যখন আকাশে একটি পূর্ণালোকিত চাঁদ উঠে, তখন চাঁদের ধরিত্রীমুখী অংশটুকু সূর্য দ্বারা প্রজ্বলিত হয়ে উঠে যা চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের নিকট নেমে আসে। যদিও চাঁদ দিগন্তে সরু একটি রুপালী বিন্দু, তারপরেও কখনো কখনো আপনি উজ্জ্বল অর্ধচন্দ্রাকার শৃঙ্গদ্বয়ের উপর সম্পূর্ণ চাঁদের আভা দেখতে পাবেন। সূর্যালোক আমাদের গ্রহ হতে প্রতিফলিত হয়ে চন্দ্রাপৃষ্টে আপতিত হয়ে আবারও আমাদের কাছে পুনরায় ফিরে আসার দরুন এমনটি ঘটে, এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকেই ধরিত্রীদীপ্তি বলা হয়। চাঁদ পূর্ণালোকিত হলে, অধিক সূর্যালোকের প্রতিফলন পৃথিবী হতে যাওয়া আলোর মৃদু প্রতিফলনকে পরাভূত করে। অপরদিকে, যখন শুধুমাত্র সরু চন্দ্ররেখা থাকে, পৃথিবী হতে প্রতিফলিত সূর্যালোক চাঁদের বুকে ক্ষীণ দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়।
৫০০ বছর আগে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি সর্বপ্রথম ধরিত্রীদীপ্তির উৎস নিরূপণ করেছিলেন। আলো এবং ছায়ার পারস্পরিক এই মেলবন্ধন একজন শিল্পী হিসেবে ভিঞ্চিকে বিমোহিত করে তুলতো। যদিও, একজন উদ্ভাবক হওয়ায়, এই জ্যোতিবিজ্ঞানীয় ধাঁধাঁ সমাধানে ভিঞ্চি তাঁর কল্পনা ও উদ্ভাবনীয় দক্ষতা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন। পৃথিবী এবং চাঁদ উভয়েই প্রতিফলক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় ভিঞ্চি প্রস্তাব করেন সূর্যালোকের পৃথিবী হতে প্রতিফলনের আলো চাঁদে পড়ার ফলই হচ্ছে ধরিত্রী দীপ্তি। |
১৫০৬ হতে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা ‘কোডেক্স লেসচার’ বইয়ে ভিঞ্চি লিখেন, ‘পৃথিবীর মহাসাগর ও সমুদ্রের প্রতিফলিত সূর্যালোক চাঁদের সাগরে আছড়ে পরে’। সেই প্রতিফলিত চান্দ্রজলই আমাদের কাছে পুনরায় ফিরে এসে অর্ধচন্দ্রাকার শৃঙ্গের উপর সম্পূর্ণ চাঁদের আবছায়া তৈরি করে। ভিঞ্চির ধরিত্রীদীপ্তির মূল ধারণাটা ছিল অসাধারণ, যদিও আমরা এখন জানি চাঁদ মোটেই জল দিয়ে পরিবেষ্টিত নয় বরং কিছু শক্ত পাথর দিয়ে তৈরি, তবে এটাও সত্য যে এখনও অনেক লোকে বিশ্বাস করে যে সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের বায়ুমণ্ডলের মেঘই পৃথিবীতে আপতিত অধিকাংশ সূর্যালোক প্রতিফলিত করলেও সমুদ্র হতে শুধুমাত্র শতকরা ১০ ভাগ আলো প্রতিফলিত হয়ে চাঁদে পৌছাতে পারে। মেঘমন্ডল প্রায় ৫০ ভাগ আলো প্রতিফলিত করতে পারে। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলই মেঘ দিয়ে আবৃত থাকে তা সত্ত্বেও বরফ ও তুষারই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক প্রতিফলনকারী বস্তু। আমাদের গ্রহের প্রতিফলিত আলোকরশ্মির অধিকাংশই মেঘমন্ডলের আয়ত্তে থাকলেও ঋতুভেদে তা পরিবর্তিত হয়। এটাই চাঁদের অন্ধকার অঞ্চলের উপর ঔজ্জ্বল্যতার পর্যায়বৃত্তিক পরিবর্তনের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
একটি অর্ধচন্দ্রাকার রাতে যদি নভোচারীরা চাঁদ হতে পৃথিবীর দিকে তাকাই, তবে পৃথিবীকে একটি পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও ৫০ গুণ উজ্জ্বল দেখতে পাবে। এটি রাতের আকাশ হতে সকল উদ্ভাসিত আলো একত্রিত করে আলতো ভাবে চাঁদের বুকে ছুঁড়ে দিবে। যেহেতু নভোচারীরা এখন অবধি চাঁদের প্রদোষকাল যাপনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে নি, তাই নাসা নভোচারীদের উল্লেখযোগ্যভাবে ভবিষ্যতে অধিকতর দীর্ঘ সময়ের জন্য চাঁদে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জনের পরিকল্পনা করছে, যা সরাসরি ধরিত্রীদীপ্তি ও ‘ভিঞ্চি দ্যুতি’র অভিজ্ঞতা দিবে।
লেখার মূল সূত্রঃ Astrophysics and Astronomy