কসমসের দ্বাদশ এপিসোডে, কার্ল সেগান তার বন্ধু এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির সহযোগী গবেষক ফ্র্যাংক ড্রেইকের সমীকরণটা বোঝাচ্ছিলেন। এই সমীকরণ ব্যাখ্যা করে, আমাদের ছায়াপথে প্রাণসমৃদ্ধ কয়টা গ্রহ থাকতে পারে। নিচে ঐ পর্বের সেই অংশটুকু বাংলা সাবটাইটেল সহ দেখতে পারেন। আর সে অংশটুকুর টেক্সট ভার্সনও নিচে দেয়া হলো।
এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেডিও/রাডার টেলিস্কোপ। নাম – অ্যারেসিবো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। অবস্থান – পুয়ের্তো রিকো দ্বীপের প্রত্যন্ত উপত্যকা। এটা রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ করে, গ্রহণও করে। এটা এতো বিশাল আর শক্তিশালী যে ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরের রেডিও টেলিস্কোপের সাথেও যোগাযোগ করতে পারে। অর্থাৎ, আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে অর্ধেক পথ। অ্যারেসিবো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটা মহাশূন্যে ভিন্ন সভ্যতার সিগন্যাল খোঁজে। শুধু একবার, একটা বার্তা পাঠানো হয়েছিলো দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ M13-এ। কিন্তু আলাপ করার মত কেউ কি আছে? শুধু আকাশগঙ্গার ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের মধ্যে, আমাদের পৃথিবীটাই কি একমাত্র বসতিপূর্ণ গ্রহ? এই সম্ভাবনা কতটুকু যে, আমাদের ছায়াপথ প্রাণের দোলায় স্পন্দিত হচ্ছে, গুণগুণ করছে? হয়তো রাতের আকাশের ঐ আলোর বিন্দুগুলো থেকে, আমাদের চেয়ে একদম ভিন্ন কেউ, আলস্য নিয়ে সূর্য নামক নক্ষত্রের দিকে তাকায় আর ক্ষণিকের জন্য (এখানে প্রাণ থাকার) অবিশ্বাস্য কল্পনা করে।
নক্ষত্রের সংখ্যা অগণিত। তাদের কয়েকটাতে বাসযোগ্য গ্রহ থাকবে। সেই গ্রহগুলোর কয়েকটাতে বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেবে। সেই সভ্যতাগুলোর কয়েকটা হয়তো নিজেদের প্রযুক্তি আর আবেগের ফাঁদ এড়াতে পারবে। সভ্যতা অনেক হলে অন্তত একটা কাছাকাছি থাকার কথা। সভ্যতার সংখ্যা কম হলে সবচেয়ে কাছেরটাও হয়তো অনেক দূরে। চমৎকার একটা প্রশ্ন হলো – কয়টা উন্নত সভ্যতা আছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে, যারা অন্তত রেডিও এস্ট্রোনমিতে সক্ষম?
ধরি, এমন সভ্যতার সংখ্যা বড় হাতের N. সংখ্যাটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আকাশগঙ্গায় থাকা মোট নক্ষত্রের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। ধরি, সংখ্যাটা N_x. যেসব নক্ষত্রে গ্রহ আছে, তার ভগ্নাংশকে ধরি, f_p. প্রাণের অনুকূল পরিবেশ আছে, সৌরজগতে এমন গ্রহের সংখ্যাকে ধরি n_e. যতগুলো অনুকূল গ্রহে আসলেই প্রাণ জন্ম নেয়, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_l. যতগুলো বসতিপূর্ণ গ্রহে বুদ্ধিমত্তার উত্থান হয়, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_i. যেসব গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীরা প্রযুক্তি আর যোগাযোগের ক্ষমতা অর্জন করে, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_c. সবশেষে, এটি নির্ভর করে – গ্রহটির আয়ুর কতটুকু অংশ প্রযুক্তিগত সভ্যতা ধারণ করে। সেটাকে ধরি f_L. সবগুলো সংখ্যাকে গুণ করলে পাই N এর মান, প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার সংখ্যা।
সমীকরণটি কর্নেল ভার্সিটির ফ্র্যাংক ড্রেকের বানানো। এটা আসলে একটা বাক্য, যার ক্রিয়াপদ হচ্ছে “সমসংখ্যক হওয়া”। আসুন দেখি, সমীকরণটি কীভাবে কাজ করে। খুব সাবধানে, আকাশের একটি ছোটো কিন্তু আদর্শ অংশে নক্ষত্রের সংখ্যা গুণে আমরা দেখলাম যে, আকাশগঙ্গায় নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ৪০০ বিলিয়ন। অর্থাৎ, অনেক অনেক নক্ষত্র। আর গ্রহ? জোড়া নক্ষত্র, আশেপাশের নক্ষত্রের গতি, আর অনেক তত্ত্বীয় গবেষণা, বেশ জোরালো ইঙ্গিত দেয় যে, অনেক (হয়তো অধিকাংশ) নক্ষত্রেরই গ্রহসঙ্গী রয়েছে।
ধরুন, f_p, অর্থাৎ গ্রহযুক্ত নক্ষত্রের সংখ্যা হচ্ছে – এক চতুর্থাংশ। অর্থাৎ, গ্রহযুক্ত সৌরজগতের সংখ্যা ৪০০ x ১/৪ = ১০০ বিলিয়ন। সর্বশেষ হিসাবটা লাল রঙে লিখে রাখবো। তো, প্রত্যেক সৌরজগতে যদি আমাদেরটার মত ১০টা গ্রহ থাকে, তাহলে, ১০০ বিলিয়ন x ১০ = ১ ট্রিলিয়ন গ্রহ আছে এই ছায়াপথে। মহাজাগতিক নাটক রচনার জন্য এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ!
আমাদের সৌরজগতের বেশ কিছু জায়গা হয়তো কোনো না কোনো প্রাণের উপযোগী। পৃথিবী তো আছেই। সম্ভাবনা আছে মঙ্গল, টাইটান, হয়তো বৃহস্পতিতেও। অন্য জগতগুলো এমনই হলে, অনুকূল জগতের সংখ্যাটা কম হবে না। যাই হোক, আসুন, উত্তেজনা কমিয়ে n_e এর মান ধরি ২। প্রতি সৌরজগতে ২টি বাসযোগ্য গ্রহ! তাহলে প্রাণের উপযোগী গ্রহের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ বিলিয়ন x ২ = ২০০ বিলিয়ন। আর প্রাণ? মহাবিশ্বের অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রাণের অণুগুলো তৈরি হয় অনায়াসে, গঠিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
কিছু বাধা আসতেই পারে। যেমন ধরুন, জেনেটিক কোডের উৎপত্তিতে ঝামেলা! যদিও বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের বিবর্তনে সেই সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব বেশ দ্রুতই হয়েছিলো; গ্রহ গঠিত হবার পরপরই। আসুন, f_l, অর্থাৎ প্রাণ জন্ম নিয়েছে এমন বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যাকে ধরি ১/২. অর্থাৎ, আকাশগঙ্গার যত গ্রহে একবার হলেও প্রাণের উদ্ভব হয়েছে, তার সংখ্যা ১০০ বিলিয়ন x ২ x ১/২ = ঘুরেফিরে সেই ১০০ বিলিয়ন।
১০০ বিলিয়ন প্রাণময় গ্রহ! হিসাবটা এখানে এসে কঠিন হয়ে যায়। অনেক আলাদা আলাদা এবং দুষ্প্রাপ্য ঘটনা ঘটেছে আমাদের প্রজাতি এবং সভ্যতা বিকাশের পথে। আবার, উন্নত প্রযুক্তিতে পৌঁছানোর হয়তো অনেক উপায় আছে। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, ট্রাইলোবাইট থেকে রেডিও টেলিস্কোপের সমমানের পথ সব গ্রহেই মোটামুটি নিশ্চিত। অন্য বিজ্ঞানীরা তা মানতে নারাজ। আসুন, মাঝামাঝি কিছু ধরি। f_i এর মান ধরি ১/১০. f_c এর মানও ধরলাম ১/১০. ১/১০ x ১/১০ = মাত্র ১% প্রাণযুক্ত গ্রহে শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতা আসবে। সবগুলো উপাদান গুণ করলে আসে, ১০০ বিলিয়ন x .১ x .১। অর্থাৎ ১ বিলিয়ন গ্রহ – যেখানে একবার হলেও সভ্যতার উত্থান হয়েছে।
তো, একটি গ্রহ তার আয়ুর শতকরা কতটুকু অংশে প্রযুক্তির শীর্ষে থাকে? পৃথিবীতে, রেডিও এস্ট্রোনমিতে সক্ষম সভ্যতা আছে মাত্র কয়েক দশক ধরে, যেখানে এর আয়ু কয়েক বিলিয়ন বছর। আগামীকালই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার সম্ভাবনাটাও তুচ্ছ না। এটাই যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে f_L হবে কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে মাত্র কয়েক দশক। ১০০ মিলিয়নের প্রায় ১ ভাগ…খুবই ছোটো সংখ্যা। তাহলে N হবে ১ বিলিয়নের শত মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ, N হচ্ছে মাত্র ১০ টি সভ্যতা। ক্ষুদ্র, নগণ্য, করুণ কয়েকটা মাত্র প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা, বিশাল এই ছায়াপথে। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লেগে যায় বিবর্তনের পথ ধরে সভ্যতার উত্থান হতে। এরপর হেলাফেলার এক তুড়িতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় চিরতরে। এমনটাই যদি সবখানে ঘটে, বাকি থাকবে খুব অল্পই।
কে জানে, কথা বলার মত হয়তো কেউই থাকবে না। কিন্তু বিকল্পটা চিন্তা করুন। মাঝে মাঝেই কিছু সভ্যতা উচ্চ প্রযুক্তির সাথে বাঁচতে শিখে নিচ্ছে। টিকে যাচ্ছে ভূ-তাত্ত্বিক, এমনকি নাক্ষত্রিক বিবর্তনের সময়কাল। যদি ১% সভ্যতাও প্রযুক্তির উদ্দাম কৈশোর সামলে উঠতে পারে তাহলে f_L এর মান ১/১০০ মিলিয়ন হবে না, ১/১০০ হবে শুধু। আর তখন সভ্যতার সংখ্যা দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন x ১/১০০. তখন ছায়াপথের সভ্যতার সংখ্যা হিসাব করা হবে মিলিয়নে। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা! তাই সভ্যতা যদি নিজেকে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি আবিষ্কারের পরপরই ধ্বংস না করে ফেলে, তাহলে হয়তো অন্তরীক্ষ গুণগুণ করছে দূর নক্ষত্র থেকে আসা বার্তা দিয়ে। এমন এক সভ্যতার বার্তা, যা আমাদের চেয়ে অনেক প্রাচীন, অনেক বিজ্ঞ।