রুত, প্রশ্নবিহীন – এই শহরের লোকেরা যেসব বলে, তাই বলে যাচ্ছিলো। মেইডিন সামার্স ওরকমই ছিলো –  সে যা দেখতো তাই বলতো, যাই শুনতো পুনরুক্তি করতো – ছোট অতিথি পাখির মতো, শিক্ষানবীশ, প্রতিদিনই একটু একটু করে শিখতো, অন্যরা যা বানাতো তাই গাইতো।

র‍্যান জিনিকে ফেলে চলে গিয়েছিলো, তিন ব্লক দূরে নতুন বাসা নিয়েছিলো। সে আবার কখন জিনির কাছে ফিরবে, সেটা নিয়ে মানুষের চিন্তার অন্ত নেই। সবাই বলাবলি করে যে সেখানে জিনি আরেকটা প্রেম করছে; একদম জিনির মায়ের নাকের ডগায়। ভাগ্য ভালো যে তার বাবা বেঁচে নেই এবং তার কোনো ভাই নেই। নিঃসন্দেহে প্রেমিকটি লনি দুগান, ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা। এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক আসলে! র‍্যানের অবর্তমানে, সাবিনাতে আর কেইবা জিনি স্টার্কের পাশে এসে দাঁড়াবে? ঘটনাটা কিভাবে ঘটলো, সেটা কেউ বলে না। কেউ কি আসলে জানে? দলের ভেতর, টেবিল আলোচনাতে, মিসেস জাজের ওখানে, রোববারের স্কুলে, সবাই বলাবলি করে যে প্রেমিক রাজি থাকলে জিনি তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু যদি জিনি এমনটা করে, তাহলে র‍্যান কাউকে না কাউকে (জিনিকে বা তার স্বামীকে, অথবা নিজেকে) মেরে ফেলবে। মদ খেতে খেতে র‍্যানের বাবা মারা গিয়েছিলো, মনে আছে? র‍্যানও খুব খারাপ কিছু করে বসবে। হয়তো সে জিনিকে ডিভোর্স দিবে না, কিন্তু খারাপ কিছু ঘটিয়ে বসবে। হয়তো সবাইকেই মেরে ফেলবে। ওরা বলে, জিনি সবে ভয় পায় না। আরো আছে, ওরা বলে, তিনজনেরই একজন আরেকজনের সাথে দেখা হয় প্রতিদিন। বাজে ব্যাপার-সেপার! কিন্তু এখানে আশ্চর্যের কিছু নেই। সামনেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। ওরা যদি মিটমাট করতে চাইতোও, তবু কীভাবে করতো? এসব থেকে কীভাবে পালাতো? সাবিনাতে পালিয়ে থাকা যায় না, কোনোকিছু থেকেই না।

মেইডিন তাঁর সাদা হাতমোজার মধ্যে টুংটাং শব্দ করতে থাকা কাঁচটি নিলো এবং জিনিকে বললো, “সারাদিন কাজ করে আমাকে যথেষ্ট ঘর্মাক্ত ও অগোছালো দেখাচ্ছে। কারো বাসায় বেড়াতে আসার উপযুক্ত দেখাচ্ছে না।” ওকে জিনির মত দেখাচ্ছিলো – জিনির একটি বিব্রতকর সংস্করণের মত। “জিনি, আমাকে খুব ঘর্মাক্ত এবং অগোছালো দেখায়। সবসময় অনেক ধুলো-ময়লার মধ্যে কাজ করি তো! অবশ্য মেনে নিয়েছি ব্যাপারটা। তাই আমি শুধু নিজেকে নিয়ে খুশি থাকি।”

আমি বলছি না যে মেইডিনের ছোট্টো চেহারাতে কোনো ধরনের বিদ্রুপ ছিলো– একেবারেই না – কিন্তু তাঁর মধ্যে জিনির অতীতের একটা ছাপ ছিলো। আমার সাথে যে জিনি ছিলো, সেরকম খোলামেলা ও প্রাণবন্ত জিনি এখন আর পাওয়া যাবে না। ধীরগতির সিলিং ফ্যানের বাতাসে তাদের কপাল থেকে চুল উড়ে যাচ্ছিলো, একদম একইরকমভাবে – মেইডিনের বাদামী লম্বা চুল এবং জিনির বাদামী ছোট বরবাদ হয়ে যাওয়া চুল। সে নিজেই চুলগুলো বরবাদ করেছিলো, এমন করতেই ওর ভালো লাগতো।

ধীর-স্থির আর নম্র থাকার পরেও, জিনির সাথে একই কক্ষে অবস্থান করার সময় অজানা কোনো মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ছিলো মেইডিন। যেন হঠাৎ করেই তার মধ্যে কোনো অজানা ঐশ্বর্য এসে গেছে, হঠাৎ করেই একটা পরিপূর্ণতা এসে গেছে। বেতের চেয়ারে বসে গল্প করছিলো ওরা। ওর বেশভূষা যে এই বাড়ির উপযুক্ত নয়, তা নিয়ে মেইডিন নিজেই যখন অভিযোগ করছিলো, তখন আমি এক ধরনের শান্তি অনুভব করছিলাম। সে নিজেকে এতটুকু ছোট করতে পারে, আমার ধারণা ছিলো না। আমি নিরুদ্বেগভাবে চেয়ারে হেলান দিলাম এবং সিগারেট টানতে লাগলাম। হঠাৎ জেগে ওঠা আগ্রহটা নিজের মধ্যেই চেপে রাখতে হলো – ওদের মিলগুলো আসলেই বেশ ভাবার মত ব্যাপার! জিনিসটা আবিষ্কার করে আমি বেশ পুলক অনুভব করছিলাম। আমি জিনির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে মেইডিনের দিকে তাকালাম (অবশ্য সে খেয়াল করেনি) এবং আবার জিনির দিকে তাকালাম। ওদের দিকে তাকিয়ে আমার এই আবিষ্কারের জন্য প্রশংসা প্রত্যাশা করলাম, আমার আবিষ্কারের প্রত্যাশা।

বাইরে ঠোকাঠুকির শব্দ হচ্ছিলো – ক্রকেট (Croquet, ব্যাট ও বলের এক ধরনের খেলা) খেলা হচ্ছিলো। জিনি আমাদেরকে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। ওখানে পেছনের উঠোনের ছায়াতে কয়েকজন আস্তে আস্তে হাঁটাহাঁটি করছিলো – ডক শর্ট, ভেরা ও রেড ল্যাসিটার, একই স্কুলের দুইজন টিচার। লনি দুগানও ছিলো, সে উইকেটের দিকে একটা বল ছুঁড়ে মারছিলো। আমি দরজা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  দেখছিলাম; ভিড়টা আগের চেয়ে কিছুটা কম মনে হলো। কে ছিল না, বুঝতে পারছিলাম না। পরে বুঝলাম, আমিই ছিলাম না আসলে।

*****

মা বললো, “খোকা, তুই স্বপ্নের জগতে বাস করছিস”।

*****

মিসেস জাজ ও’লিয়েরির ছোট কুকুরটার নাম বেলা। ও সবসময় করুণভাবে হাঁপাতো – অসুস্থ ছিলো। আমি যখনি উঠোনে যেতাম, তার সাথে কথা বলতাম। “বেচারি বেলা, কী খবর তোমার, খুকি? গরম লাগছে? ওরা তোমাকে একা ফেলে রেখেছে?

*****

মা বলল, তুই কোথায় ছিলি খোকা?

– কোথাও না মা।

– ইস্‌, তোকে যদি এতোটা রোগা না দেখতাম। আর তুই আমার থেকে কথা লুকোস, খোকা।

– কোথাও ছিলাম না কই আর যাবো?

– তুই যদি আমার সাথে ফিরে আসতি, তাহলে সবকিছুই একেবারে আগের মতনই থাকতো। আমি জানি তুই মিসেস জাজের সাথে খাবি না, তার বিস্কিট খাবি না।

*****

যখন ব্যাংক খুললো, মিস ক্যালি হাডসন আমার জানালায় এসে চিৎকার করে উঠলো, “র‍্যান্ডল, কখন তোমার দারুণ স্ত্রীর কাছে ফিরে যাচ্ছো? ওকে মাফ করে দাও, এখুনি, বুঝলে? এভাবে ক্ষোভ পুষে রেখে কোনো লাভ নেই। তোমার বাবা অনেক কষ্টে রেখেছিলেন তোমার মাকে, তবু উনি কখনোই বাবাকে কোনো ক্ষোভের সু্যোগ দেননি। উনি কখনোই তোমার বাবার প্রতি কোনো রাগ পুষে রাখেননি। আমরা সবাই এই পৃথিবীর মানুষ। লনি কই এখন, শুনি? ও কি কোথাও বেড়াতে গেছে? নাকি তুমি তাকে কিছু করেছো? আমার চোখে তো সে এখনো সেই হাঁটু প্যান্ট ও বাস্টার ব্রাউন বব পরা ছেলেটা, যে বরফের ভ্যানে চড়ে বরফ চুরি করতো – তোমার আজীবনের খেলার সাথী, জিনির আজীবনের খেলার সাথী – বিশেষ কিছু না, কিন্তু দারুণ স্মার্ট।

আমি এই রকিং চেয়ারে বসেই সব খবর রাখি, বুঝলে? সেই আমিই তোমাকে বলছি, অপ্রত্যাশিত ঘটনা সবার জীবনেই ঘটে।  তবে তুমি এখন তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাও র‍্যান ম্যাক্লেইন। শুনতে পাচ্ছো তুমি? শরীরের ব্যাপার তো, আত্মার তো আর না,এই মোহ কেটে যাবে। জিনি হয়তো তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই এসব ভুলে যাবে। বুঝলে? খুশি মনেই ফিরে যাও। এসব মাথায় রেখো না। আর এমন কিছু কোরো না যেটা শুনলে আমরা সবাই লজ্জা পাবো। আমি জানি তুমি এমন কিছু করবে না। আমি তোমার বাবাকে চিনতাম, তার জন্যে পাগল ছিলাম। কিন্তু যতদিনে সে আমাকে লক্ষ্য করলো তখন আর সময় ছিলো না। তোমার মাকেও আমি অনেক ভালোবাসি। দুনিয়ার সবচেয়ে মিষ্টি লোক ছিলেন তারা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতি।

বাড়ি গিয়ে মাকে এসব বোলো। আর এখন নিজের অমূল্য স্ত্রীর কাছে ফিরে যাও। যাও, কিছু বাচ্চাকাচ্চা নাও। কতদিন হলো? কতদিন? ঘরটা কখন ভেঙেছিলে তুমি, ক্রিস্টমাসে নাকি ইস্টারে? আমি বলেছিলাম ইস্টারে, মিস্টার হাড্‌সন বলেছিলেন ক্রিস্টমাসে – কারটা সত্যি?

আমার বন্ধুবান্ধবেরা বলে জিনি তোমাকে ডিভোর্স দেবে এবং লনিকে বিয়ে করবে, কিন্তু আমি বলি এরকম হবে না। আমি মিস্টার হাড্‌সনকে বলেছি শারীরিক ব্যাপার বেশিদিন টিকবে না, আর তোমরা তো একে অপরকে দীর্ঘদিন ধরে চেনো! মিশনারির বন্ধুরা বলেছিলো তুমি লনিকে খুন করবে এবং আমি বলেছিলাম, ধুরো, ‘কার কথা যে বলছো তোমরা! যদি র‍্যান ম্যাক্লেইনের কথা বলো, তবে তার ব্যাপারে আমি ভালো করেই জানি। র‍্যান কখনোই এমন কিছু করবে না’। হেসেছিলাম ওদের সামনে। আর আহা রে, ছোট্ট জিনি! তাকে ঠাট্টা না করে পারলাম না। সে বলে – আমার কিছু করার ছিলো না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘এটি কীভাবে হলো জিনি? বুড়ো মিস ক্যালিকে বলো’। আর সে বললো, ‘ওহ্‌ মিস ক্যালি, আমি জানি না – কীভাবে যেনো হয়ে গেলো, ব্রিজ (তাসের এক ধরনের খেলা) খেলার টেবিলেই’। আমি বললাম, ‘যাহ, ভুয়া! ব্রিজ খেলার টেবিলেই, তাই না? আর বললাম না’। জিনি গতকাল আমাকে রাস্তায় বললো, ‘ওহ্‌, সত্যিই সে বললো, আমি র‍্যানকে কে দেখেছি’। সে বললো, ‘আমি আশা করি র‍্যান আমার বিরুদ্ধে মনের মধ্যে কোনো কিছু পুষে রাখবে না। সাবিনা ব্যাংকে আমার চেক লিখতে হবে, এবং লনি দুগান এই বিষয়েই কাজ করে, র‍্যানের ঠিক পাশেই। আমরা সবাই বড় হয়েছি, কেউ আর সেই ছোট্টটি নেই’। এবং ‘আমি বললাম আমি জানি, চাইলেই তো একজন আরেকজন থেকে দূরে সরে যাওয়া যায় না। এটা একটা গোলক ধাঁধা; শারীরিক ব্যাপারগুলো এমনই’। আর সাবিনাতে এর থেকে দূরে সরে থাকতে পারা তো দূরের কথা, তুমি তা আশাও করতে পারবে না। এমনকি আমাদের ছোট শহরেও নয়। জিনি একজন উঠতি বয়সী মেয়ে হিসেবে কখনো স্বয়ং শয়তানকেও ভয় পায়নি, এবং এখনো ভয় পাওয়ার কথা না। আর লনি দুগান কি কখনোই ওর ব্যাংকের কাজে ইস্তফা দেবে? কখনোই না। কিন্তু আমি মিস্টার হাড্‌সনকে ঠিক যেটা বলেছিলাম – ওরা আলাদা জগতের বাসিন্দা। মিস্টার হাড্‌সনকে বলেছিলাম, ‘বেশ, জিনি র‍্যানের সাথে প্রতারণা করেছিলো – এটাই আসল কথা। এখান থেকেই এতকিছু; এটাই পুরো ঘটনার বীজ। এটাকে মেনে নাও’, আমি মিস্টার হাড্‌সনকে বললাম, ‘তুমি তো শুধু মামুলি রেল কর্মকর্তা, একজন ষ্টেশন প্রতিনিধি কেবল, এসব বোঝা তোমার কম্মো নয়’। কতবার যে বলেছি!”

তবে আমি আমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবো! মিস ক্যালি রডের ফাঁক দিয়ে আমার উপর চিৎকার করেন। তুমি বা আমি অথবা চাঁদের মানুষটির খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই বলেই পৃথিবীর সকল মহিমা রক্ষার্থে মিসেস জাজ্‌ ও‘লিয়েরির সিঁড়ির ওপরের এই ছোট, গরম, পশ্চিমা ধাঁচের ঘরটিতে আছি। নাহলে অন্তত আগস্টে এখানে থাকতাম না।”

কাজের শেষে আমি সবসময় মিসেস জাজের পেছনের উঠোনে ঘাস কাটার জন্য থেকে যেতাম, যাতে বেলার একটু সুবিধা হয়। এতে মশামাছি ওকে একটু কম জ্বালাতন করতো। কিছুতেই অবশ্য খুব একটা লাভ হচ্ছিলো না। উত্তাপটা রইলো আগের মতই। যখন আমি স্টার্কদের বাড়িতে ফিরে গেলাম, দেখলাম পুরুষরা তখনো কিছু বাচ্চা মেয়ের সাথে ক্রকেট খেলছিলো, এবং মহিলারা সেখান থেকে সরে গিয়ে প্রবেশ পথের ছাউনির নিচে জমায়েত হচ্ছিলো। তারা মেইডিনকে ডেকে পাঠালো, আমি ওকে তাদের কাছে পাঠালাম। মিসিসিপির দীর্ঘ সন্ধ্যায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম, আঁচটা না কমা পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া করা যাচ্ছিলো না। জিনির মায়ের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিলো – আমি শুনলাম – দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ– নইলে বাকি সবকিছুই শান্ত, খুব গরম এবং স্থির।

কেউ একজন বললো, “তুমি লনির উপর প্রচণ্ড রেগে আছো”। দেখলাম, উইলিয়াম পরিবারের ছোট্ট বেণী করা মেয়েটি বললো কথাটা।

আমি হয়তো রসিকতার মাধ্যমে জবাব দিতে পারতাম। আমার মজাই লেগেছিলো! একটা বাচ্চার কাছে জবাবদিহি করাটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হলো না। আমি লাল পট্টিওয়ালা ব্যাটটি হাতে তুলে নিলাম, এটা আজীবনই আমার। এটা দিয়েই দুগানের বাচ্চাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিলাম। সে পড়ে গিয়েছিলো, মাটি কেঁপে উঠেছিলো, ওর ঘন ঘন নিঃশ্বাসে বায়ুপ্রবাহও যেন বেড়ে গিয়েছিলো। কুঁকড়ে গিয়ে হাঁপাচ্ছিলো শালা। পড়ে যাওয়ার পর তাকে আমি পিটিয়েছিলাম, এমনকি মেয়েদের মতো নরম চুলওয়ালা মাথাতেও,  যতরকমভাবে পারা যায়। যতক্ষণ না তার প্রতিটি হাড়, এমনকি তার হাতের ছোট ছোট হাড়গুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পিটিয়েছি। যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শুনশান ছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত পিটিয়েছি। আমি প্রমাণ করেছিলাম যে পুরুষের শরীরকে একের পর এক আঘাত করলে একসময় সেটা শেষ হয়ে যায় – শিক্ষাটা জিনিকেও দিতে পারতাম। আমি পড়ে থাকা দুগানের দিকে তাকালাম। তার নীল চোখ দুটো অক্ষত রয়ে গিয়েছিলো। মাঝে মাঝে যেমন বাচ্চাদের ফোলানো বুদবুদগুলোকে দেখতে অবিনশ্বর মনে হয়, ওগুলোর ভেতর দিয়ে ঘাসের ফলা চলে গেলেও পৃথিবীকে প্রতিফলিত করে, ঠিক তেমন। আমি দুগানকে মৃত ঘোষণা করলাম।

“এবার দ্যাখ।”

এটা দুগান বলেছিলো। সে কোনো যন্ত্রণা ছাড়াই বলেছিলো। অবশ্য সে কোনো যন্ত্রণা অনুভব করেনি, করার সময়ই পায়নি। কিন্তু ওর কণ্ঠে সেই বিরক্তিকর, ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতামূলক টানটা ছিলো। এই টানটা সবসময়ই একটা রহস্য ছিলো, এখন বুঝি এটা ছিলো শঠতা। দুগান – জন্মগতভাবেই অপদার্থ। দুগান – নাচের জন্য দ্বিতীয় পছন্দ, ব্যাংকের দ্বিতীয় ব্যক্তি, সাবিনার দ্বিতীয় সুপুরুষ, জিনির দ্বিতীয় পুরুষ! পছন্দের তালিকায় সবসময় শুধু আমরা দুজনই ছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও – সবকিছুর পছন্দের তালিকা তৈরি হতো আমাদের দুজনকে দিয়েই।

তবে সেই তালিকাটা ধ্বংস করে দেয়ার পরেও, তাকে দুমড়ে দেয়ার পরেও আবার কীভাবে খুললো দুগানের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুখ? কিভাবে তাকে বলতে শুনলাম, “এবার দ্যাখ”? সে মোচড়ানো ঘাসের উপরে মরে পড়ে ছিলো। কিন্তু সে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। উঠেই উইলিয়ামদের মোটা ছোট্ট মেয়েগুলোর মধ্যে একটিকে পিছনে একটি চাপড় দিলো। আমি দেখতে পেয়েছিলাম কিন্তু শব্দটি শুনতে পাইনি, পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত শব্দ।

একটা শ্বাসরুদ্ধকর স্থিরতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আকাশটাকে কেউ যেন হাত দিয়ে ঢেকে দিলো! আমার চিৎকার করে বলা উচিৎ ছিলো – অসহ্য! সবাই যদি কান্না করতো, তাহলে মানুষের কান্না ফুঁসে উঠে এমন সন্ধ্যাগুলোকে ঢেকে দিতো, উঠোনের ঘাস পেরিয়ে কান্নাগুলো ওপারে যেত গোধূলির আলো মিশে যাওয়ার আগেই। আমাদের আগস্টের ঘাসগুলো সমুদ্রের তলদেশের মতো; আমরা আস্তে আস্তে খেলা করতে করতে এর উপর হেঁটে বেড়াই। অন্ধকার হওয়ার আগে আকাশটাও সবুজ হয়ে যায়। অন্যরা যা স্মৃতিতে রেখে দিয়েছে, আমরা সেগুলো মুখে আনি না। কিন্তু ছায়া আলোকে ছাপিয়ে আমাদের পদতলে ধীরে ধীরে গোধূলি নিয়ে আসতো এবং ঘাসফড়িঙেরা দীর্ঘ সুরে গান গাইতো, ও-ই…, ও-ই…। আমার পিঠ, বাহু, এবং পা বেয়ে ঘামের ফোঁটাগুলো নিচের দিকে নামছিলো, যেনো কিছু গাছের উল্টো করা শাখাপ্রশাখা।

তারপর, “আপনারা সবাই ভেতরে আসুন!” ছাউনির নিচ থেকে ডাক এলো। পরিচিত হলুদ বাতিগুলো সব হঠাৎ করে জ্বলে উঠলো। তীক্ষ্ণ মহিলা কণ্ঠে জিনি, তার মা, এবং বাকি সবাই ডাকাডাকি করছিলো। “বোকারা, অন্ধকারে কী আর খেলবে? রাতের খাবার খেতে এসো!”

উঠোনের আচমকা অন্ধকারে কেউ একজন আমার গায়ের উপর আছড়ে পড়লো। আমরা তাদের উৎসাহী কণ্ঠ শুনে হেসে উঠলাম। অন্ধকারের ওপারে, ছাউনির নিচে, মহিলারা অপেক্ষা করছিলো। আমার কাছে ওটা একটা লম্বা গলুই নৌকার মতো মনে হচ্ছিলো, অথবা ভেতর থেকে আলোকিত হয়ে ওঠা একটা বাক্স। তবে আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম।

আমি মিসেস জাজ ও’লিয়েরির বাড়িতে আমার পশ্চিমা ধাঁচের ছোট কক্ষটাতে ঘুমাই। সেখানে যাবো ঠিক করলাম। এটাই সেই বাড়ি যেখানে মিসেস জাজ্‌ এবং সাবিনার বাকি তিন স্কুলশিক্ষক ছাউনির নিচে বসে আড্ডাবাজি করেন। ওদেরকে এড়িয়ে যেতে আমি প্রতি সন্ধ্যায় ছাউনি এবং অভ্যর্থনা কক্ষ দুটোর মধ্যেই দ্রুত পায়ে চলতাম, বৃষ্টির মধ্যে মানুষ যেমন করে।

পেছনের দিকের বড় অন্ধকার উঠোনটা পিকান বাদামের গাছে ও জোৎস্নায় আচ্ছাদিত ছিলো। বেলা চোখ খুললো এবং আমার দিকে তাকালো। তার চোখে চাঁদ দেখা যাচ্ছিলো। মুখে পানি দিলেই সে বমি করে দিচ্ছিলো – তারপরও সে কষ্ট করে পানির পাত্রের দিকে যাচ্ছিলো, বার বার পানি খাচ্ছিলো। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। বেচারী বেলা! আমার ধারণা, সে টিউমারে আক্রান্ত। প্রায় প্রতিরাতেই আমি তার সাথে থাকতাম।

*****

মা বললো, খোকা, আমি তোর সুন্দর কোট পকেটে তোর বাবার পুরোনো পিস্তলটা খেয়াল করেছি, তুই ঠিক কী করতে চাস ওটা দিয়ে? তোর বাবা তো কখনোই ওটার ব্যাপারে গা করেনি। ব্যাংকে কোনো ডাকাত আসছে বলেও আমার জানা নেই। খোকা, কিছু টাকা জমালেই তো সমুদ্রের পাড়ে একটা ছোটখাটো ভ্রমণে যেতে পারতি। আমি তোর সাথে যেতাম। গাল্‌ফপোর্ট এ সবসময়ই বাতাস থাকে, প্রায় সব মৌসুমেই

*****

জিনির এখানে খালি মাঠ আর গুল্ম দেখা যায় – যেন একটা পুরনো খেলার মাঠ যেখান থেকে বসতবাড়ি দেখা যায় না। তীক্ষ্ণ, লম্বা লম্বা গুল্মগুলো উঁচুনিচু এবং ওগুলোর উপরের মাকড়শার জালের সুতোগুলো আলোতে চকচক করে – যেনো গুল্মগুলো ঝলমলে কোনো পোশাক পরে আছে। এবং পেছনে ছাউনির উপরে একটি নৃত্যরত মেয়ের ছোট পাথরের মূর্তি আছে, মেয়েটার চিবুকে একটি আঙ্গুল দেয়া। মূর্তিটার পুরোটাই ছোট ছোট গর্তে ভরা। ওটা জিনি একসময় ভিক্সবার্গ পার্ক থেকে চুরি করেছিলো, আর ওর মা ওকে কিছু বলেনি।

মেইডিন বললো, “তুমি কি আমাকে ওখানে নিয়ে যাচ্ছো? না নিয়ে গেলে ভালো হয়।”

আমি গেইটে হাত রেখে নিচের দিকে তাকালাম, এবং বললাম, “দাঁড়াও। আমি একটি বোতাম হারিয়ে ফেলেছি।” আমি আমার আমার খোলা হাতাটা মেইডিনকে দেখালাম। হঠাৎ নিজেকে একই সাথে বিষণ্ণ, ভাগ্যবিড়ম্বিত, ও কান্নার জন্য জন্য প্রস্তুত মনে হলো।

মেইডিন বললো “দাঁড়াবো কেনো? আমি তোমাকে একটা বোতাম লাগিয়ে দেবো, যদি তুমি আমার বাড়ি হয়ে যাও”। সে এক মুহূর্তের জন্য আমার হাতাটি স্পর্শ করলো। একটি গিরগিটি একটি পাতা বেয়ে দৌড়ে উঠলো এবং হাঁপাতে লাগলো। “তাহলে আম্মুর সাথে তোমার দেখা হয়ে যাবে। তুমি আমাদের সাথে রাতের খাবার খেলে উনি খুশি হবেন”।

আমি একটি ছোট পুরোনো গেইট খুললাম। মাটিতে পড়ে থাকা টক নাশপাতির গন্ধ এসে নাকে লাগলো, আগস্টের ঘ্রাণ। আমি কখনোই মেইডিনকে বলিনি যে কোনোদিন আমি রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করবো অথবা তার মাকে দেখতে যাবো। বললাম, “জিনি এখনই লাগিয়ে দিতে পারবে”।

“তাই?” জিনি বলে উঠলো।

নিঃসন্দেহে সে পুরোটা সময় জুড়ে আড়ালে থেকে আমার কথা শুনছিলো। সে তার টুপির নিচ থেকে মাথা তুলে তাকালো। তার সেই চেহারাটা, তার দৃষ্টিতে এক ধরণের কৌতুকীয় শাসানি – কারো কাছে মাথা নত করার ব্যাপারে। মেয়েরা যে কুকুর, ঘোড়া আর কখনো দূরবর্তী ভ্রমণে না গেলেও সেই কল্পনাটাকে ভালোবাসে, এটা তো তাদের দৃষ্টির কারণেই, তাই না?

“তাহলে আমি ভুলে যাওয়ার আগে ভিতরে আসো”, জিনি বললো।

আমরা মেইডিনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। ফুলের বেডে যেখানে পানি ছিটানোর পাত্র ছিলো ওখানে সবসময়ের মতো একই রবিন পাখিগুলো হাঁটছিলো। বাড়িটিতে আমরা আরো একবার পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম। আমরা একে অপরকে সাহায্য করলাম। আমরা টেলির পুদিনার জমিতে পা মাড়ালাম – হলুদ বিড়ালটি কোণাতে ঘোরাঘুরি করছিলো – পেছনের দরজার হাতলটি যথেষ্ট গরম ছিলো, হাত লাগানো যাচ্ছিলো না, এবং হাঁটার সময় একই সাথে দুইজন হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিলো, সূক্ষ্ম নকশা খচিত ফলের বোতলগুলোর ভেতরে পানির মধ্যে মূল গজিয়ে গিয়েছিলো। “মা আসছে, সাবধান!”, এমনটা হাজারবার ঘটেছে এই ঢোকার পথটিতে।

মিসেস স্টার্ক আমার দিকে আমার দিকে ছুটে আসতেই কাঁদো কাঁদো মুখটা কুঁচকে গেলো, এবং হন্তদন্ত করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করলেন তিনি – উনার বুক কাঁপছিলো – ওনার ছায়া ওনার সাথে সাথে একটি দীর্ঘনাসা ভালুকের মত হুড়োহুড়ি করে উপরে উঠে যেতে লাগলো। কিন্তু না ফিরে একবারে উপরে উঠে যাওয়া উনার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলো না। তিনি আবার নিচে নেমে আসলেন এবং আমার দিকে একটি আঙ্গুল তাক করলেন। এবং বললেন, “র‍্যান্ডল, তোমাকে গতকালের একটা তাসের খেলার কথা বলতে চাই। আমার পার্টনার ছিলো এমান্ডা ম্যাকেই। তুমি তো জানোই, খেলার সময় সে শুধু নিজের তাসগুলো দেখেই খেলে। পার্টনারের হাতে কী আছে, সে চিন্তাও করে না; একদম তোমার মতই। যাই হোক, সে একটি ইস্কাপন দিয়ে শুরু করলো এবং ফ্যানি ডাক দ্বিগুণ করে দিলো। আমার হাতে ছিলো একটা ইস্কাপন, রাজা-রাণীসহ পাঁচটা চিড়তন, রাজাসহ পাঁচটা হরতন, ও দুটো ছোট রুইতন। আমি বললাম দুইটা চিড়তন, গার্ট গিশ দুইটা রুইতন, এমান্ডা দুইটা ইস্কাপন, বাকিরা ডাক ছেড়ে দিলো। যখন আমি হাত নামালাম, এমান্ডা বললো, ‘ইস, পার্টনার! তুমি হরতনের ডাক দিলে না কেন’?

“আমি কিছু বলিনি, প্রতিপক্ষের ডাবল দেয়া অবস্থায় তৃতীয় দানে ডাকের অপেক্ষায়। বুঝলাম যে, তার কাছে শুধু দুই রঙের তাস ছিলো – টেক্কা ও গোলামসহ ছয়টা ইস্কাপন, এবং টেক্কা, গোলাম, ও দশসহ চারটা হরতন, সাথে ছিলো আমার চিড়তনের টেক্কা। দ্যাখো র‍্যান্ডল, এমান্ডা যখন দ্বিতীয়বার ডাক দেয়ার জন্য মুখ খুললো, তখন কিন্তু ও খুব সহজেই তিনটা হরতনের বাজি ডাকতে পারতো। কিন্তু না! সে শুধুমাত্র ওর নিজের তাস নিয়েই মত্ত ছিলো এবং ফলাফল স্বরুপ দুই ঘর নিচে নেমে এলাম আমরা, নাহলে আমরা পাঁচটা হরতনে যেতে পারতাম। এবার বলো, তোমার কি মনে হয় আমার তিনটা হরতনের বাজি লাগানো উচিৎ ছিলো?”

আমি বললাম, “না ডাকাটাই ঠিক হয়েছে, মিসেস স্টার্ক”। প্রথমে তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। এরপরেই এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন যেন আমি ওনাকে চড় মেরেছি। কত সহজেই উনি নিজের অসন্তুষ্টিকে আবার অভিযোগে রুপান্তরিত করে ফেললেন, এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন।

আমরা মোড় ঘুরলাম, পেছনের ছোট পড়ার ঘরের দিকে জিনি আমাকে পথ দেখাচ্ছিলো, ‘মায়ের অফিস’। আনুভূমিক দেয়ালচিত্র এবং একটা ডেস্ক নজরে আসলো। ডেস্কটা ‘ডটারস অফ দ্যা কনফেডারেসি’র জরুরি সব চিঠি দিয়ে ভর্তি ছিলো। সেলাইয়ের জিনিসপত্রের ঝুড়িটা নিয়ে দুলে দুলে টেলি ভেতরে এলো। এসে আমাদেরকে দেখছিলো, আমাদের অবস্থানও খেয়াল করছিলো এবং আমাদের মাঝে তার নিজের অবস্থানও দেখছিলো।

“ঝুড়িটা নামিয়ে রাখো, টেলি। এখন যাও। মুখটা বন্ধ রেখো, বুঝলে?” জিনি আকর্ষণীয় ছোট্ট ঝুড়িটা হাতে নিয়ে ঝাঁকি দিয়ে ঢাকনাটা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। আমার একটা বোতাম সেখানে দেখতে পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য সে টেলির দিকে তাকালো।

“শুনেছি, তুমি নাকি বেশ অগোছালো।” বলেই টেলি চলে গেল।

জিনি আমার দিকে তাকালো। সে আমার হাত ধরে টান দেওয়া মাত্রই আমি গুলি ছুঁড়লাম। জিনির দিকে তাক করে টার্গেট পয়েন্ট নির্দিষ্ট না করেই গুলি করলাম – একাধিকবার। একদম কাছ থেকে – পিস্তলটা বের করার মত যথেষ্ট জায়গা পর্যন্ত ছিলো না আমাদের মাঝে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুঁইয়ে সুতো পরাচ্ছিলো শুধু, তার হাত একেবারে স্থির ছিলো, গুলির শব্দে কাঁপেনি পর্যন্ত। চিমনীর ওপর রাখা স্বর্ণের ছোট হার্টটা আর চায়না ঘড়িটা শব্দ করছিলো – পিস্তলের শব্দ ওটাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

আমি জিনির দিকে তাকালাম, ওর পুঁচকে স্তন দু’টো আমার চোখে পড়লো, এটুকু স্তন থাকা না থাকা একই কথা! ওগুলো চিরে গিয়েছিলো, স্পষ্ট গর্ত দেখা যাচ্ছিলো যেগুলোতে আমার বুলেট ঢুকেছে। কিন্তু জিনি কিছুই টের পেলো না, শব্দটা ওই ফালতু ঘড়িটার কারণে চাপা পড়লো, আর সে সুঁইয়ে সুতো পরিয়ে ফেললো। তার ছোট্ট মুখটাতে সাফল্যের খুশি ফুটে উঠলো। সুঁইয়ে সুতো পড়াতে তার কখনও ভুল হতো না।

জিনি মুখ বন্ধ রেখেই আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে বললো, “নড়বে না”। সে তার যন্ত্রণা সম্পর্কে একেবারেই অবগত ছিলো না – সবই টের পাচ্ছিলো, শুধু দুঃখ ও যন্ত্রণা ছাড়া। যখনই সে রাগ করতো, সে আনমনে কিছু গান গাইতো। ঘরোয়া কোনো কথা বলার সময় তার কণ্ঠ এতটাই নিচে নেমে যেতো যে সেটা একেবারে অপমানজনক পর্যায়ে পৌঁছে যেতো। সেই অপমান আমাকে সারাটা জীবন কিছু একটা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। পুঁচকে প্রতারক কোথাকার! আমি নড়তে পারছিলাম না বলে অপেক্ষা করছিলাম, যখন সে আমার হাতা এবড়ো-থেবড়োভাবে সেলাই করছিলো; আমার অসহায় হাতের হাতা। আমি নিজের নিঃশ্বাস গুণছিলাম! এরপর আমি ধীরে ধীরে উত্তেজনাটুকু নিঃশ্বাসের সাথে ত্যাগ করে সরল হতাশা টেনে নিলাম, সে মরেনি। সে সুতোটি দাঁত দিয়ে কাঁটলো। সে যখন তার মুখ তুললো আমার তখন চঞ্চলতা অনুভূত হচ্ছিলো। প্রতারক কোথাকার!

আমি জিনিকে আর বিদায় জানানোর মত সাহস করতে পারিনি। সে আমাকে ক্রকেট খেলতে যেতে বললো। সে হলের আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল, নিজের চুল ছোট করা শুরু করে দিলো।

আমি ভেরা ল্যাসিটারকে চিনি, সে রুমে এসে হানা দিলো আর তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “ক্ষমা চাইছি”, সে বলে উঠলো, এবং সে শয়তানি করে জিনির ছোট্ট কোমল কোঁকড়া চুলে আঙ্গুল দিয়ে বললো, “কার মত হবার চেষ্টা করছো? কারো ছোট ভাই?”

কিন্তু জিনি আধো হাসিমুখে আয়নায় প্রতিফলিত তার প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে রইল, এতটা আবেদনময়ী, এতটা মিষ্টি, এতটা কোমল, বিপদাপন্ন, এতটাই স্পর্শকাতর যে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না! আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

রান্নাঘর হয়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম, বৃদ্ধা টেলি স্টোভে থুথু ফেললো এবং শব্দ করে একটা লোহার  ঢাকনা ফেলে দিলো। সে সাতাশটা বছর এখানেই কাটিয়েছে। মাঝে মাঝেই বলতো, “এই হাতেই জিনির জন্ম হয়েছে”। এখন বললো, “তুমি কোনো কাজেরই না, তুমি ওকে কোনো শাসনই করো না। কী হয়েছে তোমার? কোথায় ছিলে তুমি?”

বাইরে দেখলাম যে মেইডিন দোলনায় অপেক্ষা করছে, আমি ওর হাত ধরলাম এবং তাকে ক্রকেট খেলার ওখানে নেমে আসতে সাহায্য করলাম যেখানে আমরা সবাই জিনির খেলা খেলতাম।

হে ঈশ্বর, এসব মুছে দাও মুছে দাও, মুছে ফেলো এমনটা হতে দিও না

শেষ পর্যন্ত মিসেস জাজ ও’লিয়েরি আমাকে হলরুমে পেয়ে পাকড়াও করলেন এবং বললেন, “আমার জন্য একটা কাজ করে দাও, র‍্যান! প্লিজ, কাজটা করে দাও আর বেলাকে তার দুর্দশা থেকে মুক্তি দাও”। ওই স্কুল টিচারগুলোর একজনও এই কাজে আমার চেয়ে একটুও ভালো হবে না”। জাজ খুবই নরম মনের মানুষ। “তুমি কাজটা করো, র‍্যান। করো, আর শোনো, করার পর আমাদেরকে জানানোর দরকার নেই, বুঝলে?”

*****

– তুই কোথায় ছিলি খোকা?

– কোথাও না মা, কোথাও না।

– তুই যদি আমার সাথে থাকতি, তাহলে সবকিছুই একেবারে আগের মতনই থাকতো। খোকা, আশা করি তুই আমার সাথে যোগাযোগটা রাখবি, আর প্রমিজ কর –

*****

আর মিস্টার কিলিগ্রুর আচরণে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, অনেক ক্লান্ত। মেইডিন যখন সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে আইস হাউজের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, তখন আমি সংকুচিত বোধ করলাম। তখন আমি ওর মায়ের বিবাহপূর্ব নাম জানতাম। ঈশ্বর আমায় সাহায্য করো, পারসন্স নামটা আমার মাথায় গেঁথে ছিলো; যেসব মুকুট মাথার ওপর তুমুল চাপ দিতে থাকে, সেই মুকুটগুলোর মত। পারসন্স নামটা কিছুতেই ভোলা যাবে না।

“তোমার বিয়ের কথা আমার মনে আছে”, বৃদ্ধা লেডি হার্টফোর্ড আমার জানালার শিকের ভেতর দিয়ে আঙ্গুল গলিয়ে বললেন, “আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর বিয়ে ছিলো ওটা। এত জাঁকজমকপূর্ণ হবে, কখনো ভাবতেও পারিনি। তোমার যখন এতই টাকা ছিলো, তাহলে তুমি চাইলেই শহর ছেড়ে চলে যেতে পারতে”।

মেইডিন খুব সহজেই কাউকে বিশ্বাস করে ফেলতো – আমার ধারণা সে মিস ক্যালিকে বলেছে যে আমি তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে চাই, একটা সুন্দর সময় কাটাতে চাই – অন্য মানুষদের মতোই – কিন্তু আমি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ওটা স্থগিত করে রেখেছিলাম । তখনো তাঁর দেখার মতো চোখ ছিলো, আমরা সবসময় জিনির ওখানে যেতাম, জিনি-দুগান আর ওদের ভিড়ে। অবশ্য এই ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিলো না, সাবিনাতে থাকলে এমন হবেই। আর তারপর প্রায় উইলিয়ামদের ছোট মেয়েটিকে রাতে বাসায় নিয়ে আসতাম। সে ভালোই ব্রিজ খেলতে পারতো; মেইডিন কখনোই খেলাটা শেখেনি। মেইডিন – আমি কখনোই চুমু খাইনি মেয়েটাকে।

কিন্তু এক রবিবারে আমি তাকে ভিক্সবার্গ নিয়ে গেলাম।

রাস্তায় থাকতেই আমি ব্রিজ খেলাকে মিস করতে শুরু করলাম। আমরা চাইলে তখন আমাদের পুরনো খেলাটা শুরু করতে পারতাম – জিনি, দুগান, আমি আর প্রায়সময় উইলিয়ামদের ছোট্ট মেয়েটাও, একজন উইলিয়াম হবার পরেও সে খুব ভাল খেলতে পারতো। মিসেস স্টার্ক অবশ্যই চূড়ান্ত রকমের বিরক্ত হয়ে খেলা ছেড়ে যেতে চাইতেন। অবশ্য আমরা কেউই ওনাকে আমাদের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে চাইতাম না, চাইলে হয়তো আমরা ইঁচড়ে পাকা হয়ে যেতাম! যাই হোক, উনি না থাকাতেই বরং খেলাটা খুব ভালোভাবেই জমে উঠতো। আমাদের নীরবতায় মেইডিন একটুও ব্যাঘাত ঘটাতো না। সে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে সেটার পাতা উল্টাতো। একটু পরপরই সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতো, কিন্তু আমি তাকে বুঝতে দিতাম না যে আমি তার বিস্ময়টুকু খেয়াল করেছি। প্রতি রাতেই আমি জিততাম আর তাদের টাকা নিয়ে নিতাম। তারপর বাসায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়তাম, তবে বাইরে যেতাম যাতে টিচাররা অবাক না হয়। “তোমার এখন ছোট্ট মেইডিনকে অবশ্যই বাসায় পৌঁছে দেওয়া উচিৎ। ওর মা ভাববে, ওর সাথে বুঝি খারাপ কিছু হয়েছে। তাই না, মেইডিন?” – জিনি বললো। “আমি তোমাদের সাথে যাবো”- পিচ্চি উইলিয়াম মেয়েটি বললো। যাই হোক না কেন, মেইডিন কোনোভাবেই জিনির বাড়িতে কান্না শুরু করবে না। ওর ওপর আমার বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু সে কি কান্না করতে চেয়েছিলো? নাহ, এমন বোকা তো সে নয়!

ঘুমের জন্য পাগল হয়ে যেত মেয়েটা। সে নিজের চেয়ারে হেলান দিতো আর হেলতেই থাকতো। সে আমাদের সাথে কখনোই রাম (এক ধরণের মদ) আর কোক পান করতো না, কিন্তু ঘুমের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো। বাড়িতে ফেরার সময় সে গাড়িতে বসেই ঘুমাতো। বাড়িতে তার মা, যার বিবাহপূর্ব নাম পারসন্স, তখন বড় বড় চোখে তাকিয়ে এবং কান সজাগ করে বসে থাকতো। মেইডিনকে ঘুম ভাঙিয়ে জানাতাম যে আমরা শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে পৌঁছেছি। উইলিয়ামদের ছোট্ট মেয়েটা পেছনের সিটে বসে দুনিয়ার কথা বলতো, একদম পেঁচার মতো পুরোপুরি সজাগ বসে থাকতো।

*****

ভিক্সবার্গঃ উনিশ মাইল পাথরের রাস্তা, তেরোটি ছোট ছোট জলসেতু এবং বিগ ব্ল্যাক নদীর ওপারে। হঠাৎ করে সব উত্তেজনা যেনো ফিরে এলো।

যতক্ষণ না চোখের সামনে থেকে সাবিনা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো ততক্ষণ সাবিনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি, যতক্ষণ না রাস্তাটা আকাশে পেন্সিল দিয়ে আঁকা একটা ছোট দাগের মতো দেখাচ্ছিলো। সম্ভবত আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে সত্যিই ওখানে একটা আকাশের রাস্তা ছিলো, যেটা মূল রাস্তার সাথে মিশে গিয়েছিলো। সাথে ছিলো চারটি লাল ইটের ফলক, শাখাপ্রশাখাযুক্ত গাছ, একটা ছোট ক্রস চিহ্ন, কিন্তু আমি এসব আবেগের সাথে দেখছিলাম না। এটাকে আকাশে আঁকা একটা পেন্সিলের দাগের মত দেখাচ্ছিলো। সেখানে আর আমার সাবিনা ছিলো না। ইস্‌, যদি চিরস্থায়ী লাল নকল কিছু গাড়ি একটার সাথে আরেকটা যুক্ত হয়ে একটা ছোট চলমান খেলনার ট্রেইনের মতো তৈরি করতো! ছোটবেলার কথা আমি তেমন ভাবতাম না, কিন্তু সাবিনা আমার আত্মার সাথে মিশে ছিলো। ইস, এই ছোটো রাস্তায় আর আসা হবে না!

ভিক্সবার্গের পাদদেশে আমি গাড়ি থামালাম, দেওয়ালের নিচে, খালের ধারে। চোখ ধাঁধানো আলো জ্বলছিল, একটি জলছাপওয়ালা আলো। আমি মেইডিনের ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তার তেষ্টা পেয়েছে কিনা। সে তার জামার ভাঁজ ঠিক করলো এবং শহরের কোলাহলে মাথা তুলে বসলো। দেয়ালের পেছনেই চৌকোণা পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তাটায় যানজট লেগে ছিলো। আমি একটা ওয়াটার-ট্যাক্সি আসতে দেখলাম, দ্রুত গতিতে খালের সরু পথটা ধরে দোলনা-ঘোড়ার মত দুলে দুলে আমাদের দিকে আসছিলো ওটা।

“মাথা নিচু করে ঢোকো”, আমি মেইডিনকে বললাম।

“এটাতে?”

পানির খুব কাছেই দ্বীপটিতে সূর্যাস্তের গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়লো – উইলো গাছের একটি স্তুপ দেখা যাচ্ছিলো, হলুদ এবং সবুজ আঁশগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো একটার উপর আরেকটা বোনা হয়েছে। পানিতে ভ্রমণ করার সময় আমাদের চোখে আলো না পড়ার জন্য আমরা ছাউনি লাগালাম। আমরা সবাই আমাদের মাথা বাঁকা করে ওয়াটার ট্যাক্সির নিচু ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম।  যে নিগ্রোটি ইঞ্জিন চালকটা একবারের জন্যও মুখ খোলেনি; “ভেতরে আসুন” বা “নেমে যান” পর্যন্ত বলেনি।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”, মেইডিন বললো। দুই মিনিটের মধ্যেই আমরা বজরা নৌকায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশ বছরের পুরাতন ভগ্নপ্রায় ভাসমান মদের দোকানটির সাথে একই রকম দেখতে আরেকটা নৌকা যুক্ত ছিলো, ওখানে কৃষ্ণাঙ্গরা বসতো।

ভেতরে একজন মাত্র লোক ছাড়া আর কেউ ছিলো না –নিস্তব্ধ, নির্বাসিত একটা জায়গা, একদম গুদাম ঘরের মত। আমি তাকে কিছু কোক এবং রাম এনে বাইরের একমাত্র টেবিলটিতে রাখতে বললাম। তাস খেলার এই টেবিলটি দোকানের পেছনে বাইরের দিকে ছিলো এবং সাথে ছিলো দুটি বেতের চেয়ার। দ্বীপটিতে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিলো, এবং ভিক্সবার্গের অন্য অংশ আলোকিত করছিলো। আমরা শুধু পূর্ব-পশ্চিম দিক দেখতে পাচ্ছিলাম।

মেইডিন বললো, “আমাকে এসব খেতে জোরাজুরি কোরো না। আমি চাচ্ছি না”।

“খাও তো।”

“তোমার ভালো লাগলে তুমি খাও। আমাকে জোরাজুরি কোরো না।”

“তুমিও খাবে।”

আমি ওর দিকে তাকালাম, একটু রাম নিলাম, এবং এমনভাবে বসলাম যেনো ওর চোখে আলো না পড়ে। সেখানে পর্দাযুক্ত পুরনো দরজার উপরের তাক থেকে কিছু বোলতা নেমে আসছিলো, ওর মাথার ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। মাছের গন্ধও আসছিলো, দ্বীপটিকে ঘিরে রাখা ভাসমান মূলগুলোর গন্ধও আসছিলো। আরো ছিলো তাসখেলার টেবিল থেকে আসা তৈলাক্ত চাদরের ও অগণিত তাস বণ্টনের ভ্যাপসা গন্ধ। ওয়াটার-ট্যাক্সিতে চেপে কিছু নিগ্রো আসলো এবং কিছু টিনের কৌটা নিয়ে নেমে গেলো। ওদের সারা গায়ে গন্ধকের মতো হলুদ রঙ লেগে ছিলো, তুলোবিচি লেগে ছিলো। রঙিন নৌকার অপর প্রান্তে এক লাইন ধরে হারিয়ে গেলো ওরা, ওদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা স্থানে, যেন ওদেরকে এভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।

“সত্যি বলছি, আমি খেতে চাচ্ছি না”।

“খাও, খেতে খারাপ না”।

ভেতরে, মদের দোকানটির আবছা আলোতে, কাঁধের নিচে বন্দুক ঝোলানো দুজন মানুষকে দেখা গেলো। কোনো শব্দ ছাড়াই দুজনই কর্দমাক্ত বুটজুতা নিয়ে কাউন্টারের সামনে এলো, মদ্যপান করলো। বন্দুকের নলটি ছিলো সম্মোহিত করার মত স্থির। ওরা দ্বীপের পাশে রাখা নৌকাটিতে উঠে উইলো গাছের ডালগুলোর পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেলো। উইলো গাছগুলোকে উত্তাপের জন্য আবছা দেখাচ্ছিলো। ওদেরকে হয়তো আর কখনোই দেখা যাবে না।

সূর্যরশ্মি যেন পানির উপর কাঁপছিলো। খালের অপর তীরে পুরনো সাদা ভবন ও কংক্রিট দ্বারা বাঁধানো পাড়টা উত্তাপে ঢেউ খেলানো মনে হচ্ছিলো। নৌকা থেকে ভিক্সবার্গকে দেখতে মনে হয় যেন জরাজীর্ণ আয়নাতে তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি – যেনো তার জীবনের একটি দুঃখভরা মুহূর্তের প্রতিকৃতি।

একজন বুটজুতা পরা খাটো রাখাল-বালক এবং তার সঙ্গিনী একইভাবে হেঁটে ভেতরে আসলো। তারা  মুদ্রাচালিত গান বাজানোর যন্ত্রে (nickelodeon) একটি নিকেলের মুদ্রা প্রবেশ করালো।

খালটিতে কোনো ঢেউ দেখা যাচ্ছিলো না, তারপরেও আমরা একটু একটু দুলছিলাম। শীতের সময় ঘরের ভেতর প্রজ্জলিত আগুনের শব্দ যেমন টের পাওয়া যায়, ওরকম করে ঢেউটা টের পাচ্ছিলাম।

“তুমি কখনোই নাচো না, তাই না?”, মেইডিন বললো।

নৌকা ছাড়ার আগে ওখানে অনেক্ষণ ছিলাম আমরা। অনেক ধরনের মানুষ এসেছিলো নৌকাতে। শ্বেতাঙ্গ এবং নিগ্রো, দুই পাশই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। নৌকা ছাড়তে ছাড়তে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। পাড়ের আলোগুলো আবছাভাবে ঝিকমিক করছিলো – পুরনো ছাউনি, গুদাম ঘর, দীর্ঘ কালো দেয়াল দেখা যাচ্ছিলো। শহরের দূর্গগুলোর উপর থেকে কিছু পুরনো লোহার ঘণ্টার শব্দ আসছিলো।

“তুমি কি ক্যাথলিক?”, আমি তাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, এবং তার উত্তর শোনার জন্য মাথাটাকে একটু ঝোঁকালাম ।

“না”।

আমি তার দিকে তাকালাম – বুঝিয়ে দিলাম যে সে আমার কিছু আশায় পানি ঢেলে দিয়েছে, যদিও তার সামনে বলতে পারছিলাম না আশাটা কী।

“আমরা সবাই ব্যাপ্টিস্ট। কেন, তুমি কি ক্যাথলিক নাকি”? হাহ, সাবিনাতে তো কেউই ক্যাথলিক ছিলো না।

“না”।

মাঝে মাঝে আমার হাঁটুর গুঁতোর কথা বাদ দিলে ওকে স্পর্শ করা ছাড়াই তাঁর পিছে পিছে ঢালের এবড়ো-থেবড়ো পথ বেয়ে উঠছিলাম, ওখানের উপরেই আমার গাড়িটি খাড়া ঢালের নিচের দিকে মুখ করে পার্ক করা ছিলো। গাড়ির ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করতে পারছিলো না সে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখলাম, দরোজাটা হাঁ করে খোলা ছিলো। মেয়েটা তিন/চার বার মদ খেয়েছিলো, প্রতিবারই আমার জোরাজুরিতে। এখন সে আর দরজা বন্ধ করতে পারছিলো না।

“আমি পড়ে যাবো, তোমার কোলে পড়ে যাবো। পড়ে যাবো, আমাকে ধরো”।

“না, পড়বে না। জোরে বন্ধ করো, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে”।

অবশেষে আমি তার দরজা বন্ধ করে অল্প সময় হেলান দিয়ে থাকলাম।

আমি পাথরের ঢাল বেয়ে উঠলাম, ঘুরে গিয়ে নদীর উঁচু পাড়ের রাস্তার দিকে গেলাম, আবার ঘুরে গেলাম অমসৃণ পাড়ের গাড়ির চাকার গভীর দাগওয়ালা রাস্তাটার দিকে – অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্যাঁচানো এবং বিপদজনকভাবে নিম্নমুখী।

“আমার হাতে হেলান দিও না”, আমি বললাম, “উঠে বসো, একটু শ্বাস নাও”।

“ইচ্ছে করছে না”, সে তার কোমল কণ্ঠে এমনভাবে বললো যে আমি ওর কথা প্রায় বুঝতেই পারছিলাম না আর।

“একটু শুতে চাও?”

“না, শুতে চাই না।”

“একটু শ্বাস নাও।”

“আমাকে শুতে বোলো না। আমি কিছুই করতে চাই না, একদম কিছুই না।”

“তুমি মাতাল হয়ে আছো।”

“আমি এখন থেকে আজীবন কোনোদিন আর কিছুই করতে চাই না।”

আমরা প্যাঁচানো রাস্তা ধরে নিচে নামলাম। নদীর শব্দটা ধাক্কার মতো লাগছিলো, মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো। শব্দটা এমন অদ্ভুত যেন একটা দেয়াল চলা শুরু করেছে, আর এর উপরে মাছ, সরীসৃপ, গাছ, এবং মানুষের ফেলে দেয়া আবর্জনাগুলো ওলটপালট হচ্ছে। বিকট গন্ধের একটি ধাক্কা আমার মুখে আঘাত করলো। রাস্তাটি এমনভাবে নেমে এসেছিলো যেনো একটা গভীর গর্ত এবং আমরা ছিলাম পৃথিবীর তলদেশে। গাছগুলো মাথার উপরে মিলিত হলো, সিডার গাছেরা একত্রিত হলো, এবং তাদের মাধ্যমে ভিক্সবার্গের নক্ষত্রগুলোর দৃশ্যপট পরিবর্তিত হলো। নক্ষত্রগুলোকে খুব সূক্ষ্ম দেখাচ্ছিলো, অনেক উঁচুতে ও অনেক দূরে। একটি গুলির শব্দ শোনা গেলো, দূরে কোথাও থেকে এসেছে শব্দটা।

“ঐ যে নদী”, মেইডিন বললো, “আমি দেখতে পাচ্ছি – মিসিসিপি নদী।”

“দেখতে পাচ্ছো না। আমরা অতোটা কাছে না।”

“আমি দেখতে পাচ্ছি, নিশ্চিত।”

“আগে কখনো দ্যাখোনি, খুকুমণি?

“আগে? না, আগে কখনোই মিসিসিপি নদী দেখিনি। ভেবেছিলাম, আমরা নৌকাতে মিসিসিপি নদীতেই ছিলাম।”

“দ্যাখো, রাস্তা শেষ হয়ে গেছে।”

“এত দূর আসার পরে শেষ হয়ে গেলো কেন?”

“আমি কী জানি! মানুষ কেন আসে এখানে?”

“কেন আসে?”

“পৃথিবীতে কত রকমের মানুষ আছে।” দূরে কেউ একজন কিছু একটা পুড়ছিলো।

“খারাপ লোক আর নিগ্রোদের মত? আত্মগোপনকারীদের মত? মদ ব্যবসায়ীদের মত?

“এই যে, জেলেরা, নদীর মানুষেরা, বন্ধুক যোদ্ধারা। তুমি দেখি জেগে উঠেছো।”

“আমার মনে হয়, আমরা হারিয়ে গেছি”, মেইডিন বললো।

*****

মা বললো, “আমি যদি কখনো দেখতাম যে তুই ঐ জিনি স্টার্কের কাছে ফিরে যেতে চাইছিস, তাহলে আমি আমার মাথা ঠিক রাখতে পারতাম না।

– না মা, আমি কখনোই ফিরে যাবো না।

– গোটা বিশ্ব জানে, ও তোর সাথে কী করেছে।

*****

“আসলে তুমি স্বপ্ন দেখেছো যে আমরা হারিয়ে গেছি। এমন কোথাও যাবো যেখানে তুমি একটু শুতে পারবে।”

“সাবিনাতে কিন্তু হারিয়ে যাওয়া যায় না।”

“একটু বিশ্রাম নিলেই তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। চলো, এমন কোথাও যাই যেখানে তুমি শুতে পারবে।”

“আমি শুতে চাই না।”

“জানো, এরকম ঢালু পাহাড়ে গাড়ি উল্টোদিকে নিচে গড়িয়ে পড়তে পারে?”

“মরবে তুমি একদিন।”

“বাজি ধরে বলতে পারি, কেউ কখনোই এইরকম পাগলামি দেখেনি। তোমার কি মনে হয়, কেউ দেখেছে?”

আমরা প্রায় পুরোপুরি খাড়া রাস্তায় উঠা-নামা করছিলাম। কিছুক্ষণ খাড়া পাহাড়ের কিনারায় ঝুলছিলাম, গাড়ির পেছনের প্রান্ত ওপরে নিচে দুলছিলো, আমরা ঝাঁকি খাচ্ছিলাম, এপাশ-ওপাশ দুলছিলাম। অবশেষে আমরা চূড়োয় পৌঁছলাম। আমি যদি সেই শেষের মদটুকু না খেতাম, তাহলে সম্ভবত আমি এরকম বিপদজনক বাঁকগুলো নিতাম না, আর এতো বাহাদুরিও দেখাতাম না। যদি তুমি একটি হামিং বার্ডকে ফুলের উপর দেখে থাকো, তাহলে বুঝবে গাড়িটি কেমন সুন্দর করে কিনারার একেবারে প্রান্তে খাড়াভাবে হেলে ছিলো।

আমরা অনেক দূর পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে গেলাম। পথে চোখে পড়লো অন্ধকার পার্কের মূর্তিগুলো, একইরকম ভঙ্গিমার পুনরাবৃত্তি, বার বার ঘুরে ফিরে আসা অচেনা পাহাড়ের পাথরের খাঁজগুলো, আর প্যাঁচানো সিঁড়িযুক্ত ও ভগ্নপ্রায় মিনারগুলো।

আমি চাঁদের খোঁজে ওপরে তাকালাম, শেষ চতুর্ভাগে থাকার কথা। ঐ তো! বাতাস ছিলো, তবে অন্ধকারের বদলে ছিলো আবছা আলো, আর ভাসমান শব্দ – প্রায় মিলিয়ে যাওয়া চাঁদটির দিকে তাকিয়ে থাকা পৃথিবীর সকল মানুষের রাতের শ্বাসের শব্দ।

উদীয়মান চাঁদের নিচে আমরা উন্মত্ততার সাথে ভ্রমণ করতে লাগলাম। মেইডিন একেবারে স্থির থাকলো, হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলো; যেন তার কিছু একটা বাসনা ছিলো, হয়তো ঘুমের বাসনা – কিংবা অন্য রাস্তা ধরে চলে যাওয়ার বাসনা। ভূতের মতো সাদা একটি র‍্যাকুন রাস্তা পার হলো, জিপসিদের একটা ক্যাম্প পার হয়ে গেলো – সবাই ঘুমাচ্ছিলো।

রাস্তার পাশে একটি চুনকাম করা গাছে আলো পড়ে সেটাকে ঝলসে দিলো। চোখে পড়লো বৃত্তাকারে সাজানো কিছু চুনকাম করা অন্ধকার কুঁড়েঘর, সেগুলোর পেছনের গাছ, আর ঘরগুলোকে ঘিরে রাখা সাদা কাঠের একটি বেড়া। কাঠগুলো ছিলো সানসেট ওক গাছের। এতো রাতে একটি ছোট্ট নিগ্রো ছেলে ঐ গেইটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, ওর মাথায় প্রকৌশলীদের মত টুপি।

কুঁড়েঘরগুলো কাছেই মনে হচ্ছিলো। আমি গেইট খুলে ভেতরে ঢুকলাম, টাকা জমা দিলাম।

দরজার কাছাকাছি এসে আমি মেইডিনকে বললাম, “আর এক কদম”।

আমি বিছানায় বসলাম, লোহার রড দ্বারা তৈরি করা পুরনো বিছানা। মনে হয় বলেছিলাম, “তোমার জামাকাপড় খুলে ফেলো”।

সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো। ঘরের শেষ মাথায় একটা ঢাকনাহীন বাতি জ্বলছিলো – সাথে লাগানো লম্বা তারটা দেখে মনে হচ্ছিলো যেনে কেউ এটাকে টেনে লম্বা করে দিয়েছে। সে আমার দিকে ফিরলো, তারপর ওর স্নিগ্ধ কাঁধদুটো বাঁকিয়ে চেয়ারটির দিকে আত্মবিশ্বাসের সাথে ঝুঁকলো। ঐ রাতে, ওর সাদা ছোট পুরনো পোশাকটি সেই চেয়ারটিতেই শোভা পেয়েছিলো।

আমি ঝুলে থাকা বাতিটি নিভিয়ে দিলাম। কক্ষটা আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো যেন কোনো কুয়োতে একটি বালতি পড়লো। এক মুহূর্তের জন্যও পুরোপুরি অন্ধকার ছিলো না যদিও। বিশাল আকাশ থেকে আগস্টের আলোর ঝলকানি এসে ফাঁকা কক্ষগুলোতে এবং নিঃসঙ্গ জানালাগুলো দিয়ে হুড়োহুড়ি করে ঢুকছিলো। উল্কা বৃষ্টির মাস! বছরের এই সময়টাকে ঘৃণা করি আমি।

আমরা একসাথে বিছানাতে শুতে গেলে সাথে সাথে আমার পিঠ বিছানার শক্ত রডগুলোতে চাপ খায়, আর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি – একটার পর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস। আমি নিজের দীর্ঘশ্বাস শুনেছিলাম।

“উঠে পড়ো”, আমি বললাম, “পুরো বিছানাটাই লাগবে আমার। তোমার আর কোনো দরকার নেই এখানে”। আমি দেখালাম যে আমার কাছে পিস্তল আছে। আমি পিস্তলটি সামনে ধরে পিঠ দিয়ে হেলান দিলাম এবং তাকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলাম। ঠিক এমনটা জিনির সাথেও করতাম; ভোরে স্বপ্ন দেখতাম এবং জিনি আমাকে সেই স্বপ্ন থেকে বের করতো।

মেইডিন আমার বাহু ধরে আলতোভাবে টানছিলো, কিন্তু ওর হাতে কোনো জোরই ছিলো না। সে উঠলো, আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো, রাতের আলোতে তাকে একদম সাদামাটা দেখাচ্ছিলো। একদম অগোছালো!

ওর গায়ে রক্তের দাগ ছিলো। রক্ত আর কলংক! হয়তো ছিলো না; আমি এই ব্যাপারে কিছুই মনে নেই। এক মুহূর্তের জন্য আমি দেখলাম, সে দুজন হয়ে গেছে।

“দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে”, আমি বললাম।

সে আমার সাথে কথা বলছিলো, কিন্তু আমি শুধু আশেপাশের গোলমালের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম – ব্যাঙ ও নিশাচর পাখিদের শব্দ, বুটজুতা পরা একটা পায়ের শব্দ; এবং গর্দভ পুঁচকে নিগ্রোটার বেড়ার এদিক-ওদিক দৌড়ানোর শব্দ, লাঠি দিয়ে বেড়ার গায়ে শব্দ করতে করতে যাচ্ছিলো, আবার ফিরে আসছিলো, বার বার।

“এটা আমার দাদুর ডুয়েলিং পিস্তল – এমন দুইটা ছিলো, তার মধ্যে এটা একটা। খুব মূল্যবান।”

“না, র‍্যান, এমনটা কোরো না। প্লিজ, না।”

আমি যখন ওর সাথে আবার কথা বলার মুখ খুলেছিলাম, সেটা মিথ্যে বলার জন্য। এটা আমার বাবার পিস্তল ছিলো ঠিকই, কিন্তু কখনো এটার ব্যাপারে কোনো পাত্তা দিতেন না তিনি। যখন সে মুখ খুললো, আমি ওর কথা শুনলাম না। ওর ঠোঁট পড়ছিলাম। ট্রেইনের জানালার ফাঁক দিয়ে যাদেরকে বিদায় জানানো হয়, ওরা যেমন ঠোঁট পড়ে, তেমন। পিস্তলটার নল এখন আমার নিজের মুখের দিকে, একদম স্থির। বাইরের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিলো গেইটের ছোট্ট নিগ্রোটি বুঝি আর কোনোদিন থামবে না – বেড়ার গায়ে লাঠিটা লাগিয়ে দৌড়াতেই থাকবে, এদিক-ওদিক, শেষ প্রান্তে যাবে এবং আবার ফিরে আসবে।

*******

বেচারি বেলা, বছরের ওই সময়টা ওর জন্য যথেষ্ট গরম ছিলো। ওইদিন সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো, ওর সরু ছোট্ট কপাল কুঁচকে ছিলো, নাকটি ছিলো ফলের ফেলে দেয়া খোসার মতো শুকনা। আবহাওয়ার কারণে ভোগান্তিটা আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। ওর কখনোই একটা লম্বা পুরু লোম ছিলো না, আমার মতে এটা ইতিবাচক দিক। সে ছিলো শুধুমাত্র সাধারণ একটা কুকুর, জাতপাত নেই; এমনটাই আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম।

*******

আমি চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। কী হয়েছিলো? নাহ্‌ – আসলে চিন্তা করছিলাম, কী হয়নি? কিছু একটা হয়নি। দুনিয়াটা যেন স্থবির হয়ে ছিলো। আসলে মনে হচ্ছিলো দুনিয়াটা চলছিলো ঠিকই, কিন্তু একটা সময় বাস্তবতার বাইরে চলে গেলো। আমি হাঁটছিলাম, যেন আমি একজন দড়ির উপর হেঁটে খেলা প্রদর্শনকারী, কিন্তু আমার কাছে কোনো দড়ি নেই। কত দূরে? আমার কোথায় পড়ে যাওয়ার কথা? ঘেন্না লাগছিলো। সব উদঘাটিত হচ্ছিলো এবং ঘেন্না লাগছিলো। তারপর, একটু পরেই মনে হলো…… বিধ্বস্ততাগুলো বাস্তব ছিলো না, অপমানগুলো বাস্তব ছিলো না, মৃত্যুগুলোও নয়। ওরা সবাই জেগে উঠলো আবার, জিনি এবং দুগান জেগে উঠলো …

গর্দভ ছোট্ট নিগ্রোটি এদিক-ওদিক আসা যাওয়া করছিলো। ওর সময় ভালোই কাটছিলো। কখন বন্ধ করবে সে? এবং তখনি তা বন্ধ হলো।

আমি পিস্তলের মুখ আমার নিজের মুখে রাখলাম। আমি এর সব কলকব্জার স্বাদ পাচ্ছিলাম। এরপর আমার মুখ দিয়ে পিস্তলের মুখটা দ্রুত চেপে ধরলাম, সেই বাচ্চাদের মত যাদের খিদে প্রতি মিনিটে বাড়তে থাকে, যাকে কখনোই কোনোভাবে জলদি আশ্বস্ত বা সন্তুষ্ট করা যায় না। তখনো সেখানে মেইডিন ছিলো, সাদা পেটিকোট পরা অবস্থায়।

“এমন কোরো না র‍্যান। প্লিজ, এমন কোরো না।

তৎক্ষণাৎ আমি তা করে ফেললাম – ভয়াবহ শব্দটি করলাম।

এবং সাথে সাথে সে বললো, “দেখলে? এটি কাজ করেনি। এবার এক কাজ করো। এই মান্ধাতা আমলের জিনিসটা আমাকে দাও, এখন থেকে আমার কাছে থাকবে এটা”।

সে আমার কাছ থেকে ওটা নিয়ে নিলো। সে ওটা চেয়ারের উপর এমনভাবে নিয়ে গেলো যেনো ওটাকে বাজেয়াপ্ত করার জন্যেই তার জন্ম। সে ওটাকে তার কাপড়ের ভাঁজে রেখে ওটার মামলা চুকিয়ে খাটের কিনারায় এসে বসলো। মিনিটের মধ্যেই সে আবার তার হাত বের করলো, তবে এবার একটু ভিন্নভাবে, এবং আমার কাঁধে স্পর্শ করলো। তখন আমি ওটাকে ধরলাম, শক্ত করে, আমার মুখ দিয়ে, ছোট, রোগা, ছুলীযুক্ত (আমি জানতাম) হাত, যেটাকে আমি ঘৃণা করতাম (হ্যাঁ, আমি জানতাম), এবং চুমু খেলাম ও কামড়ালাম যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার ঠোঁটে আর জিহ্বায় লবণাক্ত চোখের-পানি ও লবণাক্ত রক্তের স্বাদ পেলাম – হাতটা জিনির ছিলো না। তারপর আমি বিছানার রডগুলোর সাথে পিঠ ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম।

সে বললো, “খুব জড়সড় হয়ে আছো যে!”

আমি শুয়ে রইলাম, কিছুক্ষণ পর আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। তখন আবার ওকে দেখলাম। আমার পাশে শুয়ে সেদিন সে নীরবে নিজের জন্যেই চোখের জল ফেলছিলো। কান্নাটা কোমল, স্নিগ্ধ, আর ধ্যানমগ্ন; শাস্তি পাওয়ার অনেক পরেও একটা বাচ্চা যেমন করে কাঁদে, তেমন।

আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সে যে নিজেকে এভাবে কষ্ট দেবে, তার আমি কী জানি? আমার কী দোষ?

তো – আমার জিনি কোথায় গেলো, হুম?

*****

লেখক পরিচিতি

ইউডোরা ওয়েল্টি (১৯০৯ – ২০০১) মিসিসিপি প্রদেশের জ্যাকসন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রেট ডিপ্রেশনের (১৯৩০ এর একটি নির্দিষ্ট সময়কাল, যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং গণ-বেকারত্ব বিদ্যমান ছিল) সময় কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকে পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু নিউ-ইয়র্কে একটিও কাজ খুঁজে পাননি, তাই তিনি জ্যাকসনে ফিরে যান এবং একটি রেডিও স্টেশন ও একটি সংবাদপত্রে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি ‘ওয়ার্ক্স প্রগ্রেস এডমিনিস্ট্রেশন’–এ একজন প্রচারক হিসেবে চাকরি নেন, এবং মিসিসিপির মানুষের গল্প লিপিবদ্ধ রয়েছে এমনসব উপাদান জড়ো করতে থাকেন। একই সময়ে তিনি লেখক ও সুরকারদের একটি দল গঠন করেন, যেটির নাম রাখেন ‘নাইট ব্লুমিং সিরেয়াস ক্লাব’।

১৯৪১ সালে ওয়েল্টি ক্যাথারিন অ্যান পোর্টারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন এবং তারা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। ওয়েল্টির প্রথম ছোটগল্প সমগ্র ‘এ কার্টেইন অব গ্রীন’  সেই বছরই প্রকাশিত হয়। তিনি গগেনহেম ফেলোশিপ অর্জন করেন, যার মাধ্যমে তিনি ইউরোপ ভ্রমণে সমর্থ হন। পরে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার প্রদান করতেন এবং সেই লেকচারসমগ্রকেই সংকলিত করেন তার ‘ওয়ান রাইটার্স বিগিনিংস’-এ। কথাসাহিত্যে তার কাজের মধ্যে ‘ডেল্‌টা ওয়েডিং’‘দ্যা পন্ডার হার্ট’‘কালেক্টেড স্টোরিজ’, এবং ‘লুজিং ব্যাটল্‌স’ উল্লেখযোগ্য। সিরিজ সম্পাদক মার্থা ফলি ওয়েল্টির কথাসাহিত্যের বর্ণনায় বলেন, “সমসাময়িক দক্ষিণী কথাসাহিত্যিকদের তুলনায় বিচিত্র চরিত্রসমূহের সভ্য ও কম উৎকট উপস্থাপনা।”

ওয়েল্টি তার ‘দ্যা অপ্‌টিমিস্ট ডটার’ এর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান। তার কর্মজীবনে তিনি যেসব সম্মান লাভ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ও হেন্‌রি’ এ্যাওয়ার্ড, একটি ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড, একটি ন্যাশনাল মেডেল অব আর্ট্‌স, এবং ফ্রেঞ্চ শিভেলির দে লা লেজিওন ডি’অনার।

প্রত্যুত্তর দিন

আপনার ইমেইল প্রকাশিত হবে না। Required fields are marked *