শৈশবের পুরানো সুন্দর স্মৃতির কথা মনে পড়ে আপনার? যখন আপনার অভিভাবক মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিতেন- কতোটা চমৎকার, মহান এবং অনেকের ভেতর একেবারেই আলাদা আপনি? “ওহ! লিলি এখনই সম্পূর্ণ বর্ণমালা শিখে ফেলেছে, চমৎকার বুদ্ধিমতী এই মেয়েটা!” “জিমি কী সুন্দর তার দাদীকে সাহায্য করে- ওর চেয়ে মায়াভরা আর কোনো ছেলে দেখেছো?” “এবং এ্যানিকে দেখো! নতুন জামাটাতে তাকে কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে! বড়ো হলে ওর মত সুন্দরী আর পাওয়া যাবে না।” নিজের সম্পর্কে এসব প্রশংসা শুনতে আপনার খুবই ভালো লাগতো- মনে হতো আপনি যে কোনো কিছুই করতে পারবেন এবং যেখানে হাত দিবেন সেখানেই সোনা ফলবে।
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেনো সেই সুদূর ছোটবেলায় আপনি এতোটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ঠিক কী কারণে নিজেকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন? না, চারিদিক থেকে পাওয়া অঢেল প্রশংসাবাণী এর পেছনের কারণ নয়; এর কারণ, এই প্রশংসাগুলো আপনি নিজে তখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু, এরপর আপনি বড়ো হয়ে উঠতে লাগলেন এবং আপনার নিজস্ব চিন্তাচেতনার জগত তৈরি হতে লাগলো। আমি অনুমান করে নিচ্ছি- এখন খুব বেশিসংখ্যক মানুষ আপনাকে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মেধাবী, বা সবচেয়ে মজার কেউ বলে ডাকে না; বা ডাকলেও আপনি এখন আর ছোটবেলার মতো চটজলদি, অনায়াসে এসব কথা বিশ্বাস করেন না।
জীবনের কোনো এক পর্যায়ে, মনের কোনো এক গহীনে আপনি নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করা শুরু করেছিলেন, আর ঠিক ঐ মুহূর্তটাই ছিলো- আপনার এতোদিনের অক্ষত আত্মবিশ্বাস আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রাচীরের প্রথম ফাটলের সাক্ষী। আপনি হয়তো আমার সাথে তর্ক করবেন, বলবেন যে এটা আসলে একজন বিনয়ী ব্যক্তির চারিত্রিক আদর্শের প্রকাশ; কিন্তু জেনে রাখুন, বিনয়ীভাব আর আত্মবিশ্বাসের অভাব- এ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, দুটোর বসত যোজন যোজন দূ্রে।
বিনয়ী ব্যক্তিরা নিজেদের মূল্য ভালোই বুঝেন, কিন্তু তাঁরা “নিজের ঢোল নিজে পেটাও”-নীতিতে বিশ্বাসী নন। অন্যদিকে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যারা ভুগেন তারা কিন্তু প্রায়শই “নিজের ঢোল নিজে পেটাও, অপরকে দিলে ফাটিয়া যাইতে পারে”- নীতিতে চলেন। অথচ, শেষোক্ত দলটি নিজেরাই নিজেদের নিয়ে সন্দিহান থাকেন, তারা নিজেদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে থাকেন- কতোটুকু অপদার্থ, মূল্যহীন তারা। এমনকি নিজেদের কোনো রকম গুণাবলী বা অর্জনের জন্যেও নিজেদের বাহবা দিতে ভুলে যায় এই দল। এই স্ব-ছিদ্রান্বেষণ শুধু যে অবমাননাকর তাই নয়, এই মাত্রাতিরিক্ত আত্মসমালোচনা সময়ের সাথে সাথে মারাত্মক কিছু মানসিক এবং শারীরিক সমস্যাও নিয়ে আসে। কীভাবে? ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ডেকে আনে নিরাপত্তাহীনতা। আর এই নিরাপত্তাহীনতাই জন্ম দেয় উদ্বেগ, হিংসা, বিষণ্নতা, মেদবৃদ্ধি, মাদকাসক্তি, ইত্যাদি নানারূপ মানসিক এবং শারীরিক ব্যাধির।
আমাদের আত্মবিশ্বাসের প্রতিনিয়তই পরীক্ষা চলে এবং সোজা বাংলায় বলতে গেলে, এই পরীক্ষার হাত থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে হয় একেবারে নিজ প্রেমে অন্ধ একজন হতে হবে; অথবা কোনো এক মরুভূমিতে, একেবারে একাকী আবাস গড়ে নিতে হবে। এই দুটো উপায় ছাড়া এই যুগে এই অগ্নিপরীক্ষা এড়ানো বেশ মুশকিল! বিলাসী তারকা, খুঁতখুঁতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, নাক সিঁটকানো বন্ধুসমাজ, সফল প্রতিবেশী, চতুর্গুণে সফল সহোদর/সহোদরা- সবাই যেনো ওঁৎ পেতে আছে, শুধু এটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে- “কি হে বাপু, এটুকুও পারলে না! এটুকু সাফল্যও নেই বুঝি তোমার ঝুলিতে!” আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আছে নয়া উৎপাত- “ফেসবুক”। আপনি হয়তো ভাবছেন, “ফেসবুক কী দোষ করলো?” এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আসুন চোখ দেই সুইডেনের গোথেনবার্গ (Gothenburg) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক চালানো এক পরীক্ষায়।
“সুইডেনের ফেসবুকসংক্রান্ত সর্ববৃহৎ অনুসন্ধান” শিরোনামে চালানো এই গবেষণায় উঠে আসে, ফেসবুকের ব্যবহার আর ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের মাত্রার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এই সম্পর্কের প্রভাব। এই গবেষণায় দেখা যায়, লম্বা সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীর আত্মমর্যাদার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীদের ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক প্রভাবের প্রকটতা পুরুষদের তুলনায় বেশি। এই পৃথিবীতে যেখানে প্রতিমাসে ১৩৯ কোটিরও বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন, সেখানে এই গবেষণালব্ধ ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর!
এতো বকবক কেনো করলাম? এসবে আপনার কী আসে যায়? আসে যায় অনেক কিছু। ভেবে দেখুন, চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অগণিত এতো সব নেতিবাচক প্রভাবককে আপনি পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আপনি যা করতে পারবেন তা হচ্ছে- এসব কুচক্রী প্রভাবকসমূহকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সু্যোগ না দেয়া। প্রতিদিনকার ছোটো ছোটো ঘটনাগুলোকে কখনোই এতো বেশি অধিকার দিবেন না যাতে ওরা আপনাকেই করায়ত্ত করে নিতে পারে, যাতে আপনাকে ক্ষণে ক্ষণে শুধু আপনার ভুলের কথা মনে না করিয়ে দিতে পারে, যাতে আপনার অর্জনগুলো সরিয়ে না রাখতে পারে।
আসুন, কিছু ছোট্ট এবং দৈনন্দিন জীবনে পালনযোগ্য পরামর্শ জেনে নেই যা আপনার মাথার ভেতরের “নেতিবাচক আমি”-কে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে।
১। নিজেদের সাথে ইতিবাচক কথা বলুনঃ
আপনিই আপনার সবচেয়ে বড়ো সমালোচক। বাইরের পৃথিবী নয়, বরং আপনার ভেতরের আপনিই সবসময় নিজের সমালোচনা করে চলেছেন। নিজের প্রতি এই রূঢ় নেতিবাচক আচরণ বন্ধ করুন। চর্চা করুন নিজের সাথে নিজের ইতিবাচক আলাপের। আপনার নিজেরই দায়িত্ব নিজেকে নিজ নিজ অর্জন, দক্ষতা, গুণাবলীর কথা মনে করিয়ে দেবার। নিজেকে বাহবা দিতে শিখুন; সেই সাথে চিহ্নিত করুন, কোথায় আরো উন্নতি করা সম্ভব।
২। দৈনন্দিন জীবনে করা আপনার সেরা তিনটি কাজের তালিকা করুনঃ
আপনি কি সময় সচেতন? টিক চিহ্ন দিন। রান্নায় দ্রৌপদী? টিক চিহ্ন দিন। ভালবাসতে পারেন উজাড় করে? টিক চিহ্ন দিন। তালিকা তৈরির কাজটি বেশ সহজ মনে হচ্ছে, তাই না? কাজটি আসলেই সহজ। প্রত্যেকেই অন্তত তিনটি এমন কাজ খুঁজে বের করতে পারে যেগুলোতে তারা বেশ পারদর্শী, প্রশংসার দাবিদার। তো দেরি করছেন কেনো? যান! খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়ুন আর তালিকা তৈরি করতে থাকুন। প্রতিদিনকার এই ছোটো ছোটো কাজগুলিই কিন্তু দিন শেষে বড়ো পরিবর্তন নিয়ে আসে।
৩। তুলনা করা বন্ধ করুনঃ
আপনার মা এবং জিনবিজ্ঞানীরা কিন্তু ভুল বলেননি; আমরা সবাই আসলেই ব্যতিক্রম। আমাদের চেহারা, ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা, জীবনের গল্প-সবারই আলাদা। হ্যাঁ, এমন মানুষ অবশ্যই আছে যারা কোনো না কোনো কাজে আপনার, আমার চেয়ে অধিক পারদর্শী; কিন্তু, তাতে কী? আপনি আর আমিও এমন অনেক কাজে দক্ষ যেখানে অন্যরা হয়তো হিমশিম খায়। তাই, তুলনা করার প্রবণতা কমান। দিনশেষে এটি হতাশা ছাড়া আর কিছুই এনে দিতে পারবে না।
৪। অর্জনযোগ্য লক্ষ্য স্থির করুন এবং সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করুনঃ
আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখা, বড়ো বড়ো লক্ষ্য থাকা খুবই চমৎকার একটি ব্যাপার এবং আমাদের সবার জীবনেই এরকম কিছু লক্ষ্য থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু, যেসব লক্ষ্য পূরণে বহু বছরের সাধনার প্রয়োজন পড়ে- সেসব লক্ষ্যের পথে হাঁটা একটু কষ্টকর বৈকি। মনপ্রাণ উজাড় করে কাজ করছেন, কিন্তু আপনার লক্ষ্যের “দিল্লী এখনো দূরে”- এমন অবস্থা কাজের উদ্দ্যমে স্থবিরতা এনে দিলে আপনাকে দোষ দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে আপনার জন্য পরামর্শ হলো, এই বিরাট কর্মপরিকল্পনাকে ছোটো ছোটো খণ্ডে ভাগ করে ফেলুন। প্রতিটি অংশের জন্য বাস্তবসম্মত সময়সীমা নির্ধারণ করুন এবং সাফল্য পর্যালোচনা করার জন্য কিছু নির্ণায়ক বেছে নিন। এতে করে দুটো কার্য সমাধা হবে, এক, আপনি বড়ো লক্ষ্যের দিকে আপনার অগ্রগতি সহজেই পরিমাপ করতে পারবেন এবং দুই, ছোটো ছোটো লক্ষ্য অর্জনের সাফল্য আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।
৫। অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাজ ভাগ করুনঃ
মাঝে মাঝে এমন দিন আসে যখন মনে হয়, আপনি সারাটা দিন নষ্ট করলেন, কিন্তু সত্যিকারের কোনো কাজই করলেন না। আবার মাঝে মাঝে এমন দিনেরও দেখা মেলে, যেদিন আপনার কাজ এতোটাই বেশি থাকে যে ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন তা ঠিক করে উঠতে পারেন না। এমন দিনে সাধারণত যেটা হয়, আপনি দোলাচলে ভুগতে থাকেন; অথবা অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে সবকাজ একসাথে শুরু করে দেন। ফলশ্রুতিতে, কোনো কাজই আপনি শেষ করতে পারেন না। এসব ঝক্কি এড়াতে আপনার কাজের প্রথমেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ ভাগ করে নিতে হবে। কাজের প্রতিটি অংশ সম্পন্ন করার জন্য সময় বরাদ্দ করতে হবে। আকাশকুসুম পরিকল্পনা না করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী দৈনিক পরিকল্পনা করলে তবেই না কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারবেন।
আপনার জীবন এমন এক একটি দিনেরই সমষ্টি, একটি দিনও নষ্ট হতে দেবেন না।